রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয় বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেছেন, ‘আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম, আবু সাঈদের শাহাদাতবার্ষিকীতে সবাই মিলে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করব। কিন্তু বাস্তবে সেটা কতটা সম্ভব হবে, তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। আমরা খানিকটা শঙ্কিত যে, সে জায়গায় আমরা যাব না।’

আজ রোববার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার সপ্তম দিনের আলোচনার শুরুতে এসব কথা বলেন আলী রীয়াজ।

আজকের আলোচনার জন্য নতুন কোনো বিষয় রাখা হয়নি। আগের কয়েকটি বিষয়ে ঐকমত্য না হওয়ায় সেগুলো নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়েছে।

আলোচ্য সূচির মধ্যে রয়েছে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট, উচ্চকক্ষের নির্বাচনপ্রক্রিয়া ও উচ্চকক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকা।

রাজনৈতিক দলগুলোকে গত জুলাই মাসের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, ‘যে নিপীড়নের মধ্যে আমরা ছিলাম, যে ফ্যাসিবাদের মধ্যে আমরা ছিলাম, তা আমাদের সবার মনে আছে। আরেকটি জুলাই এসেছে। গত জুলাইয়ে আমরা সবাই নিজ দলের পতাকা তুলে ধরিনি। বরং সবাই দেশের পতাকা তুলে ধরেছিলাম। আমরা সবাই ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি পেতে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম।’

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয় বলে উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই মাসের মধ্যে অবশ্যই এই প্রক্রিয়ার একটা পরিণতির দিকে যেতে হবে।

ভবিষ্যতে জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে কেউ যাতে সাংবিধানিক সংস্কার করতে না পারে, তা নিশ্চিতের ওপর গুরুত্বারোপ করেন আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, সাংবিধানিকভাবেই এটা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যক্তির ক্ষমতা হ্রাস করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। কারণ, শেষ পর্যন্ত শাসনের ক্ষেত্রে একটা একনায়কতান্ত্রিকতার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই আশঙ্কাকে তাঁরা উড়িয়ে দিতে পারছেন না। সাংবিধানিকভাবে এই রক্ষাকবচগুলো তৈরি করতে হবে। স্বাধীন বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত।

দেশের স্বার্থে সংস্কারের আলোচনায় অগ্রগতি প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ‘আমরা কেউই চাই না আগের অবস্থায় ফিরে যেতে। তাই দেশের স্বার্থে আপনারা বিষয়টি বিবেচনা করুন। যে অঙ্গীকার নিয়ে আমরা গত জুলাইয়ে ছিলাম, তার কতটা অর্জিত হয়েছে? আমরা কি শুধুই দলের ও নিজের স্বার্থ চাইব? নাকি দেশের স্বার্থও কিছু দেখব?’

সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য কমিশন নমনীয় বলে উল্লেখ করেন আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, ‘কমিশন তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে। কারণ, এটা আপনাদের সবার সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা। প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোই জনগণের এক বিরাট অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাবের মধ্যে দিয়েই ৭০ অনুচ্ছেদ, এনসিসি, উচ্চকক্ষ গঠনের প্রক্রিয়াসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে নমনীয় হয়েছে। কমিশন অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিপক্ষ নয়। কমিশন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা আন্তরিক থাকতে চাই।’

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় আজকের আলোচনায় আরও উপস্থিত আছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো.

এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান ও মো. আইয়ুব মিয়া।

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি

ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ অনুমোদন দেওয়ার সময় আইএমএফ বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিবিধি সম্পর্কে যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তা উদ্বেগজনকই। তারা মনে করে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাসহ চার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো খারাপ অবস্থায় আছে। অন্য তিনটি কারণ হলো কঠোর আর্থিক ও রাজস্ব নীতির প্রভাব, বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা বৃদ্ধি এবং ব্যাংক খাতে অব্যাহত চাপ।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কথা স্বীকার করে বলেছেন, বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটেনি। প্রশ্ন হলো গত ১০ মাসে অন্তর্বর্তী সরকার এই স্থবিরতা কাটাতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কি না। আইএমএফ বলছে, চলতি অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। আগামী অর্থবছরে তা বেড়ে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হবে। সংস্থাটির মতে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি গড়ে ৬ দশমিক ২ শতাংশে নেমে আসতে পারে। মূল্যস্ফীতিই জনজীবনে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলছে, সেটা জানা গেল বিশ্বব্যাংকের আরেক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, জাতীয় দারিদ্র্যের হার ২০২৫ সালে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ হবে। ২০২২ সালে তা ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা, যঁাদের দৈনিক আয় ২ ডলার ১৫ সেন্টের নিচে ছিল, তঁাদের সংখ্যা ৩০ লাখ হতে পারে। দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব। যে হারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে, সে হারে মানুষের আয় বাড়েনি। আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা দিয়ে দরিদ্র মানুষ চিহ্নিত করা হয়। ক্রয়ক্ষমতা সমতা (পিপিপি) অনুসারে, দিনে ২ দশমিক ১৫ ডলার আয় করে প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা কেনার সামর্থ্য না থাকলে অতিদরিদ্র হিসেবে ধরা হয়।

রাজনীতির সংস্কার ও বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় সরকারের সমালোচনা করেছে আইএমএফ। অবশ্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে বিনিময় হার আরও নমনীয় করা ও কর রাজস্ব বাড়াতে নেওয়া সংস্কারকাজের প্রশংসা করেছে তারা। এর পাশাপাশি সংস্থাটি বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ পুনর্গঠন ও মূল্যস্ফীতি কমানোর পরামর্শ দিয়েছে। সরকারি ভর্তুকি ধাপে ধাপে কমিয়ে একটি টেকসই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া উচিত বলেও মত দিয়েছে আইএমএফ। 

স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বর্তমানে আন্তর্জাতিক মহল থেকে যেসব সুযোগ–সুবিধা পাচ্ছে, উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হলে তার অনেকটাই কমে যাবে। এ জন্য কেবল বিদেশি সংস্থা নয়, দেশের অর্থনীতিবিদেরাও প্রাক্‌–প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলেছেন।  

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে যে অর্থনীতি মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ে, সেটা জানতে আইএমএফ বিশ্বব্যাংক বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনের প্রয়োজন পড়ে না। দেশের সাধারণ মানুষ সাদাচোখেই সেটা দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ বিষয়ে কতটা সজাগ আছে, সেই প্রশ্ন আছে। দিনের পর দিন আলোচনা করেও কেন তারা সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারছে না? যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান পরস্পর বিপরীত মেরুতে, সেখানে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করা কঠিনই বটে। 

আমরা আশা করব, রাজনৈতিক দলগুলো অবিলম্বে ন্যূনতম বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করবে, যাতে একটি শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করা যায়। কোনো দল যদি নিজের অবস্থানে অনড় থাকে এবং অন্যদের কথা শুনতে না চায়, তাহলে রাজনৈতিক ঐকমত্য কখনো হবে না। এই সরল সত্য কথাটি সংশ্লিষ্ট সবাই মনে রাখবে আশা করি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • টেবিলের আলোচনায় মাঠে চাপ, লক্ষ্য বিএনপি
  • বাংলাদেশ পুনর্গঠনের বার্তা নিয়ে ভোটারদের কাছে যেতে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের পরামর্শ এবি পার্টির
  • নির্বাচন বিলম্বিত বা না হওয়ার জন্য পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাওয়া হচ্ছে: সালাহউদ্দিন আহমদ
  • রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি
  • টাকা ও ক্ষমতা ব্যবহার করে দল গড়া মানুষ দেখতে চায় না: জোনায়েদ সাকি
  • গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সন্ধিক্ষণে ‘জনগণ’ কীভাবে কথা বলবে
  • ঐকমত্যের আলোচনা ও প্রক্রিয়া কতটা সফল হবে?