সামাজিক ব্যবসা এখন শুধু একটি ধারণা নয়, এটা বৈশ্বিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে শুধু ব্যক্তিগত মুনাফা নয়, মানব কল্যাণ ও টেকসই ভিত্তির ওপর পুনর্নির্মাণ করতে হবে। আজ রোববার রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) প্রধান মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তারা এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে অংশ নেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

আজ সকালে এনএসইউ মিলনায়তনে এনএসইউ ও ইউনূস সেন্টার যৌথভাবে ‘সোশ্যাল বিজনেস একাডেমিয়া ডায়ালগ’ ও ‘থ্রি জিরোজ ক্লাব কনভেনশন’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এর আগে গত শুক্রবার সাভারের জিরাবো সামাজিক কনভেনশন সেন্টারে দুই দিনের ‘সোশ্যাল বিজনেস ডে’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ‘সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সামাজিক ব্যবসা সর্বোত্তম পন্থা’—এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এবারের ‘সোশ্যাল বিজনেস ডে’ পালন করা হচ্ছে।

আজকের সেমিনারে ভিডিও বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এই সংলাপ একটি বিশেষ আয়োজন যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের তরুণ মেধাবী গবেষক, শিক্ষক ও শিল্পসংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরা একত্রিত হয়েছেন। সামাজিকভাবে সচেতন বিশ্ব গড়ার লক্ষ্য নিয়ে তাঁরা একত্রিত হয়েছেন। এই লক্ষ্য থ্রি জিরোজ বা তিনটি শূন্যকে কেন্দ্র করে: শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য কার্বন নিঃসরণ। এই সময়ে সামাজিক ব্যবসা আর শুধু একটি ধারণা নয়, এটি এখন একটি বৈশ্বিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে।

মুহাম্মদ ইউনূস আরও বলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে, বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চিরস্থায়ী কিছু নয়। আমরা এটি পুনর্গঠন করতে পারি এমন একটি ব্যবস্থায় যা ব্যক্তিগত মুনাফার ওপর নয়, বরং মানব কল্যাণ ও টেকসই পৃথিবী নির্মাণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে। সামাজিক ব্যবসা এমন একটি কাঠামো, যার মাধ্যমে বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজে বের করা সম্ভব।’ তিনি আশা প্রকাশ করেন, এনএসইউ ভবিষ্যতেও সৃজনশীল চিন্তক ও সামাজিক উদ্যোক্তা তৈরি করবে, যারা চ্যালেঞ্জকে সুযোগে রূপান্তর করতে পারবে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেন, বিশ্ব এখন নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জের মধ্যে। কয়েক মাস আগেও বাংলাদেশের সব মানুষ সড়কে নেমে এসেছিল সমাজ পুনর্গঠনে। এক হাজারের বেশি মানুষ তাঁদের প্রিয়জন হারিয়েছেন। বিশ্বে প্রতিদিন যুদ্ধের মধ্যে হাজার হাজার শিশু ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে। সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে মানবকল্যাণকেন্দ্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য আমাদেরকে থ্রি জিরো লক্ষ্য পূরণের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গবেষণা করার আহবান জানান।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, সামাজিক ব্যবসা জানায় কীভাবে ঝুঁকিতে থাকা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে, কীভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো যাবে। এই ব্যবসায় মুনাফা সমাজের ক্ষমতাশালীদের পকেটে চলে যায় না। তিনি বলেন, আরও মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে ও নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ বলেন, এই আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্য বিশ্বব্যাপী অগ্রাধিকারের সঙ্গে সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের দর্শনকেও ধারণ করে। এসডিজি ও থ্রি জিরোজ নিয়ে তরুণেরা সমস্যা সমাধানে প্রস্তাব করবেন আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, তরুণদের প্রস্তাবই আগামী দিনের নীতিনির্ধারণী পরিকল্পনায় স্থান পাবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে নিযামী গঞ্জাভি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের কো-চেয়ার এবং বিশ্বব্যাংকের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসমাইল সেরাগেলদিন বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা কী বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করবে তা যথাযথভাবে চিহ্নিত হয় না। বাংলাদেশে এখন শক্তিশালী নতুন কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। এখন প্রয়োজন নৈতিক ও কৌতূহল মন। শুধু অর্থ উপার্জন নয়, দরকার সামাজিকীকরণ। অধ্যাপক ইউনূসের ধারণা নিয়ে দরিদ্রদের কাছে পৌঁছাতে হবে।

আরেক বিশেষ অতিথি নরওয়ের পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক সাবেক মন্ত্রী ও ইউএন এনভায়রনমেন্ট-এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক এরিক সোলহেইম বলেন, অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশকে সামাজিক ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন। বাংলাদেশের জন্য সময় এখন একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জের ও বড় সুযোগের। সোলার সিস্টেম, বায়ো সিস্টেমকে কাজে লাগানোর সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের।

অনুষ্ঠানে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজ ও সিটি ব্যাংক পিএলসি’র চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার বলেন, বিশ্ব এখন নজিরবিহীন জটিলতার সম্মুখীন। সমস্যা সমাধানে দরকার নতুন চিন্তাভাবনা। তরুণেরাই হবেন বাংলাদেশের আগামী দিনের স্থপতি।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ও গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল হান্নান চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্যে তিনি বলেন, পুঁজিবাদের প্রথাগত বাধার সামনে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে সামাজিক ব্যবসা তিন দশক ধরে নতুন ধারণা নিয়ে কাজ করছে।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন এনএসইউর অ্যাকাউন্টিং ও ফিন্যান্স বিভাগের চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক এফ জে মোহাইমেন এবং ইংরেজি ও আধুনিক ভাষা বিভাগের চেয়ারম্যান নাজিয়া মানজুর।

অনুষ্ঠানটি শেষ হয় তিনটি কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মাধ্যমে: এনএসইউ সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার, এনএসইউ সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি সেন্টার এবং এনএসইউ ক্লাইমেট অ্যান্ড ডিজাস্টার রেসিলিয়েন্স সেন্টার। এই কেন্দ্রগুলোর যাত্রা এনএসইউর শিক্ষাগত উৎকর্ষ ও সামাজিক প্রভাব তৈরির পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয় অনুষ্ঠানে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স শ য ল ব জন স স ম জ ক ব যবস অন ষ ঠ ন ব যবস থ লক ষ য ট কসই

এছাড়াও পড়ুন:

দিল্লির আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীর সহযোগী গ্রেপ্তার

ভারতের নয়াদিল্লির লালকেল্লার কাছে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীর সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে দেশটির আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। গত সপ্তাহে লালকেল্লার কাছে গাড়ি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে অন্তত ১৩ জন নিহত হন।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, রবিবার (১৬ নভেম্বর) জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) সন্দেহভাজন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী ডা. উমর উন নবীর সহযোগীকে দিল্লি থেকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানিয়েছে।

আরো পড়ুন:

আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না: এসএস রাজামৌলি

দ. আফ্রিকার জন্য গর্ত খুঁড়ে তৃতীয় দিনেই হারল ভারত

গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে আমির রশিদ আলী হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে, তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের পাম্পোরের সাম্বুরার বাসিন্দা।

তদন্তকারীরা বলছেন, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি ‘সন্ত্রাসী হামলা চালানোর জন্য অভিযুক্ত আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীর সাথে ষড়যন্ত্র করেছিলেন’।

এনআইএ এক বিবৃতিতে বলেছে, “আমির রশীদ দিল্লিতে এসে গাড়ি কেনার কাজটি সম্পন্ন করেন। এরপর এ গাড়িতে রাখা ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।”

তদন্তকারীরা বলছেন, হামলায় জড়িত আই২০ গাড়িটি তার নামে নিবন্ধিত ছিল।

সংস্থাটি জানিয়েছে, দিল্লি পুলিশ, জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ, হরিয়ানা পুলিশ, ইউপি পুলিশ এবং বিভিন্ন সহযোগী সংস্থার সাথে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় করে কাজ করে, এনআইএ রাজ্য জুড়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। বোমা হামলার পিছনে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র উন্মোচন এবং মামলায় জড়িত অন্যান্যদের সনাক্ত করার জন্য এটি একাধিক সূত্র অনুসরণ করছে।

দিল্লি পুলিশ বৃহস্পতিবার নিশ্চিত করেছে যে, লাল কেল্লার কাছে গাড়ি বিস্ফোরণকারী ব্যক্তি হলেন ডা. উমর উন নবী, তিনি হরিয়ানার ফরিদাবাদের আল ফালাহ মেডিকেল কলেজে কর্মরত ছিলেন।

একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, বিস্ফোরণের পর উমরের পা গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল এবং অ্যাক্সিলারেটরের মধ্যে আটকা পড়েছিল, যা ইঙ্গিত দেয় যে বিস্ফোরণের সময় তিনি গাড়িটি চালাচ্ছিলেন।

সন্ত্রাসবিরোধী সংস্থা উমরের আরেকটি গাড়িও জব্দ করেছে। মামলায় প্রমাণের জন্য গাড়িটি পরীক্ষা করা হচ্ছে। এনআইএ এখন পর্যন্ত ৭৩ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, যার মধ্যে বিস্ফোরণে আহত ব্যক্তিরাও রয়েছেন।

গত সোমবার লালকেল্লার ব্যস্ত মেট্রো স্টেশনের খুব কাছে গাড়ি বিস্ফোরিত হয়। ওই সময় সেখানে কয়েক হাজার মানুষ ছিলেন। স্থানটি ভারতের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবছর দেশটির প্রধানমন্ত্রী লালকেল্লা থেকে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণ দেন।

হাসপাতালের একটি সূত্র জানিয়েছে, বিস্ফোরণে ১৩ জন নিহত হয়েছেন।

গত ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মিরের পেহেলগামে সন্ত্রাসীদের হামলায় ২৬ পর্যটক নিহত হয়। এরপর ভারতে লালকেল্লার বিস্ফোরণ ছিল সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হামলা।

ভারত সরকার এক বিবৃতিতে এই বিস্ফোরণকে ‘দেশবিরোধী শক্তির দ্বারা সংঘটিত একটি কাপুরুষোচিত এবং কাপুরুষোচিত কাজ’ বলে অভিহিত করেছে এবং ‘সকল ধরনের সন্ত্রাসবাদের প্রতি শূন্য সহনশীলতার নীতির প্রতি ভারতের অটল অঙ্গীকার’ পুনর্ব্যক্ত করেছে।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ