সন্তান প্রসবের পর হাসপাতালের শয্যায় বসে পরীক্ষা দিলেন এশা আলম
Published: 29th, June 2025 GMT
সন্তান জন্মের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালের বিছানায় বসে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন ঈশা আলম নামে শরীয়তপুরের এক তরুণী। পড়াশোনার প্রতি টান আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মানিয়েছেন শারীরিক দুর্বলতা ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে। ঈশার (১৯) এই দৃষ্টান্তে গর্বিত তাঁর শিক্ষক-সহপাঠী ও পরিবারের সদস্যরা।
ঈশা শরীয়তপুর পৌরসভার পশ্চিম কাশাভোগ এলাকার মাহবুবুর রহমান তুষারের স্ত্রী। তিনি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন পড়ুয়া ও মেধাবী। কোনো প্রতিকূলতাই তাঁকে পাঠ্যপুস্তক থেকে দূরে সরাতে পারেনি। বিয়ের পরও গর্ভে সন্তান নিয়েই চালিয়ে যান পরীক্ষার প্রস্তুতি।
চলতি এইচএসসি পরীক্ষায় ঈশার কেন্দ্র ছিল সরকারি গোলাম হায়দার খান মহিলা কলেজ। গত বৃহস্পতিবার তিনি বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষা দেন। শুক্রবার গভীর রাতে তাঁর প্রসব বেদনা ওঠে। দ্রুত শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে কন্যা সন্তানের জন্ম দেন তিনি।
শারীরিক দুর্বলতা, প্রসব-পরবর্তী যন্ত্রণা, সদ্যোজাত সন্তান– সবকিছুই ঈশাকে পরীক্ষা থেকে পিছিয়ে দেওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। কিন্তু ঈশা থেমে থাকেননি। আজ রোববার ছিল বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা। শারীরিকভাবে দুর্বল থাকলেও মানসিকভাবে দৃঢ় ছিলেন তিনি। হাসপাতালের শয্যায় বসেই পরীক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
পরিবারের সদস্যরা কলেজ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি লিখিতভাবে জানালে কলেজ কর্তৃপক্ষ ক্লিনিকের এক কক্ষে ঈশার জন্য পরীক্ষার আয়োজন করে। হাসপাতালের শয্যায় বসেই চোখে স্বপ্নজয়ের দীপ্তি নিয়ে পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি। এ সময় তাঁর নবজাতকটি ছিল দাদির কোলে।
ঈশা বলেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখেছেন বড় হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। সন্তান গর্ভে আসার পর অনেকে তাঁকে বলেছে পড়াশোনা বাদ দিতে হবে। কিন্তু তিনি পড়াশোনাকে কখনও বোঝা মনে করেননি। বরং এটিকেই শক্তি মনে করেছেন। পরীক্ষার হলে না যেতে পারলেও তিনি ভেঙে পড়েননি। হাসপাতালের শয্যায় বসেই পরীক্ষা দিয়েছেন। তিনি জানান, মনোবল থাকলে মেয়েরা সবকিছু করতে পারে।
স্বামী মাহবুবুর রহমান তুষার বলেন, পড়াশোনার প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসা দেখে তিনি অবাক হয়েছেন। হাসপাতালে সন্তানের জন্ম হওয়ার পরপরই তাঁর স্ত্রী আবার বই নিয়ে বসে পড়ে। স্ত্রীর স্বপ্ন পূরণে তিনি সবসময় পাশে থাকবেন।
সরকারি গোলাম হায়দার খান মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ওয়াজেদ কামাল বলেন, মানবিকতা ও শিক্ষার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে ঈশাকে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুয়োগ দিয়েছেন তারা। সে হাসপাতালে সন্তান প্রসব করেও পরীক্ষায় বসেছে– এই দৃঢ়তা যে কোনো শিক্ষার্থীর জন্য অনুপ্রেরণা। ঈশা জীবনে অনেকদূর এগিয়ে যাবে বলে তিনি আশাবাদী।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: এইচএসস ও সমম ন পর ক ষ পর ক ষ য় প রসব
এছাড়াও পড়ুন:
এসএসসি পরীক্ষা বাতিল নয়, সংস্কার দরকার
৩ আগস্ট প্রথম আলোতে মুনির হাসানের তথ্যবহুল লেখা ‘এসএসসি পরীক্ষার প্রয়োজন কতটুকু আছে?’ মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসএসসি সনদের কার্যকারিতা কমেছে, এ বিষয়ে লেখকের যুক্তির সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো কারণ নেই; কিন্তু তিনি সবশেষে বলেছেন, ‘এসএসসি পরীক্ষাকে ইতিহাসে পাঠিয়ে আমরা একটি মানবিক, দক্ষ ও আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যেতে পারি। একটি আধুনিক শিক্ষাবান্ধব বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বার্থেই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে এসএসসি পরীক্ষা বাতিল করা হোক।’ এই বক্তব্যের সঙ্গে বিনীতভাবে ভিন্নমত পোষণ করছি।
পরীক্ষামাত্রই মানসিক চাপ থাকবে। পরীক্ষামাত্রই কিছু তথ্য মনে রাখার ঝামেলা থাকবে। পাস-ফেল থাকবে। এই চাপ এসএসসি পরীক্ষায় যেমন, তার আগে-পরে সব পরীক্ষায়ও তেমন। কাজেই শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপের অজুহাতে কোনো পরীক্ষা বাতিলের দাবি করলে শুধু এসএসসি কেন, দুনিয়ার সব পরীক্ষা বাতিলের দাবি করতে হবে। সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার না করে যে পদ্ধতিতেই এই মূল্যায়ন করা হোক না কেন, পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। তাই প্রথমেই গণিত আর ইংরেজি বিষয়ের পাঠদানের ঘাটতি চিহ্নিত করে সংশোধনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার না করে যে পদ্ধতিতেই এই মূল্যায়ন করা হোক না কেন, পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। তাই প্রথমেই গণিত আর ইংরেজি বিষয়ের পাঠদানের ঘাটতি চিহ্নিত করে সংশোধনের ব্যবস্থা নিতে হবে।শোনা যায়, এবারের এসএসসি পরীক্ষা প্রকৃতপক্ষেই একটি ভালো পরীক্ষা হয়েছে। পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোতে অসদুপায় অবলম্বনকে যথাসম্ভব নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য পরীক্ষকদের ওপর কোনো অনৈতিক চাপ ছিল না। ফলে এবার এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার কমেছে। জিপিএ-৫ এর সংখ্যা কমেছে। প্রতি ১০ জনে ৩ জন ফেল করেছে। এদের একটি বড় অংশই ফেল করেছে গণিত ও ইংরেজিতে। এটি বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় দুর্বলতা। এসএসসি পরীক্ষা বাতিল করে দিলেই এই দুর্বলতা দূর হবে না। এসএসসি পরীক্ষা থাকুক বা না থাকুক, নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষা শেষে মূল্যায়নের একটি ব্যবস্থা তো থাকবে।
সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার না করে যে পদ্ধতিতেই এই মূল্যায়ন করা হোক না কেন, পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। তাই প্রথমেই গণিত আর ইংরেজি বিষয়ের পাঠদানের ঘাটতি চিহ্নিত করে সংশোধনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
দেশের সব শিক্ষা বোর্ডে এসএসসি পরীক্ষায় ব্যাপক ফল বিপর্যয় হলেও একই সময়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন অনুষ্ঠিত সমমানের এসএসসি (ভোক) পরীক্ষায় কিন্তু ফল বিপর্যয় ঘটেনি। এ বছর ১ লাখ ১২ হাজার ১০০ জন পরীক্ষা দিয়ে ৮৫.৬ শতাংশ পাস করেছে। ৯ হাজার ৫০০ জন জিপিএ ৫ পেয়েছে।খোঁজ নিয়ে দেখলাম, কারিগরি বোর্ডে উচ্চতর পাসের হারের পেছনে অন্যতম কারণ হলো ভিন্নতর পরীক্ষাপদ্ধতি। কারিগরি বোর্ডের সিলেবাস অন্যান্য শিক্ষা বোর্ডের সিলেবাসের মতো একই। তবে ওদের নবম ও দশম শ্রেণিতে আলাদা পরীক্ষা হওয়ায় প্রতি পরীক্ষায় সিলেবাস অর্ধেক হয়ে যায়।
উপরন্তু ধারাবাহিক মূল্যায়নে নম্বর ৪০ শতাংশ আর চূড়ান্ত পরীক্ষায় নম্বর ৬০ শতাংশ। ফলে চূড়ান্ত পরীক্ষার ওপর চাপ অনেকাংশে কম। মজার ব্যাপার হলো এসএসসি (ভোক) পরীক্ষা অন্যান্য শিক্ষা বোর্ডের অধীন অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষার সমমান হিসেবে পরিগণিত হয়। কাজেই নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ বছর সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোর এসএসসি পরীক্ষার্থীরা বৈষম্যের শিকার হয়েছে।
বিগত সরকারের আমলে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে। বিরক্ত বা ভীত হয়ে অনেকেই ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দিকে ঝুঁকেছে। ইংরেজি মাধ্যমে এসএসসি সমমানের পরীক্ষাটি হলো ‘ও লেভেল’। পরীক্ষাটি বছরে তিনবার—জানুয়ারি, মে ও নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। দুই বছর সময়ের ভেতরে মূল কয়েকটি বিষয়সহ কমপক্ষে ছয়টি বিষয় পাস করলেই ‘ও লেভেল’ পাস হয়ে যায়। তবে অনেকেই নিজ নিজ পছন্দ ও সুবিধামতো এক বা একাধিক সময়ে ৮ থেকে ১১-১২টি বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে থাকে।
এ ব্যবস্থার সুবিধা হলো, একবারে না দিয়ে একাধিক ধাপে পরীক্ষা দেওয়া যায়। কোনো একটি বিষয়ে পরীক্ষা খারাপ হলে চার মাস পরেই আবার পরীক্ষা দিয়ে গ্রেড পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে। চাইলে দুই বছরের আগেই ‘ও লেভেল’ শেষ করা যায়।
ইংরেজি মাধ্যমে এইচএসসি সমমানের পরীক্ষাটি হলো এ লেভেল। ও লেভেল পরীক্ষার মতো এ লেভেল পরীক্ষাও বছরে তিনবার অনুষ্ঠিত হয়। দুই বছর সময়ের মধ্যে কমপক্ষে তিনটি বিষয় সম্পন্ন করলেই এ লেভেল পাস হয়ে যায়। তবে কেউ কেউ তিনটির বেশি বিষয়ও নিয়ে থাকে। এতে পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় বেশি অপশন খোলা থাকে।
এইচএসসিতে প্রতিটি বিষয় দুটি মডিউলে ভাগ করা থাকে—প্রথম পত্র ও দ্বিতীয় পত্র এবং দ্বাদশ শ্রেণি শেষ করে দুই সিটিংয়ে দুটি মডিউলের পরীক্ষা দিতে হয়। অন্যদিকে ‘এ লেভেল’-এ প্রতিটি বিষয় ছয়টি মডিউলে ভাগ করা হয় এবং ছয় সিটিংয়ে ছয়টি মডিউলের পরীক্ষা দিতে হয়। শিক্ষার্থীরা সাধারণত একাদশ শ্রেণি শেষে যেকোনো বিষয়ের তিনটি মডিউল এবং দ্বাদশ শ্রেণি শেষে বাকি তিনটি মডিউলের পরীক্ষা দেয়। তবে কেউ চাইলে সব কটি মডিউল একসঙ্গে নিতেও বাধা নেই। কোনো মডিউলের পরীক্ষা খারাপ হলে চার মাসের মধ্যেই আবার পরীক্ষা দিয়ে গ্রেড ভালো করার সুযোগ আছে।
পরীক্ষার্থীদের মানসিক চাপে ফেলা আর ফেল করানো কোনো পরীক্ষার উদ্দেশ্য হতে পারে না। তাই শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ মতামতের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও লেভেল এবং এ লেভেল পরীক্ষাগুলো ডিজাইন করা হয়েছে। সিলেবাস অধিকসংখ্যক মডিউলে ভাগ করে এবং চার মাস পরপর পরীক্ষার ব্যবস্থা করে পরীক্ষার্থীদের ওপর চাপ কমিয়ে আনা হয়েছে।
আমাদের এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষাপদ্ধতি সেকেলে। টানা দুই বছর পড়াশোনা করে ঢাউস সিলেবাস মুখস্থ করে পরীক্ষার হলে যেতে হয়। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের উচ্চতর পাসের হার থেকে বোঝা উচিত আমাদের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাপদ্ধতির আশু সংস্কার প্রয়োজন। যেই পদ্ধতিতে ৩০ শতাংশের ওপরে ফেল করে এবং সেই ফল শোধরানোর জন্য একটি বছর বসে থাকতে হয়, সেই পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
কাজেই এসএসসি পরীক্ষা বাতিল নয়, আমার প্রস্তাব হলো: ১. বোর্ডের পরীক্ষাগুলো বছরে দুবার নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে; ২. এসএসসি সিলেবাসকে নবম ও দশম শ্রেণি দুই ভাগে ভাগ করতে হবে এবং আলাদাভাবে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। ৩. ‘কোর বিষয়’ এবং ঐচ্ছিক বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে হবে; ৪. নবম ও দশম শ্রেণির ফলাফলের সমন্বয়ে এসএসসির ফলাফল নির্ধারিত হবে। ৫. ‘কোর বিষয়ে’ ফেল করলে ছয় মাস পর আবার পরীক্ষার সুযোগ দিতে হবে; ৬. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো কলেজেও সেমিস্টার-পদ্ধতি চালু করতে হবে এবং ছয় মাস পরপর ভর্তির সুযোগ দিতে হবে; ৭. এইচএসসির সিলেবাস চারটি মডিউলে ভাগ করতে হবে; ৮. ছয় মাস পরপর পরীক্ষার মাধ্যমে দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে চারটি মডিউল শেষ করার সুযোগ দিতে হবে।
প্রস্তাবিত সংস্কার বাস্তবায়িত হলে আমাদের বোর্ডের পরীক্ষাগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ইংরেজি মাধ্যমের পরীক্ষাপদ্ধতির ভিন্নতা কমে আসবে। ছাত্রদের ওপর মুখস্থ করার চাপ অনেকাংশে কমবে। ছয় মাস পরপর পরীক্ষার সুযোগ থাকায় ফেল করার ভয় কেটে যাবে।
● ড. মাহবুবুর রাজ্জাক অধ্যাপক, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, বুয়েট।
[email protected]