তত্ত্বাবধায়ক সরকারে একমত, রূপরেখা নিয়ে মতভিন্নতা
Published: 2nd, July 2025 GMT
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলেও এই সরকারের রূপরেখা নিয়ে ঐকমত্য হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কীভাবে করা হবে, সাবেক প্রধান বিচারপতি বা বিচারপতিদের প্রধান উপদেষ্টা করা হবে কি না, জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে কি না; এসব বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।
গতকাল বুধবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় এসব মতপার্থক্য ওঠে আসে। আগামী সপ্তাহে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিষয়ে দলগুলোর সঙ্গে আরও আলোচনা হবে।
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে গতকাল ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের বিষয়ভিত্তিক আলোচনার অষ্টম দিন। এদিন সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বা আইনসভা ভেঙে গেলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার শপথ না নেওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার থাকবে। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ৯০ দিন। প্রধান উপদেষ্টাসহ সর্বোচ্চ ১৫ জন সদস্য নিয়ে কাজ করবে উপদেষ্টা পরিষদ। প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করবে নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইনসভা—এই তিন অঙ্গের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি)।
তবে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দলগুলোর দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এনসিসি গঠনের প্রস্তাব থেকে সরে আসে কমিশন। এর বদলে তারা সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করে। এনসিসি না থাকায় সংবিধান সংস্কার কমিশন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে রূপরেখা প্রস্তাব করেছিল, তা আর আলোচনায় রাখা হয়নি।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যেভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত করা হয়েছিল, সেই রূপরেখা গতকালের আলোচনায় তথ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এ ছাড়া প্রথম পর্বে আলোচনার মাধ্যমে আসা একটি এবং নাগরিক সমাজের দেওয়া একটি প্রস্তাব বিবেচনার জন্য তোলা হয়। তবে দলগুলোর আলোচনা ছিল মূলত আগে সংবিধানে যে রূপরেখা ছিল, সেটি নিয়ে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থেকে বিচার বিভাগকে বাইরে রাখা যায় কি না, তা ভেবে দেখার আহ্বান জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ে বিচার বিভাগকে এই ব্যবস্থা থেকে দূরে রাখার কথা বলা হয়েছিল। বিচার বিভাগ নিজেরাই এখান থেকে দূরে থাকতে চাইছে। তাই তাদের এখানে না রেখে অন্তত দুটি বিকল্প রাখা যেতে পারে। এরপর প্রয়োজন হলে বিচার বিভাগকে সম্পৃক্ত করা যায়। তবে দুটি বিকল্প কী হতে পারে, সেটা উল্লেখ করেননি সালাউদ্দিন আহমদ।
ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় বিএনপির অবস্থান হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ হবে তিন মাস। তাদের কাজ কেবল জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। দৈবদুর্বিপাকের কারণে তিন মাসের মধ্যে এটি করা না গেলে এক মাস সময় বাড়ানো যেতে পারে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার পক্ষে নয় বিএনপি।
জামায়াতে ইসলামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করার কোনো ধরনের বিধান রাখার বিপক্ষে। এই অবস্থান তুলে ধরে দলটির নায়েবে আমি সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের আলোচনায় বলেন, এই সরকারের মেয়াদ হবে চার মাস। জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচন দুটোই এই সরকারের অধীনে হবে। নির্ধারিত সময়ে যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই নির্বাচন করতে না পারে, তাহলে তাদের আরও দুই মাস সময় দেওয়া হবে।
অন্যদিকে আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি রূপরেখা জাতীয় ঐক্যমুক্ত কমিশনের কাছে তুলে ধরেছিল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তারা বিচার বিভাগকে এই প্রক্রিয়া থেকে পুরোপুরি বাইরে রাখার পক্ষে। একটি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করার সুপারিশ করা হয়েছে এনসিপির প্রস্তাবিত রূপরেখায়। গতকাল এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের প্রধান উপদেষ্টা করা হলে বিচারাঙ্গনে রাজনীতিকরণ শুরু হয়। তাই বিচারপতিদের এই প্রক্রিয়ার বাইরে রাখাই যুক্তিযুক্ত।
আলোচনায় অন্যান্য দলও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে অবস্থান তুলে ধরে। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা হবে কি না; এ বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত আসে। রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের অতিরিক্ত দায়িত্ব না দেওয়ার বিষয়ে বেশির ভাগ দল একমত হয়।
তবে এ ক্ষেত্রে বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন গোপন ব্যালটে। সর্বশেষ বিকল্প হিসেবে রাষ্ট্রপতিকে এই ব্যবস্থায় রাখা যেতে পারে।
গতকালের আলোচনা শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, সব রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অভিন্ন মত পোষণ করেছে। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট ঐকমত্য আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন এবং এর কাঠামো ও এখতিয়ার নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এসব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো অনেক কাছাকাছি এসেছে।
আলোচনায় কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো.
নির্বাচনী আসনের সীমানা
আলী রীয়াজ জানান, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ বিষয়ে আশু এবং দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। আশু ব্যবস্থা হিসেবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় যথাযথ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে একটি বিশেষায়িত কমিটি গঠন (যদি ইতিমধ্যে তা গঠিত হয়ে থাকে, তবে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করে) করা এবং সেই কমিটির পরামর্শক্রমে সংসদীয় এলাকা নির্ধারণ করা।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব চ রপত দ র র প রস ত ব র ষ ট রপত র জন ত ক ব যবস থ দলগ ল র র পর খ গতক ল ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
জামায়াতের সঙ্গে জোট ও পিআরে একমত নুর
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে সারাদেশে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৫৫৫ জন নারী ও কন্যাশিশু। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার ৩৫৪ জন, যার মধ্যে কন্যাশিশু ও কিশোরী ২৬৯ জন এবং প্রাপ্তবয়স্ক নারী ৮৫ জন। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১০৬ জন, যার মধ্যে শিশু-কিশোরী ৬২ জন। বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৮১৯ নারী ও ৭৩৬ শিশু ও কিশোরী।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের বিবৃতিতে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদ ১৫টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এ পরিসংখ্যান তৈরি করে।
বিবৃতিতে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু জানান, কেবল জুনে ১১৬ নারী ও ৮৭ জন কন্যাসহ ২০৩ জন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার ৬৫ জনের মধ্যে কন্যাশিশু ৪৩ জন। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ৮ জন, এদের মধ্যে ৫ জন কন্যা। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩ জনকে, যার মধ্যে ২ জন কন্যা। ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন ৭ কন্যাশিশু।
উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন ৫ জন নারী ও কন্যা; যার মধ্যে ২ জন আত্মহত্যা করেছেন। এ ছাড়া ১৩ জন কন্যাসহ ৬৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ২ জন কন্যাসহ ১১ জনের মৃত্যু রহস্যজনকভাবে ঘটেছে। অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন ৩ নারী, যাদের মধ্যে ২ জন মারা গেছেন। এসিডদগ্ধ হয়েছেন ১ জন নারী। ৩ জন নারী অগ্নিদগ্ধ (যার মধ্যে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে), যৌতুক নির্যাতনের শিকার ১ নারী এবং পারিবারিক সহিংসতায় শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৬ জন। আত্মহত্যা করেছেন ৬ কন্যাসহ ২২ জন। অপহরণ হয়েছে ২ কন্যা, সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন ১ জন এবং বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে দুটি।
সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে নির্যাতনের শিকার ১ হাজার ৫৫৫ জন নারী ও কন্যাশিশুর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৭ জনকে। ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৪ কিশোরী। এদের মধ্যে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১২৭ জনকে। যৌন নিপীড়নের শিকার ৫১ জন। ৩১ জনকে উত্ত্যক্ত করা হয়েছে। উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন। ২১ নারী ও কন্যাশিশু পাচার হয়েছেন। একজন এসিড সন্ত্রাসের শিকার। ৬১ কন্যাসহ হত্যার শিকার হয়েছে ৩২০ নারী ও কন্যাশিশু।
সংগঠনের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম সমকালকে বলেন, এ পরিসংখ্যান শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত ঘটনার ওপর ভিত্তি করে। বাস্তবে সংখ্যাটা আরও বেশি। বিশেষ করে কন্যাশিশুর ওপর সহিংসতা ও দলবদ্ধ ধর্ষণের সংখ্যা উদ্বেগজনক। এটি সমাজের জন্য অ্যালার্মিং।
তিনি বলেন, ছয় মাসে হাজারের বেশি নারী-কন্যা নির্যাতনের শিকার হলেও মহিলা মন্ত্রণালয় বা সরকারের উচ্চপর্যায়ের কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। আছিয়া ধর্ষণ মামলায় তড়িঘড়ি করে বিচার হয়েছে, কিন্তু ভালো তদন্ত না হওয়ায় পরিবার সন্তুষ্ট নয়। এ ধরনের বিচারে দ্রুততা নয়, নির্ভুলতা জরুরি। তিনি নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান এবং রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার তাগিদ দেন।