জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: ‘ভালো মানুষ’ যখন নীরব ছিল
Published: 29th, July 2025 GMT
১৯৬৩ সাল। আমেরিকার কালো মানুষদের অধিকারের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার অপরাধে জেলে গেছেন মার্টিন লুথার কিং। কিন্তু দমে নেই, বার্মিংহাম জেলে বসেই তিনি দেশের কৃষ্ণকায় মানুষদের নাগরিক অধিকারের আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। দেশজুড়ে ধরপাকড়, গোপন নজরদারি। জেলে গেছে হাজার হাজার মানুষ। শ্বেতকায় গুন্ডারা প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে কালো মানুষদের। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কৃষ্ণকায়দের মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
ঠিক এমন সময় আন্দোলন প্রত্যাহার করার অনুরোধ নিয়ে মার্টিন লুথার কিংকে একটি চিঠি লিখলেন আটজন শ্বেতকায় ধর্মযাজক। তাঁরা ড.
হতবাক হলেন ড. কিং। যে আটজন পাদরি তাঁকে চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন। কৃষ্ণকায়দের অধিকারের প্রতি তাঁরা এর আগে নৈতিক সমর্থনও জানিয়েছেন। লড়াই যখন শ্বেত আধিপত্যের ব্যূহে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে, তখন সে লড়াইয়ে শামিল হওয়ার বদলে তাঁরা ময়দান ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তাব করছেন। উত্তরে ড. কিং লিখলেন তাঁর সেই বিখ্যাত চিঠি, যা বার্মিংহাম জেল থেকে পাঠানো চিঠি নামে পরিচিত।
ড. কিং লিখলেন, এই প্রজন্মে আমাদের অনুশোচনা করতে হবে শুধু খারাপ মানুষের বিষাক্ত কথাবার্তা ও সহিংস কর্মের জন্য নয়, ভালো মানুষের নিন্দনীয় নীরবতার জন্যও।
এরপর আরও কয়েকবার ড. কিং ‘ভালো মানুষদের লজ্জাজনক নীরবতা’র নিন্দা জানান। ১৯৬৫ সালে সেলমা থেকে মন্টোগোমারি পদযাত্রার সময় তিনি লিখলেন, ভালো মানুষদের এই লজ্জাজনক নীরবতা আমাদের সময়ের গভীরতম একটি ট্র্যাজেডি। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় চোখের সামনে বর্বরতার প্রমাণ পেয়েও যারা চুপ করে ছিল, ড. কিং তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, আমাদের জীবনে এমন একটা সময় আসে, যখন আমাদের নীরবতা ভাঙতে হয়।
১৯৬৮ সালে, তাঁর মৃত্যুর সামান্য আগে, ড. কিং লিখলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এমন লোকের অভাব নেই, যারা চোখের সামনে ভয়াবহ মানবিক অপরাধ দেখেও না দেখার ভান করে, অথবা জেগে জেগে ঘুমায়। অনেকে হয়তো অজ্ঞতার কারণে সত্য থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকে। এই বিশ্বে সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হলো এসব মানুষের ‘আন্তরিক অজ্ঞতা ও সচেতন মূঢ়তা’।
ভয়াবহ বর্বরতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আমাদের জীবদ্দশায় কম ঘটেনি। সে অপরাধের কথা জেনেও চুপ করে থেকেছে—এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। আমাদের কাছে সবচেয়ে দীপ্যমান উদাহরণ ১৯৭১। যারা এখনো সে গণহত্যাকে অস্বীকার করে, অথবা তার ভয়াবহতাকে খাটো করে দেখে, তাদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এই মুহূর্তে গাজায় গণহত্যার কথা আমরা ভাবতে পারি। মাত্র গত সপ্তাহে নিউইয়র্ক টাইমস–এ ভাষ্যকার ব্রেট স্টিফেন্স লিখেছেন, না, গাজায় কোনো গণহত্যা হচ্ছে না। একই কথা বলেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ইহুদিদের এক অনুষ্ঠানে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, গাজায় যা হচ্ছে, তাকে কোনোভাবেই জেনোসাইড বা গণহত্যা বলা যায় না।
মার্টিন লুথার কিং এই ‘ভালো মানুষদের’ লজ্জাজনক ব্যবহারকেই ট্র্যাজেডি বলে উল্লেখ করেছিলেন।
শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের ১৫ বছর বাংলাদেশে লাগামহীন অপরাধের প্রত্যক্ষদর্শী হয়েও যারা হয় নীরব থেকেছে অথবা তার পক্ষে সাফাই গেয়েছে, আমার ধারণা, মার্টিন লুথার কিং তাদেরও সেই একই লজ্জাজনক ভালো মানুষদের তালিকায় ফেলতেন। এমন লোকের অভাব নেই, যারা এখনো পতিত সেই সরকারের পক্ষে সাফাই গাওয়ার অন্য যুক্তি হাতড়ে বেড়ায়। তারাও সেই তালিকার সদস্য।
গত বছর জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ছিল এই লাগামহীন দুর্নীতি, অধিকারহীনতা ও গণনির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি নাগরিক প্রতিবাদ। এমন বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা নেহাত কম নয়, যাঁরা নিজ চোখে ছাত্র-জনতার হত্যা দেখে কেবল নীরবই থাকেননি, তার সাফাইও গেয়েছেন।শেখ হাসিনার আমলে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন কোনো গোপন ব্যাপার ছিল না। আমাদের চোখের সামনেই ঘটেছে আকাশছোঁয়া দুর্নীতি। আইন ও বিচারব্যবস্থা পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রের নিপীড়নযন্ত্রে। দেশের ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রণভার তুলে দেওয়া হয়েছে একটি মাফিয়া চক্রের হাতে। বাক্স্বাধীনতাকে নিরাপত্তাহুমকি বলে তালাবন্দী করা হয়েছে। পুরো দেশকে পরিণত করা হয়েছে একটি পরিবারের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে।
গত বছর জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ছিল এই লাগামহীন দুর্নীতি, অধিকারহীনতা ও গণনির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি নাগরিক প্রতিবাদ। এমন বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা নেহাত কম নয়, যাঁরা নিজ চোখে ছাত্র-জনতার হত্যা দেখে কেবল নীরবই থাকেননি, তার সাফাইও গেয়েছেন।
কেউ কেউ বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ রক্ষায় অথবা মৌলবাদের উত্থান ঠেকাতে কিছু মানুষের মৃত্যু—হোক না তা অন্যায় বা অবৈধ—মেনে নেওয়া যায়। জুলাই আন্দোলন যখন তুঙ্গে, অনেক বুদ্ধিজীবী দল বেঁধে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের আনুগত্য ঘোষণা করে এসেছেন। তাঁরা যুক্তি দেখিয়েছেন, বিক্ষোভকারীদের দাবি মেনে নিলে দেশ শত্রুর হাতে চলে যাবে। অন্য কথায়, শত্রু আর কেউ নয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা। শাসকগোষ্ঠী জনতাকে শত্রু ভাবতেই পারে, কিন্তু দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীরাও যখন সেই একই কথা বলেন, তখন লজ্জায় মাথা নোয়াতে হয়।
এমন কেউ কেউ আছেন, যাঁরা হত্যা-গুম-খুনের ঘটনা স্বীকার করেও হাসিনার আমলে উন্নয়নের অর্জনকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। হাসিনা নিজেও বুক চাপড়ে বলেছেন, দেশের জন্য এত কিছু করলাম, ডিজিটাল বাংলাদেশ বানালাম, তারপরও আমাকে দেশ ছাড়তে হলো। এসব জ্ঞানপাপীকে কীভাবে বোঝানো সম্ভব যে একজন নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর মূল্য এক শ পদ্মা সেতু দিয়েও চুকানো সম্ভব নয়।
সেদিন যাঁরা নীরব ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ এখনো স্বৈরাচারের পক্ষে সরব। নামে-বেনামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের ব্যস্ত উপস্থিতি। জুলাই বিপ্লবকে একটি পরিকল্পিত চক্রান্ত প্রমাণে তাঁদের চেষ্টার অন্ত নেই।
আমেরিকার ‘ডিপ স্টেট’ কীভাবে এই অভ্যুত্থানের আসল চালিকা শক্তি, সে কথা প্রমাণের জন্য বিদেশে বসে এক বাক্বুদ্ধিজীবী আস্ত একখানা বই লিখে ফেলেছেন। জুলাইয়ের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যু পুলিশের হাতে নয়, বিক্ষোভকারীদের হাতে হয়েছে, অথবা মুগ্ধ, বিক্ষোভকারীদের পানি দিতে গিয়ে খুন হওয়া যুবক, আসলে মরেনি, সে ফ্রান্সে আছে, এসব গুজব তাঁরাই ছড়িয়েছেন। কেন, তা বোঝাও কঠিন নয়।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লব শুধু শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে নয়, যাঁরা সে স্বৈরশাসনকে মদদ জুগিয়েছেন এবং যাঁরা ফায়দা নিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও। যাঁরা এখন সে বিপ্লবের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তাঁরা প্রায় সবাই এই ফায়দা লোটা ব্যক্তিদের অন্তর্গত।
অন্যদিকে বিপুল ক্ষমতাধর রাষ্ট্রযন্ত্রের দমন-পীড়ন উপেক্ষা করে যারা সেদিন রাস্তায় নেমেছিল, তারা এই সময়ের সেরা নায়ক—এ কথায় কোনো সন্দেহ নেই। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা যুবকদের ভয় দেখিয়ে বশে আনার চেষ্টা কম হয়নি। তারা মাথা নোয়ায়নি। আমরা আবু সাঈদের প্রসারিত দুই হাত দেখেছি।
টেলিভিশনের পর্দায় আমরা দেখেছি, স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা পুলিশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বলছে, ‘চালাও গুলি, আমরা রাস্তা থেকে হটব না।’ তাদের সে কথা শুনে আমার ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর বলা একটা কথা মনে পড়েছে, আমরা যখন মরতে শিখেছি, আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। হাসিনা তাঁর শিক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছিলেন, ফলে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে তাঁকে। সঙ্গে নিয়ে গেছেন নিজের পারিষদবর্গ।
প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ—কোনোটাই খুব সহজ কাজ নয়। এর জন্য কখনো কখনো চরম মূল্য দিতে হয়। চলতি সপ্তাহে আল-জাজিরায় পরিবেশিত একটি প্রতিবেদনে আমরা ১৭ বছরের কিশোরী নাফিসার কথা শুনেছি। ৫ আগস্ট, যেদিন হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান, লাখো মানুষের সঙ্গে সে–ও ছিল বিদ্রোহের মিছিলে। মিছিল থেকেই ফোনে সে বাবাকে বলেছিল, লড়াই শেষ না করে সে মাঠ ছাড়বে না। এ কথা বলার সামান্য পরই পুলিশের গুলিতে আহত হয় নাফিসা। রক্তাক্ত অবস্থায় বাবাকে জানায়, ‘বাবা, আমার আর ফেরা হবে না। আমার লাশটা তুমি নিয়ে যেয়ো।’
জানা-অজানা এসব ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ জনতার রক্তের আগুন থেকেই জন্ম নিয়েছিল জুলাই বিপ্লব। তাঁদের এই আত্মত্যাগ যাতে ব্যর্থ না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেকের। স্বৈরাচারের সুবিধাভোগীরা এখনো তৎপর। এই সময় নীরব থাকার অর্থ হবে নাফিসা ও তার মতো সাহসী মানুষের রক্তের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা।
হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ছ ত র জনত র গণহত য র জন য আম দ র বল ছ ন র সময় ন রবত অপর ধ আগস ট
এছাড়াও পড়ুন:
কেইনের জোড়া গোলে চেলসিকে হারাল বায়ার্ন, চ্যাম্পিয়ন পিএসজির গোল উৎসব
বায়ার্ন মিউনিখ ৩–১ চেলসি
২০১২ সালে আলিয়াঞ্জ অ্যারেনায় ইতিহাস গড়েছিল চেলসি। ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখকে টাইব্রেকারে হারিয়ে প্রথমবারের মতো পরেছিল ইউরোপসেরার মুকুট।
তবে এরপর থেকে বায়ার্নের সঙ্গে মুখোমুখি সব ম্যাচেই হেরেছে চেলসি। লন্ডনের ক্লাবটি পারল না আজও। হ্যারি কেইনের জোড়া গোলে চেলসিকে ৩–১ ব্যবধানে হারিয়েছে বায়ার্ন।
আলিয়াঞ্জ অ্যারেনায় ম্যাচের ২০ মিনিটে বায়ার্ন প্রথম গোলটা পেয়েছে উপহারসূচক। চেলসির সেন্টার–ব্যাক ট্রেভোহ চালোবাহ নিজেদের জালে বল জড়ালে এগিয়ে যায় বাভারিয়ানরা।
কিছুক্ষণ পরেই ব্যবধান দ্বিগুণ করেন কেইন। এবার ভুল করে বসেন চেলসির মইসেস কাইসেদো। নিজেদের বক্সে কেইনকে কাইসেদো অযথা ট্যাকল করলে পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি।
নতুন মৌসুমে গোলের পর গোল করেই চলেছেন হ্যারি কেইন