ছাত্রদল-এনসিপির সমাবেশ রবিবার: যান চলাচলে ডিএমপির নির্দেশনা
Published: 2nd, August 2025 GMT
রাজধানীতে একাধিক রাজনৈতিক সমাবেশ ও অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে রবিবার (৩ আগস্ট) যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীর সই করা বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, শাহবাগ, শহীদ মিনার ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচির কারণে ব্যাপক জনসমাগম হবে। এতে এসব এলাকায়, বিশেষ করে শাহবাগ ক্রসিং দিয়ে যানবাহন চলাচল সম্ভব হবে না।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রবিবার (৩ আগস্ট) দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল শাহবাগ মোড়ে ‘জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান, শোক ও বিজয়ের প্রথম বর্ষপূর্তি' উপলক্ষে ছাত্র সমাবেশ করবে।
আরো পড়ুন:
চাটমোহরে সড়ক সংস্কারের দাবিতে মানববন্ধন
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মঙ্গলবার থেকে সড়ক অবরোধের ডাক
এদিকে, বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ‘জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদের' দাবিতে ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জনসমাবেশ করবে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১ থেকে ৪ আগস্ট প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ৩৬ জুলাই কালচারাল ফেস্ট ‘জুলাই জাগরণ' অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এসব কর্মসূচির পাশাপাশি রবিবার ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা এবং বিসিএস পরীক্ষাও আছে বলে জানিয়েছে ডিএমপি।
এ পরিস্থিতিতে শাহবাগ, শহীদ মিনার ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন সড়কে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটবে বলে জানিয়ে ডিএমপি কিছু বিকল্প সড়ক ব্যবহারের অনুরোধ জানিয়েছে।
বিকল্প সড়ক ও ডাইভারশন পয়েন্ট
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়: সোনারগাঁও ক্রসিং/বাংলামোটর ক্রসিং হয়ে উত্তর দিক থেকে আসা যানবাহন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ক্রসিং এ সোজা শাহবাগের দিকে না গিয়ে বামে মোড় নিয়ে হেয়ার রোড/মিন্টু রোড হয়ে যাতায়াত করবে।
কাটাবন মোড়: সায়েন্সল্যাব ক্রসিং হয়ে পশ্চিম দিক থেকে আসা যানবাহন কাটাবন মোড় থেকে শাহবাগের দিকে না গিয়ে ডানে মোড় নিয়ে নীলক্ষেত/পলাশী হয়ে অথবা কাটাবন মোড় থেকে বামে মোড় নিয়ে সোনারগাঁও (হাতিরপুল) রোড হয়ে বাংলামোটর লিংক রোড দিয়ে চলাচল করবে।
মৎস্য ভবন মোড়: হাইকোর্ট/কদম ফোয়ারা ক্রসিং হয়ে আসা যানবাহন মৎস্য ভবন থেকে শাহবাগের দিকে না গিয়ে সোজা হেয়ার রোড/শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সরণী (মগবাজার রোড) হয়ে চলাচল করবে।
অন্যদিকে, কাকরাইল মসজিদ ক্রসিং হয়ে উত্তর দিক থেকে আসা যানবাহন মৎস্যভবন ক্রসিং থেকে শাহবাগের দিকে না গিয়ে সোজা হাইকোর্ট হয়ে গুলিস্তান/ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে চলাচল করবে।
টিএসসি/রাজু ভাস্কর্য ক্রসিং: নীলক্ষেত ক্রসিং/দোয়েল চত্ত্বর ক্রসিং থেকে আসা যানবাহন টিএসটি/রাজু ভাস্কর্য ক্রসিংয়ে এসে শাহবাগের দিকে না গিয়ে দোয়েল চত্ত্বর/নীলক্ষেত ক্রসিং হয়ে চলাচল করবে।
শহীদ মিনার সংলগ্ন রাস্তা: শহীদ মিনার সংলগ্ন রাস্তা যথাসম্ভব পরিহার করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশ পথ: সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশ পথগুলো যথাসম্ভব পরিহার করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
ঢাকাবাসীকে বিশেষ করে এইচএসসি/সমমান ও বিসিএস পরীক্ষার্থীদের যথেষ্ট সময় নিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে ডিএমপি।
ঢাকা/মাকসুদ/সাইফ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর সড়ক পর বহন জ ত য় ন গর ক প র ট ছ ত রদল এনস প শ হব গ র দ ক অন র ধ রব ব র পর ক ষ আগস ট ড এমপ
এছাড়াও পড়ুন:
‘সেবার রাজনীতি’ যেভাবে ‘খয়রাতি মন’ তৈরি করে
উচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে ছাত্র সংসদ (ডাকসু ও জাকসু) নির্বাচনের পর দেশজুড়ে নাগরিক সমাজে অনেক ধরনের রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে। যে বিতর্কগুলো জাতীয় নির্বাচনের বেলায়ও প্রাসঙ্গিক হতে পারে। সে জন্য সমাজে এসব আলোচনা হওয়া দরকার আছে।
সব বিতর্ক একসঙ্গে আলোচনায় না এনে আলাদাভাবে বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে পারি আমরা। যেমন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দান-অনুদানের কদর ও নির্বাচনে তার প্রভাব নিয়ে কথা হচ্ছে। আপাতত এ বিষয় এবং এর রাজনৈতিক–অর্থনীতি নিয়ে ভাবতে পারি আমরা।
ডাকসু, জাকসু ও রাকসু হলো শিক্ষার্থীদের ইউনিয়ন। পেশাগত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দর–কষাকষি করে শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস জীবন স্বস্তিকর করাই এসব ইউনিয়নের প্রকৃত লক্ষ্য। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ছাত্রদের দাবিদাওয়া আদায় করে দেওয়াই ছাত্র সংসদের কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ব্যবস্থায় সংসদের বিধান সে জন্যই রাখা হয়েছে। এটা অনেকটা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ‘সিবিএ’র মতো।
কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানে একাধিক শ্রমিকসংগঠন থাকতে পারে; কিন্তু শ্রমিকেরা তাদের মধ্য থেকে কালেকটিভ বার্গেনিং এজেন্ট বা সিবিএ হিসেবে বেছে নেয় কয়েকজন কর্মীকে। ডাকসু, জাকসু ও রাকসুতেও শিক্ষার্থীদের তা–ই করার কথা।
ডাকসু, জাকসু ও রাকসুর কাজ হলো ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দেওয়া। এখন প্রশ্ন হলো ইউনিয়ন নেতৃত্ব যদি সরকার, রাষ্ট্র বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে দাবিদাওয়া আদায়ের বদলে নিজেরাই ভিন্ন কোনো উৎস থেকে সম্পদ সংগ্রহ করে শিক্ষার্থীদের জন্য সেবা ও সুবিধা বাড়াতে চেষ্টা করে, তাহলে সমস্যা কী? এর কি বিশেষ কোনো রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নির্বাচনী অধ্যায়ের পূর্বাপর অনুসন্ধান করে অনেক রাজনৈতিক ভাষ্যকার বলছেন, বিদ্যাপীঠগুলোতে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি বাছাইয়ের নির্বাচনে দান-অনুদানে যুক্ত সংগঠন ও প্রার্থীরা ভোটে এগিয়ে ছিলেন। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দর–কষাকষির চেয়ে নিজেরাই ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীবান্ধব কিছু পদক্ষেপ নিয়ে সেবাধর্মী সংগঠনগুলো বাড়তি ভোট পেয়েছে। ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প থেকে শুরু করে হলে পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র বসানো পর্যন্ত অনেক কাজ করছে কোনো কোনো সংগঠন। তাদের বক্তব্য, শিক্ষার্থীরা এসব কাজ পছন্দ করছেন। তাঁরা এরকম দান-অনুদানে যুক্তদের ভোটে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলে মনে হয়েছে।
এ রকম যুক্তি ও অনুমান যেহেতু অনেকের কাছে বেশ বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে, সেই কারণে এই সিদ্ধান্তে আসাও সহজ হয় যে অতীতে শিক্ষার্থীরা যেসব বিষয় দেখে নেতৃত্ব পছন্দ করতেন, এখনকার পছন্দের মানদণ্ড তার চেয়ে ভিন্ন।
এর ফল হিসেবে পরের অধ্যায় অনুমান করা কঠিন নয়। জাতীয়ভাবেও হয়তো অনেক সংগঠন এখন দান-খয়রাতধর্মী সেবামূলক কাজের দিকে বেশি ঝুঁকবে। সে ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন তো উঠতে পারে, ক্যাম্পাসে হোক বা অন্যত্র হোক, এসব সেবাধর্মী কাজের খরচ কারা জোগান দেবে বা দিচ্ছে?
শিক্ষার্থীদের পক্ষে ওয়াশিং মেশিন কিনে হলগুলোর তলায় বসানো সম্ভব নয়। হঠাৎ হঠাৎ গরু কিনে জিয়াফত আয়োজনও সহজ নয়। তাহলে নিশ্চয়ই বাইরের কোনো উৎস থেকে তারা এই অর্থ পাচ্ছে বা নিচ্ছে।
শত শত শিক্ষার্থীকে ইফতার করানো বা উপঢৌকন দেওয়াও বাইরের আর্থিক–সহায়তা ছাড়া সম্ভব নয়। তার মানে এ ধরনের সেবাধর্মী তৎপরতা শুধুই ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক বিশুদ্ধ কোনো বিষয় নয়। এর ক্যাম্পাস–বহির্ভূত একটি অন্তর্জাল অবশ্যই আছে; কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের এত অন্তর্জাল খোঁজার ‘টাইম নেই’। সুবিধাটা নগদ নগদ তাঁরা পছন্দ করছেন।
সেবাধর্মী রাজনীতির একটি অনিবার্য পার্শ্বফল হলো সামাজিক বৈষম্য আড়াল হওয়া। সমাজে সম্পদের যে অসম বণ্টন এবং পুঁজির শোষণ রয়েছে, দানের রাজনীতি তাকে ন্যায্যতা ও স্বাভাবিক চেহারা দেয়। দারিদ্র্য ও যাবতীয় সামাজিক দুর্দশা যে একটি কাঠামোগত সমস্যা, সেটি আড়াল করে তথাকথিত এই ‘সেবা’।যেমন এখন ঢাকা শহরে গণপরিবহনের স্বল্পতা একটি বিশাল সমস্যা। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও খোদ রাজধানীতে সে রকম কোনো স্বস্তিকর ব্যবস্থা কোনো সরকার করতে পারেনি বা করেনি। এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ-দুঃখ আছে। এখন কোনো রাজনৈতিক দল বা তার ছায়ায় পুষ্ট কোনো ‘সামাজিক সংগঠক’ যদি ঢাকায় বিনা মূল্যে ১০০ বাস নামায়, তাতে সাধারণ মানুষ খুব খুশি হবেন।
এ রকম খরচ ও সেবার একটি রাজনৈতিক-অর্থনীতি থাকতে পারে। নিদেনপক্ষে এর মাধ্যমে সমাজে মতাদর্শিক প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা তো থাকবেই; কিন্তু বিপন্ন মানুষ, নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত নাগরিকদের অত কিছু খেয়াল করলে চলে না। যে দল বা সংগঠন এ রকম সেবা দেবে, তারা ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থান বা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে না বিপক্ষে, সেটি ভাবার চেয়ে মানুষ দ্রুততার সঙ্গে ওই সেবা নেবেন এবং সেবাদানকারীও তাঁদের পছন্দনীয় হয়ে উঠবে।
এ রকম আরও সেবাদানকারী তখন এগিয়ে আসতে পারে এ রকম কাজে। কারণ ‘পছন্দ’ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে অনেক লোভনীয় জিনিস; কিন্তু তাতে গণপরিবহন–ব্যবস্থার দাবি খুব একটা এগোবে না। একাধিক দল একই সেবা দিতে নামলে ওই দাবি বরং হারিয়ে যাবে।
আরও পড়ুনডাকসু নির্বাচন, ফলাফল ও তরুণ মনের চাওয়া১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫কিন্তু এ রকম মডেল রাষ্ট্রের খুব পছন্দ; অন্যান্য ‘কর্তৃপক্ষের’ও পছন্দ। সমাজে দারিদ্র্য কমানো, নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা, বৈষম্য হ্রাস করা, শিক্ষার অধিকার কিংবা স্বাস্থ্যসুবিধা বাড়ানোর দায় রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে এসব বিষয়ে ভূমিকা রাখার লক্ষ্যেই। আর সরকার গঠিত হয় রাষ্ট্রের সেসব দায় বাস্তবায়নের জন্য।
কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র বা বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র সেসব দায়িত্ব মেটাতে পারছে না। তাতে জন–অসন্তোষ আছে। এ ধরনের রাষ্ট্রে নাগরিকেরা বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন চাইতে পারেন। সে অবস্থায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের ‘বিকল্প’ হিসেবে সেবাধর্মী কাজ, দান, অনুদান ও খয়রাত রাষ্ট্রের জন্য একটি ভালো ডিফেন্সলাইন। এতে রাষ্ট্রের গায়ে ক্ষোভের আঁচড় কম লাগে। প্রশাসন তার ব্যর্থতা আড়াল করতে পারে।
যেমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খাবারের মান ও পরিমাণ বাড়ানো দেশের সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। এটা রাষ্ট্রীয় বাজেট বরাদ্দের অগ্রাধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। এখন এমন হতে পারে ক্যাম্পাসের ভেতরে ও বাইরে শক্তিশালী কোনো সংগঠন তাদের মূল দল বা দেশ-বিদেশের সহযোগী বন্ধুদের মাধ্যমে বিপুল অর্থ এনে নিজেরাই হলে হলে বাড়তি খাবার সরবরাহ করল। এটা শিক্ষার্থীরা খুব পছন্দ করবে। আবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং রাষ্ট্রও খুব পছন্দ করবে।
কেবল ক্যাম্পাসে নয়, কয়েক বছর ধরে গ্রামাঞ্চলেও সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের মধে৵ কিছু রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠন এভাবে ‘দরিদ্রবান্ধব সেবাধর্মী কাজ’ করছে। জাতীয় নির্বাচন হলে তারও চমকপ্রদ কিছু ফল দেখব আমরা। এ রকম সবকিছুর প্রাপ্তি হিসেবে সেবাধর্মী দান-অনুদানের একটি প্রতিযোগিতাও হয়তো দেখব আমরা চারদিকে। এতে জনসমাজে পদ্ধতিগত বঞ্চনার রাষ্ট্রীয় সমাধানের দাবি ক্রমে অবলুপ্ত হতে বাধ্য। এ রকম সমাধানচিন্তার প্রস্তাবকারীদেরও স্বভাবত সামনে দুর্দিন।
এ রকম আর্থসামাজিক অবস্থা রাষ্ট্রের জন্য একটি সুযোগের মতো। ক্ষমতার রাজনীতিতে উচ্চ আকাঙ্ক্ষী ধনাঢ্য সমাজের জন্যও অনুরূপ। জনসমাজ সেবা পেয়ে খুশি থাকলে শিক্ষা খাত বা স্বাস্থ্য খাতে ব্যায় না বাড়িয়ে বাড়তি টাকা রাষ্ট্র সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র শক্তিশালী করায় বিনিয়োগ করতে পারে। এতে ‘রাষ্ট্র’ ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে এবং সমাজের পুরোনো অধিকারবাদী, পরিবর্তনবাদী রাজনীতিকেও কোনঠাসা করতে পারে।
সেবাধর্মী রাজনীতিতে রাষ্ট্রের লাভ তাই দ্বিবিধ। ফলে আন্তরিকভাবেই এ রকম ‘কাজ’ রাষ্ট্রের সব ‘কর্তৃপক্ষের’ সমর্থন, সহায়তা ও সহযোগিতা পায় ও পাবে। সব দেশে সেটিই হয়। কারণ, একদিকে এতে সব ‘কর্তৃপক্ষের’ সুরক্ষা বাড়ে। অন্যদিকে এতে তাদের শক্তিও বাড়ে। কুলীন সমাজ এ রকম রাষ্ট্রকে দিয়ে খুব সহজে কর্তৃত্ববাদী একটি শাসনও কায়েম করতে পারে।
আরও পড়ুনশিবিরের এই সাফল্য জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতকে সুবিধা দেবে কি২০ ঘণ্টা আগেকুলীন সমাজ ও করপোরেটদের জন্য দান-অনুদান কর্মকাণ্ডের রাজনৈতিক সুবিধা রাষ্ট্রের মতোই ব্যাপক ও সম্পূরক। সে বিষয়েও দু–চার কথা বলা দরকার।
সেবাধর্মী রাজনীতির একটি অনিবার্য পার্শ্বফল হলো সামাজিক বৈষম্য আড়াল হওয়া। সমাজে সম্পদের যে অসম বণ্টন এবং পুঁজির শোষণ রয়েছে, দানের রাজনীতি তাকে ন্যায্যতা ও স্বাভাবিক চেহারা দেয়। দারিদ্র্য ও যাবতীয় সামাজিক দুর্দশা যে একটি কাঠামোগত সমস্যা, সেটি আড়াল করে তথাকথিত এই ‘সেবা’।
‘সেবার রাজনীতি’ জনসমাজকে এই বার্তাই দেয়—‘ধনাঢ্যরা কীভাবে আয় করছেন, রাষ্ট্র সম্পদের সুষম বণ্টনে ব্যর্থ কি না, সেসব দেখার দরকার নেই তোমার। বৃহত্তর সমাজের কথা বাদ দাও। ধনাঢ্যরা তোমাকে যা দিচ্ছেন, তাতে তোমার ভালোই চলে যাবে। তুমি এতে সন্তুষ্ট থাকো। শোকর করো এবং দাতাদের তোমার অভিভাবক হতে দাও।’
এভাবে সেবার পথে, অধিকারবাদী প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিনা যুদ্ধে ধরাশায়ী করে কুলীন সমাজ রাষ্ট্র ও রাজনীতির অভিভাবকত্ব পায়। তবে এ রকম ‘সেবাবাদ’ দুইভাবে রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষতি করে। রাষ্ট্রকে জনস্বার্থে সম্পদ বণ্টন ও ব্যবস্থাপনায় আরও ন্যায্য ও দক্ষ হতে বাধাগ্রস্ত করে এটা। জনগণের তরফ থেকে এ লক্ষ্যে চাপ কমতে থাকায় রাষ্ট্র ক্রমে একটি ক্ষুদ্র সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠীর নিজস্ব হাতিয়ারে পরিণত হয়। গুটিকয়েকের হাতে সম্পদের পুঞ্জীভবনকে তখন সমস্যা মনে করা হয় না। এতে রাষ্ট্রের ভেতর সমান্তরাল অর্থনৈতিক বিকাশ সীমিত থেকে যায়।
দ্বিতীয়ত সমাজ ও রাষ্ট্রকে অধিকতর সুষম ও ন্যায়ানুগ করার ক্ষেত্রে জনসমাজের রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও আইনি অগ্রগতিও বাধাগ্রস্ত করে দান-অনুদান মডেল। সুবিধাবঞ্চিত সমাজ যেহেতু বাস্তব কারণে সেবা-দান-অনুদান অগ্রাহ্য করতে পারে না; বরং এটা পাওয়ার জন্য ন্যায্য ভিন্নমতও চেপে যায়, সে কারণে এই মডেল গণতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশও রুদ্ধ করে।
এটা জনসমাজে সৃষ্টিশীল উদ্যমের বদলে ‘খয়রাতি মন’ তৈরি করে চলে, বিশেষ করে সুবিধাগ্রহীতাদের মধ্যে। এ অবস্থায় মানুষ ভাবতে শুরু করে—তার বা তাদের অবস্থার পরিবর্তন বাইরের কোনো শক্তির দয়াদাক্ষিণ্যনির্ভর। নিজেরা বা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যমান অবস্থার বদলে সক্ষম নয়। তাদের সে রকম লক্ষ্যে সংঘবদ্ধ হওয়ারও দরকার নেই। এ রকম মনোভাব সহজে সুবিধাপ্রাপ্ত ও ক্ষমতাবানদের পুরোনো কর্তৃত্ব ও শক্তিকে উৎপাদন-পুনরুৎপাদন হতে সহায়তা করে চলে।
‘সেবা-মডেল’ সমাজের ক্ষমতা-সম্পর্ক অপরিবর্তনশীল করে রাখতে চায় এবং সেবার আদলে নতুন ধরনের একটি উপনিবেশ-সংস্কৃতি জারি করে ও তাকে প্রতিমুহূর্তে প্রয়োজনীয় মনে করায়। ‘সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তিরা’ এতে চিরকাল নির্ভরশীল ও অপরের মুখাপেক্ষী থেকে যায় এবং তাঁদের দেশের ‘প্রতিষ্ঠানগুলো’র প্রয়োজনীয় সংস্কার ও উন্নয়নও আর হয় না। এতে সমৃদ্ধ সমাজ নির্মাণের বদলে ‘সুবিধা’ পাওয়ার সর্বব্যাপক আকুতি দেখা দেয়। এসব বিবেচনায় সমাজে ‘সেবা’ বিশেষ ধরনের একটি রাজনৈতিক বিনিয়োগ এবং নিশ্চিতভাবে কৌশলগত ও হেজিমনিক বিনিয়োগও বটে।
আলতাফ পারভেজ, গবেষক
মতামত লেখকের নিজস্ব