ভোরের আলোয় ঝিলমিল করে ওঠে সিডনি হারবার। হঠাৎ করেই যেন জলরাশির বুক চিরে ভেসে ওঠে বিশাল কংক্রিটের পাল– সাদা, চকচকে, ঝলমলে। অপেরা হাউস। স্থাপত্যের বিস্ময়। এটি শুধু একটি স্থাপনা নয়। এর ভেতর জমে আছে এক ড্যানিশ স্বপ্নদ্রষ্টার চাপা কান্না, এক নির্মাতার লজ্জাকর প্রস্থান আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের রং বদলানো নাট্যমঞ্চ।

১৯৪০-এর দশকের শেষ দিকে বিখ্যাত ব্রিটিশ কন্ডাক্টর স্যার ইউজিন গুসেন্স প্রথম সিডনিতে একটি অপেরা হাউস নির্মাণের প্রস্তাব দেন। তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন সংগীত পরিচালক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি নিউ সাউথ ওয়েলস স্টেট কনজারভেটোরিয়াম অব মিউজিকের পরিচালক হিসেবে সিডনিতে আসেন। গুসেন্স তাঁর অফিস থেকে দেখতে পেতেন একটি পুরোনো ট্রাম ডিপো, বেনেলং পয়েন্ট; যা আদিবাসী গ্যাডিগাল জনগোষ্ঠীর কাছে টুবাওগুলে নামে পরিচিত; হাজার বছর ধরে সেখানে আদিবাসীদের উৎসব উদযাপন হতো।

সে স্থানে তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে ১৯৫০-এর দশকজুড়ে গুসেন্স অক্লান্তভাবে লবিং করেন। তিনি নিউ সাউথ ওয়েলসের তৎকালীন প্রিমিয়ার জোসেফ কাহিলকে রাজি করান। তবে গুসেন্স নিজে তাঁর স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারেননি। ১৯৫৬ সালে যুক্তরাজ্যে নাইটহুড গ্রহণের পর অস্ট্রেলিয়ায় ফিরলে তাঁর ব্যাগে অশ্লীল ছবি, পর্নোগ্রাফি এবং রাবারের মুখোশ পাওয়া যায়। এ কেলেঙ্কারি তাঁর সিডনির ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেয়। তিনি ‘ই গ্রে’ ছদ্মনামে রোমে পালিয়ে যান; আর কখনও অস্ট্রেলিয়ায় ফেরেননি।

তবু অপেরা হাউস নির্মাণের নকশা প্রতিযোগিতা হয়। ২৩৩টি নকশা জমা পড়ে। ১৯৫৭ সালের শুরুতে সরকার ঘোষণা করে, এক ড্যানিশ স্থপতি ইয়র্ন উৎজন বিজয়ী হয়েছেন।

‘এটি শুরু থেকেই সিডনির মানুষের শ্বাসরুদ্ধ বিস্ময় এবং ঝলসে দেওয়া গালিগালাজে উত্তপ্ত করে তোলে’– বলেন বিবিসির প্রতিবেদক ট্রেভর ফিলপট, যিনি ষাটের দশকে এ স্থাপনার নির্মাণ কাজ দেখতে যান সিডনিতে। তিনি লিখেছেন, ‘তখন কেউ একে বলেন সিডনি হারবার মনস্টার, কেউ বলেন ড্যানিশ পেস্ট্রি, আবার কেউ বলেন ভেঙে পড়া সার্কাসের তাঁবু।’

প্রিমিয়ার কাহিল জনমত বা রাজনৈতিক বিরোধিতা ঠেকাতে দ্রুত নির্মাণ শুরু করতে চাইলেন। উৎজনের ডিজাইন খরচের দিক থেকে তুলনামূলক সস্তা ছিল, তবে অর্থ সংগ্রহ ছিল কঠিন। তাই ১৯৫৭ সালে একটি স্টেট লটারি চালু করা হয় অর্থায়নের জন্য। তৎকালীন ব্যয় ধারণা ছিল ৩.

৫ মিলিয়ন পাউন্ড বা ৭ মিলিয়ন ডলার। উদ্বোধনের তারিখ ধার্য হয়েছিল ২৬ জানুয়ারি ১৯৬৩, অস্ট্রেলিয়া দিবসে। এ দুই অনুমানই পরে ভুল প্রমাণিত হয়। প্রধান পৃষ্ঠপোষক কাহিল ১৯৫৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। এর আগে তিনি তাঁর মন্ত্রী নরম্যান রায়ানকে অনুরোধ করেন, প্রকল্পটা যেন বন্ধ না হয়।

এরই মধ্যে রবার্ট অ্যাসকিন ক্ষমতায় আসেন এবং ডেভিস হিউজেসকে পাবলিক ওয়ার্কস মন্ত্রী করেন, যিনি উৎজনের সঙ্গে বারবার দ্বন্দ্বে জড়ান। এক পর্যায়ে হিউজেস অর্থ দেওয়া বন্ধ করে দেন। ফলে উৎজন তাঁর কর্মীদের বেতন দিতে না পেরে ১৯৬৬ সালে পদত্যাগ করে ডেনমার্কে চলে যান; আর ফিরে আসেননি।

উৎজনের বিদায়ের প্রতিবাদে ১৯৬৬ সালের ৩ মার্চ এক হাজার মানুষ সিডনিতে বিক্ষোভ করেন। সরকার নতুন একটি স্থপতি দল গঠন করে অভ্যন্তরীণ কাজ শেষ করে। শেষমেশ ১৯৭৩ সালে পুরো ভবন নির্মাণ শেষ হয় ১০ বছর বিলম্বে এবং প্রাথমিক বাজেটের ১৪ গুণ বেশি খরচে। মোট ব্যয় দাঁড়ায় ১০২ মিলিয়ন ডলার। ওই বছরের ২০ অক্টোবর রানী এলিজাবেথ দ্বিতীয় উদ্বোধন করেন ভবনটি। উৎজন সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তবে ১৯৯৯ সালে তিনি আবার যুক্ত হন ৬৬ মিলিয়ন ডলার বাজেটের সংস্কার প্রকল্পে। ২০০৪ সালে একটি হলকে তাঁর সম্মানে ‘উৎজন রুম’ নামকরণ করা হয়। বিবিসি অবলম্বনে

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ডন ত

এছাড়াও পড়ুন:

স্বপ্ন, সংকট আর সৃষ্টির আখ্যান

ভোরের আলোয় ঝিলমিল করে ওঠে সিডনি হারবার। হঠাৎ করেই যেন জলরাশির বুক চিরে ভেসে ওঠে বিশাল কংক্রিটের পাল– সাদা, চকচকে, ঝলমলে। অপেরা হাউস। স্থাপত্যের বিস্ময়। এটি শুধু একটি স্থাপনা নয়। এর ভেতর জমে আছে এক ড্যানিশ স্বপ্নদ্রষ্টার চাপা কান্না, এক নির্মাতার লজ্জাকর প্রস্থান আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের রং বদলানো নাট্যমঞ্চ।

১৯৪০-এর দশকের শেষ দিকে বিখ্যাত ব্রিটিশ কন্ডাক্টর স্যার ইউজিন গুসেন্স প্রথম সিডনিতে একটি অপেরা হাউস নির্মাণের প্রস্তাব দেন। তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন সংগীত পরিচালক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি নিউ সাউথ ওয়েলস স্টেট কনজারভেটোরিয়াম অব মিউজিকের পরিচালক হিসেবে সিডনিতে আসেন। গুসেন্স তাঁর অফিস থেকে দেখতে পেতেন একটি পুরোনো ট্রাম ডিপো, বেনেলং পয়েন্ট; যা আদিবাসী গ্যাডিগাল জনগোষ্ঠীর কাছে টুবাওগুলে নামে পরিচিত; হাজার বছর ধরে সেখানে আদিবাসীদের উৎসব উদযাপন হতো।

সে স্থানে তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নে ১৯৫০-এর দশকজুড়ে গুসেন্স অক্লান্তভাবে লবিং করেন। তিনি নিউ সাউথ ওয়েলসের তৎকালীন প্রিমিয়ার জোসেফ কাহিলকে রাজি করান। তবে গুসেন্স নিজে তাঁর স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারেননি। ১৯৫৬ সালে যুক্তরাজ্যে নাইটহুড গ্রহণের পর অস্ট্রেলিয়ায় ফিরলে তাঁর ব্যাগে অশ্লীল ছবি, পর্নোগ্রাফি এবং রাবারের মুখোশ পাওয়া যায়। এ কেলেঙ্কারি তাঁর সিডনির ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেয়। তিনি ‘ই গ্রে’ ছদ্মনামে রোমে পালিয়ে যান; আর কখনও অস্ট্রেলিয়ায় ফেরেননি।

তবু অপেরা হাউস নির্মাণের নকশা প্রতিযোগিতা হয়। ২৩৩টি নকশা জমা পড়ে। ১৯৫৭ সালের শুরুতে সরকার ঘোষণা করে, এক ড্যানিশ স্থপতি ইয়র্ন উৎজন বিজয়ী হয়েছেন।

‘এটি শুরু থেকেই সিডনির মানুষের শ্বাসরুদ্ধ বিস্ময় এবং ঝলসে দেওয়া গালিগালাজে উত্তপ্ত করে তোলে’– বলেন বিবিসির প্রতিবেদক ট্রেভর ফিলপট, যিনি ষাটের দশকে এ স্থাপনার নির্মাণ কাজ দেখতে যান সিডনিতে। তিনি লিখেছেন, ‘তখন কেউ একে বলেন সিডনি হারবার মনস্টার, কেউ বলেন ড্যানিশ পেস্ট্রি, আবার কেউ বলেন ভেঙে পড়া সার্কাসের তাঁবু।’

প্রিমিয়ার কাহিল জনমত বা রাজনৈতিক বিরোধিতা ঠেকাতে দ্রুত নির্মাণ শুরু করতে চাইলেন। উৎজনের ডিজাইন খরচের দিক থেকে তুলনামূলক সস্তা ছিল, তবে অর্থ সংগ্রহ ছিল কঠিন। তাই ১৯৫৭ সালে একটি স্টেট লটারি চালু করা হয় অর্থায়নের জন্য। তৎকালীন ব্যয় ধারণা ছিল ৩.৫ মিলিয়ন পাউন্ড বা ৭ মিলিয়ন ডলার। উদ্বোধনের তারিখ ধার্য হয়েছিল ২৬ জানুয়ারি ১৯৬৩, অস্ট্রেলিয়া দিবসে। এ দুই অনুমানই পরে ভুল প্রমাণিত হয়। প্রধান পৃষ্ঠপোষক কাহিল ১৯৫৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। এর আগে তিনি তাঁর মন্ত্রী নরম্যান রায়ানকে অনুরোধ করেন, প্রকল্পটা যেন বন্ধ না হয়।

এরই মধ্যে রবার্ট অ্যাসকিন ক্ষমতায় আসেন এবং ডেভিস হিউজেসকে পাবলিক ওয়ার্কস মন্ত্রী করেন, যিনি উৎজনের সঙ্গে বারবার দ্বন্দ্বে জড়ান। এক পর্যায়ে হিউজেস অর্থ দেওয়া বন্ধ করে দেন। ফলে উৎজন তাঁর কর্মীদের বেতন দিতে না পেরে ১৯৬৬ সালে পদত্যাগ করে ডেনমার্কে চলে যান; আর ফিরে আসেননি।

উৎজনের বিদায়ের প্রতিবাদে ১৯৬৬ সালের ৩ মার্চ এক হাজার মানুষ সিডনিতে বিক্ষোভ করেন। সরকার নতুন একটি স্থপতি দল গঠন করে অভ্যন্তরীণ কাজ শেষ করে। শেষমেশ ১৯৭৩ সালে পুরো ভবন নির্মাণ শেষ হয় ১০ বছর বিলম্বে এবং প্রাথমিক বাজেটের ১৪ গুণ বেশি খরচে। মোট ব্যয় দাঁড়ায় ১০২ মিলিয়ন ডলার। ওই বছরের ২০ অক্টোবর রানী এলিজাবেথ দ্বিতীয় উদ্বোধন করেন ভবনটি। উৎজন সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তবে ১৯৯৯ সালে তিনি আবার যুক্ত হন ৬৬ মিলিয়ন ডলার বাজেটের সংস্কার প্রকল্পে। ২০০৪ সালে একটি হলকে তাঁর সম্মানে ‘উৎজন রুম’ নামকরণ করা হয়। বিবিসি অবলম্বনে

সম্পর্কিত নিবন্ধ