ঐকমত্য কমিশনের দুই মাসব্যাপী টানা আলোচনার সর্বশেষ দিনে (৩১ জুলাই ২০২৫) বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মতামত দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি।

ঐকমত্য কমিশন মনে করে, রাষ্ট্রপতির পদটি ‘আলংকারিক’ না থেকে তা ‘ক্ষমতাশালী’ হওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদধারীদের নিয়োগ রাষ্ট্রপতির সরাসরি সিদ্ধান্তে হওয়া প্রয়োজন।

ঐকমত্য কমিশন প্রস্তাব করে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান, এনএসআই প্রধান, ডিজিএফআই প্রধান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ ১২টি পদে নিয়োগে রাষ্ট্রপতির সরাসরি এখতিয়ার থাকা দরকার।

এ বিষয়ে আলোচনাকালে বিভিন্ন দল বিভিন্নমুখী অবস্থান নেয়। সংসদীয় কাঠামোয় রাষ্ট্রপতির ‘আলংকারিক’ পদকে এভাবে ক্ষমতায়িত করার চেষ্টা নজিরবিহীন।

রাষ্ট্রপতির এ ধরনের ক্ষমতায়নের প্রচেষ্টা নির্বাহী বিভাগ; অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনকাঠামোয় ভারসাম্যের পরিবর্তে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। প্রকারান্তরে সংসদীয় কাঠামোয় আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে যা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা থাকা প্রয়োজন, এ ধরনের কৃত্রিম ক্ষমতায়ন এর জন্য সহায়ক না হয়ে তাকে ভারসাম্যহীন করতে পারে।

আরও পড়ুনপ্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা না কমালে কিসের সংস্কার ০৩ এপ্রিল ২০২৫

ঐকমত্য কমিশনে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায়নের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে মূলত প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’-এর মধ্যে নিয়ে আসার অভিপ্রায় থেকে। এটা সত্য যে পূর্বতন সরকারগুলোর সময় নির্বাহী বিভাগের হাতে যে ক্ষমতা ছিল, তা এককভাবে কুক্ষিগত ছিল প্রধানমন্ত্রীর হাতে।

দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির পদটি আলংকারিক করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর হাতে নির্বাহী বিভাগের সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার একক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কমতে কমতে ঠেকেছিল শূন্যের কোঠায়, রাষ্ট্রীয় সব কার্যক্রম পরিচালিত হতো প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে।

রাষ্ট্রপতির আলংকারিক ক্ষমতা বৃদ্ধি থেকে সরে এসে সংসদীয় কাঠামো ব্যবহার করে যোগ্য ব্যক্তি নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এতে প্রক্রিয়াগত স্বচ্ছতার পাশাপাশি অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা দূর করা যাবে।

এই অতিকেন্দ্রীভূত শাসনক্ষমতা এককভাবে হস্তগত হওয়ার কারণে নির্বাহী বিভাগের সব গুরুত্বপূর্ণ পদের মনোনয়ন ও পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্তই ছিল। বিগত দশকগুলোয় নির্বাহী বিভাগের বিভিন্ন শীর্ষ পদে যাঁরা দায়িত্ব পালন করেছেন, অন্যান্য যোগ্যতার পাশাপাশি দলীয় আনুগত্যও নিয়োগপ্রক্রিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল।

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে যে মনোনয়ন যোগ্যতা বিচার করার কথা ছিল, তা বিচার্য হয়নি। ফলে এসব মনোনয়ন ও নির্বাচন প্রায়ই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। তার চেয়ে বড় কথা, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের চেয়ে বিভিন্ন সময় অন্যান্য স্বার্থ অগ্রাধিকার পেয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার এ অবস্থা থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ রোধ করে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে বিভিন্ন সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল সীমিত করা, বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে সংসদীয় কমিটিগুলোর প্রধান নির্বাচন করা, প্রধান বিচারপতি নিয়োগে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা, স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা ইত্যাদি। প্রস্তাবিত এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহি বাড়বে এবং রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভ—আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের ওপর প্রধানমন্ত্রীর অযাচিত প্রভাব কমবে।

আরও পড়ুনএমন একজন রাষ্ট্রপতি কি আমরাও পেতে পারি না০৬ আগস্ট ২০২২

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি করে নির্বাহী বিভাগ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তার সরাসরি মনোনয়ন বা নিয়োগ প্রদান এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। রাষ্ট্রপতির এ ধরনের ক্ষমতায়ন তিন বিভাগের মধ্যে ভারসাম্যকে দুর্বল করবে। সংসদীয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির পদটি আলংকারিক। পদটি ক্ষমতায়িত করতে গিয়ে নির্বাহী বিভাগকে দুর্বল করা সরকার পরিচালনায় সমস্যা ও জটিলতা তৈরি করবে।

এটা সত্য যে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে যাঁরা নিয়োগ পাবেন, তাঁরা অবশ্যই যোগ্যতাসম্পন্ন, বিশেষায়িত জ্ঞানের অধিকারী, রাজনৈতিকভাবে প্রাজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হবেন। এসব বিশেষায়িত পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই যোগ্যতা–নির্ধারক মাপকাঠি থাকা এবং তার প্রয়োগ প্রয়োজন।

প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিপরিষদ স্বীয় পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তিদের আবেদন গ্রহণ, সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রস্তুতি, সুপারিশ কমিটির মাধ্যমে প্রস্তাব নেওয়া এবং তাঁর মাধ্যমে নিয়োগের প্রক্রিয়া বিবেচনা করে মনোনয়ন চূড়ান্ত করবেন। মনোনীত ব্যক্তিকে সংসদে তাঁর যোগ্যতা ব্যাখ্যা করার বিধান করা যেতে পারে।

আরও পড়ুনপ্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য: কতটা কাজে আসবে সংস্কার প্রস্তাব১৩ এপ্রিল ২০২৫

সরকারের শীর্ষ পদগুলোর নিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হতে পারে সংসদীয় কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করা। অনধিক ১০ সদস্যের সংসদীয় কমিটি গঠনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নিয়োগের বিষয়ে সংসদের মতামত নেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারি দলের উপনেতা, সরকারি দলের চিফ হুইপ এবং দুজন হুইপ, বিরোধী দলের নেতা, বিরোধী দলের দুজন সংসদ সদস্য, সংরক্ষিত নারী আসনের একজন সদস্য, সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এবং স্পিকার মনোনীত একজন সদস্য নিয়ে কমিশন কমিটি গঠন হতে পারে। সরকারের শীর্ষ পদে মনোনীত ব্যক্তি এ কমিটির কাছে তাঁর যোগ্যতা-সংক্রান্ত ব্যাখ্যা দেবেন।

এ প্রক্রিয়ায় নিয়োগের মাধ্যমে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। ভারতে গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ নির্বাহী নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের একক ক্ষমতা থাকে। প্রয়োজনবোধে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করেন। পাকিস্তানে কোনো কোনো পদে নিয়োগে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা রয়েছে, তবে তিনি যথাযথ কমিশনের সঙ্গে আলোচনাক্রমে সিদ্ধান্ত নেন।

সর্বশেষ নির্বাহী বিভাগের গতিশীল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন পদে যথাযথ যোগ্যতাসম্পন্ন শীর্ষ নির্বাহী থাকা প্রয়োজন, যাঁরা তাঁর মনোনয়নে নিযুক্ত হবেন। এ ক্ষমতা অন্য কারও মাধ্যমে প্রয়োগ করা হলে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা দুর্বল হয়। রাষ্ট্রপতির আলংকারিক ক্ষমতা বৃদ্ধি থেকে সরে এসে সংসদীয় কাঠামো ব্যবহার করে যোগ্য ব্যক্তি নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এতে প্রক্রিয়াগত স্বচ্ছতার পাশাপাশি অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা দূর করা যাবে।

ড.

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম গবেষণা পরিচালক, সিপিডি

*মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ষ ট রপত র ক ষমত ত র ক ষমত র ক ষমত য় প রস ত ব আল ক র ক প রক র য় ভ রস ম য ক ক ষমত সরক র র য গ যত পর চ ল সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

দেশকে বিপর্যয়ে ঠেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে: ইসমাইল জবিউল্লাহ

জাতীয় সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতি নিয়ে আন্দোলনের নামে নির্বাচন নস্যাৎ, গণতন্ত্র ব্যাহত ও দেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ।

সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) লক্ষ্মীপুর সদর (পূর্ব) উপজেলা বিএনপির দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ অভিযোগ করেন।

ইসমাইল জবিউল্লাহ বলেন, এই সুযোগে পালিয়ে যাওয়া ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে এসে বিশৃঙ্খলা ও নাশকতা সৃষ্টি করতে পারে। অহেতুক আন্দোলনের নামে বিভাজন ও উত্তেজনা গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী।

জামায়াতে ইসলামী আস্থাহীন দল, উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় জামায়াত একবারও জাতীয় নির্বাচনে পিআর পদ্ধতির কথা বলেনি। তারা শুধু উচ্চকক্ষের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতির কথা বলেছে। কাজেই এই আন্দোলনের পেছনে অন্য উদ্দেশ্য আছে।

তিনি বলেন, প্রশ্ন হলো—হঠাৎ করে কেন পিআর পদ্ধতি নিয়ে মাঠে নামছেন? আমরা যখন সবাই মিলে ঐকমত্য কমিশনে বসে এখনো কথা বলছি, এখনো যখন আলোচনা হচ্ছে, সেই আলোচনার টেবিল বাদ দিয়ে বাইরে আন্দোলনের নামে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা জনগণ কখনো মেনে নেবে না। এ ব্যাপারে আমাদেরকে সতর্ক ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।

বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরো বলেন, পিআর পদ্ধতি ইতোমধ্যে পঁচে গেছে। আপনি কাকে ভোট দেবেন, আপনি সেটাই জানেন না। আপনি ভোট দেবেন লক্ষ্মীপুরে শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিকে। কেন দেবেন, কারণ তাকে আপনি চেনেন। শুধু ধানের শীষ নিয়ে কথা না, ওই ব্যক্তিটাকেও আপনি চেনেন, তার ভালো-মন্দ জানেন, বিপদে-আপদে তার কাছে যাবেন, সে আপনার এমপি। আপনি বলতে পারবেন, লক্ষ্মীপুরের এমপিকে আপনি চেনেন। পিআর পদ্ধতিতে আপনি লক্ষ্মীপুর থেকে উনাকে না দিয়ে পঞ্চগড়ে ভোট দিয়ে দিতে পারে, আপনি জানবেন না। এই কথাগুলো উনারা বোঝেন না, এটা ঠিক নয়। আমি মনে করি, এরা জ্ঞানপাপী, বুঝেও না বোঝার ভান করছেন উনারা।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা পূর্ব বিএনপির আহ্বায়ক মাইন উদ্দিন চৌধুরী রিয়াজের সভাপতিত্বে সম্মেলনে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা আবুল খায়ের ভূঁইয়া। 

সদর উপজেলা পূর্ব বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শাহ মোহাম্মদ এমরান ও সদস্য সচিব মোখলেছুর রহমান হারুনের সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথি ছিলেন লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি ও কমলনগর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম আশরাফ উদ্দিন নিজান, বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক হারুনুর রশিদ, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সাহাব উদ্দিন সাবু, যুগ্ম আহ্বায়ক হাছিবুর রহমান ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সহ-সভাপতি ওয়াহিদ উদ্দিন চৌধুরী হ্যাপি প্রমুখ।

ঢাকা/লিটন/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • রাজনীতিতে নারীদের এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য
  • দেশকে বিপর্যয়ে ঠেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে: ইসমাইল জবিউল্লাহ
  • অর্থনীতিতে প্রাণ ফেরাতে চাই রাজনৈতিক সমঝোতা
  • কয়েকটি রাজনৈতিক দলের জেদ ও ভুলের কারণে নির্বাচন হুমকির মুখে পড়তে পারে: এবি পার্টি