৩ আগস্ট প্রথম আলোতে মুনির হাসানের তথ্যবহুল লেখা ‘এসএসসি পরীক্ষার প্রয়োজন কতটুকু আছে?’ মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসএসসি সনদের কার্যকারিতা কমেছে, এ বিষয়ে লেখকের যুক্তির সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো কারণ নেই; কিন্তু তিনি সবশেষে বলেছেন, ‘এসএসসি পরীক্ষাকে ইতিহাসে পাঠিয়ে আমরা একটি মানবিক, দক্ষ ও আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যেতে পারি। একটি আধুনিক শিক্ষাবান্ধব বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বার্থেই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে এসএসসি পরীক্ষা বাতিল করা হোক।’ এই বক্তব্যের সঙ্গে বিনীতভাবে ভিন্নমত পোষণ করছি।

পরীক্ষামাত্রই মানসিক চাপ থাকবে। পরীক্ষামাত্রই কিছু তথ্য মনে রাখার ঝামেলা থাকবে। পাস-ফেল থাকবে। এই চাপ এসএসসি পরীক্ষায় যেমন, তার আগে-পরে সব পরীক্ষায়ও তেমন। কাজেই শিক্ষার্থীদের ওপর মানসিক চাপের অজুহাতে কোনো পরীক্ষা বাতিলের দাবি করলে শুধু এসএসসি কেন, দুনিয়ার সব পরীক্ষা বাতিলের দাবি করতে হবে। সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার না করে যে পদ্ধতিতেই এই মূল্যায়ন করা হোক না কেন, পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। তাই প্রথমেই গণিত আর ইংরেজি বিষয়ের পাঠদানের ঘাটতি চিহ্নিত করে সংশোধনের ব্যবস্থা নিতে হবে। 

সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার না করে যে পদ্ধতিতেই এই মূল্যায়ন করা হোক না কেন, পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। তাই প্রথমেই গণিত আর ইংরেজি বিষয়ের পাঠদানের ঘাটতি চিহ্নিত করে সংশোধনের ব্যবস্থা নিতে হবে।

শোনা যায়, এবারের এসএসসি পরীক্ষা প্রকৃতপক্ষেই একটি ভালো পরীক্ষা হয়েছে। পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোতে অসদুপায় অবলম্বনকে যথাসম্ভব নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য পরীক্ষকদের ওপর কোনো অনৈতিক চাপ ছিল না। ফলে এবার এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার কমেছে। জিপিএ-৫ এর সংখ্যা কমেছে। প্রতি ১০ জনে ৩ জন ফেল করেছে। এদের একটি বড় অংশই ফেল করেছে গণিত ও ইংরেজিতে। এটি বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় দুর্বলতা। এসএসসি পরীক্ষা বাতিল করে দিলেই এই দুর্বলতা দূর হবে না। এসএসসি পরীক্ষা থাকুক বা না থাকুক, নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষা শেষে মূল্যায়নের একটি ব্যবস্থা তো থাকবে।

সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার না করে যে পদ্ধতিতেই এই মূল্যায়ন করা হোক না কেন, পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। তাই প্রথমেই গণিত আর ইংরেজি বিষয়ের পাঠদানের ঘাটতি চিহ্নিত করে সংশোধনের ব্যবস্থা নিতে হবে।

দেশের সব শিক্ষা বোর্ডে এসএসসি পরীক্ষায় ব্যাপক ফল বিপর্যয় হলেও একই সময়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন অনুষ্ঠিত সমমানের এসএসসি (ভোক) পরীক্ষায় কিন্তু ফল বিপর্যয় ঘটেনি। এ বছর ১ লাখ ১২ হাজার ১০০ জন পরীক্ষা দিয়ে ৮৫.

৬ শতাংশ পাস করেছে। ৯ হাজার ৫০০ জন জিপিএ ৫ পেয়েছে।খোঁজ নিয়ে দেখলাম, কারিগরি বোর্ডে উচ্চতর পাসের হারের পেছনে অন্যতম কারণ হলো ভিন্নতর পরীক্ষাপদ্ধতি। কারিগরি বোর্ডের সিলেবাস অন্যান্য শিক্ষা বোর্ডের সিলেবাসের মতো একই। তবে ওদের নবম ও দশম শ্রেণিতে আলাদা পরীক্ষা হওয়ায় প্রতি পরীক্ষায় সিলেবাস অর্ধেক হয়ে যায়।

উপরন্তু ধারাবাহিক মূল্যায়নে নম্বর ৪০ শতাংশ আর চূড়ান্ত পরীক্ষায় নম্বর ৬০ শতাংশ। ফলে চূড়ান্ত পরীক্ষার ওপর চাপ অনেকাংশে কম। মজার ব্যাপার হলো এসএসসি (ভোক) পরীক্ষা অন্যান্য শিক্ষা বোর্ডের অধীন অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষার সমমান হিসেবে পরিগণিত হয়। কাজেই নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ বছর সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোর এসএসসি পরীক্ষার্থীরা বৈষম্যের শিকার হয়েছে।

বিগত সরকারের আমলে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে। বিরক্ত বা ভীত হয়ে অনেকেই ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দিকে ঝুঁকেছে। ইংরেজি মাধ্যমে এসএসসি সমমানের পরীক্ষাটি হলো ‘ও লেভেল’। পরীক্ষাটি বছরে তিনবার—জানুয়ারি, মে ও নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। দুই বছর সময়ের ভেতরে মূল কয়েকটি বিষয়সহ কমপক্ষে ছয়টি বিষয় পাস করলেই ‘ও লেভেল’ পাস হয়ে যায়। তবে অনেকেই নিজ নিজ পছন্দ ও সুবিধামতো এক বা একাধিক সময়ে ৮ থেকে ১১-১২টি বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে থাকে।

এ ব্যবস্থার সুবিধা হলো, একবারে না দিয়ে একাধিক ধাপে পরীক্ষা দেওয়া যায়। কোনো একটি বিষয়ে পরীক্ষা খারাপ হলে চার মাস পরেই আবার পরীক্ষা দিয়ে গ্রেড পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে। চাইলে দুই বছরের আগেই ‘ও লেভেল’ শেষ করা যায়।

 ইংরেজি মাধ্যমে এইচএসসি সমমানের পরীক্ষাটি হলো এ লেভেল। ও লেভেল পরীক্ষার মতো এ লেভেল পরীক্ষাও বছরে তিনবার অনুষ্ঠিত হয়। দুই বছর সময়ের মধ্যে কমপক্ষে তিনটি বিষয় সম্পন্ন করলেই এ লেভেল পাস হয়ে যায়। তবে কেউ কেউ তিনটির বেশি বিষয়ও নিয়ে থাকে। এতে পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় বেশি অপশন খোলা থাকে। 

এইচএসসিতে প্রতিটি বিষয় দুটি মডিউলে ভাগ করা থাকে—প্রথম পত্র ও দ্বিতীয় পত্র এবং দ্বাদশ শ্রেণি শেষ করে দুই সিটিংয়ে দুটি মডিউলের পরীক্ষা দিতে হয়। অন্যদিকে ‘এ লেভেল’-এ প্রতিটি বিষয় ছয়টি মডিউলে ভাগ করা হয় এবং ছয় সিটিংয়ে ছয়টি মডিউলের পরীক্ষা দিতে হয়। শিক্ষার্থীরা সাধারণত একাদশ শ্রেণি শেষে যেকোনো বিষয়ের তিনটি মডিউল এবং দ্বাদশ শ্রেণি শেষে বাকি তিনটি মডিউলের পরীক্ষা দেয়। তবে কেউ চাইলে সব কটি মডিউল একসঙ্গে নিতেও বাধা নেই। কোনো মডিউলের পরীক্ষা খারাপ হলে চার মাসের মধ্যেই আবার পরীক্ষা দিয়ে গ্রেড ভালো করার সুযোগ আছে।

পরীক্ষার্থীদের মানসিক চাপে ফেলা আর ফেল করানো কোনো পরীক্ষার উদ্দেশ্য হতে পারে না। তাই শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ মতামতের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও লেভেল এবং এ লেভেল পরীক্ষাগুলো ডিজাইন করা হয়েছে। সিলেবাস অধিকসংখ্যক মডিউলে ভাগ করে এবং চার মাস পরপর পরীক্ষার ব্যবস্থা করে পরীক্ষার্থীদের ওপর চাপ কমিয়ে আনা হয়েছে। 

আমাদের এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষাপদ্ধতি সেকেলে। টানা দুই বছর পড়াশোনা করে ঢাউস সিলেবাস মুখস্থ করে পরীক্ষার হলে যেতে হয়। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের উচ্চতর পাসের হার থেকে বোঝা উচিত আমাদের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাপদ্ধতির আশু সংস্কার প্রয়োজন। যেই পদ্ধতিতে ৩০ শতাংশের ওপরে ফেল করে এবং সেই ফল শোধরানোর জন্য একটি বছর বসে থাকতে হয়, সেই পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। 

কাজেই এসএসসি পরীক্ষা বাতিল নয়, আমার প্রস্তাব হলো: ১. বোর্ডের পরীক্ষাগুলো বছরে দুবার নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে; ২. এসএসসি সিলেবাসকে নবম ও দশম শ্রেণি দুই ভাগে ভাগ করতে হবে এবং আলাদাভাবে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। ৩. ‘কোর বিষয়’ এবং ঐচ্ছিক বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে হবে; ৪. নবম ও দশম শ্রেণির ফলাফলের সমন্বয়ে এসএসসির ফলাফল নির্ধারিত হবে। ৫. ‘কোর বিষয়ে’ ফেল করলে ছয় মাস পর আবার পরীক্ষার সুযোগ দিতে হবে; ৬. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো কলেজেও সেমিস্টার-পদ্ধতি চালু করতে হবে এবং ছয় মাস পরপর ভর্তির সুযোগ দিতে হবে; ৭. এইচএসসির সিলেবাস চারটি মডিউলে ভাগ করতে হবে; ৮. ছয় মাস পরপর পরীক্ষার মাধ্যমে দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে চারটি মডিউল শেষ করার সুযোগ দিতে হবে। 

প্রস্তাবিত সংস্কার বাস্তবায়িত হলে আমাদের বোর্ডের পরীক্ষাগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ইংরেজি মাধ্যমের পরীক্ষাপদ্ধতির ভিন্নতা কমে আসবে। ছাত্রদের ওপর মুখস্থ করার চাপ অনেকাংশে কমবে। ছয় মাস পরপর পরীক্ষার সুযোগ থাকায় ফেল করার ভয় কেটে যাবে। 

ড. মাহবুবুর রাজ্জাক অধ্যাপক, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, বুয়েট। 

[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ ক ষ ব যবস থ র স ক শ ক ষ ব যবস থ র র পর ক ষ র চ হ ন ত কর র ব যবস থ দশম শ র ণ ছয় ম স পর ম স পরপর র এসএসস পর ক ষ প অন ষ ঠ ত পর ক ষ য় দ ই বছর দ র ওপর ফ ল কর ভ গ কর প রথম সমম ন

এছাড়াও পড়ুন:

এসএসসির পুনর্নিরীক্ষণের ফল প্রকাশ আজ, জানবেন যেভাবে

২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার উত্তরপত্র পুনর্নিরীক্ষণের ফল আজ রবিবার (১০ আগস্ট) প্রকাশ করা হবে।

আন্ত শিক্ষা বোর্ড পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার এ তথ্য জানিয়েছেন।

অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার জানান, ‍ফল প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যেই পুনর্নিরীক্ষণ শেষ করার নিয়ম রয়েছে। সেটা মেনেই আজ রবিবার পুনর্নিরীক্ষণের ফল প্রকাশ করা হবে।

আরো পড়ুন:

শাবিপ্রবিতে ‘অধিকার সচেতন’ শিক্ষার্থীদের সংবাদ সম্মেলন

দেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাখতে বাকৃবির অবদান অপরিসীম: উপাচার্য

শিক্ষার্থীরা যে মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে খাতা পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করেছিল সে নম্বরে এসএমএসে পরিবর্তিত ফল জানানো হবে। এ ছাড়া শিক্ষা বোর্ডগুলো নিজ নিজ ওয়েবসাইটেও খাতা পুনর্নিরীক্ষণের ফল প্রকাশ করবে।

ঢাকা বোর্ডের ৯২ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী খাতা পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করেছে বলেও জানান অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার।

এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল গত ১০ জুলাই প্রকাশ হয়। ফলে সন্তুষ্ট না হওয়া শিক্ষার্থীদের প্রতিবারের মতো এবারো খাতা চ্যালেঞ্জ বা ফল পুনর্নিরীক্ষার আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। খাতা পুনর্নিরীক্ষণের জন্য এসএমএসের মাধ্যমে ১১ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত আবেদন করেছেন পরীক্ষার্থীরা। আবেদনের পদ্ধতি শিক্ষা বোর্ডগুলোর ওয়েবসাইট ও টেলিটকের মাধ্যমে জানানো হয়।

এবারের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদরাসা ও কারিগরি বোর্ড মিলিয়ে মোট ৬ লাখ ৬৬০ শিক্ষার্থী ফেল করেছেন। এর মধ্যে ছাত্র ৩ লাখ ২৪ হাজার ৭১৬ জন এবং ছাত্রী ২ লাখ ৭৫ হাজার ৯৪৪ জন।

ঢাকা/হাসান/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আমাদেরকে স্বার্থক হতে হবে, আর স্বার্থক হতে গেলে কৃতজ্ঞ হতে হয় : অতি. জেলা প্রশাসক
  • একাদশে ভর্তিতে আবেদনের সময় বৃদ্ধি, পছন্দ সর্বনিম্ন ৫টি এবং সর্বোচ্চ ১০টি কলেজ
  • এসএসসিতে পুনর্নিরীক্ষণ ফলাফল: শিক্ষার্থীদের একাদশে ভর্তিতে আবেদন আজ সন্ধ্যা থেকে
  • কুমিল্লা বোর্ডে উত্তরপত্র পুনঃনিরীক্ষণে ৬৭ জনের জিপিএ-৫ অর্জন
  • এসএসসির পুনঃনিরীক্ষণের ফল প্রকাশ
  • সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়োগ, এইচএসসি থেকে স্নাতকোত্তরে আবেদন
  • এসএসসিতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৮৬ পরীক্ষার্থী, ফেল থেকে পাস ২৯৩
  • একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি: আবেদন শেষ কাল সোমবার
  • এসএসসির পুনর্নিরীক্ষণের ফল প্রকাশ আজ, জানবেন যেভাবে