এ মাসের শুরুতে লেবানন সরকার তার সেনাবাহিনীর জন্য যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত হিজবুল্লাহ নিরস্ত্রীকরণ পরিকল্পনা অনুমোদন দিয়েছে। শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দল—দুই পরিচয়ের হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্রীকরণের এই উদ্যোগকে কর্মকর্তারা বলছেন ‘ঐতিহাসিক বাঁকবদল’। লেবাননের সেনাবাহিনী এ বছর থেকেই এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করবে।

এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক। এটি সম্ভব হতো না, যদি সর্বশেষ যুদ্ধে ইসরায়েল হিজবুল্লাহর নেতৃত্বকাঠামো ধ্বংস না করত, আর যদি হিজবুল্লাহর দীর্ঘদিনের পৃষ্ঠপোষক ও ইরানের মিত্র সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের পতন না হতো। 

লেবাননের প্রেসিডেন্ট জোসেফ আউন ও প্রধানমন্ত্রী নওয়াফ সালাম ঘোষণা দিয়েছেন, হিজবুল্লাহর কঠোর বিরোধিতা সত্ত্বেও এ প্রকল্প থেকে আর ফিরে আসার কোনো পথ নেই। হিজবুল্লাহর নেতা নাইম কাসেম পরোক্ষভাবে সহিংসতার পথ বেছে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। নিরস্ত্রীকরণের পরিকল্পনাটি গ্রহণের সময় হিজবুল্লাহর প্রতি অনুগত মন্ত্রীরা মন্ত্রিসভা বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসেন। 

আরও পড়ুনলেবানন থেকে কেন পিছু হটল ইসরায়েল২৯ নভেম্বর ২০২৪

এখন লেবাননের জনপরিসরে সবচেয়ে বেশি আলোচিত প্রশ্ন হলো সেনাবাহিনী আসলেই কীভাবে হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করবে? সেনাবাহিনীর কি যথেষ্ট রাজনৈতিক সমর্থন ও সামরিক শক্তি আছে, যাতে গৃহযুদ্ধের ঝুঁকি ছাড়াই এই দায়িত্ব তারা পালন করতে পারবে?

 কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমি আমার সাম্প্রতিক লেবানন সফরে সেনাপ্রধান জেনারেল রদলফ হায়কালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি বিস্তারিতভাবে তাঁর সামরিক কৌশল ও বিভিন্ন উদ্বেগের কথা জানান। তাঁর পরিকল্পনা তিনটি প্রধান চিত্রকে মাথায় রেখে করা হয়েছে। প্রতিটির জন্য নির্দিষ্ট পথনকশা ও সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে।

 প্রথম চিত্রে ধরে নেওয়া হয়েছে, হিজবুল্লাহ কোনো সহযোগিতা করবে না, বরং সশস্ত্র প্রতিরোধ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ইসরায়েলও কোনো ছাড় দেবে না। তারা দক্ষিণ লেবাননের পাঁচটি পাহাড়ি এলাকা এখন দখল করে রেখেছে।

এ ছাড়া ইসরায়েল লেবানন ভূখণ্ডে একটি বাফার জোন বা নিরপেক্ষ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেটাকে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ‘বাধা প্রদানের কৌশল’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এই বাফার অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কারণ হচ্ছে ইসরায়েল তার উত্তরাঞ্চলে বসবাসকারী সম্প্রদায়গুলোকে হিজবুল্লাহর রকেট হামলা থেকে রক্ষা করতে চায়। 

বহু বছরের মার্কিন সামরিক সহায়তার কারণে সেনাবাহিনীর সক্ষমতা এখন অনেক বেড়েছে আর হিজবুল্লাহ এখন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু হিজবুল্লাহ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে চাইবে; তার বড় কারণ হলো, এ ধরনের সংঘাত লেবাননের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবে। এতে হিজবুল্লাহ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। 

লেবাননে প্রায় কেউই তৃতীয় চিত্রটা বাস্তবে সম্ভব বলে মনে করে না। কারণ, হিজবুল্লাহর কাছে অস্ত্রসমর্পণ করার মানে হচ্ছে রাজনৈতিক আত্মহত্যা। লেবাননের সবাই এখন প্রথম চিত্রটি নিয়েই উদ্বিগ্ন। সম্ভাব্য সংঘাত এড়াতে লেবাননের নেতারা ও জেনারেল হায়কাল সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। তবে হিজবুল্লাহর জন্যও লেবাননের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়াটা কম ক্ষতির কারণ হবে না।

দ্বিতীয় চিত্রটা মূলত বর্তমান বাস্তবতারই একটি ভিন্ন সংস্করণ। এ ক্ষেত্রে লেবাননের সেনাবাহিনী লিতানি নদীর দক্ষিণে অবস্থিত হিজবুল্লাহর সামরিক অবকাঠামো ধ্বংস করবে আর হিজবুল্লাহ সেটি দেখেও না দেখার ভান করবে। একই সঙ্গে ইসরায়েলি বাহিনী তাদের অবস্থান বজায় রাখবে। 

তৃতীয় চিত্রটা হলো হিজবুল্লাহ অস্ত্র পরিত্যাগ করে একটি সাধারণ রাজনৈতিক দলে পরিণত হবে, আর ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত পরিকল্পনায় সম্মতি জানিয়ে লেবাননের দখলকৃত এলাকা থেকে চলে যাবে। 

আরও পড়ুনইসরায়েলের আক্রমণ সামলে হিজবুল্লাহ যেভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে১৯ নভেম্বর ২০২৪

বহু বছরের মার্কিন সামরিক সহায়তার কারণে সেনাবাহিনীর সক্ষমতা এখন অনেক বেড়েছে আর হিজবুল্লাহ এখন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু হিজবুল্লাহ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে চাইবে; তার বড় কারণ হলো, এ ধরনের সংঘাত লেবাননের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবে। এতে হিজবুল্লাহ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।  

সব বিচারে দ্বিতীয় চিত্রটিই বেশি সম্ভাবনাময়। তবে এটি কার্যকর করতে হলে জেনারেল হায়কালের আরও বেশি সম্পদের প্রয়োজন পড়বে। এমনকি হিজবুল্লাহ পুরোপুরি সহযোগিতা করলেও এটি শেষ করতে ১২ থেকে ১৬ মাস সময় লাগতে পারে।

 সব রাজনৈতিক জটিলতা থাকা সত্ত্বেও লেবাননের সেনাবাহিনীর মূল দায়িত্ব হলো ধর্মীয়ভাবে বৈচিত্র্যের একটি দেশে স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা দেওয়া। যদি সেনাবাহিনী এই দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়, তবে নিরস্ত্রীকরণের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত অর্থহীন হয়ে যাবে।

বিলাল ওয়াই সাব চ্যাথাম হাউসের অ্যাসোসিয়েট ফেলো

টাইম ম্যাগাজিন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ল ব নন র স ন ব হ ন র জন ত ক ইসর য় ল মন ত র

এছাড়াও পড়ুন:

শীর্ষ ১০ বৈজ্ঞানিক ভুল

বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের অনেক ভুল আছে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ভুল করে বলেছিলেন, পরমাণু থেকে কোনো শক্তি পাওয়া যাবে এমন সামান্যতম ইঙ্গিত নেই। পারমাণবিক যুগ শুরুর আগে তিনি এ কথা বলেছিলেন। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের নানা প্রক্রিয়ার মধ্যে নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার হয়। যেকোনো গবেষকই আপনাকে বলবেন বিজ্ঞানের অগ্রগতি হয় চেষ্টা ও ত্রুটির মাধ্যমে। যেখানে বেশির ভাগ কাজেই ত্রুটির মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হয়। এক ধাপ এগিয়ে দুই ধাপ পিছিয়ে যাওয়াই যেন গবেষণার নীতিবাক্য। ত্রুটি ছাড়াও অনেক বড় বড় বৈজ্ঞানিক ভুল ইতিহাসে আলোচিত হয়। এসব ভুল কখনো কখনো অনিচ্ছাকৃত, আবার কখনো কখনো অনিচ্ছাকৃত নয় বলা যায়। বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী স্টিফেন জে গোল্ড যুক্তি দিয়েছেন, বিজ্ঞানীরা যেন নিজেরাই নিজেদের প্রতারিত করেন। কখনো কখনো ভুল অত্যন্ত সৌভাগ্যজনক হতে পারে। ভুলের কারণেই একটি উন্মুক্ত পেট্রি ডিশ থেকে পেনিসিলিন আবিষ্কার হয়েছিল। এমনই কয়েকটি বৈজ্ঞানিক ভুলের তথ্য জেনে নিন।

ব্রিটিশদের মস্তিষ্কের শক্তি পরীক্ষা

১৯৯০–এর দশকে যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গের ইনস্টিটিউট ফর অ্যানিমেল হেলথের বিজ্ঞানীরা গরু ও ভেড়ার প্রজাতি নিয়ে পরীক্ষা করেন। তাঁরা ২ লাখ পাউন্ড সরকারি অনুদান পান। পাঁচ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা ভুলবশত ভেড়ার মগজের পরিবর্তে গরুর মগজ পরীক্ষা করছেন বলে ২০০১ সালে ধরা পড়ে।

বৈজ্ঞানিক ওয়াটারগেট

ইউএস ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ তদন্ত প্যানেল দেখেন, রোগ প্রতিরোধবিষয়ক বিজ্ঞানী থেরিজা ইমানিশি-কারি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ডেভিড বাল্টিমোরের সঙ্গে ১৯৮৬ সালের একটি গবেষণাপত্রের তথ্য জাল করেছিলেন। সেই গবেষণাপত্রে রোগ প্রতিরোধব্যবস্থার জিনগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

ডায়েরি নিয়ে জালিয়াতি

অক্সব্রিজের ইতিহাসবিদ হিউ ট্রেভর-রোপার জার্মানভিত্তিক স্টার্ন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হিটলারের ডায়েরিকে খাঁটি বলে প্রমাণ করেছিলেন। পরে সেই ডায়েরি নকল বলে প্রমাণিত হয়।

পানি দিয়ে জ্বালানি সমস্যা

১৯৮৯ সালে ইউটা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নবিদ স্ট্যানলি পনস ও মার্টিন ফ্লিশম্যান কোল্ড ফিউশন আবিষ্কার করে বিশ্বের জ্বালানি সমস্যার সমাধান করার দাবি করেন। তবে সেই থেকে কেউই পানির পারমাণবিক ফিউশনের মাধ্যমে জ্বালানি তৈরি করতে পারেননি।

হাবল স্পেস টেলিস্কোপ

নাসার বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর ভিত্তিক লেন্সের চেয়ে ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি শক্তিশালী একটি লেন্স তৈরি করতে হাবল টেলিস্কোপ উৎক্ষেপণ করেন। ১৯৯০ সালের এপ্রিলে উৎক্ষেপণের পরপরই প্রধান আয়নাতে একটি গুরুতর নকশার ত্রুটি ধরা পড়ে। আয়নাটি মেরামতের জন্য নভোচারীর মাধ্যমে শত শত কোটি পাউন্ডের প্রয়োজন হয়।

এন-রে

বিজ্ঞানী রন্টজেন কর্তৃক এক্স-রে আবিষ্কারের কিছুদিন পর ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী রেনে ব্লন্ডলট এক নতুন ধরনের বিকিরণ আবিষ্কারের দাবি করেন। তবে মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট উড প্রকাশ করেন, এন-রে সামান্য বিভ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। উড এন-রে শনাক্তকরণ ডিভাইস থেকে প্রিজমটি সরিয়ে ফেলেন, যা ছাড়া যন্ত্রটি কাজ করতে পারত না। যদিও বিজ্ঞানী ব্লন্ডলটের সহকারীর দাবি ছিল তাঁরা এন-রে খুঁজে পেয়েছেন।

শিক্ষাগত মানদণ্ড নিয়ে বিতর্ক

১৯৬০-এর দশকে ব্রিটিশ মনোবিজ্ঞানী সিরিল বার্ট অভিন্ন যমজদের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করেন। যমজদের শিক্ষাগত মান হ্রাস পাচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি। বহু বছর পরে দেখা যায়, যমজদের মধ্যে এমন প্রভাব নেই।

পিল্টডাউন মানব

১৯১৩ সালে যুক্তরাজ্যে পিল্টডাউনের কাছে একটি স্থানে মানুষের দাঁতের মতো ক্ষয়প্রাপ্ত কুকুরের চোয়াল ও বানরের চোয়ালের অংশ পাওয়া যায়। ব্রিটিশ জীবাশ্ম বিজ্ঞানীরা খুলি ও চোয়ালকে বিবর্তন শৃঙ্খলে বানর ও মানুষের মধ্যেকার অনুপস্থিত সংযোগ বলে দাবি করেন। ১৯৫৩ সালে পিল্টডাউন মানবকে জালিয়াতি হিসাবে ঘোষণা করা হয়। মাথার খুলিটি ছিল আধুনিক ও বানরের চোয়ালের দাঁত ঘষে ক্ষয় করা হয়েছিল।

বিজ্ঞানী নিউটনের আলকেমি

স্যার আইজ্যাক নিউটনকে এককভাবে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি তৈরি করেন বলে কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তিনি আলকেমি নামের বিশেষ রহস্যময় রসায়নে বিশ্বাস করতেন। জীবনের বেশির ভাগ সময় ধরেই তিনি নিশ্চিত ছিলেন, সাধারণ ধাতুকে সোনায় রূপান্তর করা যাবে।

সমতল পৃথিবী

ক্রিস্টোফার কলম্বাস বহু বছর আগে পৃথিবী অভিযানের মাধ্যমে গোলাকার বলে প্রমাণ করেছিলেন। তারপরেও অনেকে বিশ্বাস করেন পৃথিবী সমতল। অনেকেই বিশ্বাস করেন, পৃথিবী আসলে প্যানকেকের মতো আকৃতির।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

সম্পর্কিত নিবন্ধ