ঐকমত্য না হলে দেশে টালমাটাল অবস্থা তৈরি হবে
Published: 7th, November 2025 GMT
জুলাই সনদের ধারণাটাই একটা অভিনব ধারণা। সেটাকে সংবিধানে সংযুক্ত করা, আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করা—এগুলো একটা দীর্ঘ কাজের ব্যাপার, যা এর আগে বাংলাদেশে কখনো করা হয়নি। ফলে এই কাজে মতভিন্নতা স্বাভাবিক। তবে নাগরিক হিসেবে আমরা আশা করব, রাজনৈতিক দলগুলো প্রজ্ঞার পরিচয় দেবে। যতটুকু ছাড় দিলে কোনো দলের বড় কোনো মৌলিক ক্ষতি হয় না, তার বিনিময়ে যদি একটা বৃহত্তর ঐক্য হয়; সেটা তারা বিবেচনা করবে বলে আমরা মনে করি।
আমাদের প্রত্যাশা, জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো প্রজ্ঞার পরিচয় দেবে, দল ও গোষ্ঠীর স্বার্থকে উপেক্ষা করে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কতগুলো ন্যূনতম জায়গায় শিথিলভাবে হলেও তারা একমত হবে। ঐকমত্য হলে হয়তো ১০০–এর বদলে ৮০ বা ৬০ মেনে নিতে হবে। যদি ঐকমত্য না হয়, এমন সম্ভাবনা আছে যে সবারই ১০০–ই হারাতে হবে। দেশ আরেকবার অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে, টালমাটাল অবস্থা তৈরি হবে।
আরও পড়ুনযেটা ৮ মাসে হয়নি, সেটা ৮ দিনের কম সময়ে কীভাবে হবে৮ মিনিট আগেগণভোট ও অধ্যাদেশ
গণভোট হয় আসলে নীতিনির্ধারণী বিষয়। ধরা যাক, আমরা জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চাই কি না, নির্বাচিত সরকার এসে সনদের বাস্তবায়ন কত দিনের মধ্যে করবে—এ রকম নীতিনির্ধারণী দু–চারটি প্রশ্ন হলে গণভোট ঠিক আছে। কিন্তু যদি জুলাই সনদের এই ধারা–ওই ধারা নিয়ে প্রশ্ন থাকে বা প্রশ্ন দু–চারটির বেশি হয়, তখন সেটা একটা দুরূহ ব্যাপার হবে। গণভোটের প্রশ্নপত্রের আদলে ব্যালট তা কে বা কারা তৈরি করবেন, বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয়ই ভেবেছেন।
এই মুহূর্তে অধ্যাদেশ জারি করে গণভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। একটা পক্ষ বলছে, সনদে প্রধান উপদেষ্টা স্বাক্ষর করবেন। কিন্তু বিদ্যমান আইনি বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী প্রধান উপদেষ্টা এটা পারবেন না। অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন কেবল রাষ্ট্রপতি।
কিন্তু বর্তমান রাষ্ট্রপতি স্বৈরাচারের নিয়োগ দেওয়া এবং তাদের ধারা বহন করা ব্যক্তি। আবার এ কথাও সত্য যে এই রাষ্ট্রপতির কাছেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদকে শপথ নিতে হয়েছে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর আমরা এমন কোনো বিপ্লবী সরকার গঠন করিনি, যারা এই সংবিধান রদ করেছে বা এই রাষ্ট্রপতিকে অস্বীকার করেছে।
এই রাষ্ট্রপতি যদি অধ্যাদেশ ঘোষণা করেন, জুলাইয়ে প্রাণ দেওয়া ও আত্মত্যাগকারী এবং তাঁদের পরিবার, স্বজন ও সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক পক্ষগুলোর জন্য এটা মেনে নেওয়া কঠিন। সব পক্ষের আলাপ–আলোচনার মধ্য দিয়ে এ বিষয়ে একটা পথ বের করতে হবে। এটা খুঁজে দেখা যেতে পারে, পৃথিবীতে কোথাও এমন কোনো দৃষ্টান্ত আছে কি না, যেখানে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতি ছাড়া অন্য কেউ অধ্যাদেশ জারি করেছেন। কিংবা এ–সংক্রান্ত এখতিয়ার রাষ্ট্রপতি কাউকে অর্পণ করতে পারেন কি না এবং তাঁর বদলে অন্য কেউ স্বাক্ষর করতে পারেন কি না।
তবে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির বিষয়টাকে জনগণের ক্ষমতার কাছে বিগত রেজিমের লিগ্যাসি বহনকারী রাষ্ট্রপতির মাথা নোয়ানো হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
দলগুলোর সহযোগিতা সরকারের লাগবে
নির্বাচন সুষ্ঠু করতে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য লাগবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় সহযোগিতা সরকারের লাগবে। অন্তত একটা কার্যকর আলাপ–আলোচনা সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর লাগবে।
মাঠে যে পুলিশ আছে, সেই পুলিশের ওপর এখনো জনগণের পুরোপুরি আস্থা নেই। পুলিশের মধ্যে বিগত রেজিমের অপচ্ছায়া আছে। সেই পুলিশ, সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীকে যখন মাঠে মোতায়েন করা হবে, ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার থাকবে কি না—এই প্রশ্নগুলো গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা যাতে নির্বাচনে অবাধে কাজ করতে পারেন, তা–ও নিশ্চিত করতে হবে।
একটা জাতীয় ঐকমত্য তৈরির ক্ষেত্রে যেন সরকার এখন থেকেই উদ্যোগী হয়—যাতে সব নাগরিক ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে উদ্দীপ্ত হন। জনগণ যদি ভাবেন যে ভোটকেন্দ্রে গেলে গোলাগুলি হবে, তাহলে তাঁরা কেন্দ্রে যাবেন না। জনগণের মনে আস্থা, সাহস ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সরকারকে কাজ করতে হবে। আমরা চাইব, সরকার সর্বতোভাবে একটা জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ষ ট রপত সরক র র দলগ ল র ঐকমত য গণভ ট সনদ র
এছাড়াও পড়ুন:
সরকারের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছে
জুলাই সনদ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত থাকা সত্ত্বেও মোটাদাগে যে ঐক্য সৃষ্টি হয়েছিল, সরকারের ভুল পদক্ষেপ এবং নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা সেই ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছে বলে দাবি করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। তারা বলছে, এর মধ্য দিয়ে চব্বিশের অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ও সংস্কারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়। সংবাদ সম্মেলনে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি হাসনাত কাইয়ূম, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তানিয়া রব, নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল্লাহ কায়সার, ভাসানী জনশক্তি পার্টির মহাসচিব আবু ইউসূফ সেলিমসহ গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বলেন, জুলাই সনদ এবং সনদের আইনি ভিত্তি হিসেবে গণভোটকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থার জন্য অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দায় রয়েছে। এ অচলাবস্থার মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টির দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দিয়ে সরকার দায়মুক্তির চেষ্টা করছে।
সরকারকেই অচলাবস্থা নিরসনের দায়িত্ব নিতে হবে উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বলেন, গণভোটের তারিখ নির্ধারণের দায়িত্ব সরকারের। অথচ তারা পরস্পরবিরোধী অবস্থানে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে এই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে সৃষ্ট সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। একই সঙ্গে নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতা থেকে সরে এসে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসন করে সরকারকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের নিয়মতান্ত্রিক পন্থা অনুসরণ করতে হবে।
যথাসময়ে নির্বাচন না হলে নিরাপত্তা-সংকটের মুখে পড়বে উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, নির্বাচন যাতে কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেই ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে মনে রাখতে হবে ঘোষিত সময়ে নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করা না গেলে দেশ ভয়াবহ নিরাপত্তাঝুঁকিতে পড়বে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, জুলাই সনদ প্রণয়নের ক্ষেত্রে ‘নোট অব ডিসেন্ট’গুলোকে যেভাবে লিপিবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই ঐকমত্য কমিশন সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে।
বক্তারা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরিত সনদ এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়ার মধ্যে নীতিগত পার্থক্য রয়েছে। এ বিষয়গুলো উদ্ভূত পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। যদিও ঐকমত্য কমিশন এবং সরকারের পক্ষ থেকে ইতিপূর্বে আশ্বস্ত করা হয়েছিল, যে তারা কোনো বিষয় চাপিয়ে দেবে না। অথচ জুলাই সনদ স্বাক্ষর-পরবর্তী সময়ে তারা সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছে। এটা একদিকে যেমন প্রতারণার শামিল, অন্যদিকে সরকারের স্বৈরাচারী মানসিকতার প্রকাশ।