১৯৪১ সাল। বিশ্বজুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালো ছায়া। ভারতে ব্রিটিশরা চাপের মুখে। একদিকে তাদের সবচেয়ে বৃহত্তম উপনিবেশ ভারত ছাড়ো আন্দোলন। অন্যদিকে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচের তেলখনিসমৃদ্ধ ব্রিটিশ উপনিবেশগুলো অক্ষশক্তির দুই বড় দেশ জার্মানি ও ইতালির কাছে হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা।

এই সময়ে ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে নতুন একটি ফ্রন্ট খুলতে গোপনে ভারতবর্ষের আলোচিত নেতা সুভাষচন্দ্র বসু ভারত ছাড়েন। শান্তিপূর্ণ সংগ্রামে আর কাজ হবে না, সশস্ত্র লড়াই করে ভারত থেকে ব্রিটিশদের তাড়াতে হবে—এই ছিল তাঁর ভাবনা। ভারত ছেড়ে প্রথমে তিনি যান জার্মানি।

১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সাল সময়কালে তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে জার্মানিতে ইতিবাচক–নেতিবাচক নানা মূল্যায়ন আছে। বিতর্কের বড় কারণ, তিনি নাৎসি নেতা হিটলারের সহায়তায় ভারতকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন এবং সে লক্ষ্যে ইতালির ফ্যাসিবাদী নেতা বেনিতো মুসোলিনি ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তোজোর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন।

যে জার্মানিতে সুভাষচন্দ্র বসু ‘নেতাজি’ নামে ভূষিত হয়েছিলেন এবং তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের গোড়াপত্তন হয়েছিল, সে দেশের গবেষক ও ইতিহাসবিদেরা তাঁর কী মূল্যায়ন করেছেন, একবার দেখা যাক।

‘ডের স্পিগেল’–এর স্মৃতিচারণা

জার্মানির স্বনামধন্য সাময়িকী ডের স্পিগেল পত্রিকাটি ৮০ বছর আগেকার সেই ঘটনা স্মরণ করেছে।

১৯৪৫ সালে ১৮ আগস্ট তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেতে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু এবং আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো অনুসন্ধান করে পাঁচ পৃষ্ঠার একটি নিবন্ধ লিখেছেন সাংবাদিক–গবেষক ইয়োসি বার্টেল। তিনি লিখেছেন, ‘জার্মানির মাটি থেকে সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন। তিনি নির্ভর করেছিলেন নাৎসি শাসকদের সমর্থনের ওপর। অথচ এখন জার্মানিতে সেই মানুষটিকে আর সেভাবে স্মরণ করা হয় না অথচ ভারতজুড়ে তিনি এখনো মানুষের হৃদয়ে আসন গেড়ে রয়েছেন।’

১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সাল সময়কালে তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে জার্মানিতে ইতিবাচক–নেতিবাচক নানা মূল্যায়ন আছে। ১৯৪৩ সালের ২৬ জানুয়ারি বার্লিনে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস উদ্‌যাপিত হয়। এর আয়োজন করা হয়েছিল ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ঘোষণার স্মরণে। বহু নাৎসি কর্মকর্তা এবং সহযোগী রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হাজির ছিলেন। প্রধান বক্তা সুভাষচন্দ্র বসু।

বার্লিন শহরের প্রায় কেন্দ্রে হাউস অব দ্য এভিয়েটরস, বর্তমানে ফেডারেল কাউন্সিল ভবন। ১৯৪৩ সালের ২৬ জানুয়ারি সেখানে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস উদ্‌যাপিত হয়। এর আয়োজন করা হয়েছিল ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ঘোষণার স্মরণে। বহু নাৎসি কর্মকর্তা এবং সহযোগী রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হাজির ছিলেন। প্রধান বক্তা সুভাষচন্দ্র বসু। সেখানে তিনি বলেন, ভারতীয়রা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র দাবি করায় ব্রিটিশরা ভারতজুড়ে সন্ত্রাসী শাসন কায়েম করেছে। তাঁর জার্মান ভাষায় দেওয়া বক্তৃতাটি রেডিওতে সম্প্রচারিত হয় এবং পরদিন জার্মানির বহু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। জানুয়ারির সেই সন্ধ্যাতেই বার্লিনে শেষবারের মতো তিনি প্রকাশ্যে উপস্থিত হয়েছিলেন।

ইয়োসি বার্টেল লিখেছেন, জার্মানি, ইতালি ও জাপান—এই তিন অক্ষশক্তির দৃষ্টিতে উপনিবেশিত বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। বার্লিনে আসার বছর কয়েক আগেও তিনি ছিলেন কংগ্রেসের সভাপতি এবং দলের সমাজতান্ত্রিক ধারার নেতৃত্বে। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তিনি বলপ্রয়োগসহ শর্তহীন স্বরাজের পক্ষে অবস্থান নেন। এতে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সঙ্গে তাঁর বিরোধের সৃষ্টি হয়। তিনি তাঁর সভাপতি পদের বিরোধিতা করেন। সুভাষ ঐক্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন, কিন্তু গান্ধী তাঁকে তাঁর নিজস্ব পরিষদ গঠন করার পরামর্শ দেন। এ ঘটনা সুভাষ ও জওহরলাল নেহরুর মধ্যেও বিচ্ছেদ ঘটায়। সুভাষ কংগ্রেস সভাপতির পদ ছাড়তে বাধ্য হন।

জার্মানির মাটি থেকে সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন। তিনি নির্ভর করেছিলেন নাৎসি শাসকদের সমর্থনের ওপর। অথচ এখন জার্মানিতে সেই মানুষটিকে আর সেভাবে স্মরণ করা হয় না অথচ ভারতজুড়ে তিনি এখনো মানুষের হৃদয়ে আসন গেড়ে রয়েছেন।জার্মান সাংবাদিক–গবেষক ইয়োসি বার্টেল

ডের স্পিগেল লিখেছে, ১৮৯৭ সালে জন্ম নেওয়া সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধীর নীতিকে বহুবার প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন। গান্ধীর বিপরীতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন।

১৯৪১ সালে ১৬ জানুয়ারি রাতে কলকাতার এলগিন রোডে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে পালিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে চলে যান। ভিন্ন নাম–পরিচয় ব্যবহার করে আড়াই মাস পরে মস্কো হয়ে ১৯৪১ সালের ২ এপ্রিল তিনি জার্মানির রাজধানী বার্লিনে এসে পৌঁছান। ব্রিটিশ শাসনে কুড়ি বছরের মধ্যেই ১১ বার জেল খেটেছিলেন। বুঝেছিলেন, সাধারণ পথে ব্রিটিশদের তাড়ানো সম্ভব নয়। বিকল্প পথ খুঁজতে শেষ পর্যন্ত তিনি থিতু হলেন বার্লিনে।

স্মারকলিপিতে প্রবাসী সরকার

বার্লিনে পৌঁছানোর পরদিন, ৩ এপ্রিল ১৯৪১ সুভাষচন্দ্র বসু দেখা করেন জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার-সেক্রেটারি অব স্টেট আর্নস্ট ভোরম্যানের সঙ্গে। ভোরম্যান সুভাষের পরিকল্পনা শুনে সব লিখে দিতে বলেন।

সপ্তাহখানেক পরে, ৯ এপ্রিল ১৯৪১, ভোরম্যানের সঙ্গে সুভাষের আবার সাক্ষাৎ হয়। এ সাক্ষাতে জার্মানির সঙ্গে সহযোগিতার কথা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসমেত সাত পৃষ্ঠার একটি সম্পূরক স্মারকলিপি সুভাষ বসু ভোরম্যানের হাতে তুলে দেন। সম্পূরক প্রস্তাবটির শিরোনাম ছিল ‘অক্ষশক্তি ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতার পরিকল্পনা’। পরিকল্পনাটির মধ্য দিয়ে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ সহজ হয়।

বার্লিনে পৌঁছানোর পরদিন, ৩ এপ্রিল ১৯৪১ সুভাষচন্দ্র বসু দেখা করেন জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার-সেক্রেটারি অব স্টেট আর্নস্ট ভোরম্যানের সঙ্গে। সপ্তাহখানেক পরে, ৯ এপ্রিল ১৯৪১, ভোরম্যানের সঙ্গে দ্বিতীয় সাক্ষাতে জার্মানির সঙ্গে সহযোগিতার কথা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসমেত সাত পৃষ্ঠার একটি সম্পূরক স্মারকলিপি সুভাষ বসু ভোরম্যানের হাতে তুলে দেন।

স্মারকলিপিটির শুরুতেই সুভাষ একটি প্রবাসী সরকার প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেন এবং নির্বাসিত ভারতীয় সরকারের প্রতি কূটনৈতিক স্বীকৃতির দাবি জানান। তিনি বলেন, জার্মানি ও তার মিত্ররা ভারতে ব্রিটিশদের পতন ঘটাতে প্রত্যক্ষ সহায়তা দিতে পারে। তার পরিকল্পনায় আফগানিস্তান ও ভারতের মধ্যবর্তী উপজাতীয় অঞ্চলে একটি সামরিক ঘাঁটি বানিয়ে ভারতে কার্যক্রম চালানোর প্রস্তাব ছিল। তিনি ভেবেছিলেন, এর মধ্য দিয়ে স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করা সম্ভব হবে। জার্মানির মাটিতে যুদ্ধে আত্মসমর্পণকারী ব্রিটিশ–ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে একটি ভারতীয় বাহিনী গড়ে তোলার বিষয়টি আরও পরে আসে।

জার্মানির সঙ্গে সহযোগিতা নিয়ে সুভাষ বসুর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ সম্পূরক স্মারকলিপির প্রথম পৃষ্ঠা.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ল র ২৬ জ ন য স ম রকল প কর ছ ল ন উপন ব শ সহয গ ত স মরণ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে জার্মান গবেষকদের ভাবনা

১৯৪১ সাল। বিশ্বজুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালো ছায়া। ভারতে ব্রিটিশরা চাপের মুখে। একদিকে তাদের সবচেয়ে বৃহত্তম উপনিবেশ ভারত ছাড়ো আন্দোলন। অন্যদিকে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচের তেলখনিসমৃদ্ধ ব্রিটিশ উপনিবেশগুলো অক্ষশক্তির দুই বড় দেশ জার্মানি ও ইতালির কাছে হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা।

এই সময়ে ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে নতুন একটি ফ্রন্ট খুলতে গোপনে ভারতবর্ষের আলোচিত নেতা সুভাষচন্দ্র বসু ভারত ছাড়েন। শান্তিপূর্ণ সংগ্রামে আর কাজ হবে না, সশস্ত্র লড়াই করে ভারত থেকে ব্রিটিশদের তাড়াতে হবে—এই ছিল তাঁর ভাবনা। ভারত ছেড়ে প্রথমে তিনি যান জার্মানি।

১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সাল সময়কালে তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে জার্মানিতে ইতিবাচক–নেতিবাচক নানা মূল্যায়ন আছে। বিতর্কের বড় কারণ, তিনি নাৎসি নেতা হিটলারের সহায়তায় ভারতকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন এবং সে লক্ষ্যে ইতালির ফ্যাসিবাদী নেতা বেনিতো মুসোলিনি ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তোজোর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন।

যে জার্মানিতে সুভাষচন্দ্র বসু ‘নেতাজি’ নামে ভূষিত হয়েছিলেন এবং তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের গোড়াপত্তন হয়েছিল, সে দেশের গবেষক ও ইতিহাসবিদেরা তাঁর কী মূল্যায়ন করেছেন, একবার দেখা যাক।

‘ডের স্পিগেল’–এর স্মৃতিচারণা

জার্মানির স্বনামধন্য সাময়িকী ডের স্পিগেল পত্রিকাটি ৮০ বছর আগেকার সেই ঘটনা স্মরণ করেছে।

১৯৪৫ সালে ১৮ আগস্ট তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেতে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু এবং আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো অনুসন্ধান করে পাঁচ পৃষ্ঠার একটি নিবন্ধ লিখেছেন সাংবাদিক–গবেষক ইয়োসি বার্টেল। তিনি লিখেছেন, ‘জার্মানির মাটি থেকে সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন। তিনি নির্ভর করেছিলেন নাৎসি শাসকদের সমর্থনের ওপর। অথচ এখন জার্মানিতে সেই মানুষটিকে আর সেভাবে স্মরণ করা হয় না অথচ ভারতজুড়ে তিনি এখনো মানুষের হৃদয়ে আসন গেড়ে রয়েছেন।’

১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সাল সময়কালে তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে জার্মানিতে ইতিবাচক–নেতিবাচক নানা মূল্যায়ন আছে। ১৯৪৩ সালের ২৬ জানুয়ারি বার্লিনে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস উদ্‌যাপিত হয়। এর আয়োজন করা হয়েছিল ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ঘোষণার স্মরণে। বহু নাৎসি কর্মকর্তা এবং সহযোগী রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হাজির ছিলেন। প্রধান বক্তা সুভাষচন্দ্র বসু।

বার্লিন শহরের প্রায় কেন্দ্রে হাউস অব দ্য এভিয়েটরস, বর্তমানে ফেডারেল কাউন্সিল ভবন। ১৯৪৩ সালের ২৬ জানুয়ারি সেখানে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস উদ্‌যাপিত হয়। এর আয়োজন করা হয়েছিল ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ঘোষণার স্মরণে। বহু নাৎসি কর্মকর্তা এবং সহযোগী রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হাজির ছিলেন। প্রধান বক্তা সুভাষচন্দ্র বসু। সেখানে তিনি বলেন, ভারতীয়রা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র দাবি করায় ব্রিটিশরা ভারতজুড়ে সন্ত্রাসী শাসন কায়েম করেছে। তাঁর জার্মান ভাষায় দেওয়া বক্তৃতাটি রেডিওতে সম্প্রচারিত হয় এবং পরদিন জার্মানির বহু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। জানুয়ারির সেই সন্ধ্যাতেই বার্লিনে শেষবারের মতো তিনি প্রকাশ্যে উপস্থিত হয়েছিলেন।

ইয়োসি বার্টেল লিখেছেন, জার্মানি, ইতালি ও জাপান—এই তিন অক্ষশক্তির দৃষ্টিতে উপনিবেশিত বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। বার্লিনে আসার বছর কয়েক আগেও তিনি ছিলেন কংগ্রেসের সভাপতি এবং দলের সমাজতান্ত্রিক ধারার নেতৃত্বে। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তিনি বলপ্রয়োগসহ শর্তহীন স্বরাজের পক্ষে অবস্থান নেন। এতে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সঙ্গে তাঁর বিরোধের সৃষ্টি হয়। তিনি তাঁর সভাপতি পদের বিরোধিতা করেন। সুভাষ ঐক্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন, কিন্তু গান্ধী তাঁকে তাঁর নিজস্ব পরিষদ গঠন করার পরামর্শ দেন। এ ঘটনা সুভাষ ও জওহরলাল নেহরুর মধ্যেও বিচ্ছেদ ঘটায়। সুভাষ কংগ্রেস সভাপতির পদ ছাড়তে বাধ্য হন।

জার্মানির মাটি থেকে সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন। তিনি নির্ভর করেছিলেন নাৎসি শাসকদের সমর্থনের ওপর। অথচ এখন জার্মানিতে সেই মানুষটিকে আর সেভাবে স্মরণ করা হয় না অথচ ভারতজুড়ে তিনি এখনো মানুষের হৃদয়ে আসন গেড়ে রয়েছেন।জার্মান সাংবাদিক–গবেষক ইয়োসি বার্টেল

ডের স্পিগেল লিখেছে, ১৮৯৭ সালে জন্ম নেওয়া সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধীর নীতিকে বহুবার প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন। গান্ধীর বিপরীতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন।

১৯৪১ সালে ১৬ জানুয়ারি রাতে কলকাতার এলগিন রোডে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে পালিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে চলে যান। ভিন্ন নাম–পরিচয় ব্যবহার করে আড়াই মাস পরে মস্কো হয়ে ১৯৪১ সালের ২ এপ্রিল তিনি জার্মানির রাজধানী বার্লিনে এসে পৌঁছান। ব্রিটিশ শাসনে কুড়ি বছরের মধ্যেই ১১ বার জেল খেটেছিলেন। বুঝেছিলেন, সাধারণ পথে ব্রিটিশদের তাড়ানো সম্ভব নয়। বিকল্প পথ খুঁজতে শেষ পর্যন্ত তিনি থিতু হলেন বার্লিনে।

স্মারকলিপিতে প্রবাসী সরকার

বার্লিনে পৌঁছানোর পরদিন, ৩ এপ্রিল ১৯৪১ সুভাষচন্দ্র বসু দেখা করেন জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার-সেক্রেটারি অব স্টেট আর্নস্ট ভোরম্যানের সঙ্গে। ভোরম্যান সুভাষের পরিকল্পনা শুনে সব লিখে দিতে বলেন।

সপ্তাহখানেক পরে, ৯ এপ্রিল ১৯৪১, ভোরম্যানের সঙ্গে সুভাষের আবার সাক্ষাৎ হয়। এ সাক্ষাতে জার্মানির সঙ্গে সহযোগিতার কথা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসমেত সাত পৃষ্ঠার একটি সম্পূরক স্মারকলিপি সুভাষ বসু ভোরম্যানের হাতে তুলে দেন। সম্পূরক প্রস্তাবটির শিরোনাম ছিল ‘অক্ষশক্তি ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতার পরিকল্পনা’। পরিকল্পনাটির মধ্য দিয়ে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ সহজ হয়।

বার্লিনে পৌঁছানোর পরদিন, ৩ এপ্রিল ১৯৪১ সুভাষচন্দ্র বসু দেখা করেন জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার-সেক্রেটারি অব স্টেট আর্নস্ট ভোরম্যানের সঙ্গে। সপ্তাহখানেক পরে, ৯ এপ্রিল ১৯৪১, ভোরম্যানের সঙ্গে দ্বিতীয় সাক্ষাতে জার্মানির সঙ্গে সহযোগিতার কথা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসমেত সাত পৃষ্ঠার একটি সম্পূরক স্মারকলিপি সুভাষ বসু ভোরম্যানের হাতে তুলে দেন।

স্মারকলিপিটির শুরুতেই সুভাষ একটি প্রবাসী সরকার প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেন এবং নির্বাসিত ভারতীয় সরকারের প্রতি কূটনৈতিক স্বীকৃতির দাবি জানান। তিনি বলেন, জার্মানি ও তার মিত্ররা ভারতে ব্রিটিশদের পতন ঘটাতে প্রত্যক্ষ সহায়তা দিতে পারে। তার পরিকল্পনায় আফগানিস্তান ও ভারতের মধ্যবর্তী উপজাতীয় অঞ্চলে একটি সামরিক ঘাঁটি বানিয়ে ভারতে কার্যক্রম চালানোর প্রস্তাব ছিল। তিনি ভেবেছিলেন, এর মধ্য দিয়ে স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করা সম্ভব হবে। জার্মানির মাটিতে যুদ্ধে আত্মসমর্পণকারী ব্রিটিশ–ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে একটি ভারতীয় বাহিনী গড়ে তোলার বিষয়টি আরও পরে আসে।

জার্মানির সঙ্গে সহযোগিতা নিয়ে সুভাষ বসুর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ সম্পূরক স্মারকলিপির প্রথম পৃষ্ঠা

সম্পর্কিত নিবন্ধ