Prothomalo:
2025-11-06@17:26:27 GMT

কায়রো যাচ্ছে ‘কাফফারা’

Published: 6th, November 2025 GMT

২০২২ সালের কথা। সেই সময় প্রথম সিনেমার শুটিং শুরু করেন তরুণ নির্মাতা তানভীর চৌধুরী। প্রথম লটে সাত দিন শুটিং করেন। পরে সম্পাদনাকক্ষে এসে দেখতে পারেন দৃশ্যগুলোর বেশ কিছু অংশ মনমতো হয়নি। বেশ কিছু জায়গায় কারিগরি সমস্যা রয়ে গেছে। শুরু হয় বিলম্ব। দীর্ঘ সময় নিয়ে দুই বছর পর পুনরায় শুটিং শেষ করেন। সেই ‘কাফফারা’ সিনেমাটি দিয়েই অবশেষে সুখবর এল। সিনেমাটি ৪৬তম কায়রো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রতিযোগিতা করবে।

‘কাফফারা’ সিনেমার দৃশ্যে সহশিল্পীর সঙ্গে ফারহানা হামিদ। ছবি: পরিচালকের সৌজন্যে.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

পুতুলের সংসার

আমি প্রথম যেদিন সেই বাসায় গেলাম, নাদুসনুদুস বিড়ালটাকে প্রায় মাড়িয়ে দিয়েছিলাম। সে আমার পদক্ষেপের কোনো তোয়াক্কা না করে হেলতে–দুলতে পায়ের নিচ থেকে বেরিয়ে গেল। মেঝেতে পা পড়ল কতগুলো টুকরো টুকরো শক্ত পদার্থের ওপর। ঘেন্নায়, বিরক্তিতে আমার প্রায় বমি চলে এল। ইতিমধ্যে আমি দেখলাম, ড্রয়িংরুমের সোফা থেকে বিড়ালটা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আমি চোখ রাঙিয়ে তার দৃষ্টিকে প্রতিহত করতে চাইলাম। পরক্ষণে চোখ পড়ল অর্ধেক ভেজানো দরজার দিকে। সেখান থেকে আধো আলো-আঁধারিতে বসে এক বয়স্ক মহিলা আমার দিকে কুতকুত করে তাকিয়ে আছেন।

আমি কৌশলে আমার অভিব্যক্তিকে ঘুরিয়ে আন্তরিক করে তার দিকে মাথা নাড়ালাম। কারণ, এজরা পাউন্ড বলেছেন কৌশল হলো আন্তরিকতার পরীক্ষাপত্র। ভদ্রমহিলার কুঞ্চিত ঝুলে পড়া মুখে কোনো অভিব্যক্তির ছায়া দেখা গেল না। বরং মনে হলো, তার চোখ দুটি পলকহীন সাপের চোখের মতো শীতল।

হঠাৎ মুঠোফোনটা বেজে ওঠায় কিছুটা চমকে গিয়ে ধাতস্থ হওয়ার সুযোগ পেলাম। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সেই ধোঁয়াটে আর খাদে নামা কণ্ঠ বলল, ‘গুড মর্নিং। আপনি এসেছেন?’

‘জি। আপনার মায়ের সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।’

‘আপনার কাজটা জরুরি হলে...’

‘ম্যাম, কাজটা আমার খুব জরুরি।’

‘আমি আপনাকে যে টাকা দিতে চেয়েছি...’

‘ম্যাম, অনেক বেশি বলেছেন। অর্ধেক হলেও হবে।’

‘আপনাকে আমি আরও বাড়িয়ে দেব।’

‘জি ম্যাম। আমার আর...’

‘আমি জানি, আপনি আপনার মাকে নিয়ে অনেক কষ্ট করে চলেন। তাকে স্বাচ্ছন্দ্যে রাখার পক্ষে এই অর্থ আশা করি যথেষ্ট।’

‘জি ম্যাম।’

‘আর... আর... আপনি কাজ করে যাবেন। কোনো প্রশ্ন করবেন না। এটা আমার অনুরোধ বা আপনার চাকরির রিকয়্যারমেন্ট বলতে পারেন।’

আমি দেখলাম, ড্রয়িংরুমের সোফা থেকে বিড়ালটা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আমি চোখ রাঙিয়ে তার দৃষ্টিকে প্রতিহত করতে চাইলাম। পরক্ষণে চোখ পড়ল অর্ধেক ভেজানো দরজার দিকে। সেখান থেকে আধো আলো-আঁধারিতে বসে এক বয়স্ক মহিলা আমার দিকে কুতকুত করে তাকিয়ে আছেন।

‘জি ম্যাম।’

‘আপনার কাজ...’

‘আমার কাজ আপনার মাকে...’

‘উঁহু, উঁহু...’

‘মাকে দেখে রাখা।’

‘হ্যাঁ। মা মা-ই হন। আমার হোক, আপনার হোক। ফলে...’

‘মা! জি, ম্যাম! মা।’

‘আপনি মায়ের রুমের দরজা এখন টেনে দেবেন। ওটা খুলবেন বিকেল চারটায়।’

‘আচ্ছা, ম্যাম।’

২.

আমি প্রথমেই বাসাটা গোছানোর অভিযানে নেমে গেলাম। যদিও এটা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু একটা জায়গায় থাকলে তার পরিবেশ ঠিক রাখার দায়িত্ব আপনা থেকেই অবস্থানরত ব্যক্তির ওপর বর্তায়। তার ওপর এত টাকা বেতন! কিন্তু গোছাতে গিয়ে দেখলাম, কাজ তেমন নেই। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল। আসলে যতটা অগোছালো মনে হচ্ছিল, এটা ততটা নয়। বিড়ালের খাবারে পুরো ফ্লোর ভরে আছে, তাই দেখে ভ্রম হয় বুঝি বাসাটা ময়লায়–ময়লায় ছেয়ে আছে। আসলে সারা বাসা সুন্দর করে গোছানো। কিচেনেও কোনো নোংরা পড়ে নেই।

গোছগাছ সেরে রান্না চাপিয়ে দিলাম। ফ্রিজে সব ঠেসে রাখা আছে। ভদ্রমহিলার পছন্দের খাবারের তালিকায় আছে পাবদা মাছের ভুনা আর টাকি মাছের ভর্তা। শেষে আমার জন্য গরুর মাংস বসিয়ে দিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে টিভিটা ছেড়ে দিলাম। আমার বসার সঙ্গে সঙ্গে বিড়ালটা সোফা থেকে নেমে দূরে গিয়ে বসল। আমি আর তার দিকে তাকালাম না। টিভি স্ক্রিনে চোখ রেখে একটু আয়েশি ভঙ্গিতে গা এলিয়ে দিতেই বেল বেজে উঠল।

অদ্ভুত এক মেয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে। চোখ ভাসা ভাসা আর কোঁকড়া চুল। ঠোঁটের কোণটায় তুলির সূক্ষ্ম একটা আঁচড়—সে জন্য মনে হয় মুখটা সব সময় হেসে আছে।

‘ধন্যবাদ।’

‘জি, ম্যাম।’

‘আমাকে ম্যাম বলবেন না। আমি এ বাসায় কাজ করি। কথা কটা বলে সে সোজা কিচেনে চলে গেল।’

আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। সে বাসার মালিক না? এমন মার্জিত পরিপাটি কেউ কাজের লোক হয় নাকি? তারপর মনে পড়ল মালকিনের অর্থের হাতের কথা। টাকায় বলে কথা—এমন একটা প্রবচন আছে। নিশ্চয়ই মোটা অঙ্ক পেয়েছে। নিজের যুক্তিতে তুষ্ট হয়ে আবার সোফায় গিয়ে বসলাম।

আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। সে বাসার মালিক না? এমন মার্জিত পরিপাটি কেউ কাজের লোক হয় নাকি? তারপর মনে পড়ল মালকিনের অর্থের হাতের কথা। টাকায় বলে কথা—এমন একটা প্রবচন আছে। নিশ্চয়ই মোটা অঙ্ক পেয়েছে। নিজের যুক্তিতে তুষ্ট হয়ে আবার সোফায় গিয়ে বসলাম।

আধা ঘণ্টা পর কিচেন থেকে বেরিয়ে এল সে। বলল, ‘আপনি এসব কাজ করছেন কেন?’

‘কেন? সমস্যা নাই তো! একই...’

‘আমার চাকরিটা খেতে চান, স্যার?’

‘না। আমি চাকরি খাওয়ার কেউ নই। আর আমি স্যারও না!’

‘আশা করি, স্যার, আমার চাকরিটা খাবেন না, প্লিজ। আমার কাজ আমাকে করতে দিন।’ বলে সে বেরিয়ে গেল।

আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। এ কেমন বাসা গো! কোথায় এলাম এটা?

পরক্ষণে আবার মনে পড়ল আমার বেতনের মোটা অঙ্কের টাকাটার কথা। আসলে মোটা অঙ্কটা আমার দরকার, তার চেয়ে বেশি দরকার টাকাটা। ফলে আশ্চর্য হওয়ার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এখানে এই আশ্চর্যকে পাত্তা না দেওয়া।

৩.

চারটা বাজে। আমি ধীরে ধীরে বৃদ্ধার দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। খোলার জন্য নবে হাত রাখলাম। তখনই সেলফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা রেখে এসেছি সোফায়। আবার পিছিয়ে গিয়ে ধরলাম।

‘সালামালাইকুম, ম্যাম।’

‘হুম, ওয়ালাইকুম। মায়ের রুমে গিয়েছেন?’

‘যাচ্ছিলাম তখন...’

‘আচ্ছা, আসাদ সাহেব, আপনি প্রচুর বই পড়েন?’

‘জি।’

‘আশা করি, আপনি বুদ্ধিমান হবেন।’

ভদ্রমহিলার কুয়াশাময় খাদে পড়া অদ্ভুত গলাটা নিশ্চুপ হয়ে থাকল কতক্ষণ, যেন আমার উত্তর চাচ্ছে। কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দেওয়া যায়! কিন্তু তার নীরবতা বাধ্য করে উত্তর দিতে, ‘জি, ম্যাম।’

‘আপনার টাকা দরকার, আমার দরকার মায়ের সঙ্গ। তা–ই তো?’

‘জি।’

‘আচ্ছা, আমি যদি বলি, একটা ঝাউগাছ আমার মা, আপনার তাতে আপত্তি আছে?’

‘জি? জি না, ম্যাম।’

‘আর যদি বলি, ঝাউগাছটাকে আপনার দেখতে হবে এবং তার বিনিময়ে আপনাকে আমি অর্থ দেব, আপনার আপত্তি আছে?’

আমি খুব দ্বিধায় পড়ে গেলাম। কিন্তু আমার জীর্ণশীর্ণ মায়ের মুখটা তখনই আমার চোখে ভেসে উঠল, ‘জি! জি, ম্যাম।’

‘আপত্তি আছে?’

‘না না! না, ম্যাম।’

‘ওকে, রাখি। আল্লাহ হাফেজ।’ ফোন কেটে গেল।

বৃদ্ধার রুমের দরজার নব ঘুরিয়ে দরজাটা খুলে দিলাম। ভেতর থেকে একটা ভারী হাওয়া বেরিয়ে গেল। যেন দীর্ঘ সময় শ্বাস রুদ্ধ হওয়া কেউ দম নিল, এভাবে রুমটায় মুড়মুড় করে বাইরের আলো-হাওয়া গিয়ে প্রবেশ করল। আধো আলো-আঁধারিতে কুঞ্চিত মুখের বৃদ্ধা সেই সকালের অবস্থানে এবং একইভাবে তাকিয়ে আছেন।

আমি আঁতকে উঠে চিৎকার করে উঠলাম, ‘আপনি কি মারা গেছেন?’

বিদ্যুৎগতিতে নাইনটি নাইন নম্বর তুলে ফোন দিয়ে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিলাম। রুমটা আলোকিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলার ফোনের কথা আর এখানকার দৃশ্য যেন জোড়া লেগে গেল। সেই সঙ্গে উন্মোচিত হলো রহস্যও। আমার সামনে চেয়ারে যে বসে আছে, সে কোনো মানুষ নয়, একটা পুতুল!

বৃদ্ধার রুমের দরজার নব ঘুরিয়ে দরজাটা খুলে দিলাম। ভেতর থেকে একটা ভারী হাওয়া বেরিয়ে গেল। যেন দীর্ঘ সময় শ্বাস রুদ্ধ হওয়া কেউ দম নিল, এভাবে রুমটায় মুড়মুড় করে বাইরের আলো-হাওয়া গিয়ে প্রবেশ করল। আধো আলো-আঁধারিতে কুঞ্চিত মুখের বৃদ্ধা সেই সকালের অবস্থানে এবং একইভাবে তাকিয়ে আছেন।৪.

এরপর শুরু হলো আমার পুতুলের সংসার।

বই, বিড়াল, পুতুল আর ফোনে আমার মায়ের সঙ্গে কথা...এ–ই করেই চলে যেতে লাগল দিন। সঙ্গে সুন্দরী কাজের মেয়ের হাতের মজার মজার রান্না। মাস গেলে অ্যাকাউন্টে বড় একটা অ্যামাউন্ট। বেশ চলে যাচ্ছিল।

এদিকে বিড়ালের সঙ্গেও খাতির জমে ক্ষীর। সেও আমাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। গা ঘেঁষে সারা দিন বসে থাকে। বিড়ালটার গায়ে আঙুল চালিয়ে দিয়ে আমি বই পড়ি। মনে হচ্ছে, এই আমিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সুখী মানুষ।

তখন সোফায় শুয়ে শুয়ে পড়ছিলাম। মায়ের ফোন এল।

‘মা, কেমন আছ?’

‘কী করো, বাবা?’

‘বই পড়ি।’

‘কাজ করো কখন তুমি? খালি বই পড়ি, বই পড়ি। কাজে ফাঁকি দিয়ো না কিন্তু! অন্যের টাকা হালাল করে নিয়ো, বাবা।’

‘মা, তুমি যে কী বলো! আমাকে তুমি চেনো না? আমার কাজই তো এটা। বৃদ্ধাকে বই পড়ে শোনানো। কী মনোযোগ দিয়ে সে শোনে, দেখলে তুমি আশ্চর্য হয়ে যাবে, হা হা হা...’

‘আচ্ছা বাবা, তোর ভদ্রতাবোধ কোথায় গেল? একজন বয়স্ক মানুষের সামনে, তাকে তুই বৃদ্ধা বলছিস, হাসছিস! তুই এমন হলি কবে রে?’

‘মা, শুধু শুধু তুমি ভুল বুঝছ আমাকে। আচ্ছা, সরি বলছি তাকে। আমার কথা শুনে সে হাসছে। তার সাথে আমার এমনই সম্পর্ক। সে এমনই চায়, এতেই তার খুশি। বুঝেছ, মা?’

‘তুই যে কী বলিস, আল্লাহ জানে। দে তো তারে, আমি কথা বলি।’

একটা গাড্ডায় পড়তে পড়তে আমি বেঁচে গেলাম। জিবের ডগায় কথাগুলো যেন সাজিয়ে দিল কেউ আর আমি গড়গড় করে বলে গেলাম, ‘মা, সে তো কথা বলতে পারে না। তার স্বামী মারা যাওয়ার পর সে এমন শক পায় যে বোবা হয়ে যায়। সে জন্যই তো এই চাকরি। তাকে সঙ্গ দেওয়া।’

‘হুম। আচ্ছা বাবা, তুই কবে আসবি? কত দিন তোকে দেখি না।’

‘সামনের সপ্তাহে বেতন পেয়ে, মা।’

‘আচ্ছা। ভদ্রমহিলাকে ভালোভাবে দেখিস। দেখেশুনে রাখিস। আহা রে! কেউ নেই। মেয়েটাও বিদেশে।’

‘আচ্ছা মা, তুমি নিজের খেয়াল রেখো। ডিম-দুধ প্রতিদিন খাচ্ছ? কুসুম...’

ইতিমধ্যে কলবেলটা বেজে উঠল। ‘আচ্ছা মা, রাখি।’

৫.

‘ধন্যবাদ।’

‘আপনাকেও ধন্যবাদ।’

‘আজ কী পড়ছেন?’

‘তলস্তয়ের কনফেশন। এই বই আমাকে পাগল করে দেবে, বুঝেছেন?’

‘কেন? কী খাবেন?’

‘গরম ভাত, বেগুনভর্তা আর আলুকুচি দিয়ে মাছের ডিমভাজি। আজ কিন্তু আপনি আমার সঙ্গে খাবেন।’

‘কনফেশন...’ সূত্রধরের মতো পারুল কড়াইয়ে চামচ নাড়াতে নাচাড়ে আমাকে পূর্বের কথার খেই ধরিয়ে দেয়।

‘অদ্ভুত বুঝলেন, বইটা। সারা জীবন শুনে এসেছি অনুসন্ধানের কথা। এই বইজুড়ে সেই অনুসন্ধান, এত অনুসন্ধান যে শেষমেশ সেই অনুসন্ধান অর্থহীনতায় পর্যবসিত। যেন অনুসন্ধানের কোনো দাম নেই, অনুসন্ধান আসলে আমাদের আরও অন্ধকার আর অর্থহীনতার কাছে নিয়ে যায়। সে তা এতটা প্র্যাকটিক্যাল করেছে যে চরম হতাশ হওয়া ছাড়া বইটা আপনাকে কিছুই দিতে পারবে না। আশ্চর্য বই!’

‘আচ্ছা, আপনাকে কি কেবল বই পাগল করে?’ পারুল জিজ্ঞেস করে।

‘হুম... না। আরও অনেক কিছু। এই যেমন ফুল, পাখি... পারুলও একটি ফুলের নাম, জানেন তো! হেমন্তে ফোটে। হেমন্তের রাজকন্যা বলতেন পারেন। কারণ, হেমন্তে এমনিতেই ফুল দুর্লভ, তখন পারুলের ঐশ্বর্য চোখকে শীতল করে দেয়।’

‘তা–ই বুঝি! রূপকথার সাত ভাই চম্পার বোনের নামও পারুল না? হা হা হা...’

‘বোন! আরে তা–ই তো!’

আমি কোনো কথা বলতে পারি না। আমার অন্তর কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মনে হয়, মহাকর্ষ শক্তি লোপ পেয়েছে। পা মাটি খুঁজে পাচ্ছে না। আমি ভাসছি শূন্যে। ভদ্রমহিলা তার খাদে নামানো কুয়াশাময় গলায় বলতে থাকেন, ‘এই ফ্ল্যাট তোমার নামে কেনা। আমি চাইব, তুমি আমাদের মাকে নিয়ে এখানে উঠে আসো।’ ৬.

দীর্ঘদিন পর আবার সেই ফোন।

‘সালামালাইকুম, ম্যাম।’

‘ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছ, ভাই?’

‘জি ম্যাম, ভালো।’

‘তুমি কি আমাকে আপু ডাকতে পারো না?’

‘জি না! জি, ম্যাম।’ থতমত খেয়ে যাই।

ভদ্রমহিলার কথাই এমন অদ্ভুত, তার কাজও যেমন অদ্ভুত, সে দেখতে না জানি কেমন অদ্ভুত!

‘আমার বাবা তাঁর স্ত্রী, মানে আমার মাকে খুব ভালোবাসতেন। খুউব। বাবা তার সন্তানদেরও খুব ভালোবাসতেন।’

‘জি, ম্যাম।’

‘আপু।’

‘জি, আপু।’

‘আমার একটা ছেলে ছিল। তিন বছর শেষ করে চারে পা দেবার আর এক দিন বাকি ছিল। তারা মানে বাবা, মা, আমার ছেলে আর হাজব্যান্ড আসছিল আমার কাছে, ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে। আমি কাজের সূত্রে দূরে থাকতাম। যদি আমার ছেলের কাছে থাকতাম, এটা হতো না। হ্যাঁ, হতো না। আমি দূরে ছিলাম আর তারা আমার কাছে আসছিল। গাড়িটা ড্রাইভ করছিল বাচ্চার বাবা। সে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। উদ্যমী একটা মানুষ। আমাকে খুব ভালোবাসত। খুউব। বুঝতে পারছ?’

‘জি, আপু।’

‘এক বছর হয়ে গেল... তোমার মুখের আপু ডাক আমাকে আনন্দ দিচ্ছে। আরেকবার ডাকবে?’

‘জি। আপু।’

‘ধন্যবাদ, ভাই। তিনি মানে আমার বাবা তাঁর সন্তানদের খুব ভালোবাসতেন। তোমাকেও। হ্যাঁ, তোমাকেও খুব ভালোবাসতেন। মাঝেমধ্যেই তোমার কথা বলতেন। তোমার ফেসবুক আইডি খুঁজে দিতে বলেছিলেন আমাকে। আমি সে জন্য দেশে এসে এক মাস থেকেছিলাম তোমাকে খুঁজে পেতে। তোমার বাড়িতেও গিয়েছিলাম। সব বলেছিলাম বাবাকে। তিনি খুব কষ্ট পেতেন তোমাদের জন্য। তোমার ছবি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে নিয়ে বসে থাকতেন, কথা বলতেন। তিনি বলেছিলেন, আমি যেন তাঁর ছেলের জন্য কিছু করি।’

‘কিন্তু...’

আমাকে কোনো কথার ফুরসত না দিয়ে ভদ্রমহিলা গড়গড় করে বলে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার কিছুই আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তাঁর বাবা আমাকে কেন খুঁজবেন?

‘তিনি বলছিলেন, হ্যাঁ, তিনি প্রবলভাবে চাইতেন, আমি যেন কিছু করি। আর তার জন্য তোমাকে সত্যটা আমার জানাতেই হতো। কিন্তু আমি এ–ও চাইনি যে তুমি আমার মাকে ঘৃণা করো, যখন সে গত। তাই পুতুলটাকে তোমাকে দিয়ে মা বলিয়ে নিয়েছি। আমি নিজেকে এটা বোঝাতে যে আমার মাকে তুমি ঘৃণা করো না। আমার মাকে তুমিও মা বলে ডাকো।’

আমি কোনো কথা বলতে পারি না। আমার অন্তর কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মনে হয়, মহাকর্ষ শক্তি লোপ পেয়েছে। পা মাটি খুঁজে পাচ্ছে না। আমি ভাসছি শূন্যে।

ভদ্রমহিলা তার খাদে নামানো কুয়াশাময় গলায় বলতে থাকেন, ‘এই ফ্ল্যাট তোমার নামে কেনা। আমি চাইব, তুমি আমাদের মাকে নিয়ে এখানে উঠে আসো।’

‘আপনার বাবা আমার মাকে কেন এত কষ্ট দিলেন? কেন?’ আমি চিৎকার করে ফোন রেখে দিলাম। আমার গলা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ল।

সম্পর্কিত নিবন্ধ