সাতসকালে ফোন পেয়ে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। দুটি কারণে। প্রথমত, লেট নাইট করে বাসায় এসে ঘুমিয়েছি সকাল সাড়ে ছয়টায়। যদিও লেট নাইট ডিউটি রাত ২টা পর্যন্ত; কিন্তু আমাকে বাসায় আসতে হয় সকালে, কারণ এত রাতে বাসার গেট খোলে না। তাই বাধ্য হয়ে অফিসে থেকে যেতে হয় এবং কাকডাকা ভোরে অফিস থেকে বাসায় ফিরতে হয়। চোখটা কেবল লেগেছে এর মধ্যেই ফোন। পরের কারণটা হলো ফোনটা যিনি করেছেন তিনি আমার দুলাভাই। প্রশ্ন আসতে পারে দুলাভাইয়ের ফোন পেয়ে মেজাজ খারাপ হওয়ার কী আছে? আছে। ব্যাপারটা বরং খুলেই বলি।
দুই মাস ধরে দুলাভাই আমার মাথা খাচ্ছেন ওনার একটা কাজ করে দেওয়ার জন্য। অফিসে ওনার একটা ঝামেলা হয়েছে। প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন নিতে গিয়ে শুনলেন তিনি নাকি আগেই ওই ফান্ড থেকে টাকা তুলেছেন। শুনে তিনি আকাশ থেকে পড়লেন। হেড অফিসে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে দেখলেন, ওনার সই জাল করে কেউ একজন এই অপকর্ম করেছে। অনেক দৌড়াদৌড়ি করেও যখন এর কোনো বিহিত করতে পারলেন না, তখন আমাকে রিকোয়েস্ট করতে থাকলেন আমি যেন ওনার সঙ্গে একবার হেড অফিসে যাই।
এটা শোনার পর থেকেই আমি বিভিন্ন অজুহাতে বিষয়টা অ্যাভয়েড করতে লাগলাম। একে তো আমি নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ, কোনো ঝামেলায় পড়তে চাই না। তার চেয়েও বড় কথা ওনার অফিসের সমস্যা সমাধানে আমি কী ভূমিকা রাখতে পারি? না আমি কোনো পলিটিক্যাল লিডার, না গুন্ডা-মাস্তান। তা ছাড়া আমার চেহারায় এমন কী মহিমা আছে যে ওনার সঙ্গে ওনার অফিসে গেলে আমাকে দেখলেই বাপ বাপ করে সব সমাধান করে দেবে! আমার মাথায় ঢোকে না।
তবে এই রহস্য আর রহস্য রইল না। সব পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল আমার বোনের ফোন পেয়ে।
— তোর দুলাভাইয়ের কাজটা করে দিচ্ছিস না কেন?
— আমার কী করার আছে? ওনার অফিসের সমস্যা আমি কী করে সমাধান করব? কী আশ্চর্য!
— তুই ওর সঙ্গে গেলেই হবে। লক্ষ্মী ভাই আমার। যা না একবার। খুব টেনশনে আছে।
— আমি গেলে কাজ হবে মানে কী। আমি কি বাঘ, না ভাল্লুক?
— তুই সাংবাদিক মানুষ, সঙ্গে গেলেই হবে।
ব্যাপার তাহলে এই। যেহেতু আমি সংবাদপত্রে চাকরি করি, সেহেতু আমি সাংবাদিক। বাহ! কী চমৎকার সমীকরণ। আমি আইটির লোক। তা–ও যদি হতো সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট কিংবা নেটওয়ার্ক–বিষয়ক কোনো সমস্যা, না হয় হেল্প করতে পারতাম। তাই বলে ব্যুরোক্রেটিক প্রবলেম?
ওদিকে সময়ে–অসময়ে দুলাভাইয়ের ফোন আসতে লাগল। অবস্থা এমন হলো যে ফোনের রিং বাজলেই আঁতকে উঠি। ঘুমের মধ্যে রিংটোন শুনি। এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম ফোন রিসিভ করব না। কিন্তু সেটাও খুব একটা কাজে দিল না। অন্য নম্বর থেকে ফোন করা শুরু করলেন। আমি চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম।
অবশেষে ঠিক করলাম আমার মেজ ভাইকে ফোন করে বিষয়টা খুলে বলব। আমি যে সাংবাদিক নই, আমাকে দিয়ে যে এই সমস্যার সমাধান হবে না এবং দুলাভাই যেন অন্য উপায় খুঁজে নেন, সেটা বুঝিয়ে বলব। এই বিপদ থেকে তা–ও অন্তত মুক্তি পাওয়া যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ।
কিন্তু মেজদা উল্টো আমাকে বকাঝকা করে যা বলল সেটা আরও হতাশাজনক। আমি একটা পোতানো মুড়ি (পড়ুন মিয়ানো মুড়ি) হয়ে গেলাম। উপায়ান্তর না দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম ওই অফিসে ফোন করব, যা আছে কপালে।
দুলাভাইয়ের কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে একদিন ফোন করলাম। পরিচয় দিয়ে খুব শান্ত নম্রভাবে জানতে চাইলাম সমস্যা কোথায়? এ–ও বললাম যে ব্যস্ততার জন্য আসতে পারছি না, দু–এক দিনের মধ্যে এসে দেখা করব। ফোনের ওই পাশে যিনি কথা বলছেন, তাঁর কথার সুর শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। আমার কানে বাজছে সেই কথা—
— ভাই আপনাকে কষ্ট করে আসতে হবে না। ফাইলটা যার কাছে ওনি এখন ছুটিতে আছেন, তাই এখন কিছু করতে পারছি না। তবে আপনাকে কথা দিচ্ছি কাজটা হয়ে যাবে।
— আমি কি পরে আবার খোঁজ নেব?
— ভাই লজ্জা দিয়েন না। আপনাকে ফোন করতে হবে না। আমি বলছি তো কাজটা হয়ে যাবে। টেনশন নিয়েন না।
কথা শুনে মনে হতেই পারে ফোনে কাজ হয়েছে। কিন্তু আমি জানি এরা কত বদ। হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। হয়তো এমনিতেই বিষয়টা সমাধান হতো; কিন্তু আজকের ফোনের পর আর তা–ও হবে না। না হলেই বরং আমার জন্য ভালো। যখন দেখবে আমাকে দিয়ে কাজ হয় না, তখন আর আমাকে বিরক্ত করবে না। আমি মনে মনে বরং একটু খুশিই হলাম।
এরপর অনেক দিন বিষয়টা নিয়ে আর কোনো কথা শুনিনি। আর কোনো ফোনও আসেনি। আমিও ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু আজকের সাতসকালের ওই ফোন কল মেজাজটা শুধু খারাপই করেনি, সহ্যের সব বাঁধ ভেঙে দিয়েছে। ফোনটা ধরলেই হয়তো বলবে ওনার সঙ্গে যাওয়ার জন্য, যেহেতু ফোনে কাজ হয়নি। আমি মনে মনে ঠিক করলাম এবার কিছু কঠিন কথা শুনিয়ে দেব, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো রিকোয়েস্ট নিয়ে আমাকে আর ফোন না করে। হোক না দুলাভাই, আই ডোন্ট কেয়ার।
অথচ ফোন ধরার পর দুলাভাই উল্টো আমাকে থ্যাংকস জানাল। তার প্রবলেম সলভ্ড। এই খবরে আমার হয়তো খুশি হওয়ার কথা, যেহেতু ঝামেলা চুকে গেছে; কিন্তু আমি খুশি হতে পারলাম না। কারণ, খাল কেটে আমি কুমির নয় অক্টোপাস নিয়ে এসেছি। এখন থেকে এ ধরনের আবদার আসতেই থাকবে এবং আমাকে নিয়ে পারিবারিক মণ্ডলে একটা মিথ চালু হয়ে যাবে। আমি আবারও পোতানো মুড়ি হয়ে গেলাম।
তবে পরে বিষয়টি নিয়ে ভেবেছি, ঠিক কোন জাদুবলে এত সহজে কাজটি হয়ে গেল। আসলে ফোনে আমি যখন আমার পরিচয় দিয়েছিলাম যে আমি প্রথম আলোতে কাজ করি, ঠিক তখনই ব্যাপারটা পাল্টে গেছে। প্রথম আলোই ছিল সেই জাদুর কাঠি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন য ফ ন কর ব ষয়ট সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
জয়পুরহাটে তিনটি হিমাগার থেকে গোপনে ৫০ হাজার বস্তা আলু বিক্রি
সংরক্ষণ করা আলু না পেয়ে কৃষকেরা সাথী হিমাগারের ব্যবস্থাপকের কক্ষে ভিড় করেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে