পাবনার রূপপুরে যে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, তা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সীমানার বাইরে হয়েছে জানিয়ে এ নিয়ে গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

গতকাল শুক্রবার রূপপুরে দেশের একমাত্র পারমাণিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে অগ্নিকাণ্ডের খবর প্রকাশের পর বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ আহ্বান জানানো হয়।

রাশিয়ার সহায়তায় প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হচ্ছে, সেখান থেকে আগামী বছর বিদ্যুৎ পাওয়ার আশা করা হচ্ছে।

আজ শুক্রবার প্রকল্প এলাকায় অগ্নিকাণ্ড নিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফোকাল পয়েন্ট সৈকত আহমেদের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে কেন্দ্রের সীমানার বাইরে পদ্মা ও ইছামতী নদীর পানিপ্রবাহ সচল রাখার জন্য তৈরি করা কৃত্রিম চ্যানেলের পাশে ডাম্পিং কাঠের বর্জ্য অপসারণকালে ছোট আকারের এক অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ৪০ মিনিটের মধ্যে সে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয় এবং বেলা ১টা ৫০ মিনিটে তা সম্পূর্ণ নিভিয়ে ফেলা হয়।

এই আগুনের কারণে প্রকল্পের কোনো ক্ষতি হয়নি জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আমরা সবাইকে এই বিষয়ে বিভ্রান্ত ও গুজবে কান না দেওয়ার অনুরোধ করছি।’

আরো পড়ুন: রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ পেতে আরও অপেক্ষা

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র পপ র

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই সনদ ও নোট অব ডিসেন্টের রাজনীতি

অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থার এক বছরের বেশি হয়ে গেল। এর মধ্যে আমরা অনেক কমিশন দেখলাম, দেখলাম তাদের নানা সুপারিশ। রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে অধরা ঐক্য গড়তে গঠিত হলো ঐকমত্য কমিশন। ঐকমত্য কমিশনও সরকারের কাছে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করল।

সংস্কারের কতটা বাস্তবায়িত হলো বা অধরা ঐক্য কতটা অর্জিত হলো, সে এক প্রশ্ন। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে তাকালে প্রত্যাশিত ঐক্য তৈরি না হলেও সামনে এগিয়ে যাওয়ার মতো একটি পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, সেটি বলা যায়। যদিও আমরা জানি, ভিন্নমত থাকবেই আর মতভিন্নতার মধ্য দিয়েই ঐক্য তৈরি হবে।

কিন্তু যদি ঐক্য গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া অপ্রত্যাশিতভাবে দীর্ঘ হয়, তাহলে সেটি জনগণের জন্য সুখকর নয়। বিশেষত বাংলাদেশ যখন জুলাই–পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র গঠনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যখন মানুষ ভাবতে শুরু করেছিল, এই দেশকে নতুন করে ঢেলে সাজাবে, তেমনই একটি বাস্তবতায় আমরা যদি আরও বিভাজিত হয়ে পড়ি, তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো জুলাই সনদ বাস্তবায়ন, গণভোট ও নির্বাচন নিয়ে আবারও রাজনৈতিক দলগুলোয় ও জনমনে একধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে, যার দ্রুত সমাধান বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য জরুরি। কেননা, বাংলাদেশ এখন এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক সেই সময়ে জুলাই সনদ আমাদের সুশাসন ও সংস্কারের স্বপ্ন যেমন দেখিয়েছে, তেমনি আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর আধুনিকায়ন ও কার্যকর হয়ে ওঠার একটি ব্লুপ্রিন্ট হিসেবে আমাদের সামনে আবির্ভূত হয়েছে।

আরও পড়ুনমৌলিক সংস্কারে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রাখলে জুলাই সনদ হবে মূল্যহীন০৩ নভেম্বর ২০২৫

জুলাই সনদকে আশা-আকাঙ্ক্ষার একটি দলিল হিসেবে দেখলেও এটি যে শুধু রাজনৈতিক দল কিংবা তার নেতৃত্বকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার একটি দলিলে পরিণত হয়েছে, সেটিও দেশের মানুষ বুঝতে পারছে বৈকি। এর সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তোলার প্রচেষ্টা।

এই আলাপ-আলোচনা যেমন রুদ্ধদ্বার বৈঠকের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে, সিদ্ধান্তগুলোও তেমনি রুদ্ধদ্বার প্রক্রিয়ায়ই হয়েছে, যেখানে জনগণের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ তো নেই, বরং তাদের সঙ্গে খুব একটা কনসালটেশন বা পরামর্শমূলক সভা করা হয়নি। অন্যদিকে সাংবিধানিক চর্চা সব সময়ই জনগণকে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে একটি সংসদীয় ব্যবস্থায় তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়ে পরোক্ষ হলেও নীতি ও অন্যান্য বিষয়ে অংশগ্রহণের একধরনের সুযোগ তৈরি করে দেয়, যা জুলাই সনদ তৈরির পেছনে দেখতে পাইনি।

বরং এই সনদ প্রণয়নে প্রথাগত এলিট গোষ্ঠীর কাছে খুবই জনপ্রিয় ‘ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া’ দৃষ্টিভঙ্গির বহুল ব্যবহার আমরা দেখতে পাই, যা একটি গণবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ার মধ্যে খেটে খাওয়া মানুষের অংশগ্রহণ থাকে না এবং তাদের অংশগ্রহণের কথা বিবেচনাও করা হয় না। বরং এর মধ্য দিয়ে শাসক ও শাসিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমাগত দূরত্ব সৃষ্টি হয়, যা আমাদের বর্তমান পটভূমিতে ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য শঙ্কার বিষয়।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দলাদলি, নেপোটিজম, পারিবারিক প্রাধান্য, রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত আমলাতন্ত্র ও প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্কের যে বহুল চর্চা, তেমন বাস্তবতায় রাজনৈতিক শুদ্ধাচার বা শিষ্টাচার কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে, সেটি এক বিরাট প্রশ্ন, যার উত্তর জুলাই সনদে নেই।

এটি জুলাই সনদের অন্যতম সীমাবদ্ধতা হলেও দেশের মানুষ জাতীয় স্বার্থে এ বিষয় নিয়ে তাদের শঙ্কা সেভাবে প্রকাশ করেনি বা একে একটি সংকট হিসেবেও দেখেনি। কারণ, দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিল যে এই পুরো প্রক্রিয়ার শেষে আমরা একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারব, যার মধ্য দিয়ে আমরা ধীরে ধীরে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ফিরে আসতে পারব।

আমরা যদি জুলাই সনদের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব এর বিষয়বস্তু আদর্শগত জায়গা থেকে খুবই চমৎকার এবং দেশের সুশাসনের জন্য তা তাত্ত্বিকভাবে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। কিন্তু এই বিষয়গুলো, যে ধরনের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বাস্তবায়নযোগ্য, সেটি বাংলাদেশের রয়েছে কি না, সেগুলো আমাদের বিবেচনায় নিয়ে আসতে হবে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দলাদলি, নেপোটিজম, পারিবারিক প্রাধান্য, রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত আমলাতন্ত্র ও প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্কের যে বহুল চর্চা, তেমন বাস্তবতায় রাজনৈতিক শুদ্ধাচার বা শিষ্টাচার কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে, সেটি এক বিরাট প্রশ্ন, যার উত্তর জুলাই সনদে নেই। এর সঙ্গে এটিও মাথায় রাখতে হবে, বিগত সময়ে যে শোষণমূলক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি, সেটি গড়ে উঠতে যেমন একটা লম্বা সময় লেগেছে, তা থেকে বের হয়ে আসার জন্যও একটি দীর্ঘমেয়াদি পথনকশা বা কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন।

আরও পড়ুনজুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলো কেন০২ নভেম্বর ২০২৫

জুলাই সনদকে তেমনই একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। এখানে রাতারাতি বদলের কোনো সুযোগ নেই। এখানে যেমন স্বল্পমেয়াদি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করার জন্য কিছু টার্গেট থাকবে এবং কিছু বিষয় থাকবে, যেগুলো আমরা সংসদীয় একটি ব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধিদের তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়ে অর্জন করব। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জনগণও অংশগ্রহণের মাধ্যমে তার অংশীদারত্ব অনুভব করবে।

তাই সংস্কার বিষয়ে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ আসতে পারে সেই বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে, যা জুলাই সনদে এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। বিএনপির ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা আপত্তির মধ্য দিয়ে তারা যে ভিন্নমতের জায়গাগুলো তৈরি করেছে, সেই ভিন্নমতের মীমাংসার প্রক্রিয়া হতে পারে পরবর্তী সংসদীয় ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে।

সেদিক বিবেচনায় রাজনৈতিক দলগুলো যতটুকু ঐকমত্যে পৌঁছেছে, আমরা যদি সেটিকে ইতিবাচক একটি সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে অন্তত এতটুকু দাবি করতে পারব যে আমরা বিচ্ছিন্নভাবে সব সিদ্ধান্ত এককভাবে নিইনি, বরং অনেক মৌলিক বিষয় জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সংসদীয় একটি ব্যবস্থায় নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। যে প্রক্রিয়া আরও বেশি অংশগ্রহণমূলক ও অংশীদারত্বের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে, যা জুলাই সনদের জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর বাস্তবায়নের সাফল্য নিয়ে আসবে এবং লম্বা সময় টিকে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করবে।

আরও পড়ুনজুলাই সনদ নিয়ে জট খুলুন, সময় কিন্তু চলে যাচ্ছে০১ নভেম্বর ২০২৫

এমনিতেই জুলাই সনদের বেশ কিছু ব্লাইন্ড স্পট রয়েছে, যেগুলোকে বিশেষজ্ঞরা তাঁদের বিশ্লেষণে নিয়ে এসেছেন। যেমন জুলাই সনদ কীভাবে আমাদের আর্থসামাজিক, শিক্ষা খাতসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে এবং সেসব খাতের উন্নয়নের রূপরেখাবিষয়ক কোনো দিকনির্দেশনা দেয়নি। যদিও কিছু কমিশন গঠিত হয়েছিল, কিন্তু সেই কমিশনের সুপারিশমালা জুলাই সনদে কতটা স্থান পেয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।

সেই অর্থে জুলাই সনদ শুধু কিছু রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বিষয় সামনে রেখে গঠিত হয়েছে। তবে যে বিষয়গুলো স্থান পায়নি, সেগুলোকে রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকারের মধ্য দিয়ে জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে মীমাংসা করার একটা সুযোগ রয়েছে, যাকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখতে পারি।

তাই আপত্তি থাকা মানেই স্রোতের বিপরীতে হাঁটা এবং রাজনৈতিক ঐক্য না চাওয়া নয়। আপত্তি না থাকা মানে একটি এলিট ব্যবস্থার একচ্ছত্র সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রবণতাকে নির্দেশ করে। সেদিক দিয়ে দেখলে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ কেবল বিএনপিকে নয়, বরং জনগণকে একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে, যা দেশের জনগণের জন্য শাসকগোষ্ঠীর সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করার সুযোগ তৈরি করে, পরবর্তীকালে যার মুখোমুখি বিএনপিও ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলও হতে পারে। তাই জনবান্ধব একটি ব্যবস্থা গড়ে উঠুক, যেখানে জনগণ তার বয়ানকে যেন রাজনৈতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে পারে এবং তা যেন প্রাধান্য পায়। জনগণকে উপেক্ষা ও শোষণমূলক ব্যবস্থায় বসবাসে বাধ্য করলে কী হতে পারে, সেটি আমরা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে দেখেছি।

বুলবুল সিদ্দিকী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ