যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগালের একই দিনে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। শতাধিক দেশ বহু আগে থেকেই ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়েছে; তবে এই পশ্চিমা শক্তিগুলোর পদক্ষেপ কেবল সংখ্যাত্মক নয়, বরং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাবের দিক থেকে অতুলনীয় গুরুত্ব বহন করে। দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং বৈশ্বিক কূটনীতির মঞ্চে প্রভাবশালী এই দেশগুলো যখন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়, তখন এটি কেবল কাগজে লেখা ঘোষণা নয়—এটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ধারণাকে নতুন প্রাণশক্তি দেয়। তাৎক্ষণিকভাবে প্রতীকী হলেও তা গভীর অর্থ বহন করে।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই স্বীকৃতি কি ফিলিস্তিনি মানুষের দৈনন্দিন যন্ত্রণার সীমারেখা অতিক্রম করতে পারবে? গাজার ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে থাকা মা, যিনি তাঁর সন্তান হারিয়েছেন অথবা পশ্চিম তীরে দখলদার সৈন্যদের হাতে প্রাণ হারানো কিশোর—তাদের জন্য এই ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রভাব আসলে কতটা? যখন মৃত্যুর মিছিল, ঘরবাড়ি ধ্বংস ও মানবিক সংকট অব্যাহত, তখন এই প্রতীকী পদক্ষেপ বাস্তব জীবনকে রক্ষা করতে পারছে না।

স্বীকৃতি প্রদানের ঘোষণার দিনেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সরকার ইসরায়েলি প্রেসিডেন্টকে লন্ডনে অভ্যর্থনা জানায় আর গাজায় নিরীহ জনপদে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতেও তাদের অস্ত্র (যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, গোলাবারুদ) ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে যদি ইসরায়েলকে অস্ত্র সহায়তা অব্যাহত রাখা হয়, তাহলে এ ধরনের স্বীকৃতি বাস্তবে আসলে কী ফল দেবে।

কূটনীতির মসৃণ ভাষণে মানবাধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রতিধ্বনি শোনা গেলেও বাস্তব নীতিতে প্রাধান্য পাচ্ছে কৌশলগত স্বার্থ, সামরিক ব্যবসা ও ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ। এই পরস্পরবিরোধী অবস্থান ফিলিস্তিনের স্বীকৃতিকে শুধু প্রতীকী পদক্ষেপে সীমাবদ্ধ করে।

গাজার মাটি আজও লাল রঙে রাঙানো। জাতিসংঘের সর্বশেষ তথ্যমতে, ৬৪ হাজারের অধিক ফিলিস্তিনি নিহত, লাখো মানুষ গৃহহীন, অবকাঠামো ধ্বংসস্তূপে পরিণত। হাসপাতাল ও চিকিৎসাব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত, খাদ্য ও পানির সরবরাহ ব্যাহত, শিশুরা অনাহারে মৃত্যুর মুখোমুখি। এই ভয়াবহ মানবিক বাস্তবতায় কেবল প্রতীকী স্বীকৃতি যথেষ্ট নয়। এখন জরুরি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ প্রয়োজন অবরোধ প্রত্যাহার, আগ্রাসন বন্ধ, পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ও দায়িত্বশীল অংশগ্রহণ। 

বিশ্বরাজনীতির জটিল হিসাব-নিকাশ, বাণিজ্য স্বার্থ এবং নানা বৈপরীত্য সত্ত্বেও চারটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের এই স্বীকৃতি রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের অস্তিত্বকে অস্বীকারের ইসরায়েলি প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বাস্তবতাকে পুনরায় জাগ্রত করে। এটি কেবল কূটনীতির মঞ্চে নয়, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মানচিত্রেও ফিলিস্তিনকে দৃঢ় অবস্থানে রাখে। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন এখনো জীবন্ত—এ বার্তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে স্পষ্ট।

কিন্তু এই স্বীকৃতির প্রকৃত মূল্য তখনই প্রতিফলিত হবে, যখন স্বীকৃতিদানকারী দেশগুলো বাস্তব পদক্ষেপে প্রবল ও কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করবে। গণহত্যা বন্ধ, দখলনীতি স্থায়ীভাবে ত্যাগ, গাজার অবকাঠামো পুনর্গঠন এবং মানবিক সহায়তায় সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়া এই স্বীকৃতি শূন্য প্রতীক হয়ে থাকবে। ফিলিস্তিনিদের অবিচ্ছেদ্য আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার শুধু ঘোষণায় নয়, বাস্তব সহায়তায় নিশ্চিত করতে হবে। 

যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগালের সাম্প্রতিক পদক্ষেপকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে এটি কেবল সূচনালগ্ন। এখন প্রয়োজন দৃঢ় আন্তর্জাতিক উদ্যোগ। প্রয়োজন দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথে দ্রুত অগ্রগতি, যাতে প্রতীকী স্বীকৃতি ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ না থেকে ফিলিস্তিনের রক্তাক্ত মাটিতে তার বাস্তব প্রতিফলন খুঁজে পায়। এই প্রতিফলনই হবে মানবিক ন্যায়ের জয়, যা কূটনীতির নীরবতার আবরণ ভেঙে দিয়ে স্বাধীনতার দীপ্তিকে চিরন্তন করে তুলবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এই স ব ক ত ক টন ত র র জন ত ক পদক ষ প ইসর য় ল ম নব ক

এছাড়াও পড়ুন:

সুদানের যুদ্ধ ও গণহত্যার পেছনে কারা

১৮ মাস ধরে সবার চোখের সামনে সবকিছু ঘটে যাচ্ছে। সুদানের দারফুর অঞ্চলের আল ফাশের শহর মিলিশিয়া বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ) অনেক দিন ঘেরাও করে রেখেছিল। গত সপ্তাহে শহরটিতে এই বাহিনী ঢুকে পড়ে এবং তারপর যা ঘটেছে, তাকে এককথায় বলা যায় মহাবিপর্যয়। 

সেখানে নির্বিচার গণহত্যা চলছে। একটি হাসপাতালেই প্রায় ৫০০ মানুষ হত্যা করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে রোগী ও তাদের পরিবারের লোকজনও আছে। যাঁরা পালাতে পেরেছেন তাঁরা জানিয়েছেন, সেখানে একেবারে সাধারণ নাগরিকদের বাছবিচার ছাড়াই হত্যা করা হয়েছে। 

আরএসএফ এত নৃশংসভাবে মানুষ হত্যা করছে যে কৃত্রিম উপগ্রহ থেকেও জমিতে জমে থাকা রক্ত দেখা গেছে। আল ফাশের পতনের পর প্রথম কয়েক ঘণ্টার গণহত্যার গতি ও তীব্রতাকে রুয়ান্ডার গণহত্যার প্রথম ২৪ ঘণ্টার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। 

আল ফাশের ছিল সুদানের সেনাবাহিনীর দারফুর শেষ শক্তিকেন্দ্র। আর গত সপ্তাহটি সুদান যুদ্ধে একটি গুরুতর পরিবর্তনের সময় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এখন এই যুদ্ধে সুদানের সশস্ত্র বাহিনী এসএএফ এবং মিলিশিয়া বাহিনী আরএসএফ দেশের নিয়ন্ত্রণের জন্য নিষ্ঠুর ও অবিরাম লড়াই চালাচ্ছে। 

সুদানের যুদ্ধকে অনেকে ‘ভুলে যাওয়া যুদ্ধ’ বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। এটি বিশ্বশক্তিগুলোর চুপ থাকা ও অবহেলার ফসল। কারণ, সুদানের ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া মানে হচ্ছে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির ভণ্ডামির মুখোমুখি হওয়া।

এই দুই পক্ষ আগে একসঙ্গে সরকারে অংশীদার ছিল। ২০১৯ সালে এক জনপ্রিয় বিপ্লবের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তারা বেসামরিক গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মিলিত হয়ে এক অস্বস্তিকর জোট সরকার গঠন করেছিল। কিন্তু পরে তারা প্রথমে বেসামরিকদের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেয় এবং এরপর একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। 

এই দুই গ্রুপে যে সংঘাত শুরু হয়, তা ছিল ভয়াবহ। এই সংঘাতেই স্পষ্ট হয়ে যায়, বশিরের গড়ে তোলা আরএসএফ বাহিনী (বশিরকে রক্ষা করা ও দারফুর তাঁর হয়ে লড়ার জন্য মূলত জানজাউইদ যোদ্ধাদের নিয়ে এই বাহিনী গঠিত হয়েছিল) গোপনে কতটা শক্তি ও সম্পদ সংগ্রহ করে ফেলেছিল। 

২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে যে যুদ্ধ শুরু হয়, সেটি কেবল সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনো ছোটখাটো বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সংঘর্ষ ছিল না। এটি ছিল দুই পূর্ণাঙ্গ সেনাবাহিনীর মধ্যকার যুদ্ধ। কারণ, উভয় পক্ষের হাতেই অস্ত্রভান্ডার, অর্থের উৎস, হাজার হাজার সেনা এবং বিদেশি জোগানদাতাদের সহায়তা—সবকিছু ছিল। 

আরও পড়ুনযে কারণে সুদানে আজ রক্তক্ষয়ী সংঘাত১৯ এপ্রিল ২০২৩

এর পর থেকে সেখানে কয়েক কোটি মানুষ ভিটেছাড়া হয়েছে এবং আনুমানিক দেড় লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। সেখানে এখন তিন কোটির বেশি মানুষের জরুরি মানবিক সহায়তার প্রয়োজন। কিন্তু এই ভয়াবহ সংখ্যাগুলোও সুদানের আসল দুর্দশার পুরোটা চিত্র দেয় না। 

দেশটা খুব দ্রুত ভেঙে পড়ছে। সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আর দারফুর আরএসএফ যে ভয়ংকরভাবে মানুষ হত্যা করেছে, তা এসব পরিসংখ্যানের বাইরের টাটকা নিষ্ঠুর বাস্তবতা। 

প্রকাশ্যে আসা এক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে স্থানীয় মানুষ মিলিশিয়াদের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইছেন। এক ব্যক্তিকে একজন কমান্ডার বলছিলেন, ‘কেউ বাঁচবে না।’ এরপর তাঁকে গুলি করা হয়। কমান্ডার বলছিলেন, ‘আমি তোমাদের প্রতি কোনো দয়া দেখাব না। আমাদের কাজ শুধুই হত্যা করা।’ 

সবকিছুই আগে থেকে অনুমান করা গিয়েছিল। কোনো কিছু একদমই অপ্রত্যাশিত ছিল না। মাসের পর মাস ধরে গণহত্যা ও নৃশংসতার আশঙ্কা নিয়ে আগাম সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছিল। প্রায় ১০ লাখ বাস্তুচ্যুত দারফুরবাসী (যাঁরা অন্য যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা থেকে পালিয়ে এসেছিলেন) আল ফাশের শহরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তবে যুদ্ধ বাড়তে থাকায় কেউ কেউ সেখান থেকে আবার পালিয়ে যান। অনেকেই শহরটিতে আটকা পড়ে যান।

আরও পড়ুনসুদানে আরএসএফের গণহত্যায় আরব আমিরাত ইন্ধন দিচ্ছে কেন০২ নভেম্বর ২০২৫

এই দৃশ্য শুধু ১৯৯৪ সালের রুয়ান্ডা গণহত্যার প্রথম দিকের দিনগুলোকেই মনে করিয়ে দেয় না; বরং ২০ বছর আগের দারফুরের সেই ভয়ংকর গণহত্যাকেও আবার জীবন্ত করে তোলে। তবে এবার তা ফিরে এসেছে আরও ভয়াবহ ও ঘনীভূত আকারে। 

আজকের আরএসএফ আসলে সেই পুরোনো জানজাওয়িদেরই নতুন রূপ। তবে এবার তারা আরও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত, শক্তিশালী বিদেশি মিত্রদের সমর্থনপুষ্ট এবং আবারও তারা অনারব জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার প্রবল ইচ্ছা নিয়ে এগোচ্ছে। এখন তারা উট বা ঘোড়ায় চড়ে আসে না। তারা আসে চার চাকার ‘টেকনিক্যাল’ গাড়িতে। সেই গাড়িতে মেশিনগান বসানো থাকে। তাদের সঙ্গে আরও থাকে ভয়ংকর শক্তিশালী ড্রোন। 

দারফুর ও আল ফাশের অঞ্চলে যে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চলছে, তার পেছনে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) বড় ভূমিকা রাখছে। ইউএই অনেক দিন ধরেই আরএসএফ-এর ঘনিষ্ঠ মিত্র। আরএসএফ মিলিশিয়াদের ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে ইউএই এর আগে ইয়েমেনের যুদ্ধে পাঠিয়েছিল। এখন তারা আরএসএফের হাতে প্রচুর টাকা ও অস্ত্র দিচ্ছে। এর ফলে সুদানের যুদ্ধ আরও ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়েছে। 

ভূরি ভূরি প্রমাণ থাকার পরও ইউএই এখনো দারফুরে নিজের ভূমিকা অস্বীকার করে যাচ্ছে। বিনিময়ে তারা সুদানের মতো বড়, কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশে নিজেদের প্রভাব বাড়িয়েছে। এ ছাড়া আরএসএফের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোর খনি থেকে তোলা সোনার বেশির ভাগ অংশও ইউএই পাচ্ছে। 

এদিকে আরও কিছু দেশ ও গোষ্ঠী এই সংঘাতে নিজেদের স্বার্থে জড়িয়েছে। ফলে যুদ্ধটি এখন একধরনের ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ বা পরোক্ষ শক্তির লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। এর ফল এক ভয়াবহ অচলাবস্থা, রক্তক্ষয় ও এমন এক পরিস্থিতি, যার ইতি টানা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে, অথচ সবকিছুই সবার চোখের সামনে ঘটছে। 

সুদানের যুদ্ধকে অনেকে ‘ভুলে যাওয়া যুদ্ধ’ বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। এটি বিশ্বশক্তিগুলোর চুপ থাকা ও অবহেলার ফসল। কারণ, সুদানের ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া মানে হচ্ছে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির ভণ্ডামির মুখোমুখি হওয়া। 

নাসরিন মালিক দ্য গার্ডিয়ান–এর কলাম লেখক। 

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুদানের যুদ্ধ ও গণহত্যার পেছনে কারা