রাষ্ট্র সংস্কারের সুযোগ গ্রহণ করুন
Published: 27th, January 2025 GMT
গণতন্ত্র, সুশাসন, বাকস্বাধীনতা, সাম্য এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। বিভিন্ন সংস্কারের জন্য যেসব কমিশন গঠন করা হয়েছে, সেসব কমিশনের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক। সেই প্রত্যাশা পূরণে আমার কিছু প্রস্তাবনা এখানে তুলে ধরা হলো।
আমাদের জনসংখ্যার মধ্যে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী ৬৮ শতাংশ। বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে যদি সততার সঙ্গে সঠিকভাবে পরিচালনা করা যায়, তবে এ দেশ সুন্দর, সুশঙ্খল হতে কোনো বাধা থাকবে না। এসব মানুষকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য মেকানিজম তৈরি করে দিতে হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থায় অনির্বাচিত ব্যক্তিরা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন বলে যে অভিযোগ আছে, সে সমস্যার সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নির্বাচন যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্দলীয়ভাবে হতো। সেই নির্দলীয় ব্যবস্থা পুনরায় ফিরিয়ে এনে বাংলাদেশের সব ইউনিয়ন ও সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচনের আয়োজন করা যেতে পারে। সারাদেশের সব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি এবং রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা যেতে পারে। পার্লামেন্ট সদস্যরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে এবং রাষ্ট্রপতি ও তাঁর উপদেষ্টা পরিষদ প্রান্তিক জনগণের প্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। অনির্বাচিত ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা এই বদনাম থেকে যাতে রক্ষা পায়।
রাষ্ট্রের জ্ঞানী, শিক্ষিত নির্দলীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ১০ বা ১৫ সদস্য রাষ্ট্রপতি ও উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হবে। পার্লামেন্ট সদস্যরা রাষ্ট্রপতি ও উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের জন্য ৩০ থেকে ৫০ সদস্যবিশিষ্ট ব্যক্তিদের তালিকা প্রস্তাব ও অনুমোদন করবেন, যাদের বাংলাদেশের যে কোনো রাজনৈতিক দল সহযোগী বা অঙ্গসংগঠনের কোনো পদে অধিষ্ঠিত থাকা অযোগ্যতা বলে বিবেচিত হবে। রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন মন্ত্রণালয়, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, অব্যাহতি, জনপ্রশাসনের একটি অংশ থাকবে। রাষ্ট্রপতি উপদেষ্টা পরিষদের সহায়তায় পরিচালনা করবেন।
সব মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও অধিদপ্তরের শীর্ষ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এবং রাষ্ট্রপতি দপ্তর আলোচনা করে সমঝোতার মাধ্যমে নিয়োগ দেবেন। রাষ্ট্রপতি এবং উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা মাত্র একবারের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ বছর নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন।
বাংলাদেশের নিবন্ধিত কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যদের ইউনিয়ন পরিষদ, ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শোভনীয় নয়। তবে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের কোনো সদস্য দলের প্রাথমিক সদস্য থেকে পদত্যাগ করার পর পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হলে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বা ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য কমপক্ষে ব্যাচেলর ডিগ্রিধারী হতে হবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের কাজের এলাকা, ক্ষমতা, দক্ষতা বাড়ানোর নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশের আনুমানিক ১ কোটি ২০ লাখ নাগরিক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাস করে। তারা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থা করছেন অথচ দেশের জাতীয় নির্বাচনে তারা ভোট দিতে পারেন না। বিদেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশিদের জন্য পোস্টাল ভোটের ব্যবস্থা করা উচিত।
যারা বিসিএস বা অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজে যোগদান করেন, সবাই নিজের সর্বোচ্চটা রাষ্ট্র বা জনগণকে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সংকীর্ণ বা দলীয় রাজনীতির অভিশাপে অনেকে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। বেশির ভাগ স্বপ্ন ভঙ্গ হয় দলীয় নিকৃষ্ট রাজনৈতিক কালচারের কারণে। কীভাবে প্রতিভা নষ্ট হয়ে যায়, তার একটি অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা।
জাতীয় সরকার অর্থাৎ ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিত নিরপেক্ষ নির্বাচনে যে দল যত আসন পাক না কেন, সবাই মিলে একটি জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে। অন্যটি হচ্ছে, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে সংসদে উচ্চকক্ষ গঠন করা। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একনায়ক স্বৈরাচারের পতন এবং পলায়নের পর আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্বে এবং তাদের দোসরদের বিচার এবং শাস্তি অবশ্যই হতে হবে। বিচারের ক্ষেত্রে ন্যায় ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ে বিচারের কাজ শেষ করতে হবে।
যে কোনো যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সঠিক বা উপযুক্ত পরিবেশ এবং সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপামর ছাত্র-জনতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের ফলে একনায়ক স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের পর বর্তমানে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান সংস্কারের যুগান্তকারী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। দলীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং নির্দলীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি– যারা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে অথবা প্রান্তিক জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত– উভয়ের সমন্বয়ে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা বাংলাদেশের বর্তমান সমস্যা সমাধানে, সব প্রতিষ্ঠান পুনরায় নির্মাণসহ নতুন বৈষম্যহীন বাংলাদেশ তৈরিতে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী বলে আমি মনে করি। অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে বাংলাদেশ পরিচালনার অপবাদ থেকে দেশ রক্ষা পাবে। বিচার ব্যবস্থায় এবং বিচারকের বিভাজন-দলাদলি থেকে রক্ষা করে তাদের প্রকৃত কাজে যত্নবান হওয়ার সুযোগ তৈরি করবে।
মো.
নঈম তাহের: গবেষক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র ষ ট রপত র ব যবস থ ন র দল য উপদ ষ ট র জন য সদস য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদের বাস্তবায়নে দেরি হলে জনগণ আবারও রাস্তায় নামবে: জামায়াত নেতা রফিকুল
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এখন দেশের ১৮ কোটি মানুষের দাবি বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘এই সনদ নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জারি করা হোক এবং প্রয়োজনে গণভোটের আয়োজন করা হোক। তবে এই গণভোট অবশ্যই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই হতে হবে, নির্বাচনের পরে নয়।’
আজ বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে তৃতীয় ধাপে তৃতীয় দিনের আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন রফিকুল ইসলাম খান। এ সময় উপস্থিত ছিলে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ।
জুলাই সনদের বাস্তবায়নে দেরি হলে জনগণ স্বাভাবিকভাবেই আবারও রাস্তায় নেমে আসবে বলে মন্তব্য করেন রফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর সে সময়কার দলগুলোর ঐকমত্য থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতায় থাকা দলগুলো সেটি (তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা) যথাসময়ে বাস্তবায়ন করেনি। পরে আন্দোলনের মাধ্যমেই তা সংবিধানে যুক্ত হয়।
জামায়াতের এই নেতা আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়েছিল বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের মাধ্যমে। আদালতের ওপর প্রভাব বিস্তার করে এ রায় দেওয়ানো হয়েছিল। তাই বিচার বিভাগকে আবার বিতর্কের মুখে না ফেলে সংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে জামায়াত।
জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ঐকমত্য কমিশন একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে চারটি বিকল্প নিয়ে কাজ করেছে, যার মধ্যে কমিশন সংবিধানিক আদেশের প্রস্তাবটি সমর্থন করেছে। এই আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদের ২২টি আর্টিকেল বাস্তবায়িত হতে পারে। এটি আইনিভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী ভিত্তি।
এক প্রশ্নের জবাবে হামিদুর রহমান বলেন, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করার এখতিয়ার সংসদের নেই, এবং এ ধরনের পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই গণভোটের প্রয়োজন হয়।
জামায়াতে ইসলামী জনগণের অভিপ্রায়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় উল্লেখ করে জামায়াতের এ সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষাই হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আইন।
জুলাই সনদের যে আদর্শ ও চেতনা, তা বাস্তবায়ন হওয়া উচিত এবং যারা এই আদর্শের পথে হাঁটবে না, জনগণ তাদের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে বলে মনে করেন হামিদুর রহমান আযাদ। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ এটি প্রমাণ করে যে এ দেশের তরুণসমাজ ও জনগণ নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা চায় এবং জুলাই বিপ্লবের যোদ্ধাদের পক্ষেই রয়েছে।