সরকার যদি বিবৃতি দিয়েই যায়, কাজটা করবে কে
Published: 15th, February 2025 GMT
এবার মৌসুমের শুরুতেই বোরোর আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষকেরা। বোরোর ফলন নির্ভর করে সেচের ওপর, এবারে তাঁরা সেচটা ঠিকমতো দিতে পারবেন কি না, তা নিয়েই এই দুশ্চিন্তা।
তিন মাস আগে অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের কাছে গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা মেটানোর আগাম প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা কিছু স্বল্পমেয়াদি, কিছু মধ্যমেয়াদি ও কিছু দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিয়ে জ্বালানি পরিস্থিতি উন্নতি করার চেষ্টা করছি। আমরা আশা করি, গ্রীষ্ম মৌসুমে, সেচের মৌসুমে বড় ধরনের ঘাটতি হবে না।’
গত সপ্তাহে বণিক বার্তার প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়া এলএনজির আমদানি বাড়িয়ে এবারের গরমের মৌসুমে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। এরপরও উপদেষ্টা মনে করছেন, দৈনিক ৭০০ থেকে ১৪০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করা লাগতে পারে।
ধরে নিই, বোরোয় সেচের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহে সরকার অগ্রাধিকার দেবে। কিন্তু তারপরও কেন সেচ নিয়ে কৃষকের এমন দুশ্চিন্তা?
এ প্রশ্নের একটা উত্তর মিলবে ৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত লেখক ও গবেষক গওহার নঈম ওয়ারার ‘আমনে পাস হয়নি, বোরোতেও কি ফেল হবে’ শিরোনামের লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘সিংহভাগ সেচব্যবস্থা চলে সমবায় উদ্যোগে নানা কিছিমের সমিতির মাধ্যমে। এগুলো সংগঠিত করতে, চালাতে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী স্থানীয় নেতৃত্বের আশীর্বাদ লাগে। অধিকাংশ আশীর্বাদদাতার হালহকিকত আগের মতো নেই। ইতিমধ্যেই “এবার আমরা খাব” গোষ্ঠী বেরিয়ে পড়েছে যার যার ক্ষমতা অনুযায়ী।’
এই যে ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক গোষ্ঠী ছাড়া কৃষক যে সেচ পান না, তার মানে হচ্ছে, রাষ্ট্র বলি, আর সরকার বলি, বাংলাদেশের বিরাট অংশজুড়ে তার অস্তিত্ব প্রায় খুঁজে পাওয়া যায় না। নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্র কিংবা সরকারের সম্পর্ক এখানে সরাসরি নয়। মাঝখানে কায়েমি রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে ধরেই তাদের রাষ্ট্রের কাছে পৌঁছাতে হয়।
দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ ও রাজনীতিবিষয়ক গবেষক আরাইল্ড এঙ্গেলসন রুড বাংলাদেশের সমাজের এই ধরনকে বলেছেন নেটওয়ার্ক সমাজ। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলছেন, ‘বাংলাদেশে রাষ্ট্র দুর্বল। প্রশাসনিক যন্ত্র হিসেবেও রাষ্ট্র দুর্বল। দেশের বড় অংশে কার্যত রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্ব নেই। গ্রামীণ পর্যায়ে আপনি এমন কাউকে ভোট দেন, যিনি প্রয়োজনে আপনাকে রক্ষা করবেন। এমন কাউকে, যিনি শক্তিশালী, যাঁর সংযোগ আছে, যিনি হস্তক্ষেপ করতে পারেন। আপনার যদি পুলিশ, প্রতিবেশী বা প্রশাসনের সঙ্গে সমস্যা হয়, আপনি স্থানীয় নেতার কাছে যাবেন। সেই নেতা যেতে পারেন একজন মধ্যপর্যায়ের নেতার কাছে। সেই নেতা আবার যেতে পারেন এমপির কাছে। তারপর আপনি আপনার সমস্যা সমাধান করতে পারেন’ (বাংলাদেশে একটি নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা খুব কঠিন হবে, প্রথম আলো, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪)।
বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির এই সরল সমীকরণ পাঠ করা না গেলে যেকোনো পরিবর্তনের আলোচনাই অর্থহীন হয়ে পড়ে। কার্ল মার্ক্স ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ভারতবর্ষের সমাজের স্থবিরতার পেছনে এখানকার স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামভিত্তিক সমাজকে দায়ী করেছিলেন। একেকটা গ্রামই একেকটা বিচ্ছিন্ন দেশ। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল রাজধানীতে। প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের এই যে বিচ্ছিন্নতা কিংবা ব্যবধান, সেখান থেকে আমরা কতটা বেরিয়ে আসতে পেরেছি।
বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ এমন একটা দেশ হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে সারা দেশ থেকে সম্পদ এনে ঢাকাকে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। ফলে চিকিৎসা থেকে শুরু করে সুই কেনা—সবই ঢাকাকেন্দ্রিক। এখানেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব প্রবলভাবে বিরাজ করে। প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্র যেখানে প্রবলভাবে অস্তিত্বশীল থাকার কথা, সেই ঢাকাতেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের অস্তিত্ব কি আমরা খুঁজে পাচ্ছি? বলা চলে, সেই শূন্যস্থানে প্রবল প্রতাপে বিরাজ করছে ‘মবতন্ত্র’।
দুই.সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আগে থেকেই ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। হাওয়ার বেগে সেসব পোস্ট ভাইরাল হচ্ছে। উত্তেজিত জনতা ভার্চ্যুয়াল জগৎ থেকে নেমে আসছে রাস্তায়। শুরু হয়ে যাচ্ছে ভাঙচুর বা হামলার ঘটনা।
একের পর এক মাজার ভাঙা হলো। কোথাও কিছুই ঠেকানো যাচ্ছে না, হচ্ছে না। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে নিন্দা জানিয়ে, ব্যবস্থা নেওয়া হবে, কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে একের পর এক বিবৃতি আসছে। বিবৃতিনির্ভর এই নিষ্ক্রিয়তা বড় করেই প্রশ্ন তৈরি করছে, সরকার কি এনজিও বা নাগরিক সংগঠন? নিন্দা জানিয়ে সরকার যদি বিবৃতি দেয়, তাহলে পদক্ষেপটা নেবে কে?
অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস পেরিয়েছি। জুলাই-আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানে রাষ্ট্র ও সরকারে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল এবং আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শাসন, লুটপাট, দুর্নীতি ও অপরাধে সমাজের বিশাল অংশের মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত ও ক্ষুব্ধ ছিল, তাতে প্রতিশোধ অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু ছয় মাস পরে এসে ‘মবতন্ত্র’ কোথাও কোথাও যেভাবে রাষ্ট্র ও সরকারের অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে, তার ব্যাখ্যা কী?
এখানে সরকারের নীতিকেই প্রধানভাবে দায়ী করতে হবে। কেননা, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী অংশ বাদে অভ্যুত্থানের পক্ষে রাস্তায় নেমে আসেনি কিংবা অভ্যুত্থানকে সমর্থন দেননি—এমন মানুষ বিরল। বিশেষ করে যাঁদের বয়স ৩০-এর মধ্যে, তাঁদের মা–বাবা ও পরিবারের বয়স্করা কোন দলের সমর্থক, সেটা বিবেচনা তাঁরা করেননি। বুলেটের সামনে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, দলনির্বিশেষে অন্তর্বর্তী সরকারের জনসমর্থন ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর থেকে কোনো কোনো পক্ষ নিজেদের অতি ক্ষমতায়িত গোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হলো।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে উঠল ঘৃণাচর্চা, আর যাকে–তাকে ধরে ট্যাগ দেওয়ার জায়গা। অভ্যুত্থানের সামনের কাতারের মুখগুলোও হরেদরে আক্রান্ত হতে লাগল। শুধু ভার্চ্যুয়াল জগতে নয়, বাস্তবেও ভিন্নমতের মানুষেরা আক্রান্ত হলেন। পাঠ্যবইয়ে ঠাঁই পাওয়া গ্রাফিতিতে আদিবাসী থাকায় সেটা বাদ দেওয়ার দাবি জানানো হলো। এনসিটিবি কোনো নিয়ম–পদ্ধতিতে না গিয়ে সেটা বাদ দিল। আদিবাসী শিক্ষার্থী ও বামপন্থী শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে রাস্তায় নামলে তাঁরা আক্রান্ত হলেন। ঘোষণা দিয়েই তাঁদের পেটানো হলো। নানাভাবে আক্রান্ত হতে থাকলেন নারীরা। মেয়েদের ফুটবল খেলাতেও বাধার ঘটনা আমরা দেখলাম।
ভারতে পালিয়ে যাওয়া পতিত স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার ভার্চ্যুয়াল বক্তব্য দেওয়ার ক্ষোভে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙা হলো। বুলডোজার এল কোত্থেকে সেটিও আমরা জানলাম। আওয়ামী লীগের লোকজনের বাড়িঘর ভাঙা হলো। বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় ম্যুরাল, ভাস্কর্যও ভাঙা হলো। কৃষকভাস্কর্যও ভাঙা হলো। কাউকে কোথাও থামানো হলো না। থামানোর চেষ্টা করা হলো না। ভাঙাভাঙির পর বিবৃতি এল। এখানেই থেমে থাকল না। ঘোষণা দিয়ে বইমেলায় মানুষ জড়ো করা হলো, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের দাবি জানালেন কিছু শিক্ষার্থী।
অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারা ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় নানাভাবে উসকানি তৈরি করছেন। দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রও আছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্তটা রাজনৈতিক লাভ–লোকসানের সমীকরণ থেকেই নেওয়া জরুরি। রাজনীতিতে একটি ভুল সিদ্ধান্ত রিপেল ইফেক্টের মতো আরও অনেক ভুলের জন্ম দিতে বাধ্য।
তিন.একটি বিষয় বেশ প্রবলভাবে চোখে পড়ছে। পুলিশ যে সব ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়, তা তো নয়। শিক্ষার্থীদের পেটানো, ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের সড়ক থেকে সরাতে তারা আগের আমলের মতোই পারদর্শিতা দেখিয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের সড়ক থেকে সরিয়ে দিতে যেভাবে সন্তান কোলে থাকা শিক্ষক মায়েদের দিকে জলকামান থেকে পানি ছুড়েছে, সেটা আমাদের পুরোনো আমলের স্মৃতিকেই জাগিয়েছে।
মানুষ চায় অন্তর্বর্তী সরকার প্রকৃতপক্ষে সরকার হিসাবে ক্রিয়াশীল হোক। এভাবে বিবৃতি দিয়ে তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তার জন্য দরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক ব যবস থ সরক র র ক ষমত আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
আবার কি চাঁদের বুকে পা রাখতে যাচ্ছে মানুষ
শত শত বছর ধরে মানুষকে আকর্ষণ করে আসছে চাঁদ। সেখানে মানুষের প্রথম পা রাখার প্রায় ৫৫ বছর পেরিয়ে গেছে। এখন আবারও বিজ্ঞানীরা চন্দ্রজয়ের তোড়জোড় শুরু করেছেন। এ নিয়ে শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা চাইছে সবার আগে চাঁদে মিশন পাঠাতে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে চাঁদে নভোচারীসহ অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর মাসে নাসার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপপ্রশাসক লেকিশা হকিন্স এক সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য জানিয়েছিলেন।
নাসার তথ্যানুযায়ী, চন্দ্রজয়ে ‘আর্টেমিস ২’ নামের মিশন পরিচালনা করা হবে। এ মিশন থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা চাঁদে অবতরণের জন্য নির্ধারিত ‘আর্টেমিস ৩’ মিশনে ব্যবহার করা হবে। ২০২৭ সালে এ মিশন পরিচালিত হবে। নাসার এই তৃতীয় আর্টেমিস অভিযানের মাধ্যমে ৫৭ বছরের বেশি সময় পর আবার চাঁদের বুকে মানুষের পা পড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
নাসার কর্মকর্তা হকিন্সের তথ্যানুযায়ী, নাসার আর্টেমিস ২ মিশনে প্রথম নভোযান উৎক্ষেপণের সুযোগ আসতে পারে ২০২৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। এর আগে পরিকল্পিত উৎক্ষেপণ তারিখ ছিল ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসে। তবে সময় কিছুটা এগিয়ে আনা হয়েছে।
এ মিশনের মূল উদ্দেশ্য হলো মহাকাশযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিস্টেম পরীক্ষা করা, যেমন নভোচারীর জীবনধারণব্যবস্থা। এসব অভিজ্ঞতা ২০২৭ সালে চাঁদে অবতরণের জন্য নির্ধারিত আর্টেমিস ৩ মিশনে ব্যবহার করা হবে।
পাঁচ দশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মহাকাশ কর্মসূচি আর্টেমিস, যাতে নভোচারী নিয়ে চাঁদে মিশন পাঠানো হবে।হকিন্স বলেন, নাসার আর্টেমিস প্রোগ্রামের লক্ষ্য হলো চাঁদে মানুষের অব্যাহত উপস্থিতি নিশ্চিত করা। এর অংশ হিসেবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক অংশীদার, বিশেষ করে ইউরোপের সঙ্গে মিলিতভাবে তৈরি প্রযুক্তি পরীক্ষা করা হবে, যা প্রথম নভোচারীদের পরবর্তী গন্তব্য মঙ্গল গ্রহে পৌঁছে দিতে সাহায্য করতে পারে।
পাঁচ দশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মহাকাশ কর্মসূচি আর্টেমিস, যাতে নভোচারী নিয়ে চাঁদে মিশন পাঠানো হবে। অ্যাপোলো প্রোগ্রামের এ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। মূলত চীনকে পেছনে ফেলতে যুক্তরাষ্ট্র আগাম এ মিশনের পরিকল্পনা করেছে।
চীনের লক্ষ্য হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে চাঁদে নভোচারী পাঠানো। যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে সবার আগেই সাফল্য পেতে মরিয়া। এরই মধ্যে চীন ২০৩০ সালের আগে চাঁদে মহাকাশচারী পাঠানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। নতুন রকেট ও নানা ধরনের চন্দ্র ল্যান্ডার নিয়ে বেইজিং বেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
আর্টেমিস ও অ্যাপোলো কর্মসূচির মধ্যে বড় এক পার্থক্য রয়েছে। এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্র অন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে সহযোগিতা ছাড়াই চন্দ্র মিশনে যাচ্ছে। এর আগে ২০২২ সালে চাঁদের মিশনের অংশ হিসেবে আর্টেমিস ১ কর্মসূচিতে নভোচারী ছাড়া প্রথম ওরিয়ন ক্যাপসুল উৎক্ষেপণ করা হয়।
এখন দ্বিতীয় মিশনটি চাঁদের কক্ষপথে একটি পরীক্ষামূলক ফ্লাইট হিসেবে পরিকল্পনা করা হয়েছে। এত ওরিয়ন ক্যাপসুল, এসএলএস রকেট এবং ভবিষ্যতে চাঁদে অবতরণের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যপ্রণালি যাচাই করা হবে।
আর্টেমিস ২-এ কী কী থাকবেআর্টেমিস ২-এর অভিযান প্রায় ১০ দিন চলবে এবং এতে চারজন নভোচারী ১২ লাখ মাইলের বেশি দূরত্ব পাড়ি দেবেন। পৃথিবীর কক্ষপথে দুবার ঘুরে আসার পর ওরিয়ন ক্যাপসুলে থাকা চারজন ক্রু সদস্য চাঁদের দিকে যাত্রা করবেন এবং একবার চাঁদের কক্ষপথে ঘুরবেন।
নভোচারীরা ক্যাপসুলের জানালা থেকে চাঁদের দূরপৃষ্ঠ পর্যবেক্ষণ করবেন। এ সময় চাঁদ থেকে তাদের নিকটতম দূরত্ব হবে প্রায় ৪ হাজার ৩৫০ মাইল (৭ হাজার কিলোমিটার)। নাসার এ যাত্রার সময় নভোচারীরা যেসব দৃশ্য দেখবেন, তা একটি টাইম-ল্যাপ ভিডিওতে ধরে রাখবেন।
টাইম-ল্যাপ ভিডিও হলো এমন একটি ভিডিও, যা সময়কে দ্রুততর গতিতে দেখায়। এতে দীর্ঘ সময়ের ঘটনা যেমন ঘণ্টা বা দিনের পরিবর্তন কয়েক মিনিট বা সেকেন্ডে দেখানো যায়। উদাহরণস্বরূপ, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত, বৃষ্টি বা শহরের ব্যস্ততা এক ঝলকে দেখা।
আর্টেমিস প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে মোট তিনটি মিশন পরিচালনা করা হচ্ছে। এ প্রোগ্রামের লক্ষ্য মানুষকে চাঁদে ফিরিয়ে নেওয়া এবং মঙ্গলে পাড়ি দেওয়া। এ প্রোগ্রামের প্রথম ধাপ, অর্থাৎ আর্টেমিস ১ উৎক্ষেপণ করা হয় ২০২২ সালের ১৬ নভেম্বর। এটা ছিল একটি পরীক্ষামূলক ফ্লাইট। ওই মিশনে কোনো মানুষ ছিলেন না। বরং মানুষের পরিবর্তে ছিল তিনটি পুতুল।
আর্টেমিসের মাধ্যমে চাঁদে মানুষ পৌঁছাবে। অনাবিষ্কৃত অনেক এলাকা পরিদর্শনের সুযোগ থাকবে।লেকিশা হকিন্স, উপপ্রশাসক, নাসাপরীক্ষামূলকভাবে পুতুলগুলোকে পাঠানো হয়েছিল। আর্টেমিস ২ মিশনও অনেকটা আর্টেমিস ১ মিশনের মতোই সম্পন্ন হবে। শুধু পুতুলের পরিবর্তে নভোযানে থাকবেন চার নভোচারী। ২০২৭ সালে চাঁদের উদ্দেশে যাত্রা করবে আর্টেমিস ৩। আর্টেমিস ৩ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করবে। ইতিমধ্যে অবতরণের সম্ভাব্য ১৩টি স্থানের নামও প্রকাশ করেছে নাসা।
চাঁদের এই অবস্থান পুঙ্খানুপুঙ্খ বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ও প্রকৌশলীদের তথ্যের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়েছে। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবস্থিত প্রস্তাবিত অবতরণ অঞ্চল হচ্ছে ক্যাবিউস বিয়ের কাছের শিখর, হাওর্থ, ম্যালাপার্ট ম্যাসিফ, মন্স মাউটন মালভূমি, মনস মাউটন, নোবিল রিম ১, নোবিল রিম ২, ডি গের্লাচে রিম ২ ও স্লেটার প্লেইন।
নাসা জানিয়েছে, স্থানগুলো পাথুরে। এসব এলাকা থেকে চন্দ্রসম্পদ ও সৌরজগতের বিস্তৃত ইতিহাস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লাভের সুযোগ আছে। মনুষ্যবাহী অভিযানের মাধ্যমে অনাবিষ্কৃত দক্ষিণ মেরুর বিভিন্ন তথ্য জানা যাবে। এ এলাকা স্থায়ীভাবে অন্ধকার অঞ্চল, যেখানে পানির উপস্থিতি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
নাসার বিজ্ঞানী লেকিশার ভাষ্য, আর্টেমিসের মাধ্যমে চাঁদে মানুষ পৌঁছাবে। অনাবিষ্কৃত অনেক এলাকা পরিদর্শনের সুযোগ থাকবে। নতুন নির্বাচিত চন্দ্র এলাকা দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি অবস্থিত। এসব এলাকায় নিরাপদে অবতরণ করার সুযোগ আছে। অভিযাত্রীরা সেখানে নতুন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সুযোগ পাবেন।
বিজ্ঞানী সারাহ নোবেল বলেন, অ্যাপোলো অভিযানের সময় যেখানে অবতরণ করা হয়, তার চেয়ে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ দেখা যায়। এ এলাকায় চাঁদের প্রাচীনতম ভূখণ্ড রয়েছে। এখানে ঠান্ডা ছায়াযুক্ত অঞ্চলে পানি ও অন্যান্য যৌগ থাকতে পারে। দক্ষিণ মেরুতে এসব স্থান নির্ধারণ করতে নাসার বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের একটি দল দীর্ঘদিন ধরে চন্দ্রের দক্ষিণ মেরু বিশ্লেষণ করেছে।
নভোচারী কারাচাঁদের কক্ষপথে ভ্রমণের জন্য নির্বাচিত ক্রুদের মধ্যে আছেন কমান্ডার রিড ওয়াইজম্যান, পাইলট ভিক্টর গ্লোভার, মিশন স্পেশালিস্ট ক্রিস্টিনা কোচ এবং কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সির নভোচারী জেরেমি হ্যানসেন। নভোচারীদের ঘুম, গতিবিধি, জৈবিক নমুনা এবং ফ্লাইটের প্রভাব শরীরে কেমন হচ্ছে, তা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে।
মার্কিন নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন রিড ওয়াইজম্যানের আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ১৬৫ দিন কাটানোর অভিজ্ঞতা আছে। আর্টেমিস ২ মিশনে তিনি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করবেন।
আরেক মার্কিন নভোচারী ভিক্টর গ্লোভার আর্টেমিস ২ মিশনে অরিয়ন নভোযানের পাইলটের দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি স্পেসএক্সের ক্রু ড্রাগন ক্যাপসুলের প্রথম পাইলট ছিলেন। তাঁরও আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ১৬৮ দিন কাটানোর অভিজ্ঞতা আছে। তিনিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে গিয়েছিলেন। এবার যাচ্ছেন চন্দ্রাভিযানে।
আর্টেমিস ২–এর নভোচারীরা