এবার মৌসুমের শুরুতেই বোরোর আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষকেরা। বোরোর ফলন নির্ভর করে সেচের ওপর, এবারে তাঁরা সেচটা ঠিকমতো দিতে পারবেন কি না, তা নিয়েই এই দুশ্চিন্তা।

তিন মাস আগে অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের কাছে গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা মেটানোর আগাম প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা কিছু স্বল্পমেয়াদি, কিছু মধ্যমেয়াদি ও কিছু দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিয়ে জ্বালানি পরিস্থিতি উন্নতি করার চেষ্টা করছি। আমরা আশা করি, গ্রীষ্ম মৌসুমে, সেচের মৌসুমে বড় ধরনের ঘাটতি হবে না।’

গত সপ্তাহে বণিক বার্তার প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়া এলএনজির আমদানি বাড়িয়ে এবারের গরমের মৌসুমে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। এরপরও উপদেষ্টা মনে করছেন, দৈনিক ৭০০ থেকে ১৪০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করা লাগতে পারে।

ধরে নিই, বোরোয় সেচের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহে সরকার অগ্রাধিকার দেবে। কিন্তু তারপরও কেন সেচ নিয়ে কৃষকের এমন দুশ্চিন্তা?

এ প্রশ্নের একটা উত্তর মিলবে ৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত লেখক ও গবেষক গওহার নঈম ওয়ারার ‘আমনে পাস হয়নি, বোরোতেও কি ফেল হবে’ শিরোনামের লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘সিংহভাগ সেচব্যবস্থা চলে সমবায় উদ্যোগে নানা কিছিমের সমিতির মাধ্যমে। এগুলো সংগঠিত করতে, চালাতে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী স্থানীয় নেতৃত্বের আশীর্বাদ লাগে। অধিকাংশ আশীর্বাদদাতার হালহকিকত আগের মতো নেই। ইতিমধ্যেই “এবার আমরা খাব” গোষ্ঠী বেরিয়ে পড়েছে যার যার ক্ষমতা অনুযায়ী।’

এই যে ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক গোষ্ঠী ছাড়া কৃষক যে সেচ পান না, তার মানে হচ্ছে, রাষ্ট্র বলি, আর সরকার বলি, বাংলাদেশের বিরাট অংশজুড়ে তার অস্তিত্ব প্রায় খুঁজে পাওয়া যায় না। নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্র কিংবা সরকারের সম্পর্ক এখানে সরাসরি নয়। মাঝখানে কায়েমি রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে ধরেই তাদের রাষ্ট্রের কাছে পৌঁছাতে হয়।

দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ ও রাজনীতিবিষয়ক গবেষক আরাইল্ড এঙ্গেলসন রুড বাংলাদেশের সমাজের এই ধরনকে বলেছেন নেটওয়ার্ক সমাজ। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলছেন, ‘বাংলাদেশে রাষ্ট্র দুর্বল। প্রশাসনিক যন্ত্র হিসেবেও রাষ্ট্র দুর্বল। দেশের বড় অংশে কার্যত রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্ব নেই। গ্রামীণ পর্যায়ে আপনি এমন কাউকে ভোট দেন, যিনি প্রয়োজনে আপনাকে রক্ষা করবেন। এমন কাউকে, যিনি শক্তিশালী, যাঁর সংযোগ আছে, যিনি হস্তক্ষেপ করতে পারেন। আপনার যদি পুলিশ, প্রতিবেশী বা প্রশাসনের সঙ্গে সমস্যা হয়, আপনি স্থানীয় নেতার কাছে যাবেন। সেই নেতা যেতে পারেন একজন মধ্যপর্যায়ের নেতার কাছে। সেই নেতা আবার যেতে পারেন এমপির কাছে। তারপর আপনি আপনার সমস্যা সমাধান করতে পারেন’ (বাংলাদেশে একটি নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা খুব কঠিন হবে, প্রথম আলো, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪)।

বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির এই সরল সমীকরণ পাঠ করা না গেলে যেকোনো পরিবর্তনের আলোচনাই অর্থহীন হয়ে পড়ে। কার্ল মার্ক্স ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ভারতবর্ষের সমাজের স্থবিরতার পেছনে এখানকার স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামভিত্তিক সমাজকে দায়ী করেছিলেন। একেকটা গ্রামই একেকটা বিচ্ছিন্ন দেশ। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল রাজধানীতে। প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের এই যে বিচ্ছিন্নতা কিংবা ব্যবধান, সেখান থেকে আমরা কতটা বেরিয়ে আসতে পেরেছি।

বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ এমন একটা দেশ হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে সারা দেশ থেকে সম্পদ এনে ঢাকাকে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। ফলে চিকিৎসা থেকে শুরু করে সুই কেনা—সবই ঢাকাকেন্দ্রিক। এখানেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব প্রবলভাবে বিরাজ করে। প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্র যেখানে প্রবলভাবে অস্তিত্বশীল থাকার কথা, সেই ঢাকাতেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের অস্তিত্ব কি আমরা খুঁজে পাচ্ছি? বলা চলে, সেই শূন্যস্থানে প্রবল প্রতাপে বিরাজ করছে ‘মবতন্ত্র’।

দুই.

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আগে থেকেই ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। হাওয়ার বেগে সেসব পোস্ট ভাইরাল হচ্ছে। উত্তেজিত জনতা ভার্চ্যুয়াল জগৎ থেকে নেমে আসছে রাস্তায়। শুরু হয়ে যাচ্ছে ভাঙচুর বা হামলার ঘটনা।

একের পর এক মাজার ভাঙা হলো। কোথাও কিছুই ঠেকানো যাচ্ছে না, হচ্ছে না। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে নিন্দা জানিয়ে, ব্যবস্থা নেওয়া হবে, কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে একের পর এক বিবৃতি আসছে। বিবৃতিনির্ভর এই নিষ্ক্রিয়তা বড় করেই প্রশ্ন তৈরি করছে, সরকার কি এনজিও বা নাগরিক সংগঠন? নিন্দা জানিয়ে সরকার যদি বিবৃতি দেয়, তাহলে পদক্ষেপটা নেবে কে?

অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস পেরিয়েছি। জুলাই-আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানে রাষ্ট্র ও সরকারে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল এবং আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শাসন, লুটপাট, দুর্নীতি ও অপরাধে সমাজের বিশাল অংশের মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত ও ক্ষুব্ধ ছিল, তাতে প্রতিশোধ অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু ছয় মাস পরে এসে ‘মবতন্ত্র’ কোথাও কোথাও যেভাবে রাষ্ট্র ও সরকারের অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছে, তার ব্যাখ্যা কী?

এখানে সরকারের নীতিকেই প্রধানভাবে দায়ী করতে হবে। কেননা, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী অংশ বাদে অভ্যুত্থানের পক্ষে রাস্তায় নেমে আসেনি কিংবা অভ্যুত্থানকে সমর্থন দেননি—এমন মানুষ বিরল। বিশেষ করে যাঁদের বয়স ৩০-এর মধ্যে, তাঁদের মা–বাবা ও পরিবারের বয়স্করা কোন দলের সমর্থক, সেটা বিবেচনা তাঁরা করেননি। বুলেটের সামনে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, দলনির্বিশেষে অন্তর্বর্তী সরকারের জনসমর্থন ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর থেকে কোনো কোনো পক্ষ নিজেদের অতি ক্ষমতায়িত গোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হলো।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে উঠল ঘৃণাচর্চা, আর যাকে–তাকে ধরে ট্যাগ দেওয়ার জায়গা। অভ্যুত্থানের সামনের কাতারের মুখগুলোও হরেদরে আক্রান্ত হতে লাগল। শুধু ভার্চ্যুয়াল জগতে নয়, বাস্তবেও ভিন্নমতের মানুষেরা আক্রান্ত হলেন। পাঠ্যবইয়ে ঠাঁই পাওয়া গ্রাফিতিতে আদিবাসী থাকায় সেটা বাদ দেওয়ার দাবি জানানো হলো। এনসিটিবি কোনো নিয়ম–পদ্ধতিতে না গিয়ে সেটা বাদ দিল। আদিবাসী শিক্ষার্থী ও বামপন্থী শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে রাস্তায় নামলে তাঁরা আক্রান্ত হলেন। ঘোষণা দিয়েই তাঁদের পেটানো হলো। নানাভাবে আক্রান্ত হতে থাকলেন নারীরা। মেয়েদের ফুটবল খেলাতেও বাধার ঘটনা আমরা দেখলাম।

ভারতে পালিয়ে যাওয়া পতিত স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার ভার্চ্যুয়াল বক্তব্য দেওয়ার ক্ষোভে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙা হলো। বুলডোজার এল কোত্থেকে সেটিও আমরা জানলাম। আওয়ামী লীগের লোকজনের বাড়িঘর ভাঙা হলো। বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় ম্যুরাল, ভাস্কর্যও ভাঙা হলো। কৃষকভাস্কর্যও ভাঙা হলো। কাউকে কোথাও থামানো হলো না। থামানোর চেষ্টা করা হলো না। ভাঙাভাঙির পর বিবৃতি এল। এখানেই থেমে থাকল না। ঘোষণা দিয়ে বইমেলায় মানুষ জড়ো করা হলো, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের দাবি জানালেন কিছু শিক্ষার্থী।

অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারা ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় নানাভাবে উসকানি তৈরি করছেন। দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রও আছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্তটা রাজনৈতিক লাভ–লোকসানের সমীকরণ থেকেই নেওয়া জরুরি। রাজনীতিতে একটি ভুল সিদ্ধান্ত রিপেল ইফেক্টের মতো আরও অনেক ভুলের জন্ম দিতে বাধ্য।

তিন.

একটি বিষয় বেশ প্রবলভাবে চোখে পড়ছে। পুলিশ যে সব ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়, তা তো নয়। শিক্ষার্থীদের পেটানো, ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের সড়ক থেকে সরাতে তারা আগের আমলের মতোই পারদর্শিতা দেখিয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের সড়ক থেকে সরিয়ে দিতে যেভাবে সন্তান কোলে থাকা শিক্ষক মায়েদের দিকে জলকামান থেকে পানি ছুড়েছে, সেটা আমাদের পুরোনো আমলের স্মৃতিকেই জাগিয়েছে।

মানুষ চায় অন্তর্বর্তী সরকার প্রকৃতপক্ষে সরকার হিসাবে ক্রিয়াশীল হোক। এভাবে বিবৃতি দিয়ে তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তার জন্য দরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক ব যবস থ সরক র র ক ষমত আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

ছুটিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর লম্বা মিছিল

তিন দিন পর অবশেষে শুক্রবার ১৩ জুন দুই বোনের লাশ মেহেন্দীগঞ্জের গজারিয়া নদীতে ভেসে ওঠে। রাইসা ও জান্নাত মামাতো-ফুফাতো বোন। তারা আর হাসবে না। বই–খাতা, স্কুলড্রেস সব আছে, শুধু তারা তারা হয়ে গেছে দূর আকাশে। ১৩ বছরের জান্নাত ঢাকার গেন্ডারিয়া থেকে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ গিয়েছিল ঈদের ছুটিতে। তার এক বছরের ছোট মামাতো বোন রাইসার সঙ্গে খুব খাতির। ঈদ উপলক্ষে একসঙ্গে হাতে মেহেদিও দিয়েছিল দুজন। নানার বাড়ির কাছেই গজারিয়া নদী। সেখানে তারা বুধবার ১১ জুন যায় গোসল করতে। বলা হচ্ছে স্রোতের টানে ভেসে গিয়ে তারা নিখোঁজ হয়। ঈদের ছুটির আগে-পরে (৫ জুন-১৪ জুন) এ রকম প্রায় ৬৬টি ঘটনায় ৭৮ জন ডুবে মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। মর্মান্তিক সব মৃত্যুর খবর এখনো আসছে।

যেকোনো বড় ছুটিতে ‘বাড়ির’ জন্য রওনা দিলেই সবাই পৌঁছাতে পারে না, আবার পৌঁছালেও সবার আর ফেরা হয় না কর্মস্থলে, স্কুলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, খেলার মাঠে বন্ধুদের কাছে। সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণহানি ঘটে। শিশুরা এ সময় বেশি মারা যায় পানিতে ডুবে। এবার সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হয়েছে পানিতে ডুবে মৃত্যুর মিছিল। গণমাধ্যমের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত উল্লিখিত ৭৮ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে স্থানীয় হাসপাতাল আর পুলিশ কর্তৃপক্ষ।

৭৮টি মৃতদেহের মধ্যে মাত্র ১২টি হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের। বাকি ৬৬ জনই শিশু–কিশোর। এদের বয়স ১০ মাস থেকে ১৭ বছর। ৬৬ জনের মধ্যে অর্ধেকের বয়স ৫ বছরের নিচে। বাংলাদেশে এখন ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ) হচ্ছে পানিতে ডুবে মৃত্যু।

ভারতের জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) তথ্য অনুসারে, দেশটিতে প্রতিবছর ৩৮ হাজারের বেশি মানুষ ডুবে মারা যায়। এটি সে দেশের মোট দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর প্রায় ৯ শতাংশ। অন্যদিকে গত বছর ইউনিসেফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৪ হাজারের বেশি শিশু ডুবে মারা যায়। অর্থাৎ দিনে মারা যায় প্রায় ৪০ জন।

এটা জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে বাংলাদেশে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা ভারতের চেয়ে বেশি।

বেসরকারি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার (আইডিআরসি) বাংলাদেশের ডিরেক্টর ড. আমিনুর রহমান মনে করেন, সবাই বলে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় বেশি শিশু মারা যায়। আসলে বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে।

টিকা দিয়ে বা সময়মতো চিকিৎসায় ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের অকালমৃত্যু ঠেকানো গেলেও ‘লাভের গুড় পিঁপড়ে’ মানে পানিতে খেয়ে যাচ্ছে। শিশুরা ডুবে মারা যাচ্ছে পানির বালতিতে, ডোবায়, পুকুরে, খালে, নদীতে।

একে অপরকে বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যু

রাইসা আর জান্নাতের মতো কমপক্ষে ১৬ জন মারা গেছে, যারা একে অপরের বোন বা ভাই। মেহেন্দিগঞ্জে রাইসা ও জান্নাতের ক্ষেত্রে ঠিক কী ঘটেছিল, তা জানা না গেলেও ফরিদপুরের সালথায় তানহা নিজের ভাই তালহাকে বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিল। তখন তানহা নিজেও পানিতে ডুবে যায়। যে কজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ডুবে মারা গেছেন, তাঁদের অনেকেই প্রিয়জনদের বাঁচাতে গিয়ে মারা গেছেন। যাঁরা সাঁতার জানেন, তাঁদের বিশ্বাস, তাঁরা ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধার করতে পারবেন। আসলে ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধারের কৌশল জানা না থাকলে শুধু সাঁতারের জ্ঞান দিয়ে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রাণঘাতী প্রচেষ্টার নামান্তরমাত্র। একইভাবে আমি সাঁতার জানি বলেই আরেকজনকে সাঁতার শেখাতে পারব, এমন ভাবনার কোনো মানে নেই। সব খেলোয়াড় যেমন কোচ হতে পারেন না, তেমনি সব সাঁতারুই সাঁতারের প্রশিক্ষক হওয়ার উপযুক্ত নন। এবার যে চারজন অভিভাবক ডুবে মারা গেছেন, তাঁরা সবাই সাঁতার শেখাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। সাঁতার শেখানো কোনো তামাশা বা ফান নয়। এটা আমাদের অনুধাবন করতে হবে।

এত মৃত্যুর কারণ কী

এই প্রশ্নের বিজ্ঞানভিত্তিক উত্তর পেতে হলে আমাদের ধারাবাহিক গবেষণা দরকার।

যেসব কারণ কথিত বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করে থাকেন, তা নিতান্তই অনুমাননির্ভর। গত শুক্রবার (১৩ জুন) দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় তিন শিশু (রাফা (২), তাসিব (২) ও তুহিন (৫) ডুবে মারা গেলে সংবাদকর্মীরা স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি অনুমাননির্ভর ধারণা থেকে জানান, শিশুর মৃত্যুর জন্য মূলত অভিভাবকেরাই অনেকটা দায়ী। পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেশি হওয়ায় অভিভাবকেরা শিশুদের প্রতি তেমন নজর দিতে পারেন না। এ ছাড়া প্রতিটি ঘরের পাশেই পুকুর বা ডোবা রয়েছে। শিশুদের প্রতি অভিভাবকদের নজরদারির অভাবে প্রায় পুকুরে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

এবারের মৃত্যুতালিকা দেখলে জানা যাবে অনেকেই তাঁদের একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছেন। কাজেই ছেলেমেয়ে বেশি, তাই নজরদারি নেই, এমন সরলীকরণ করা ঠিক হবে না। প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত হওয়া উচিত। ময়নাতদন্ত হওয়া উচিত। ওয়ারিশজনিত জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে খুনখারাবি, শিশুহত্যা এ দেশে নতুন কিছু নয়। বড় ছুটির সুযোগ কেউ নিচ্ছে না তো?

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর নানা কারণ আমাদের প্রকল্পনির্ভর গবেষকেরা খুঁজে বের করেছেন। মা ও অভিভাবকদের গাফিলতি আর সাঁতার না জানাকেই মূল কারণ হিসেবে শনাক্ত করে ব্যবস্থাপত্র জারি হয়েছে। পানিতে ডুবে মৃত্যু ঠেকাতে গ্রামে গ্রামে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র চালু করা, ছয় বছর বা তার চেয়ে বড় শিশুদের জন্য সাঁতার শিক্ষার ব্যবস্থার কথাও বলা হচ্ছে। দিবাযত্ন কেন্দ্রগুলো কি বড় ছুটিতে খোলা থাকবে? ছুটিতে যখন গ্রামে শিশুর সংখ্যা বেড়ে যাবে তখন কি তাদের দিবাযত্ন কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হবে? এসব প্রশ্নের কেউ জবাব দেওয়ার নেই।

গত কয়েক বছরের পানিতে ডোবার ঘটনাগুলো একটু খতিয়ে দেখলে অন্য একটা কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দুঃখজনকভাবে সেই কারণটি আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে। বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরাম জানাচ্ছে, হঠাৎ খিঁচুনি দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ঝোঁক আছে, এমন শিশুদের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা একেবারেই কম নয়। খিঁচুনির নানা ধরন থাকলেও আমাদের দেশে সাধারণভাবে এটা মৃগীরোগ নামে পরিচিত। বেসরকারি সংস্থা দুর্যোগ ফোরাম ২০২০ সালে পানিতে ডুবে মৃত ২২ জনের বিস্তারিত খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখে এদের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচজনের খিঁচুনি বা মৃগীরোগের প্রভাব ছিল।

গত মে মাসে বড় জোয়ারের সময় মহেশখালীতে যে তিনজন (জামাল মিয়া, দানু মিয়া, ঝুমু) পানিতে ডুবে মারা যান, তাঁদের প্রত্যেকের মৃগীরোগের প্রভাব ছিল বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

যুক্তরাজ্যের ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজির বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট ড. লে সানডার এ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত যে মৃগীরোগের উপসর্গ থাকলে শিশুদের পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। ২০১৪ সালে তিনি ও তাঁর দল ৮৮টি পানিতে ডোবার ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, পাঁচজন ছাড়া বাকি সবাই মৃগী বা মৃগীরোগ-সংক্রান্ত কোনো না কোনো জটিলতায় ভুগছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অনলাইন পত্রিকা মেডপেজ টুডে লে সানডার–এর গবেষণার সূত্র ধরে জানিয়েছে, অন্যদের চেয়ে মৃগীরোগীদের পানিতে ডোবার আশঙ্কা ২০ গুণ বেশি। আবার বিশেষ ধরনের মৃগীরোগীর ক্ষেত্রে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৭ গুণ।

মৃগীরোগীর সংখ্যা কম নয়

বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের মৃগীরোগের উপসর্গ নিয়ে অনেক শিশু আমাদের পরিবারে, পাড়ায়, সমাজে অবহেলায় বেঁচে আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কম বয়সের শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ—সবাই মৃগীরোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে শিশুদের মধ্যে এই রোগের প্রভাব বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আগ্রহে এবং আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত একটি জরিপ চালানো হয়। এটাই ছিল মৃগীরোগীর সংখ্যা নিরূপণের প্রথম জরিপ। কাকতালীয়ভাবে এই জরিপের ফলাফলের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার মৃগীরোগীর তথ্য হুবহু মিলে যায়। শ্রীলঙ্কার মতো আমাদের দেশেও প্রতি হাজারে ৯ জন মৃগীরোগী আছে বলে এই জরিপে জানা যায়। সেই হিসাবে বাংলাদেশে মোট মৃগীরোগীর সংখ্যা কমপক্ষে ২০ লাখের মতো। বলে রাখা ভালো, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মৃগীরোগীর গড় সংখ্যার ব্যাপক তারতম্য আছে।

শিশুর মধ্যে কী কী আলামত দেখলে প্রাথমিকভাবে মৃগীরোগের সন্দেহ করা করা যায়:

এক. হঠাৎ করে কোনো শিশু চোখ-মুখ উল্টিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলে আর তার সঙ্গে সারা শরীরে ঝাঁকুনি বা খিঁচুনি শুরু হলে।

দুই. কোনো শিশু যদি চোখের পলক না ফেলে হঠাৎ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে বা অন্যমনস্ক হয়ে গেলে। অনেক ক্ষেত্রে হাতে কিছু থাকলে হঠাৎ করেই পড়ে যায়। (অভিভাবকেরা অনেক সময় ভাবেন, এটা শিশুর কাব্যিক ভাব। সন্তান তার কবি হয়ে উঠছে।)

তিন. আপাতদৃষ্টে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ এক শিশু যদি হঠাৎ করে অস্বাভাবিক ব্যবহার শুরু করে। মুখভঙ্গির পরিবর্তনসহ অস্বাভাবিক হাঁটাচলা করে। আবোলতাবোল কথা বলতে শুরু করে। আবার কয়েক মিনিট পর আগের মতো সুস্থ হয়ে যায়।

চার. পানি বা আগুনের কাছে গেলেই হঠাৎ খিঁচুনি ওঠে।

পাঁচ. শিশু চোখেমুখে অন্ধকার দেখার কথা বলে। চোখে আলোর ঝিলিক দেখে, তারপর আর কিছু বলতে পারে না।

এসবের কোনোটাই আমাদের উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে, মৃগী কোনো অভিশাপ নয় বা দৈব কোনো রোগ নয়। মৃগীরোগ মস্তিষ্কের একটি অসুখ, যা মাথায় কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের তারতম্যের কারণে হয়। কোলের শিশু থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সের শিশু এমনকি বয়স্ক মানুষেরও এটা হতে পারে।

পানিতে নামতে না দেওয়া ছাড়াও এ ধরনের শিশুদের গাছে চড়তে দেওয়া ঠিক নয়। যেসব শিশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাচ্ছে, তাদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার সময় ওষুধ সঙ্গে রাখতে হবে।

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর স্রোত নিয়ন্ত্রণ সম্ভব কি

নিয়ত ঠিক থাকলে অবশ্যই সম্ভব। ২০১৯ সালে জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা বলছে, পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব। ৮৮ শতাংশের বেশি কমিয়ে আনা কোনো কঠিন কাজ নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে তিনটি কৌশল সবচেয়ে কার্যকর বলে উল্লেখ করা হয়। এগুলো হচ্ছে, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী শিশুযত্নের সুযোগ সৃষ্টি করা। পানিতে সুরক্ষা ও নিরাপদ উদ্ধারের ওপর জোর দিয়ে ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের সাঁতার শেখার সুযোগ বৃদ্ধি করা। শিশুদের নিরাপত্তাঝুঁকি এবং তা হ্রাস করার পদ্ধতি সম্পর্কে জনসাধারণ ও মা-বাবাদের সচেতনতা বাড়ানো।

গ্রামে আগে শিশুদের কোমরে পিতলের একটা ছোট্ট ঘণ্টি বেঁধে দেওয়া হতো। এটা কোনো অলংকার ছিল না। কর্মব্যস্ত মায়ের কান থাকত সেই ঘণ্টির দিকে। সচেতন অভিভাবকেরা বাড়ির আশপাশের পুকুরে বাঁশের বা টিনের ঘেরা দিতে পারেন। এতে একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, যেটা পেরিয়ে শিশু পুকুরে যেতে পারবে না।

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ২০২২ সালে ২৭১ কোটি ৮২ লাখ ৫৭ হাজার টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। একই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশুযত্ন কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং শিশুর সাঁতার সুবিধা প্রদান’ শীর্ষক প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদিত হয়। জানুয়ারি ২০২২ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের আওতায় ২ লাখ শিশুকে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে শিশুযত্ন কেন্দ্র স্থাপন এবং পরিচালনা, ৬ থেকে ১০ বছরের শিশুদের জন্য ১ হাজার ৬০০টি ভেন্যুতে সাঁতার প্রশিক্ষণ সুবিধার ব্যবস্থা এবং সুইমসেফ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ৩ লাখ ৬০ হাজার শিশুকে সাঁতার শেখানোর কথা। দেশের ৮টি বিভাগের ১৬টি জেলাকে এ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এখন প্রয়োজন এসব প্রকল্পের স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে স্থানীয় অভিভাবক ও তরুণদের সম্পৃক্ত করে তাদের নেতৃত্বে একটি টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

লেখক গবেষক: [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ