আমি পেশায় চা–বিক্রেতা। সংসারের হাল ধরতে গিয়ে আমার পড়াশোনার ইতি ঘটে মাধ্যমিকে। তিন ভাই আর তিন বোনের মধ্যে আমি
পঞ্চম। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে আর দুই ভাই বিয়ে করে অন্যত্র সংসার করছেন। তবু আট সদস্যের এই বিশাল পরিবারের
বেশির ভাগ নির্ভর করত বাবার আয়ের ওপর। বাবা ছিলেন সবজি বিক্রেতা। গৌরীপুর শহরের অলিগলিতে ফেরি করে তিনি সবজি বিক্রি করতেন।
পড়াশোনায় ইতি ঘটলে আমি হাল ধরি পরিবারের। ২০১০ সালে গৌরীপুর পৌর শহরে একটি মুদিদোকানে দৈনিক ১০০ টাকা বেতনে কাজ নিই। এক বছর মুদিদোকান থেকে আশানুরূপ বেতন না পাওয়ায় সেখান থেকে সরে আসি। পরে গৌরীপুর পৌর শহরের কালীখলা এলাকায় আমার মামার জালাল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে কাজ শুরু করি সেই ১০০ টাকা বেতনেই। সেখানেও বেশ কয়েক মাস কাজ করার পর পারিশ্রমিক ঠিকমতো না পাওয়ায় চলে আসি।
ওই হোটেলের বারান্দায় একটা চায়ের দোকান দেওয়ার স্বপ্ন দেখি। মাসে ৬০০ টাকা ভাড়ায় ২০১২ সালের শেষ দিকে হোটেলটির বারান্দায় হারুন টি হাউসের যাত্রা শুরু হয়। চায়ের দোকানটি আলাদা পরিচিতি লাভ করে। দোকানটিতে চা–প্রেমীর ভিড় লেগেই থাকত। কারণ, আমি গরুর খাঁটি দুধের চা বিক্রি করতাম। যে কারণে নানা সময়ে হোটেলটির মালিকের কটুকথাও সহ্য করতে হয়েছে আমাকে। চায়ের দোকানে ভিড়ের কারণে হোটেলে বেচাকেনায় সমস্যা হচ্ছে—এই ছিল তাঁর কথা। দোকান ছেড়ে দিতে চাপ দেন তিনি।
তবু হাল না ছেড়ে ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করি। চায়ের দোকানটি না ছেড়ে গরুর দুধের চা বিক্রি করা বন্ধ করে দিই। কমে যায় চা–প্রেমীদের ভিড়। এতে মনোমালিন্য বন্ধ হয় হোটেলের মালিকের সঙ্গে।
চা বিক্রির পাশাপাশি একসময় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার স্বপ্ন দেখি। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে এসএসসিতে ভর্তি হই। ২০২১ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করি। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২৩ সালে এইচএসসি পাস করি। আমার চা বিক্রি চলতে থাকে।
চা বিক্রি, পড়াশোনা, পরিবারের দেখভাল করার পাশাপাশি শতাধিক বই নিয়ে ২০২৩ সালে একই হোটেলের বারান্দায় হারুন পাঠাগার নামে আমার এই উদ্যোগের যাত্রা শুরু করি। ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগের প্রশংসাও করেন অনেকে। বাংলাদেশের প্রথম সারির সব গণমাধ্যমেও খবরটি প্রকাশিত হয়। দোকানে নিয়মিত চা খেতে আসা গ্রাহকদের প্রতিবছর বর্ষসেরা চা–প্রেমী সম্মাননা দিই ২০১৭ সাল থেকে। চা বিক্রির পাশাপাশি এই কাজও ব্যতিক্রম হওয়ায় আলোচিত হই।
মানুষকে বইমুখী করার লক্ষ্যে ২০২৩ সালে যাত্রা শুরু হওয়া আমার পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে দেড় হাজার। পাঠক বেড়ে হয়েছে তিন শতাধিক।
২০২৩ সালের জুন মাসে বাবাকে হারাই। মরণব্যাধি ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে মৃত্যু হয় তাঁর। সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে আমার কাঁধে।
মা আর ছোট বোনকে নিয়ে তিনজনের সংসারের একমাত্র আয়ের উৎস ছিল চায়ের দোকানটি। ২০২৪ সালের নভেম্বরে ওই জায়গায় থাকা চারটি প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেওয়ার জন্য নোটিশ দেন জায়গার মালিক। যে কারণে দেড় হাজার বই আর চায়ের দোকানটি নিয়ে বিপাকে পড়ে যাই।
বইগুলো নিরাপদে রাখার জন্য একাধিক মানুষের শরণাপন্ন হই; কিন্তু কেউ জায়গা দিতে সম্মত হননি। শেষ পর্যন্ত এগিয়ে আসেন গৌরীপুর কালীখলা মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক শংকর ঘোষ। তিনি মন্দিরের পাশে একটি ঘরে পাঠাগারটি পরিচালনার সুযোগ দেন; কিন্তু চায়ের দোকানটি শুরু করতে পারিনি। এখন শুধু বই আর পত্রিকা পড়েই সময় কাটছে আমার।
ছোট বোন বর্তমানে গৌরীপুর সরকারি কলেজে ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আমি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন স্নাতক শ্রেণিতে পড়াশোনা করছি। একজন চা–বিক্রেতা হিসেবে জীবন আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। তবু আশা রাখি এই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ২০২৩ স ল
এছাড়াও পড়ুন:
আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশের কিস্তির প্রস্তাব উঠছে আইএমএফ পর্ষদে
আগামী ২৩ জুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্বাহী পর্ষদের সভায় বাংলাদেশের সঙ্গে চলমান ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ ও পঞ্চম দুই কিস্তির অর্থ ছাড়ের প্রস্তাব উঠছে। সভায় অনুমোদন হলে একসঙ্গে দুই কিস্তির ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার পাবে বাংলাদেশ। আইএমএফ শুক্রবার কার্যসূচিতে নির্বাহী পর্ষদের সভার এ তারিখ নির্ধারণের তথ্য প্রকাশ করেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফ পর্ষদের বৈঠকে চলমান ঋণ কর্মসূচির পর্যালোচনা প্রতিবেদন উপস্থাপনের কথা রয়েছে। এ প্রতিবেদন পর্ষদ অনুমোদন করলে বাংলাদেশ একসঙ্গে পাবে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ। ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য সাড়ে তিন বছর মেয়াদি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে।
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, ঝুঁকিতে থাকা ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা দিতে আইএমএফ ঋণ কর্মসূচি অনুমোদন করে। চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়া, টাকার দরপতন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার কারণে ওই সময় আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির মধ্যে বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) বাবদ ঋণ রয়েছে ৩৩০ কোটি ডলার। আর রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) বাবদ রয়েছে ১৪০ কোটি ডলার। আরএসএফ আইএমএফের একটি নতুন তহবিল, যেখান থেকে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশকেই প্রথম ঋণ দেওয়া হচ্ছে।
২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আইএমএফের কাছ থেকে প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ও ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। তিন কিস্তিতে আইএমএফের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকি আছে ২৩৯ কোটি ডলার।
আইএমএফের ঋণের চতুর্থ কিস্তির অর্থ গত বছরের ডিসেম্বরে পাওয়ার কথা থাকলেও শর্ত পরিপালন নিয়ে বিশেষত টাকা–ডলার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে অর্থ মন্ত্রণালয় জানায়, চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি একসঙ্গে ছাড়ের সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত এপ্রিলে আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল শর্ত পালনের অগ্রগতি পর্যালোচনায় ঢাকায় আসে। তবে সমঝোতা না হওয়ায় চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড় আটকে যায়। এরপর ওয়াশিংটনে গত ২১ থেকে ২৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে এ বিষয়ে আরও আলোচনা হয়।
সবশেষে গত মাসে এ নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে কয়েকটি ভার্চুয়াল বৈঠক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১২ মে দুই পক্ষ চূড়ান্ত সমঝোতা হয় এবং বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করে বাংলাদেশ। ১৪ মে আইএমএফ ওয়াশিংটন থেকে এক বিবৃতিতে জানায়, দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে এবং পর্ষদ সভার অনুমোদন সাপেক্ষে ঋণের অর্থ ছাড় করা হবে জুনে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ৭৬ কোটি ডলার বাড়তি ঋণ চেয়েছে। বাড়তি ঋণ যোগ হলে মোট দাঁড়াবে ৫৪০ কোটি ডলার। বিবৃতিতে বিনিময় হার, রাজস্ব আদায়, ব্যাংক খাতসহ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়।