বিনিয়োগবান্ধব বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ ও প্রত্যাশা
Published: 8th, April 2025 GMT
বাংলাদেশ গত এক দশকে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে দক্ষিণ এশিয়ার এক সম্ভাবনাময় অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। ২০১০ সালে যেখানে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) ছিল মাত্র ৯১৩ মিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০১৯ সাল নাগাদ তা ছাড়িয়ে যায় ৩.৬ বিলিয়ন ডলারে। যদিও করোনা-পরবর্তী অভিঘাত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক মন্দার ফলে বিনিয়োগের গতিপথ কিছুটা বাধাগ্রস্ত, তার পরও বাংলাদেশ এখনও শ্রমনির্ভর উৎপাদনশীলতা, ভোক্তাবাজার ও ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য।
এই প্রেক্ষাপটে ‘বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২৫’ একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ, যা সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সরাসরি সংলাপের সুযোগ তৈরি করেছে। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হলো, ঠিক এমন একটি ইতিবাচক উদ্যোগের সময়েই দেশের কয়েকটি জেলায় ঘটে গেল এমন কিছু ঘটনা, যা আমাদের বিনিয়োগ পরিমণ্ডল নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।
সম্প্রতি ইসরায়েলের গাজায় সামরিক অভিযান এবং এর জবাবে বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদ-প্রতিবেশ গড়ে ওঠার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও অনুষ্ঠিত হয়েছে মিছিল ও বিক্ষোভ। এটি গণতান্ত্রিক পরিসরেরই অংশ। কিন্তু সেই মিছিলের ভেতরে যখন দেখা যায় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড যেমন– কেএফসি, পিৎজা হাট, বাটা কিংবা মেট্রো শুর মতো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ, তখন প্রশ্ন ওঠে, এ দেশে
কি বিনিয়োগ নিরাপদ? এই প্রশ্ন কেবল বিনিয়োগকারীর নয়, বরং আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্যও।
আমরা ভুলে যাই, এসব আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড আজকের দিনে শুধু বিদেশি প্রতিষ্ঠানের লোগো নয়, বরং এরা বাংলাদেশের বাজারে লোকাল ফ্র্যাঞ্চাইজির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে নিয়োজিত হাজার হাজার বাংলাদেশি তরুণ-তরুণী। তারা কাজ করছেন বিপণন, রন্ধন, গ্রাহকসেবা, সরবরাহ চেইনসহ বিভিন্ন বিভাগে। কাজেই এসব প্রতিষ্ঠানে হামলা মানে একদিকে দেশের অর্থনীতিতে আঘাত, অন্যদিকে
কর্মসংস্থান বিনষ্ট।
বিনিয়োগকারীর সবচেয়ে বড় চাহিদা হলো ‘নীতি ও নিরাপত্তার স্থিতিশীলতা’। একটি দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, হঠাৎ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি অথবা সামাজিক অস্থিরতা বিদেশি বিনিয়োগকে শুধু ভয়ই দেখায় না; তাদের বিকল্প গন্তব্য খুঁজতে বাধ্য করে। ইতোমধ্যে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া এমনকি সাব-সাহারান আফ্রিকার কিছু দেশ বাংলাদেশকে টেক্কা দেওয়ার মতো প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা বছরে পাঁচটির বেশি, সেসব দেশে এফডিআই প্রবাহ গড়ে ৩০ শতাংশ কমে যায়। বাংলাদেশ যদি সত্যিই ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চায়, তাহলে এ রকম ‘পাবলিক পারসেপশন রিস্ক’ আমাদের দ্রুত সমাধান করতে হবে। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মাঠে নামানো নয়, বরং একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে বিনিয়োগবান্ধব নীতি বাস্তবায়ন জরুরি।
আমাদের যুবসমাজকে বোঝাতে হবে, কোনো ধর্মীয় বা আন্তর্জাতিক ইস্যুতে প্রতিবাদ হতেই পারে। কিন্তু সেটা যেন আমাদের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ডে আঘাত না করে। একটি কেএফসি দোকানে হামলা মানে শুধু একটুখানি শপিংমল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া নয়, বরং সেটি একটি ব্র্যান্ডের কাছে সংকেত– ‘এ দেশে তুমি নিরাপদ নও’। আজকের বিশ্বে বিনিয়োগকারীরা রিটার্নের আগে ঝুঁকি বিশ্লেষণ করেন। এই ঝুঁকি যদি হয় ‘উগ্র জনতায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়’, তাহলে কোনো ট্যাক্স ছাড়, কোনো সস্তা শ্রম কিংবা এক্সপোর্ট ইনসেনটিভও তাদের টানতে পারবে না।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষদের শুধু ঘটনার পর প্রতিক্রিয়া নয়, বরং ঘটনার আগে রক্ষা-পরামর্শমূলক নীতিমালা গঠন করতে হবে। সরকার চাইলে ‘ব্র্যান্ড প্রটেকশন স্কিম’ চালু করতে পারে, যেখানে বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোকে নির্দিষ্ট অঙ্কের বিনিময়ে একটি সরকারি ঝুঁকি-নিরাপত্তা সেবা দেওয়া হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজন কূটনৈতিক যোগাযোগ, যাতে আন্তর্জাতিক মহলে এটি ব্যাখ্যা করা যায়– বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ বিনিয়োগবান্ধব এবং বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে কখনও রাষ্ট্রীয় সমর্থন বা গণমতের প্রতিফলন বলা যাবে না।
আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগ মানে শুধু টাকা আনা নয়। এটি কর্মসংস্থান, প্রযুক্তি হস্তান্তর, মানসম্পন্ন পণ্য ও পরিষেবার উন্নয়ন এবং বৈদেশিক বাজারে প্রবেশাধিকার। এসবের একটিও আমরা হারাতে চাই না। তাই আমাদের আত্মসমালোচনা জরুরি। আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে– বাংলাদেশ ব্যবসার জন্য প্রস্তুত এবং এ দেশে কাউকে হুমকির মুখে পড়তে হবে না।
মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ক আম দ র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সুনামি সতর্কতা প্রত্যাহার, বাড়ি ফিরছেন লাখো মানুষ
রাশিয়ার পূর্ব উপকূলে গতকাল বুধবার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানার পর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের চারপাশে যে সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এরপরই বিভিন্ন দেশে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া লাখো মানুষ নিজ নিজ বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন।
রাশিয়ার কামচাতকা উপদ্বীপের কাছে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ওই ভূমিকম্পের পর প্রশান্ত মহাসাগরের কিছু অংশে চার মিটার (১২ ফুট) পর্যন্ত জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস দেওয়া হয়। জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইকুয়েডর পর্যন্ত এক ডজনেরও বেশি দেশের নাগরিকদের সতর্ক করে উপকূলীয় অঞ্চল থেকে সরে উঁচু স্থানে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলা হয়।
সুনামি সতর্কতা জারির পর প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের ১২১টি বন্দরের মধ্যে ৬৫টির কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঙ্গরাজ্যের মাউই দ্বীপ কর্তৃপক্ষ এ দ্বীপে সব ফ্লাইটের চলাচল বাতিল করে।
তবে যতটা বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হয়েছিল, তেমনটা ঘটেনি। সুনামি দেখা গেলেও ঢেউয়ের উচ্চতা কম ছিল। পরে একের পর এক দেশ সুনামি সতর্কতা প্রত্যাহার করে বা হ্রাস করে এবং উপকূলবাসীদের জানিয়ে দেয় যে তাঁরা ঘরে ফিরতে পারেন।
জাপানে প্রায় ২০ লাখ মানুষকে উঁচু স্থানে সরে যেতে বলা হয়েছিল। পরে সতর্কতা কমানো বা বাতিল করা হয়।
জাপানে সুনামি সতর্কতা জারির পর এক নারী গাড়ি চালিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সময় সেটি পাহাড়ের খাড়িতে পড়ে গেলে তিনি মারা যান। সেখানে এখন পর্যন্ত একজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে জানিয়েছে জাপানের গণমাধ্যম।জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সাময়িকভাবে খালি করে ফেলা হয়েছিল। ২০১১ সালে শক্তিশালী ভূমিকম্প ও ভয়ংকর সুনামিতে কেন্দ্রটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জাপানে সুনামি সতর্কতা জারির পর এক নারী গাড়ি চালিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সময় গাড়ি পাহাড়ের খাড়িতে পড়ে গেলে তিনি মারা যান। সেখানে এখন পর্যন্ত একজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে জানিয়েছে জাপানের গণমাধ্যম।
চিলিতে ১৪ লাখ মানুষকে উঁচু স্থানে সরে যেত বলা হয়েছিল। সেখানে কোনো ক্ষয়ক্ষতি বা হতাহতের ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছেন দেশটির কর্মকর্তারা। চিলির উত্তর উপকূলে মাত্র ২ ফুট উচ্চতার ঢেউ দেখা গেছে।
সুনামিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে রাশিয়ায়। রুশ কর্তৃপক্ষ বলেছে, সেখানে জলোচ্ছ্বাস সেভেরো-কুরিলস্ক শহরের বন্দর প্লাবিত হয়েছে এবং স্থানীয় মাছ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র পানিতে ডুবে গেছে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেখানো ভিডিও ফুটেজে ভবন ও ধ্বংসাবশেষ সমুদ্রের পানির তোড়ে ভেসে যেতে দেখা গেছে।
আরও পড়ুনরাশিয়ার পূর্ব উপকূলীয় এলাকায় ৮.৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প, সুনামি সতর্কতা জারি৩০ জুলাই ২০২৫মেয়র আলেক্সান্ডার ওভস্যাননিকভ বলেছেন, জলোচ্ছ্বাসের পানি শহরের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত পৌঁছায়, যা তটরেখা থেকে প্রায় ৪০০ মিটার দূরে অবস্থিত।
তবে এবারের ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২০১১ সালে হওয়া শক্তিশালী ভূমিকম্পে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় সামান্য। ২০১১ সালের ভূমিকম্প ও সুনামিতে জাপানে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ নিহত হন।
গতকালের ভূমিকম্পের কিছুক্ষণ পরই ক্লিউচেভস্কয় আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত হয় বলে জানিয়েছেন রুশ বিজ্ঞানীরা।
আরও পড়ুনরাশিয়ায় শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর জাপানে সুনামির আঘাত৩০ জুলাই ২০২৫আঞ্চলিক ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ সংস্থা বলেছে, গতকালের ভূমিকম্প ছিল কামচাতকা অঞ্চলে ১৯৫২ সালের পর সবচেয়ে শক্তিশালী। সংস্থাটি ৭ দশমিক ৫ মাত্রা পর্যন্ত পরাঘাতের বিষয়ে সতর্ক করে।
চিলিতে ১৪ লাখ মানুষকে উঁচু স্থানে সরে যেত বলা হয়েছিল। সেখানে কোনো ক্ষতি বা হতাহতের ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছেন দেশটির কর্মকর্তারা। চিলির উত্তর উপকূলে মাত্র ২ ফুট উচ্চতার ঢেউ দেখা গেছে।এদিকে মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) বলেছে, গতকালের ভূমিকম্প ১৯০০ সালের পর রেকর্ডকৃত ১০টি সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পের মধ্যে একটি।
এই ভূমিকম্পের পর রাশিয়ার জনবিরল দূর পূর্বাঞ্চলে একাধিক পরাঘাত অনুভূত হয়। এর একটি ছিল ৬ দশমিক ৯ মাত্রার।
ইউএসজিএস বলেছে, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে অন্তত একটি পরাঘাত ৭ মাত্রার বেশি হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৫৯ শতাংশ।
আরও পড়ুনশক্তিশালী ১০ ভূমিকম্পের দুটিই আঘাত হানে রাশিয়ায়, আজকেরটি কততম২১ ঘণ্টা আগেআরও পড়ুনরাশিয়ার পূর্ব উপকূলে ভূমিকম্প: সরিয়ে নেওয়া হলো ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মীদের৩০ জুলাই ২০২৫