বাংলাদেশ গত এক দশকে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে দক্ষিণ এশিয়ার এক সম্ভাবনাময় অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। ২০১০ সালে যেখানে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) ছিল মাত্র ৯১৩ মিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০১৯ সাল নাগাদ তা ছাড়িয়ে যায় ৩.৬ বিলিয়ন ডলারে। যদিও করোনা-পরবর্তী অভিঘাত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক মন্দার ফলে বিনিয়োগের গতিপথ কিছুটা বাধাগ্রস্ত, তার পরও বাংলাদেশ এখনও শ্রমনির্ভর উৎপাদনশীলতা, ভোক্তাবাজার ও ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য।

এই প্রেক্ষাপটে ‘বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২৫’ একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ, যা সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারক ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সরাসরি সংলাপের সুযোগ তৈরি করেছে। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হলো, ঠিক এমন একটি ইতিবাচক উদ্যোগের সময়েই দেশের কয়েকটি জেলায় ঘটে গেল এমন কিছু ঘটনা, যা আমাদের বিনিয়োগ পরিমণ্ডল নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।
সম্প্রতি ইসরায়েলের গাজায় সামরিক অভিযান এবং এর জবাবে বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদ-প্রতিবেশ গড়ে ওঠার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও অনুষ্ঠিত হয়েছে মিছিল ও বিক্ষোভ। এটি গণতান্ত্রিক পরিসরেরই অংশ। কিন্তু সেই মিছিলের ভেতরে যখন দেখা যায় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড যেমন– কেএফসি, পিৎজা হাট, বাটা কিংবা মেট্রো শুর মতো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ, তখন প্রশ্ন ওঠে, এ দেশে 
কি বিনিয়োগ নিরাপদ? এই প্রশ্ন কেবল বিনিয়োগকারীর নয়, বরং আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্যও।

আমরা ভুলে যাই, এসব আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড আজকের দিনে শুধু বিদেশি প্রতিষ্ঠানের লোগো নয়, বরং এরা বাংলাদেশের বাজারে লোকাল ফ্র্যাঞ্চাইজির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে নিয়োজিত হাজার হাজার বাংলাদেশি তরুণ-তরুণী। তারা কাজ করছেন বিপণন, রন্ধন, গ্রাহকসেবা, সরবরাহ চেইনসহ বিভিন্ন বিভাগে। কাজেই এসব প্রতিষ্ঠানে হামলা মানে একদিকে দেশের অর্থনীতিতে আঘাত, অন্যদিকে 
কর্মসংস্থান বিনষ্ট।

বিনিয়োগকারীর সবচেয়ে বড় চাহিদা হলো ‘নীতি ও নিরাপত্তার স্থিতিশীলতা’। একটি দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, হঠাৎ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি অথবা সামাজিক অস্থিরতা বিদেশি বিনিয়োগকে শুধু ভয়ই দেখায় না; তাদের বিকল্প গন্তব্য খুঁজতে বাধ্য করে। ইতোমধ্যে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া এমনকি সাব-সাহারান আফ্রিকার কিছু দেশ বাংলাদেশকে টেক্কা দেওয়ার মতো প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা বছরে পাঁচটির বেশি, সেসব দেশে এফডিআই প্রবাহ গড়ে ৩০ শতাংশ কমে যায়। বাংলাদেশ যদি সত্যিই ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চায়, তাহলে এ রকম ‘পাবলিক পারসেপশন রিস্ক’ আমাদের দ্রুত সমাধান করতে হবে। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মাঠে নামানো নয়, বরং একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে বিনিয়োগবান্ধব নীতি বাস্তবায়ন জরুরি।

আমাদের যুবসমাজকে বোঝাতে হবে, কোনো ধর্মীয় বা আন্তর্জাতিক ইস্যুতে প্রতিবাদ হতেই পারে। কিন্তু সেটা যেন আমাদের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ডে আঘাত না করে। একটি কেএফসি দোকানে হামলা মানে শুধু একটুখানি শপিংমল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া নয়, বরং সেটি একটি ব্র্যান্ডের কাছে সংকেত– ‘এ দেশে তুমি নিরাপদ নও’। আজকের বিশ্বে বিনিয়োগকারীরা রিটার্নের আগে ঝুঁকি বিশ্লেষণ করেন। এই ঝুঁকি যদি হয় ‘উগ্র জনতায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়’, তাহলে কোনো ট্যাক্স ছাড়, কোনো সস্তা শ্রম কিংবা এক্সপোর্ট ইনসেনটিভও তাদের টানতে পারবে না।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষদের শুধু ঘটনার পর প্রতিক্রিয়া নয়, বরং ঘটনার আগে রক্ষা-পরামর্শমূলক নীতিমালা গঠন করতে হবে। সরকার চাইলে ‘ব্র্যান্ড প্রটেকশন স্কিম’ চালু করতে পারে, যেখানে বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোকে নির্দিষ্ট অঙ্কের বিনিময়ে একটি সরকারি ঝুঁকি-নিরাপত্তা সেবা দেওয়া হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজন কূটনৈতিক যোগাযোগ, যাতে আন্তর্জাতিক মহলে এটি ব্যাখ্যা করা যায়– বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ বিনিয়োগবান্ধব এবং বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে কখনও রাষ্ট্রীয় সমর্থন বা গণমতের প্রতিফলন বলা যাবে না।
আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগ মানে শুধু টাকা আনা নয়। এটি কর্মসংস্থান, প্রযুক্তি হস্তান্তর, মানসম্পন্ন পণ্য ও পরিষেবার উন্নয়ন এবং বৈদেশিক বাজারে প্রবেশাধিকার। এসবের একটিও আমরা হারাতে চাই না। তাই আমাদের আত্মসমালোচনা জরুরি। আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে– বাংলাদেশ ব্যবসার জন্য প্রস্তুত এবং এ দেশে কাউকে হুমকির মুখে পড়তে হবে না।

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত ক আম দ র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

রাজশাহীতে বইমেলায় বিক্রি কম, এখনো আশায় আছেন প্রকাশকেরা

রাজশাহী বিভাগীয় বইমেলার প্রথম তিন দিনে লোকজনের ভিড় থাকলেও বেচাকেনা তেমন হয়নি। এতে অনেক প্রকাশকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তবে আগামী কয়েক দিনে বেচাকেনা বাড়বে বলে আশা করছেন প্রকাশকেরা ও আয়োজক কর্তৃপক্ষ।

গত শুক্রবার রাজশাহী জেলা কালেক্টরেট মাঠে ৯ দিনব্যাপী এই বইমেলার উদ্বোধন করা হয়। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায়, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে এবং রাজশাহী বিভাগীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত এ মেলা চলবে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত। মেলায় ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ৭০টি বেসরকারি প্রকাশনাসহ মোট ৮১টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে মেলা চলছে বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। আর ছুটির দিনে মেলা শুরু হয় বেলা ১১টায়।

উদ্বোধনের আগের দিন বৃষ্টিতে মেলার মাঠ কাদাপানিতে একাকার হয়ে যায়। সেই কর্দমাক্ত পরিবেশেই মেলার উদ্বোধন হয়। দর্শনার্থীদের ভোগান্তি কমাতে পরে প্রতিটি স্টলের সামনে ইট বিছিয়ে দেওয়া হয়। এতে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও বিক্রির খরা কাটেনি বলে জানালেন বিক্রেতারা।

গতকাল রোববার সন্ধ্যায় মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের বিভিন্ন অংশে তখনো পানি জমে আছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত মঞ্চের সামনের প্যান্ডেলেও কাদা। সেখানেই কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা চলছিল, তবে দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতি ছিল নগণ্য। স্টলের সামনে ইটের সলিংয়ের তৈরি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন অনেকে। অনেকে বই দেখছেন।

সূর্যোদয় প্রকাশনীর বিক্রেতা রিপন আলী বলেন, প্রথম দিন তো কাদাপানির মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। তখনো মানুষ ছিলেন। এখন ইট বিছানোর পর আরও বেশি মানুষ আসছেন, ভিড়ও করছেন, কিন্তু বই কিনছেন খুব কম।

ঐতিহ্য প্রকাশনীর স্টলে কাদার ওপর চেয়ার পেতে বসে থাকতে দেখা গেল বিক্রয়কর্মী ও চিত্রশিল্পী অর্ণব পাল সন্তুকে। তিনি বলেন, মানুষ আসছেন, ঘুরে দেখছেন, কিন্তু বিক্রি নেই বললেই চলে। মেলার ব্যবস্থাপনা আরও ভালো হতে পারত। আরেক বিক্রেতা আবদুল্লাহ হীল বাকি জানালেন, এমনও স্টল আছে, যেখানে সারা দিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার বইও বিক্রি হচ্ছে না।

তবে হতাশার ভিড়ে আশার কথাও শোনালেন কেউ কেউ। চট্টগ্রাম থেকে আসা নন্দন বইঘর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী সুব্রত কান্তি চৌধুরী বলেন, বেচাবিক্রি আজ না হোক কাল হবে। মানুষ যে মেলায় এসে বই হাতে নিয়ে দেখছেন, এটাই বড় পাওয়া। এতে তাঁদের মধ্যে বই কেনার আগ্রহ তৈরি হবে।

মেলায় আসা পাঠকদের মধ্যে অবশ্য ভিন্ন চিত্র। দুই সন্তানের জন্য শিশুতোষ বই কিনে এক অভিভাবক বলেন, বাচ্চাদের হাতে বই তুলে দেওয়ার আনন্দটাই অন্য রকম।
মেলা থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপ্যাধ্যায়ের বই কিনেছেন মনির হোসেন। তিনি বলেন, মেলায় একসঙ্গে অনেক বই পাওয়া যায়, যা বই কেনার জন্য দারুণ সুযোগ।

রাজশাহী কালেক্টরেট মাঠে বইমেলা উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছে আলোচনা সভা। গতকাল রোববার সন্ধ্যায়

সম্পর্কিত নিবন্ধ