শ্রীনগর থেকে রওনা হয়েছিলাম দুধপত্রী যাব বলে। মাঝপথে চোখে পড়ে রাস্তার পাশে উনুন বসিয়ে কিছুদূর পরপর ছোট ছোট অস্থায়ী খাবারের দোকান পেতে বসেছেন স্থানীয় নারীরা। চারপাশের মনোরম দৃশ্যের মধ্যে এই জায়গাটা যেন একটু বেশিই ঝকঝকে তকতকে। গাছের নিচের খোলা দোকানগুলোর আশপাশে কোথাও একটা পাতাও পড়ে নেই। যাঁর দোকানের সামনে থামলাম সেই নারীর নাম রাজা বেগম। বেঁকে যাওয়া রাস্তার পাশে এ রকম আর কয়েকটা দোকান। মাথার ওপর বড় রংচঙে বিচ ছাতা। পাশে পাতা বিশাল গালিচা দেখে মনে হয় সঙ্গে তাকিয়া থাকলে যেন ষোলোকলা পূর্ণ হতো। কেউ গালিচায় বসতে না চাইলে তাদের জন্য বসার বেঞ্চও আছে। মহিলার কাছে গিয়ে হিন্দিতে জানতে চাই এগুলো কী ধরনের রুটি। দুর্বোধ্য ভাষায় মহিলার জবাব শুনে বুঝতে পারি এক বর্ণ হিন্দিও জানেন না। অগত্যা আমাদের চলনদার আইউব দোভাষীর দায়িত্ব নেয়। এখানকার সব দোকানের অভিন্ন মেনু হচ্ছে পরোটার মতো দেখতে ঘি দিয়ে সেঁকে দেওয়া মকাই চট অর্থাৎ ভুট্টার রুটি। সাথে সরিষা শাক আর পেঁয়াজের আচার। তারপর চা থাকে তিন রকম– চিনি ছাড়া, চিনি দেওয়া মিষ্টি আর লবণ দেওয়া ‘নুন চাই’, যার যেমন ইচ্ছে। আগে থেকে বানিয়ে রাখা সেই রুটি সেঁকে দেওয়া হলো আমাদের সামনে।
কাশ্মীরের নতুন জমে ওঠা এই জায়গার ওপর এখনও বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর চোখ পড়েনি। তাই রাজা বেগমরা তাদের ঘরে বানানো মকাই চট আর ‘নুন চাই’ খাইয়ে দু-চার পয়সা রোজগারের সুযোগ পাচ্ছেন। আর বেড়াতে আসা মানুষও স্বাদ নিতে পারছেন কাশ্মীরের অথেনটিক খাবারের। তা না হলে তাদের খেতে হতো পাউরুটি আর অমলেট কিংবা চাউমিন। ছোট নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এটা বড় সুযোগ। মুসলমান অধ্যুষিত কাশ্মীরে নারীচালিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কম হলেও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন এখানকার আনপড় নারীরা। তবে তাদের পেছনে রয়েছেন স্বামীরা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টা প্রথমেই চোখে পড়েছিল, পরে জানতে পারি, এতে পৌর কর্তৃপক্ষের কোনো কৃতিত্ব নেই। অস্থায়ী দোকান বসানো নারীরাই এই পরিচ্ছন্নতার প্রধান নায়িকা। উচ্ছিষ্ট কোনো কিছুই ফেলে জায়গাটা নোংরা করেন না কেউ। এমনকি ব্যবহৃত চা পাতাও তারা নিয়ে যান জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। পলিথিনের ব্যবহার একেবারেই নেই। আগে চিপস জাতীয় খাবার রেখেছিলেন কিছুদিন। কিন্তু ক্রেতারা পলিথিনের খালি প্যাকেট যেখানে-সেখানে ফেলে জায়গাটা নোংরা করে ফেলে বলে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পরিবেশ নষ্ট করে এমন জিনিস বিক্রি করবেন না তারা। আগে বড় কোম্পানির প্যাকেট করা রুটিও বিক্রি করতেন কেউ কেউ। কিন্তু নিজেদের জমিতে ফলানো ভুট্টার আটা ব্যবহার করে রুটি বানিয়ে বিক্রি করলে উৎপাদন খরচ কম পড়বে, খদ্দেরের পাতে দেওয়া যাবে তাজা খাবার। সেই বিজনেস মডেলই সফল হয়েছে বলে মনে হলো। এরা কেউই অর্থনীতি বা স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্ট পড়েননি, কিন্তু মার্জিনাল কস্ট বা সাপ্লাই চেইনের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের উপকারিতা আবিষ্কার করে ফেলেছেন নিজেরাই। পরিবেশ সম্পর্কে এদের সচেতনতাকেও কুর্নিশ করতে হয়।
জায়গাটার নাম দুধপাথরী কিংবা দুধপত্রী– সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নয়। সেখানে দুধ না থাকলেও পাথর আছে বেশুমার। কাশ্মীরের শ্রীনগর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরের এই জায়গা কয়েক বছর আগেও খুব পরিচিত ছিল না, এখনও কাশ্মীরের সরকারি পর্যটন ওয়েবসাইটে এই নামটার উল্লেখই নেই। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক মাতবরি নেই বলেই হয়তো জায়গাটা এখনও রয়ে গেছে অনাঘ্রাতা, বিস্তৃত তৃণভূমি আর পাইন দেবদারু গাছে ঘেরা অঞ্চলে এখনও আসেনি আধুনিকতার কৃত্রিমতা। 
জায়গাটার নাম নিয়ে শুরুতেই যে প্রশ্ন জেগেছিল তার জবাব পাওয়া যায় স্থানীয় এক উপকথায়। অনেককাল আগে কাশ্মীর উপত্যকার কোনো এক অঞ্চলে বাস করতেন কবি, গীতিকার ও সুফি সাধক শেখ নূর-উদ্দিন নূরানী। একদিন এই পথ দিয়েই দূরে কোথাও যাচ্ছিলেন তিনি। চলতে চলতে নামাজের সময় হয়ে যায়, ফলে পথের ধারে ঘাসে ঢাকা এক অজানা মাঠে থামতে হয় তাঁকে। কিন্তু নামাজের জন্য অজুর পানি খুঁজে পেলেন না কোথাও। আশপাশে নদী বা ঝরনা কিছুই নেই। অগত্যা ঘাসে ঢাকা জমির কোথাও জল পাওয়া যায় কিনা খোঁজার জন্য মাঠের এখানে সেখানে হাতের লাঠি পুঁতে পুঁতে দেখছিলেন। আর তাতেই এক জায়গা থেকে বেরিয়ে আসে দুধের ধারা। কিন্তু দুধ দিয়ে তো আর অজু হয় না, তাই অনেকটা আপন মনেই যেন বলেন, দুধ খাওয়া যায় কিন্তু অজু তো করা যায় না। এ কথায় দুধের নহর হয়ে যায় পরিষ্কার পানির ধারা। তখন থেকেই জায়গাটার নাম মুখে মুখে হয়ে যায় দুধপাথরী, তারপর দুধপত্রী। এই পানির ধারা থেকে জন্ম হয় শালিগঙ্গা নদীর। এই উপকথায় যারা আস্থা রাখতে পারবেন না, তাদের জন্য আরেকটা বাস্তব ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হতে পারে যে গবাদি পশুর অবারিত চারণভূমির কারণে এখানে প্রচুর দুধ উৎপাদন হয়, আর শালিগঙ্গা নদী খাতে পাওয়া যায় বেশুমার পাথর। এই দুটো মিলে দুধপাথরী নাম হওয়াটাও বিচিত্র নয়।
এগিয়ে যেতে যেতে মনে হয় যেন ইংল্যান্ডের গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। ঢেউ খেলানো প্রান্তরের ঘাস কোনো অদৃশ্য ঘাসকাটা যন্ত্র দিয়ে যেন ছেঁটে দিয়েছে কেউ। সেই নরম মসৃণ ঘাসের গালিচা পেরিয়ে পাইন অরণ্যের কালচে সবুজ প্রাচীর, যেদিকে তাকাই সেদিকই একেকটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। বিরান প্রান্তরের এক জায়গায় বুক ভরে তাজা বাতাস নিয়ে অপার্থিব সুন্দর-শ্যামল পরিবেশের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। গাড়ি থেকে নামতেই পায়ের কাছে সবুজ গালিচা, সামনে তাকালেই ঢেউ খেলানো সবুজ প্রান্তর, পাইন-দেবদারু গাছে ছাওয়া বিজন উপত্যকা। তার ওপর বিছিয়ে রয়েছে স্নিগ্ধ আদুরে রোদ। প্রান্তরের শেষ মাথায় আকাশ নামিয়ে দিয়েছে মসলিনের মতো ফিনফিনে সাদা আঁচল। এখানে প্রকৃতি এখনও অলস, নাগরিক ব্যস্ততাহীন হাঁপধরা নির্জনতার মাঝে দূরের সবুজ মাঠজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঘোড়া আর আলখাল্লা পরা সহিসদেরও যেন বিশেষ তাড়া নেই। এটা হেমন্তের দৃশ্য, তবে শীত নামার পর এই শ্যামলিমা আর থাকবে না, পুরো এলাকা ঢেকে যাবে বরফে। 
চোখে পড়ে নিচের উপত্যকায় সার বেঁধে চলেছে আনাড়ি ঘোড়সওয়ার পর্যটকের দল। প্রতিটি ঘোড়ার সামনে কিংবা পাশে পায়ে হেঁটে চলছে ফিরান গায়ে ঘোড়ার মালিক। চারপাশের নিশ্চল অসহ্য সুন্দর দৃশ্যের মধ্যে সচল অশ্বারোহী বাহিনীর অভিযান একটা ভিন্ন মাত্রা যোগ করে দেয়। অসম্ভব সুন্দরকে বেশি সময় ধরে দেখলে সেটাও একসময় বেশি চিনি দেওয়া চায়ের মতো হয়ে যায়, তাই শালিগঙ্গা নদী দর্শনে যাওয়ার সিদ্ধান্তই ভালো, সেখানে নদীটি অন্তত নিশ্চল নয়। 

এ কী! এখানে নদী কোথায়? বাঁধানো সিঁড়ি বেয়ে বেশ কিছুদূর নেমে যে ঝিরিটির কাছে পৌঁছাই, সেটিকে নদী তো দূরে থাক, খালও বলা যায় না। ছোট-বড় পাথরের ভেতর দিয়ে বড়জোর আট থেকে দশ ফুট চওড়া নালা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ জলের ধারা। তোড়ে নেমে আসা সেই জল পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ে খিলখিল করে হাসছে, উচ্ছ্বাসে হয়ে উঠছে ফেনিল। বড়সড় একটা পাথর বেছে নিয়ে জলের ধারার কাছে বসে থেকে সেই মিষ্টি হাসি শুনে কাটিয়ে দেওয়া যায় দীর্ঘ সময়। শীত মৌসুম এগিয়ে আসার সঙ্গে ক্ষীণতর হয়েছে স্রোতধারা, তবে চওড়া খাত দেখে আন্দাজ করা যায় গ্রীষ্মে বা বর্ষায় এই নদীর চেহারা কেমন হয়। নালাসদৃশ নদীটার ওপর একটা কাঠের সেতু, সেটা পেরিয়ে পাইন বনে যাওয়া যায়, অনেকেই যাচ্ছে, ঘোড়ায় চড়েও যাচ্ছে কেউ কেউ। সেখানে দেখার বিশেষ কিছু নেই, তাই অযথা মেহনত না করে জলের নিক্কন শোনা ঢের ভালো। এপাড়ে খুব ছোট অস্থায়ী দোকান দিয়ে বসেছেন দু-চারজন স্থানীয় মানুষ। তরমুজ, আনারস, আপেল, ফুটি এসব মিলিয়ে ফ্রুট সালাদ তৈরি করছেন সফেদ শ্মশ্রুমণ্ডিত একজন। নিবিষ্টমনে ভুট্টা পোড়াচ্ছিলেন আলীম আহমেদ। জানালেন ভুট্টা পুড়িয়ে চলছেন বিশ বছর। আরেকটা এরকম দোকান আছে তাঁর, সেটা চালাচ্ছেন তাঁর ছেলে। বিশ বছর ধরে এই ব্যবসা করলেও যে ভাগ্য বিশেষ ফেরেনি তাঁর, সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। 
ফেরার পথে রাস্তার পাশের ঢালু মাঠে অদ্ভুত দেখতে কয়েকটা মাটির চালাঘর দেখে আবার নেমে পড়ি। এগুলো স্থানীয় বাসিন্দাদের তৈরি করা মাটির ট্রাডিশনাল ঘর, কাশ্মীরি ভাষায় ‘দোখ’। একপাশের চাল নামিয়ে দেওয়া হয়েছে ঢালের উঁচু অংশের খুব কাছাকাছি। ছাদ তৈরি করতে বিছানো হয় কাঠের কাঠামোর ওপর খড়, তার ওপর পুরু প্লাস্টিকের পর্দা বিছিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় ছয় ইঞ্চি পুরু কাদা দিয়ে। ঘরের দেয়ালও কাঠের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি, তার ওপর কাদার পুরু আস্তর। এখানে শীতে ছয়-সাত ফুট বরফ পড়ে, সে সময় এরকম ঘর না থাকলে প্রচণ্ড ঠান্ডায় মানুষের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ত। পরিত্যক্ত বাড়ির মতো পড়ে থাকা ঘরগুলোতে কোনো মানুষজনের সাড়া পাওয়া যায় না। আশপাশেও জনমনিষ্যির চিহ্ন পাওয়া গেল না। দুপুরের রোদের মধ্যে ঘাসের ওপর একজন মানুষকে নামাজ পড়তে দেখা যায়। লোকটা যে এখানকার বাসিন্দাদের কেউ নয়, সেটা তাঁর পোশাক দেখেই বোঝা যায়। হয়তো আমাদের মতোই কোনো পর্যটক। 
ফিরতে ফিরতে একসময় উধাও হয় দুধপত্রীর শ্যামল প্রান্তর, এখানে রাস্তার দু’পাশে ফসলকাটা রিক্ত মাঠ, তার মাঝে কাটা শস্যের গাদা, সেগুলো পাহারা দিচ্ছে সান্ত্রীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘদেহ পপলার। মাঠের দূর প্রান্তে একাকী আধা পাকা চাষিবাড়ি। পপলার গাছগুলো না থাকলে এই ছবি বাংলাদেশের কোনো ফসলকাটা মাঠ বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। ফেরার রাস্তার ধারেই একের পর এক আপেল বাগান। একটিতে আপেল পাড়া হচ্ছে দেখে থেমে যাই। কোনো কথাবার্তা জানাশোনা ছাড়া আচমকা ভেতরে ঢুকে পড়লে কেমন হবে, ওরাই বা কীভাবে নেবে ব্যাপারটা– ভাবতে ভাবতে সামান্য ইতস্তত করে ভেতরে যাই। কী আর হতে পারে, বড়জোর বের করে দিতে পারে, মারধর তো করবে না। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে ঘাসের ওপর আধশোয়া হয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলছেন একজন। মুখভর্তি কালো দাড়ি, পরনে ফিরান। তাঁর কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে নিজের নাম জানিয়ে হিন্দিতে বলি, আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আপেল পাড়া হচ্ছে দেখে ঢুকে পড়লাম। তিনি ইংরেজিতে বলেন, নো প্রবলেম, ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। ইনিই বাগানের মালিক মোহাম্মদ বিলাল। তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে যাই। গাছে গাছে লালাভ আপেল ধরে আছে বেশুমার, দুই অল্পবয়সী কর্মচারী পাকাগুলো পেড়ে জড়ো করছে এক জায়গায়। ওদের কাজ দেখভাল করছেন বিলাল-পত্নী কাওসার। খুবই সাদামাটা পোশাক তাঁর পরনে। একটু সলজ্জ হেসে গাছ থেকে সদ্য পাড়া লাল আপেল খেতে দেন সবাইকে। একেবারে তাজা সেই আপেল খেয়ে বুঝতে পারলাম বাংলাদেশে বাজার থেকে কেনা আপেলের স্বাদ কেন কখনোই টানে না আমাকে। কখনও মায়ের সঙ্গে কখনও বাবার কাছে ঘুরঘুর করছে আপার কেজিতে পড়া খুব মিষ্টি চেহারার বছর আটেকের মোস্তফা। বাগানের মাঝখানে আপেলের স্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে আমার স্ত্রী কাওসারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমি ওদের দিকে ক্যামেরা তাক করতেই ভদ্রমহিলা দ্রুত সরে যান। আমার স্ত্রী বেশ সাধাসাধি করেও তাঁকে রাজি করাতে পারে না। তাঁর স্বামীটি তখনও ঘাসের ওপর আধশোয়া হয়ে সব লক্ষ্য করছিলেন। ছবি তোলার ব্যাপারটাও বুঝতে পেরে কাশ্মীরি ভাষায় স্ত্রীকে কিছু একটা বলেন। নিশ্চয়ই বলেছিলেন, তোমার সমস্যা কী, বেচারি তোমার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে চাইছেন, দাঁড়ালেই পারো। তা না হলে বেঁকে বসা কাওসার সলজ্জ হেসে ছবি তুলতে রাজি হয়ে যেতেন না। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র স মন র জন য ব যবহ র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

মে দিবস ২০২৫ : শ্রমিক-মালিক ঐক্যে গড়বে নতুন বাংলাদেশ

১৮৮৬ সালের ১ মেÑএকটি দিন, একটি দাবি, আর হাজারো শ্রমিকের আত্মত্যাগের মাধ্যমে ইতিহাসে রক্তাক্ত দাগ কেটে দিয়েছিল যে মুহূর্ত, তা আজ বিশ্বব্যাপী ‘মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। তখনকার দাবিটি ছিল স্রেফ ৮ ঘণ্টা শ্রমের অধিকার। কিন্তু আজ ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে শ্রমিকের দাবি শুধু সময়
নয়Ñমর্যাদা, সুরক্ষা ও ন্যায্যতার প্রশ্নও।

এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য “শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়বো এদেশ নতুন করে”Ñএ যেন সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। উন্নয়নশীল বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই বার্তা কেবল প্রাসঙ্গিক নয়, বরং তা রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও সমাজের জন্য এক যৌথ দিকনির্দেশনা।

বাংলাদেশের শ্রমচিত্র ও বাস্তবতা

বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত শ্রমনির্ভর। তৈরি পোশাক শিল্পে প্রায় ৪০ লাখ, কৃষি ও নির্মাণ খাতে আরও কয়েক কোটি মানুষ নিয়োজিত। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে শ্রমনির্ভর খাত থেকে। কিন্তু যাঁরা এই অর্থনীতির ইঞ্জিন হিসেবে কাজ করছেন, সেই শ্রমিকরা কি পেয়েছেন তাদের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা?

দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনও বহু শ্রমিক পান না ন্যূনতম মজুরি, কর্মস্থলে নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সেবা কিংবা ছুটি সংক্রান্ত মৌলিক সুবিধা। নারী শ্রমিকদের পরিস্থিতি আরও জটিলÑযত্রতত্র হয়রানি, মাতৃত্বকালীন সুবিধার অভাব, কিংবা নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ গড়ে না তোলার ফলে এই খাতেও স্থিতিশীলতা আসছে না।

মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক: দ্বন্দ্ব নয়, দরকার সহমর্মিতা

এক সময় শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক মানেই ছিল দ্বন্দ্ব, ধর্মঘট ও হুমকি। তবে বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতা বলছেÑসহযোগিতাই টেকসই উৎপাদনের চাবিকাঠি। মালিকপক্ষ যখন শ্রমিককে কেবল “ব্যয়” হিসেবে না দেখে “সম্পদ” হিসেবে  বিবেচনা করেন, তখন প্রতিষ্ঠান লাভবান হয়। একইভাবে শ্রমিকও যদি বুঝেন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন মানে তার কর্মস্থলের স্থায়িত্বÑতাহলে দুপক্ষের মধ্যে বিশ্বাসের
ভিত্তি গড়ে ওঠে।

এই বিশ্বাস গঠনের জন্য প্রয়োজন তিনটি স্তম্ভ: 

নীতিগত স্বচ্ছতা Ñ ন্যায্য মজুরি, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা ও চুক্তিভিত্তিক নিরাপত্তা দায়িত্বশীল মালিকপক্ষ Ñ কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্যসেবা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিতে উদ্যোগ সচেতন শ্রমিকশ্রেণি Ñ অধিকার আদায়ের পাশাপাশি কর্তব্য পালনের মানসিকতা

নীতি ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ ও সংশোধিত ২০১৮ সংস্করণ অনুযায়ী শ্রমিকের অধিকার স্বীকৃত হলেও বাস্তবায়নের জায়গায় ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে  অনানুষ্ঠানিক খাতে (যেমন কৃষি, গৃহপরিচারিকা, গিগ-ওয়ার্কার) শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়টি এখনও প্রায় উপেক্ষিত।

এছাড়া, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, দুর্ঘটনা বীমা, এবং পুনঃপ্রশিক্ষণের ব্যবস্থাপনা আরও জোরদার হওয়া জরুরি। সরকার শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠন করলেও তা অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

এই প্রেক্ষাপটে ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে’ দেশ গড়ার বার্তাটি যেন শুধুই স্লোগানে সীমাবদ্ধ না থাকে। বরং এটি হোক রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আর্থিক বিনিয়োগ ও মানবিক বিবেচনার এক বাস্তব প্ল্যাটফর্ম।
প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ ও নতুন শ্রম বাস্তবতা

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রেক্ষাপটে শ্রমবাজার দ্রুত বদলে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অটোমেশন ও গিগ-ইকোনমি অনেক চাকরি বিলুপ্ত করছে, আবার নতুন দক্ষতা চাচ্ছে। বাংলাদেশ যদি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চায়, তাহলে  শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ, পুনঃস্কিলিং এবং ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।

এখানে মালিক ও রাষ্ট্র উভয়ের উচিত হবে, শ্রমিককে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে বিনিয়োগ করা, কারণ দক্ষ শ্রমিক ছাড়া কোনো শিল্পই টিকে থাকে না।

মে দিবস: উৎসব নয়, দায়বদ্ধতার প্রতীক

মে দিবস কেবল লাল পতাকা হাতে শোভাযাত্রার দিন নয়, এটি আমাদের মানবিক চেতনার প্রতিফলন। যে শ্রমিক ঘাম ঝরিয়ে ভবন গড়ে, কৃষি জমি চষে, রপ্তানি পণ্য তৈরি করেÑতার জন্য আমাদের উচিত মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করা।

এবছর, আসুন আমরা সবাই রাষ্ট্র, মালিকপক্ষ ও শ্রমিকÑএকটি মানবিক, উৎপাদনশীল ও  শীদারিত্বভিত্তিক সমাজ গঠনের পথে এগিয়ে যাই। শ্রমিকের হাতে গড়া এই বাংলাদেশ হোক তার জন্যই গর্বের জায়গা। 


লেখক পরিচিতি:

মীযানুর রহমান
সাংবাদিক ও সমাজ বিশ্লেষক
মোবাইলঃ ০১৭৫৪১০৯০৭২
যোগাযোগ: : [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • চিনি-লবণের অনুপম পাঠ
  • মে দিবস ২০২৫ : শ্রমিক-মালিক ঐক্যে গড়বে নতুন বাংলাদেশ
  • বিদ্যালয়ের ১৮টি গাছ বিক্রি করলেন প্রধান শিক্ষক 
  • কর্ণাটকে ক্রিকেট খেলার সময় বচসা, যুবককে পিটিয়ে হত্যা
  • দেশে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ে চালুর দাবি 
  • রাখাইন রাজ্যে ‘মানবিক করিডোর’ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিলেন প্রেস সচিব
  • কানাডায় আবারও লিবারেল পার্টির সরকার গঠনের আভাস