দুধপত্রীর নারী উদ্যোক্তারা ও ক্ষীণাঙ্গী শালিগঙ্গা
Published: 17th, April 2025 GMT
শ্রীনগর থেকে রওনা হয়েছিলাম দুধপত্রী যাব বলে। মাঝপথে চোখে পড়ে রাস্তার পাশে উনুন বসিয়ে কিছুদূর পরপর ছোট ছোট অস্থায়ী খাবারের দোকান পেতে বসেছেন স্থানীয় নারীরা। চারপাশের মনোরম দৃশ্যের মধ্যে এই জায়গাটা যেন একটু বেশিই ঝকঝকে তকতকে। গাছের নিচের খোলা দোকানগুলোর আশপাশে কোথাও একটা পাতাও পড়ে নেই। যাঁর দোকানের সামনে থামলাম সেই নারীর নাম রাজা বেগম। বেঁকে যাওয়া রাস্তার পাশে এ রকম আর কয়েকটা দোকান। মাথার ওপর বড় রংচঙে বিচ ছাতা। পাশে পাতা বিশাল গালিচা দেখে মনে হয় সঙ্গে তাকিয়া থাকলে যেন ষোলোকলা পূর্ণ হতো। কেউ গালিচায় বসতে না চাইলে তাদের জন্য বসার বেঞ্চও আছে। মহিলার কাছে গিয়ে হিন্দিতে জানতে চাই এগুলো কী ধরনের রুটি। দুর্বোধ্য ভাষায় মহিলার জবাব শুনে বুঝতে পারি এক বর্ণ হিন্দিও জানেন না। অগত্যা আমাদের চলনদার আইউব দোভাষীর দায়িত্ব নেয়। এখানকার সব দোকানের অভিন্ন মেনু হচ্ছে পরোটার মতো দেখতে ঘি দিয়ে সেঁকে দেওয়া মকাই চট অর্থাৎ ভুট্টার রুটি। সাথে সরিষা শাক আর পেঁয়াজের আচার। তারপর চা থাকে তিন রকম– চিনি ছাড়া, চিনি দেওয়া মিষ্টি আর লবণ দেওয়া ‘নুন চাই’, যার যেমন ইচ্ছে। আগে থেকে বানিয়ে রাখা সেই রুটি সেঁকে দেওয়া হলো আমাদের সামনে।
কাশ্মীরের নতুন জমে ওঠা এই জায়গার ওপর এখনও বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর চোখ পড়েনি। তাই রাজা বেগমরা তাদের ঘরে বানানো মকাই চট আর ‘নুন চাই’ খাইয়ে দু-চার পয়সা রোজগারের সুযোগ পাচ্ছেন। আর বেড়াতে আসা মানুষও স্বাদ নিতে পারছেন কাশ্মীরের অথেনটিক খাবারের। তা না হলে তাদের খেতে হতো পাউরুটি আর অমলেট কিংবা চাউমিন। ছোট নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এটা বড় সুযোগ। মুসলমান অধ্যুষিত কাশ্মীরে নারীচালিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কম হলেও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন এখানকার আনপড় নারীরা। তবে তাদের পেছনে রয়েছেন স্বামীরা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টা প্রথমেই চোখে পড়েছিল, পরে জানতে পারি, এতে পৌর কর্তৃপক্ষের কোনো কৃতিত্ব নেই। অস্থায়ী দোকান বসানো নারীরাই এই পরিচ্ছন্নতার প্রধান নায়িকা। উচ্ছিষ্ট কোনো কিছুই ফেলে জায়গাটা নোংরা করেন না কেউ। এমনকি ব্যবহৃত চা পাতাও তারা নিয়ে যান জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। পলিথিনের ব্যবহার একেবারেই নেই। আগে চিপস জাতীয় খাবার রেখেছিলেন কিছুদিন। কিন্তু ক্রেতারা পলিথিনের খালি প্যাকেট যেখানে-সেখানে ফেলে জায়গাটা নোংরা করে ফেলে বলে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পরিবেশ নষ্ট করে এমন জিনিস বিক্রি করবেন না তারা। আগে বড় কোম্পানির প্যাকেট করা রুটিও বিক্রি করতেন কেউ কেউ। কিন্তু নিজেদের জমিতে ফলানো ভুট্টার আটা ব্যবহার করে রুটি বানিয়ে বিক্রি করলে উৎপাদন খরচ কম পড়বে, খদ্দেরের পাতে দেওয়া যাবে তাজা খাবার। সেই বিজনেস মডেলই সফল হয়েছে বলে মনে হলো। এরা কেউই অর্থনীতি বা স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্ট পড়েননি, কিন্তু মার্জিনাল কস্ট বা সাপ্লাই চেইনের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের উপকারিতা আবিষ্কার করে ফেলেছেন নিজেরাই। পরিবেশ সম্পর্কে এদের সচেতনতাকেও কুর্নিশ করতে হয়।
জায়গাটার নাম দুধপাথরী কিংবা দুধপত্রী– সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নয়। সেখানে দুধ না থাকলেও পাথর আছে বেশুমার। কাশ্মীরের শ্রীনগর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরের এই জায়গা কয়েক বছর আগেও খুব পরিচিত ছিল না, এখনও কাশ্মীরের সরকারি পর্যটন ওয়েবসাইটে এই নামটার উল্লেখই নেই। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক মাতবরি নেই বলেই হয়তো জায়গাটা এখনও রয়ে গেছে অনাঘ্রাতা, বিস্তৃত তৃণভূমি আর পাইন দেবদারু গাছে ঘেরা অঞ্চলে এখনও আসেনি আধুনিকতার কৃত্রিমতা।
জায়গাটার নাম নিয়ে শুরুতেই যে প্রশ্ন জেগেছিল তার জবাব পাওয়া যায় স্থানীয় এক উপকথায়। অনেককাল আগে কাশ্মীর উপত্যকার কোনো এক অঞ্চলে বাস করতেন কবি, গীতিকার ও সুফি সাধক শেখ নূর-উদ্দিন নূরানী। একদিন এই পথ দিয়েই দূরে কোথাও যাচ্ছিলেন তিনি। চলতে চলতে নামাজের সময় হয়ে যায়, ফলে পথের ধারে ঘাসে ঢাকা এক অজানা মাঠে থামতে হয় তাঁকে। কিন্তু নামাজের জন্য অজুর পানি খুঁজে পেলেন না কোথাও। আশপাশে নদী বা ঝরনা কিছুই নেই। অগত্যা ঘাসে ঢাকা জমির কোথাও জল পাওয়া যায় কিনা খোঁজার জন্য মাঠের এখানে সেখানে হাতের লাঠি পুঁতে পুঁতে দেখছিলেন। আর তাতেই এক জায়গা থেকে বেরিয়ে আসে দুধের ধারা। কিন্তু দুধ দিয়ে তো আর অজু হয় না, তাই অনেকটা আপন মনেই যেন বলেন, দুধ খাওয়া যায় কিন্তু অজু তো করা যায় না। এ কথায় দুধের নহর হয়ে যায় পরিষ্কার পানির ধারা। তখন থেকেই জায়গাটার নাম মুখে মুখে হয়ে যায় দুধপাথরী, তারপর দুধপত্রী। এই পানির ধারা থেকে জন্ম হয় শালিগঙ্গা নদীর। এই উপকথায় যারা আস্থা রাখতে পারবেন না, তাদের জন্য আরেকটা বাস্তব ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হতে পারে যে গবাদি পশুর অবারিত চারণভূমির কারণে এখানে প্রচুর দুধ উৎপাদন হয়, আর শালিগঙ্গা নদী খাতে পাওয়া যায় বেশুমার পাথর। এই দুটো মিলে দুধপাথরী নাম হওয়াটাও বিচিত্র নয়।
এগিয়ে যেতে যেতে মনে হয় যেন ইংল্যান্ডের গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। ঢেউ খেলানো প্রান্তরের ঘাস কোনো অদৃশ্য ঘাসকাটা যন্ত্র দিয়ে যেন ছেঁটে দিয়েছে কেউ। সেই নরম মসৃণ ঘাসের গালিচা পেরিয়ে পাইন অরণ্যের কালচে সবুজ প্রাচীর, যেদিকে তাকাই সেদিকই একেকটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। বিরান প্রান্তরের এক জায়গায় বুক ভরে তাজা বাতাস নিয়ে অপার্থিব সুন্দর-শ্যামল পরিবেশের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। গাড়ি থেকে নামতেই পায়ের কাছে সবুজ গালিচা, সামনে তাকালেই ঢেউ খেলানো সবুজ প্রান্তর, পাইন-দেবদারু গাছে ছাওয়া বিজন উপত্যকা। তার ওপর বিছিয়ে রয়েছে স্নিগ্ধ আদুরে রোদ। প্রান্তরের শেষ মাথায় আকাশ নামিয়ে দিয়েছে মসলিনের মতো ফিনফিনে সাদা আঁচল। এখানে প্রকৃতি এখনও অলস, নাগরিক ব্যস্ততাহীন হাঁপধরা নির্জনতার মাঝে দূরের সবুজ মাঠজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঘোড়া আর আলখাল্লা পরা সহিসদেরও যেন বিশেষ তাড়া নেই। এটা হেমন্তের দৃশ্য, তবে শীত নামার পর এই শ্যামলিমা আর থাকবে না, পুরো এলাকা ঢেকে যাবে বরফে।
চোখে পড়ে নিচের উপত্যকায় সার বেঁধে চলেছে আনাড়ি ঘোড়সওয়ার পর্যটকের দল। প্রতিটি ঘোড়ার সামনে কিংবা পাশে পায়ে হেঁটে চলছে ফিরান গায়ে ঘোড়ার মালিক। চারপাশের নিশ্চল অসহ্য সুন্দর দৃশ্যের মধ্যে সচল অশ্বারোহী বাহিনীর অভিযান একটা ভিন্ন মাত্রা যোগ করে দেয়। অসম্ভব সুন্দরকে বেশি সময় ধরে দেখলে সেটাও একসময় বেশি চিনি দেওয়া চায়ের মতো হয়ে যায়, তাই শালিগঙ্গা নদী দর্শনে যাওয়ার সিদ্ধান্তই ভালো, সেখানে নদীটি অন্তত নিশ্চল নয়।
এ কী! এখানে নদী কোথায়? বাঁধানো সিঁড়ি বেয়ে বেশ কিছুদূর নেমে যে ঝিরিটির কাছে পৌঁছাই, সেটিকে নদী তো দূরে থাক, খালও বলা যায় না। ছোট-বড় পাথরের ভেতর দিয়ে বড়জোর আট থেকে দশ ফুট চওড়া নালা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ জলের ধারা। তোড়ে নেমে আসা সেই জল পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ে খিলখিল করে হাসছে, উচ্ছ্বাসে হয়ে উঠছে ফেনিল। বড়সড় একটা পাথর বেছে নিয়ে জলের ধারার কাছে বসে থেকে সেই মিষ্টি হাসি শুনে কাটিয়ে দেওয়া যায় দীর্ঘ সময়। শীত মৌসুম এগিয়ে আসার সঙ্গে ক্ষীণতর হয়েছে স্রোতধারা, তবে চওড়া খাত দেখে আন্দাজ করা যায় গ্রীষ্মে বা বর্ষায় এই নদীর চেহারা কেমন হয়। নালাসদৃশ নদীটার ওপর একটা কাঠের সেতু, সেটা পেরিয়ে পাইন বনে যাওয়া যায়, অনেকেই যাচ্ছে, ঘোড়ায় চড়েও যাচ্ছে কেউ কেউ। সেখানে দেখার বিশেষ কিছু নেই, তাই অযথা মেহনত না করে জলের নিক্কন শোনা ঢের ভালো। এপাড়ে খুব ছোট অস্থায়ী দোকান দিয়ে বসেছেন দু-চারজন স্থানীয় মানুষ। তরমুজ, আনারস, আপেল, ফুটি এসব মিলিয়ে ফ্রুট সালাদ তৈরি করছেন সফেদ শ্মশ্রুমণ্ডিত একজন। নিবিষ্টমনে ভুট্টা পোড়াচ্ছিলেন আলীম আহমেদ। জানালেন ভুট্টা পুড়িয়ে চলছেন বিশ বছর। আরেকটা এরকম দোকান আছে তাঁর, সেটা চালাচ্ছেন তাঁর ছেলে। বিশ বছর ধরে এই ব্যবসা করলেও যে ভাগ্য বিশেষ ফেরেনি তাঁর, সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না।
ফেরার পথে রাস্তার পাশের ঢালু মাঠে অদ্ভুত দেখতে কয়েকটা মাটির চালাঘর দেখে আবার নেমে পড়ি। এগুলো স্থানীয় বাসিন্দাদের তৈরি করা মাটির ট্রাডিশনাল ঘর, কাশ্মীরি ভাষায় ‘দোখ’। একপাশের চাল নামিয়ে দেওয়া হয়েছে ঢালের উঁচু অংশের খুব কাছাকাছি। ছাদ তৈরি করতে বিছানো হয় কাঠের কাঠামোর ওপর খড়, তার ওপর পুরু প্লাস্টিকের পর্দা বিছিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় ছয় ইঞ্চি পুরু কাদা দিয়ে। ঘরের দেয়ালও কাঠের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি, তার ওপর কাদার পুরু আস্তর। এখানে শীতে ছয়-সাত ফুট বরফ পড়ে, সে সময় এরকম ঘর না থাকলে প্রচণ্ড ঠান্ডায় মানুষের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ত। পরিত্যক্ত বাড়ির মতো পড়ে থাকা ঘরগুলোতে কোনো মানুষজনের সাড়া পাওয়া যায় না। আশপাশেও জনমনিষ্যির চিহ্ন পাওয়া গেল না। দুপুরের রোদের মধ্যে ঘাসের ওপর একজন মানুষকে নামাজ পড়তে দেখা যায়। লোকটা যে এখানকার বাসিন্দাদের কেউ নয়, সেটা তাঁর পোশাক দেখেই বোঝা যায়। হয়তো আমাদের মতোই কোনো পর্যটক।
ফিরতে ফিরতে একসময় উধাও হয় দুধপত্রীর শ্যামল প্রান্তর, এখানে রাস্তার দু’পাশে ফসলকাটা রিক্ত মাঠ, তার মাঝে কাটা শস্যের গাদা, সেগুলো পাহারা দিচ্ছে সান্ত্রীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘদেহ পপলার। মাঠের দূর প্রান্তে একাকী আধা পাকা চাষিবাড়ি। পপলার গাছগুলো না থাকলে এই ছবি বাংলাদেশের কোনো ফসলকাটা মাঠ বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। ফেরার রাস্তার ধারেই একের পর এক আপেল বাগান। একটিতে আপেল পাড়া হচ্ছে দেখে থেমে যাই। কোনো কথাবার্তা জানাশোনা ছাড়া আচমকা ভেতরে ঢুকে পড়লে কেমন হবে, ওরাই বা কীভাবে নেবে ব্যাপারটা– ভাবতে ভাবতে সামান্য ইতস্তত করে ভেতরে যাই। কী আর হতে পারে, বড়জোর বের করে দিতে পারে, মারধর তো করবে না। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে ঘাসের ওপর আধশোয়া হয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলছেন একজন। মুখভর্তি কালো দাড়ি, পরনে ফিরান। তাঁর কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে নিজের নাম জানিয়ে হিন্দিতে বলি, আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আপেল পাড়া হচ্ছে দেখে ঢুকে পড়লাম। তিনি ইংরেজিতে বলেন, নো প্রবলেম, ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। ইনিই বাগানের মালিক মোহাম্মদ বিলাল। তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে যাই। গাছে গাছে লালাভ আপেল ধরে আছে বেশুমার, দুই অল্পবয়সী কর্মচারী পাকাগুলো পেড়ে জড়ো করছে এক জায়গায়। ওদের কাজ দেখভাল করছেন বিলাল-পত্নী কাওসার। খুবই সাদামাটা পোশাক তাঁর পরনে। একটু সলজ্জ হেসে গাছ থেকে সদ্য পাড়া লাল আপেল খেতে দেন সবাইকে। একেবারে তাজা সেই আপেল খেয়ে বুঝতে পারলাম বাংলাদেশে বাজার থেকে কেনা আপেলের স্বাদ কেন কখনোই টানে না আমাকে। কখনও মায়ের সঙ্গে কখনও বাবার কাছে ঘুরঘুর করছে আপার কেজিতে পড়া খুব মিষ্টি চেহারার বছর আটেকের মোস্তফা। বাগানের মাঝখানে আপেলের স্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে আমার স্ত্রী কাওসারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমি ওদের দিকে ক্যামেরা তাক করতেই ভদ্রমহিলা দ্রুত সরে যান। আমার স্ত্রী বেশ সাধাসাধি করেও তাঁকে রাজি করাতে পারে না। তাঁর স্বামীটি তখনও ঘাসের ওপর আধশোয়া হয়ে সব লক্ষ্য করছিলেন। ছবি তোলার ব্যাপারটাও বুঝতে পেরে কাশ্মীরি ভাষায় স্ত্রীকে কিছু একটা বলেন। নিশ্চয়ই বলেছিলেন, তোমার সমস্যা কী, বেচারি তোমার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে চাইছেন, দাঁড়ালেই পারো। তা না হলে বেঁকে বসা কাওসার সলজ্জ হেসে ছবি তুলতে রাজি হয়ে যেতেন না।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র স মন র জন য ব যবহ র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
স্বপ্নে হলো দেখা
কারও স্বপ্নে আপনি প্রবেশ করেছেন বা অন্য কেউ আপনার স্বপ্নে এসেছেন, তাও তখন, যখন আপনি স্বপ্নে নিজের ইচ্ছায় পরিচালিত হচ্ছেন– এমনটা কি কখনও ভেবেছেন? বিজ্ঞানীদের দাবি– একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এমনটিই করেছেন তারা, যেখানে দু’জন মানুষের মধ্যে স্বপ্নের ভেতরে যোগাযোগ সম্ভব হয়েছে। এমনটি সত্যি হয়ে থাকলে এটিই হবে প্রথমবারের মতো ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখার সময় একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের প্রমাণ– যা এখনও বিজ্ঞানের কাছে এক রহস্য।
ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক নিউরোটেক কোম্পানি রেমস্পেস, যারা মূলত লুসিড ড্রিমিং (স্বপ্নের মধ্যে সচেতন থাকা) ও ঘুমের বিকাশ নিয়ে কাজ করে। তারা জানিয়েছে, ইতোমধ্যে দু’বার দু’জন ব্যক্তিকে লুসিড ড্রিমে প্রবেশ করিয়ে একটি সাধারণ বার্তা আদান-প্রদান করাতে পেরেছে।
কল্পকাহিনির মতো এক স্বপ্নপরীক্ষা
রেমস্পেসের গবেষকরা দাবি করেন, তারা এমন এক প্রযুক্তি তৈরি করেছেন; যার মাধ্যমে দু’জন ব্যক্তি লুসিড ড্রিম অবস্থায় একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছেন। স্বপ্ন এখনও মানবতার জন্য এক বিশাল রহস্য। ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্কে বিভিন্ন উজ্জ্বল ভাবনা, দৃশ্য, অনুভূতি ও কল্পনা গঠিত হয়। আমরা প্রায় সবাই স্বপ্ন দেখি, যদিও ঘুম ভাঙার পর তা মনে থাকে না। বিজ্ঞানীরা বলেন, স্বপ্নের মাধ্যমে মস্তিষ্ক আমাদের অনুভূতি ও চিন্তা প্রক্রিয়া করে, স্মৃতি দর্শন করে এবং বাস্তব জীবনে এর প্রস্তুতি নেয়।
স্বপ্নের মাধ্যমে যোগাযোগ
রেমস্পেসের দাবি, গত ২৪ সেপ্টেম্বর, গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা নিজ নিজ বাড়িতে ঘুমাচ্ছিলেন, তখন রেমস্পেসের তৈরি বিশেষ যন্ত্র ওয়াইফাইয়ের মাধ্যমে দূর থেকে তাদের মস্তিষ্কের তরঙ্গ, রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা, হৃদস্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাস রেকর্ড করে। যখন তাদের সার্ভার শনাক্ত করে যে, একজন অংশগ্রহণকারী লুসিড ড্রিমে প্রবেশ করেছে, তখন তারা একটি র্যানডম শব্দ তৈরি করে সেটি কানে দেওয়া ইয়ারবাডের মাধ্যমে তাকে শুনিয়ে দেয়। কোম্পানি শব্দটি প্রকাশ করেনি– এটি শুধু ওই ব্যক্তি জানতেন এবং স্বপ্নে পুনরায় উচ্চারণ করেন বলে দাবি করা হয়েছে। এরপর সেই প্রতিক্রিয়া সার্ভারে সংরক্ষণ করা হয়। আট মিনিট পরে, দ্বিতীয় অংশগ্রহণকারী লুসিড ড্রিমে প্রবেশ করলে, সার্ভার থেকে তাঁকে সেই রেকর্ডকৃত বার্তা পাঠানো হয়, যা তিনি ঘুম থেকে উঠে বলেন এভাবেই স্বপ্নে প্রথমবারের মতো একটি ‘যোগাযোগ’ সম্পন্ন হয়। রেমস্পেস জানায়, ‘আমরা একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক অর্জন করেছি, এতে লুসিড ড্রিমের মাধ্যমে মানবযোগাযোগ ও সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।’
লুসিড ড্রিম কী?
লুসিড ড্রিম তখন হয়, যখন কোনো ব্যক্তি স্বপ্ন দেখার সময় সচেতন থাকেন যে, তিনি স্বপ্ন দেখছেন। ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক জানায়, এটি সাধারণত ঘুমের ‘র্যাপিড আই মুভমেন্ট’ ধাপে ঘটে, যেখানে সবচেয়ে প্রাণবন্ত স্বপ্ন দেখা যায়। এ অবস্থায় মানুষ নিজের ইচ্ছেমতো স্বপ্নে কাজ করতে পারেন, পরিকল্পিতভাবে কিছু করতে পারেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল চৌধুরী বলেন, ‘যে কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো– যে তথ্যগুলো পাওয়া যাচ্ছে, তা কতটা নির্ভরযোগ্য। অর্থাৎ, এই গবেষণা অন্য কেউ অন্য কোনো জায়গায় করলে একই ফল দেবে কিনা। ঘুমের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়টা নিশ্চিত হতে আরও গবেষণার দরকার।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, মোটা দাগে ঘুমের দুইটা ভাগ আছে– এক. ননরেম ঘুম, যখন আমাদের চোখের মণি নড়ে না; দুই. রেম ঘুম, এ পর্বে আমাদের চোখের মণি নড়াচড়া করে। এ সময়ে মানুষ স্বপ্ন দেখে। এই স্বপ্নও দুই রকমের। লুসিড ড্রিম; যে স্বপ্নগুলো একদম বাস্তবের মতো জলজ্যান্ত। এমন এক স্বপ্ন যা দেখার পর ঘুম থেকে উঠে মনে হবে আসলেই এমনটি ঘটেছে, এটি বাস্তব। আরেকটি স্বপ্ন হলো নন লুসিড ড্রিম। এ স্বপ্নগুলো অবাস্তব। ঘুম ভাঙার পর বেশির ভাগ সময়েই আমরা স্বপ্নের কথা মনে করতে পারি না। লুসিড ড্রিমের ক্ষেত্রে আমরা তা মনে রাখতে পারি।’
প্রথম পরীক্ষার সাফল্যের পর, রেমস্পেসের সিইও মাইকেল রাদুগা (৪০) দাবি করেন, গত ৮ অক্টোবর আরও দু’জনের সঙ্গে একই ধরনের যোগাযোগ সম্ভব হয়। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আগে স্বপ্নে যোগাযোগ ছিল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, আগামী দিনে এটা এতটাই স্বাভাবিক হয়ে যাবে যে, আমাদের জীবনে এটি ছাড়া কল্পনাই করা যাবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, র্যাপিড আই মুভমেন্ট বা আরইএম ঘুম এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়, লুসিড ড্রিম আগামী দিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পর বড় শিল্প হতে যাচ্ছে।’
যদিও রেমস্পেস এখনও জানায়নি তাদের প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করে, তবে তারা সম্প্রতি ফেসবুকে জানিয়েছে, ‘লুসিড ড্রিমে যোগাযোগ’ নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রস্তুত হয়েছে এবং তা একটি বৈজ্ঞানিক জার্নালে পর্যালোচনার জন্য জমা দেওয়া হয়েছে– প্রকাশ হতে সময় লাগবে দুই থেকে ছয় মাস। তবে এখনও এই প্রযুক্তির কোনো বাহ্যিক বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা হয়নি এবং অন্য কেউ এ পরীক্ষা পুনরাবৃত্তি করতে পারেননি।
রাদুগা যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম আমেরিকান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনকে বলেছেন, তাঁর প্রত্যাশা– এ ধরনের প্রযুক্তি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মোবাইল ফোনের মতো সাধারণ হয়ে যাবে। ‘মানুষ নিজেদের জীবন এসব ছাড়া কল্পনা করতে পারবে না, কারণ এটি তাদের জীবনকে আরও উজ্জ্বল, আরও বৈচিত্র্যময় করে তুলবে। এটি মানুষের জীবনমান এমনভাবে বাড়িয়ে দেবে যে, তারা এটি ছাড়া নিজেদের কল্পনাই করতে পারবে না। আমাদের শুধু এগুলো উন্নত করতে হবে– এটি শুধু সময়ের ব্যাপার।’
২০০৭ সালে রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় রেমস্পেস এবং ছয় মাস আগে যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হয়, এখন লুসিড ড্রিমিংয়ে অভিজ্ঞ বা আগ্রহী নতুন অংশগ্রহণকারীদের খুঁজছে।
স্বপ্ন-যোগাযোগের ভবিষ্যৎ
ঘুমের মধ্যে মানুষের যোগাযোগ একসময়ে নিছক কল্পবিজ্ঞান মনে হতো। এখন বিজ্ঞান এটিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছে। কল্পনা করুন– হাতের ফোনে মেসেজ না পাঠিয়ে, সরাসরি কারও স্বপ্নে ঢুকে তাঁর সঙ্গে ঘুমের মধ্যে সময় কাটানো, কথা বলা যাচ্ছে।
এই ভাবনা যেন স্বপ্নের মতো। ইতোমধ্যে কিছু কোম্পানি মানুষের চেতনা একটি বিকল্প পরিবেশে স্থানান্তরের প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। একবার তা সফল হলে, সম্ভাবনার কোনো শেষ থাকবে না– মানবসভ্যতার বিবর্তন নতুন ধাপে প্রবেশ করবে।
লুসিড ড্রিমের মাধ্যমে নানারকম প্রয়োগ সম্ভব– শরীরগত সমস্যা সমাধান থেকে শুরু করে দক্ষতা অর্জন পর্যন্ত। আগের এক গবেষণায় রেমস্পেস দেখিয়েছে, মুখের পেশিতে সূক্ষ্ম সাড়া থেকে স্বপ্নে উচ্চারিত শব্দ শনাক্ত করা সম্ভব। এখান থেকেই ‘রেমিও’ নামে এক স্বপ্ন-ভাষার জন্ম, যা সেন্সরের মাধ্যমে শনাক্ত করা যায়।
লুসিড ড্রিমে যে র্যানডম শব্দ শোনানো হয় অংশগ্রহণকারীদের, সেখানে ‘রেমিও’ স্বপ্ন-ভাষা ব্যবহার করা হয়। রেমস্পেস জানায়, এই সাফল্য এসেছে পাঁচ বছরের গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নের পর। গবেষকরা প্রথম পরীক্ষার পর থেকে প্রতিটি পর্যায়ে প্রযুক্তি আরও উন্নত করেছেন। এবার তাদের লক্ষ্য আরও বড়– লুসিড ড্রিমে রিয়েল-টাইম যোগাযোগ। যদিও এটি অনেক জটিল, গবেষকদের আশা, আগামী কয়েক মাসেই তারা সফল হবেন।
শেষ কথা
যেখানে স্বপ্নে যোগাযোগ এতদিন ছিল সায়েন্স ফিকশন সিনেমা বা উপন্যাসের বিষয়; এই পরীক্ষা সেটিকে বাস্তবের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। যদি অন্যান্য বিজ্ঞানী ও প্রতিষ্ঠান একে যাচাই করে, তবে এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ধরনই বদলে দিতে পারে– যেখানে ঘুমের মাঝেও আমরা অন্যের সঙ্গে কথা বলতে পারব। এখনই অতি উত্তেজিত না হয়ে সতর্ক আশাবাদী হওয়াই ভালো– প্রযুক্তিটির সাফল্য এখনও গবেষণাগারে পর্যালোচনার অপেক্ষায়; তাতেও একে পুরোপুরি বাস্তব করতে দশককাল লেগে যেতে পারে। v