বাংলাদেশের পাকিস্তান সফর তাহলে কি পিছিয়েই যাচ্ছে
Published: 9th, May 2025 GMT
পাঁচটি টি–টোয়েন্টি খেলতে চলতি মাসেই পাকিস্তান সফরে যাওয়ার কথা বাংলাদেশ দলের। তবে ভারত–পাকিস্তান সংঘাতের জেরে সফরটি পিছিয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছে পাকিস্তানের জিও নিউজ। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) পাকিস্তানে দল পাঠাবে কি না, এমন প্রশ্ন ছাড়িয়েও সামনে চলে আসছে পিসিবির বাস্তবতা।
এরই মধ্যে পাকিস্তান সুপার লিগের (পিএসএল) বাকি ম্যাচ সংযুক্ত আরব আমিরাতে স্থানান্তর করা হয়েছে। দিনক্ষণ চূড়ান্ত না হলেও ম্যাচগুলো চলতি মাসেই শেষ করা হতে পারে। আর সেটি করতে গেলে ২৫ মে শুরু বাংলাদেশ–পাকিস্তান টি–টোয়েন্টি সিরিজ পেছাতেই হবে।
বাংলাদেশ দলের পাকিস্তানে যাওয়ার কথা ২১ মে। তার আগে ১৮ মে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা পিএসএলের এবারের আসর। তবে রাওয়ালপিন্ডি স্টেডিয়াম এলাকায় ড্রোন হামলার পর পাকিস্তানে পিএসএল আয়োজন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় টুর্নামেন্ট সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
সূত্রের বরাতে জিও নিউজ জানিয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে পিএসএলের ম্যাচ চালু করতে এক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। কারণ, সম্প্রচারসহ বিভিন্ন লজিস্টিক্যাল বিষয় স্থানান্তরের ব্যাপার রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই পিএসএলের বাকি ৮ ম্যাচ শেষ হতে হতে বাংলাদেশ–পাকিস্তান সিরিজ শুরুর সময় চলে আসবে।
আরও পড়ুনআজ রাতে পাকিস্তান ছাড়ছেন নাহিদ-রিশাদ১ ঘণ্টা আগেপাঁচ টি–টোয়েন্টির সিরিজটি আইসিসির ভবিষ্যৎ সফরসূচির (এফটিপি) অংশ। এরই মধ্যে লিটন দাসকে অধিনায়ক করে ১৫ সদস্যের দলও ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। পাকিস্তান সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ দলের ১৪ মে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা। ২১ মে পাকিস্তানে পৌঁছানোর আগে দুবাইয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে দুটি টি–টোয়েন্টি যুক্ত করেছিল বিসিবি।
এখন পাকিস্তান সফর পিছিয়ে গেলে বা স্থগিত হয়ে গেলে লিটনদের আমিরাত সফরও পড়ে যাবে অনিশ্চয়তায়। কারণ, দুবাই হয়ে যাওয়ার পথে দুটি ম্যাচ খেলাই যায়, এমন ভাবনা থেকেই করা হয়েছিল আরব আমিরাতের সূচি।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) অবশ্য এ সফর পিছিয়ে যাওয়া নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি। আগামীকাল পরিচালকদের সঙ্গে এক সভায় এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ।
আরও পড়ুনআইপিএল আয়োজন করতে রাজি হয়নি আরব আমিরাত৪৪ মিনিট আগে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ক স ত ন সফর প এসএল
এছাড়াও পড়ুন:
মাইকেলের হাতে রামাদি চরিত্র
মাইকেল মধুসূদন দত্ত স্কুলের বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে লেখা চিঠিতে স্পষ্টভাবে লিখলেন, রামকে ভালো চোখে দেখতেন না, বরং রাবণের ওপরে তাঁর উত্সাহ ও সম্মান অনেক বেশি: ‘People here grumble and say that the heart of the Poet in Meghanad is with the Rakhasas. And that is the real truth. I despise Ram and his rabble, but the idea of Ravan clevates and kindles my imagination; he was a grand fellow.১ এই মনোভাব তাঁর মেঘনাদবধ কাব্যে নানাভাবে প্রতিফলিত হয়। কাব্যটি পড়লে পাঠকের সহানুভূতি রামের জন্য নয়, রাবণের জন্য গড়ে ওঠে। ফলে অনেকে মনে করেন যে সুপরিচিত প্রাচীন রামায়ণের রাম-রাবণের তুলনায় মাইকেলের রাম-রাবণ নিশ্চয় অন্য ধরনের চরিত্র হয়ে গিয়েছে।
তা সত্ত্বেও অথবা সেই কারণেই হয়তো অধিকাংশ সমালোচক মাইকেলের কৃতির প্রশংসা করেছেন। তিনিই প্রকাশ্যে—নিজের ঢাক বোধ হয় একটু বেশি পিটিয়ে, তা মেনে নিয়ে বললেন: ‘The poem is rising into splendid popularity. Some say it is better than Milton—but that is all bosh—nothing can be better than Miltion; many say it licks Kalidasa; I have no objection to that. I don’t think it impossible to equal Virgil, Kalidasa and Tasso. Though glorious, still they are mortal poets; Milton is divine.২ যতই প্রশংসা হোক প্রায় সবাই বলেন, মাইকেলের রাম-রাবণ চরিত্রে মূলগত পরিবর্তন ঘটে গেছে। অবশ্যই এই মতের ব্যতিক্রমে মাইকেলের সমসাময়িক ও ভক্ত কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখেছিলেন: ‘দত্ত কবিবর রামচন্দ্রের পবিত্র চরিত্র অবলম্বন করিয়াই মেঘনাদবধ কাব্য লিখিয়াছেন।’৩ তবে বঙ্কিমচন্দ্র চরিত্রের নতুনত্বর উল্লেখ করেছেন: ‘...Mr. Datta owes a great deal more to Valmiki than the mere story. But, nevertheless, the poem is his own work from beginning to end. The scenes, character, machinery and episodes, are in many respects of Mr. Datta's own creations.’৪
রাবণকে নিয়ে মোহিতলাল মজুমদার, খুব সম্ভব বর্তমানের সমালোচকদের মতামতের স্রষ্টা, যখন লিখেছেন: ‘মেঘনাদবধে’র রাবণ দুরাচারী দুর্মদ রাক্ষসমাত্র নহে; কবি তাহার চরিত্রকে সর্ববিধ মর্যাদায় মণ্ডিত করিয়াছেন—রাজা, পিতা, ভ্রাতা, স্বামী, যোদ্ধা ও সরলস্বভাব ভক্তরূপে তিনি তাহার যে মূর্তি নির্মাণ করিয়াছেন, তাহার কোথাও নীচতা বা কপটতা নাই।’৫
আজকালকার একাধিক সমালোচক মোহিতলালের কথা টেনে নিয়ে রামায়ণের রাবণ ও মাইকেলের রাবণের মধ্যে যে ব্যবধান, সেটার ওপরে জোর দেন। নীলিমা ইব্রাহিম লেখেন: ‘রাবণচরিত্র রূপায়ণে যে মধুসূদন পৌরাণিক নীতির পরিবর্তন করেছেন এ সর্বজনগ্রাহ্য সত্য, পুরাণের রাবণ রাক্ষস দশমুণ্ড, কুড়ি হাত।...কিন্তু মধুসূদনের রাবণ নামে রাক্ষস,...রাবণ রাজা, রাবণ স্বামী, রাবণ পিতা, রাবণ শ্বশুর, রাবণ ভক্ত, সর্বোপরি নিষ্ঠুর নিয়তির চক্রে নিষ্পেষিত অসহায় মানবসন্তান।’৬
সুরেশচন্দ্র মৈত্র এভাবে রাবণকে বর্ণনা করেন: ‘মধুর নায়ক সর্ববিধ সুস্থতার প্রতীক—সে দক্ষ সেনানী, প্রেমময় স্বামী, স্নেহকাতর পিতা, জনপ্রিয় শাসক এবং সুতনুনর।’৭ মোবাশ্বের আলী, বোধ হয়, মোহিতলালের কথা সবচেয়ে বেশি বাড়িয়ে দেন, যেখানে লেখেন: ‘যুগগত প্রয়োজনে কবি এ চরিত্রকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে সৃষ্টি করেছেন এবং এ চরিত্রে মানবতাবোধ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।....রাবণ তাঁর কাব্যে রাক্ষস হলেও মহৎগুণে মণ্ডিত।...সে কর্তব্যপরায়ণ সম্রাট, প্রজাবত্সল রাজা, সন্তানবত্সল পিতা, স্নেহবত্সল ভ্রাতা এবং অনুরাগী স্বামী।’৮
এই হলো মেঘনাদবধ কাব্যের প্রধান চরিত্রর বৈশিষ্ট্যের তালিকা। তথাকথিত পরিবর্তিত চরিত্রের উত্স ও মাইকেলের প্রেরণা বের করতে গেলে সমালোচকেরা সাধারণত পাশ্চাত্য সাহিত্যে খুঁজতে যান। কয়েকজন দক্ষিণ ভারতেও তাকিয়ে দেখেন, বিশেষত তামিল ভাষায় রচিত কম্ব-রামায়ণের প্রভাবের জন্য।৯ মাইকেলের হাতে কোনো না কোনোভাবে এবং কোনো না কোনো কারণে রাম-রাবণ চরিত্র রূপান্তরিত হয়েছে, সেই ধারণা খুব ব্যাপকভাবে রটে গেছে। মাইকেলের নিজস্ব ঐতিহ্যের রামায়ণের দিকে সমালোচকেরা তুলনা করার জন্য যে দৃষ্টিক্ষেপ করেন না, তা নয়, তবে যতটা করা উচিত, হয়তো ততটা করা হয়নি।
এখানে আমি আমার বক্তব্য বলে রাখি। কৃত্তিবাসের রাম-রাবণের তুলনায় যে মেঘনাদবধ কাব্যে চরিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে বিস্তর পরিবর্তন হয়েছে, আমার মতে তা আসলে সঠিক নয়। মূলত রাম-রাবণের যে রকম স্বভাব ও স্বধর্ম রামায়ণে দেখা যায় (বিশেষ করে বাংলা ভাষার সবচেয়ে বিখ্যাত কৃত্তিবাস-প্রণীত রামায়ণে), তা থেকে মেঘনাদবধ কাব্যের চরিত্র-বিচ্যুতি নেই। পাঠক কৃত্তিবাসের চরিত্রগুলোর তুলনায় মাইকেলের রামাদিকে অন্য চোখে দেখেন, তবে সেটা আলাদা একটা ব্যাপার। মূল চরিত্রের রূপ ও রেখা রূপান্তরিত হয়নি।
চরিত্রগুলো এখন পরীক্ষা করে দেখি। মাইকেলের রাবণ ‘কর্তব্যপরায়ণ সম্রাট’ আর ‘প্রজাবত্সল রাজা’ কি না, সেই বিষয় আমার ছাড়াও চিত্রাঙ্গদা নামে তাঁর একজন স্ত্রীর এবং তাঁর ইষ্টদেবতা মহাদেব শিবের সংশয় থাকতে পারে, কেননা দ্বিধা না করে এ দুজন সোনার লঙ্কার দুর্দশার জন্য রাবণকে দায়ী মনে করেন। চিত্রাঙ্গদা দুঃখে ও রাগে বলেন: ‘হায়, নাথ, নিজ কর্ম-ফলে/ মজালে রাক্ষসকুলে মজিলা আপনি’ (১:৪০৪-৪০৫)। শিবও মনে করেন: ‘পরম ভকত মম নিকষানন্দন;/ কিন্তু নিজ কর্ম-ফলে মজে দুষ্টমতি।/ বিদরে হৃদয় মন স্মরিলে সে কথা,/ মহেশ্বরী হায়;! দেবী, দেবে কি মানবে,/ কোথা হেন সাধ্য রোধে প্রাক্তনের গতি?’ (২:৪২৯-৪৩৩) নির্দোষ, আদর্শ রাজেন্দ্র যদি নাই-বা হয়ে থাকেন তো রাক্ষসগণের অধিপতি রাবণ মাইকেলের হাতে ‘সন্তানবত্সল পিতা’, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রথম সর্গে আমরা একজন স্নেহশীল পিতাকে দেখতে পাই। পুত্র বীরবাহুর মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁর এত দুঃখ লাগে যে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। মাইকেল বলেন:
এ হেন সভায় বসে রক্ষঃকুলপতি
বাক্যহীন পুত্রশোকে! ঝর ঝর ঝরে
অবিরল অশ্রুধারা—তিতিয়া বসনে,
যথা তরু, তীক্ষ্ণ শর সরস শরীরে
বাজিলে, কাঁদে নীরবে। কর যোড় করি,
দাঁড়ায় সম্মুখে ভগ্নদূত,...
(১:৬২-৬৭) আর
এ দূতের মুখে শুনি সুতের নিধন,
হায়, শোকাকুল আজি রাজকুলমণি
নৈকষেয়! সভাজন দুঃখী রাজ-দুঃখে।
আঁধার জগৎ, মরি, ঘন আবরিলে
দিননাথে! কত ক্ষণে চেতন পাইয়া,
বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি কহিলা রাবণ;—
(১: ৭৪-৭৯)
তারপর শোক-আফসোস মিলে সুন্দর একটা ভাষণ রাবণের মুখ দিয়ে প্রকাশ করার পরে মাইকেল বলেন:
এইরূপে বিলাপিলা আক্ষেপে রাক্ষস—
কুলপতি রাবণ; হায় রে মরি, যথা
হস্তিনায় অন্ধ রাজ, সঞ্জয়ের মুখে
শুনি, ভীমবাহু ভীমসেনের প্রহারে
হত যত প্রিয়পুত্র কুরুক্ষেত্র-রণে।
(১:১১৪-১১৮)
কৃত্তিবাসের রাবণ পুত্রদের প্রতি কী রকম স্নেহ ও মমতা দেখান, তা নিয়ে মাইকেলের রাবণের সঙ্গে তুলনা করে দেখা যাক, কত ব্যবধান রয়েছে বা আদৌ ব্যবধান আছে কি না। বীরবাহু মারা গেলে কৃত্তিবাস বলেন:
ভগ্নদূত কহে গিয়া রাবণ গোচর।
বীরবাহু পড়ে বার্তা শুন লঙ্কেশ্বর।।
শোকের উপরে শোক হইল তখন
সিংহাসন হৈতে পড়ে রাজা দশানন।।
চৈতন্য পাইয়া রাজা কান্দিল বিস্তর।১০
কৃত্তিবাসী রামায়ণে বীরবাহুর পরাজয়ের পরে রাবণের শ্রেষ্ঠ ও জ্যেষ্ঠ পুত্র মেঘনাদের তৃতীয়বার যুদ্ধযাত্রা ও সেইবার তাঁর পরাজয়। তবে বীরবাহুর আগে আরও অনেক পুত্র মারা গিয়েছিল। তাদেরও মৃত্যুর উপলক্ষে কৃত্তিবাসের রাবণ রাক্ষস সত্ত্বেও মনুষ্যের মতো—এমনকি মাইকেলের রাবণের মতোই—শোক প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশ করেন।
রাক্ষসপুত্রদের মধ্যে মকরাক্ষ নামে একজন, যার মৃত্যুর পরে কৃত্তিবাস বলেন:
ভগ্ন পাইক কহে গিয়া রাবণ গোচর।
মকরাক্ষ পড়ে রণে শুন লঙ্কেশ্বর।।
শোকের উপরে শোক হৈল বিপরীত।
সিংহাসন হতে পড়ে হইয়া মূর্ছিত।।
পাত্রমিত্র আসিয়া বুঝায় বহুতর।
ধরাসনে বসি রাজা কান্দিল বিস্তর।।
অতিকায় নামে রাবণের আরেকজন পুত্র। কৃত্তিবাস বলেন:
তবে ভগ্নদূত গিয়া দশানন পাশে।
নিবেদন করিতেছে গদগদভাবে।।
মহারাজ চারিজন তনয় তোমার।
রণে গিয়াছিল দুইজন ভ্রাতা আর।।
তার মধ্যে পঞ্চ জনে বানরে বধিল।
অতিকায় লক্ষ্মণের বাণেতে মরিল।।
দূত মুখে এত বাণী করিয়া শ্রবণ।
কিছুকাল স্তব্ধ হয়ে রহে দশানন।।
মুহূর্তেক পরে পুনঃ পাইয়া চেতন।
কি কহিলে বলিয়া করয়ে জিজ্ঞাসন।।
পুনর্বার দূত কৈল সব নিবেদন।
তাহা শুনি মূর্ছিত হইল দশানন।।
কিছুকাল পরে পুনঃ সংবিৎ পাইয়া।
সুদীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে হুঙ্কার করিয়া।।
হইয়াছে অতিশয় শোকেতে মগন।
না পারয়ে করিবারে ধৈরয ধারণ।।
বিংশতি নয়নে ঘন অশ্রুধারা বয়।
মুক্ত কণ্ঠ হয়ে রাজা ক্রন্দন করয়।।
(পৃ. ৪০২)
শুধু আপন পুত্র নয়, ভ্রাতুষ্পুত্রকে—যে ভ্রাতাকে রাবণ দেখতে পারেন না, তাঁর পুত্রকে—মায়া-মমতা দেখালেন। বিভীষণ ও সরমার সন্তান তরণীসেন আপন বাপের মাতে মারা যাওয়ার পর বিভীষণ কেঁদে ফেলেছেন, সরমা শোকে ভেঙে গেছেন এবং রাবণ জ্যাঠাও কাঁদেন। কৃত্তিবাস বলেন:
ভগ্ন পাইক কহে গিয়া রাবণ গোচরে।।
দূত কহে লঙ্কেশ্বর নিবেদি চরণে।
পড়িল তরণীসেন আজিকার রণে।।
তরণীসেনের মৃত্যু শুনি লঙ্কেশ্বর।
সিংহাসন হৈতে পড়ে ধরণী উপর।।
চৈতন্য পাইয়া রাজা করয়ে ক্রন্দন।
রাজারে প্রবোধ দেয় পাত্রমিত্রগণ।।
মৃত্তিকাতে বসে ভাবে লঙ্কা অধিকারী।
ঘরে ঘরে কান্দে যত সব বীর নারী।।
(পৃ. ৪৩৬)
এই কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে নেওয়া দৃষ্টান্তে যা পাই, তা পাই মাইকেলের কাব্যে—একজন সন্তানবত্সল রাক্ষসপিতা, রাবণ নামে।
মাইকেলের রাবণ যে ভাইদের সঙ্গে ‘স্নেহবত্সল ভ্রাতা’, তা আমরা কী করে জানতে পারি? মেঘনাদবধ কাব্যে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কুবেরের উল্লেখ আছে, একটি অলংকারে, তবে রাবণের সঙ্গে সম্পর্কটার বর্ণনা নেই। বিভীষণ আর রাবণের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। বিভীষণ তাঁর ভাইয়ের বিপক্ষীয় দলের একজন। সরমা সীতার স্বপ্ন অশোকবনে শোনেন:
‘আছিল সে সভাতলে ধীর ধর্মসম
বীর এক; কহিল সে, ‘পূজ রঘুবরে,
বৈদেহীরে দেহ ফিরি; নতুবা মরিবে
সবংশে!’ সংসার-মদে মত্ত রাঘবারি,
পদাঘাত করি তারে কহিল কুবাণী।
অভিমানে গেলা চলি সে বীর-কুঞ্জর
যথা প্রাণনাথ মোর।’—কহিল সরমা,
‘হে দেবী, তোমার দুঃখে কত যে দুঃখিত
রক্ষোরাজানুজ বলী, কি আর কহিব?
(৪: ৫০৩-৫১১)
বিভীষণ ভাইয়ের সঙ্গে খুব একটা স্নেহের সম্পর্ক দেখানো হয় না, মেঘনাদবধ কাব্যে নয়, কৃত্তিবাসী রামায়ণেও নয়। তবে মাইকেলের খণ্ডকাহিনির শুরুর আগে রাবণের আরেক ভাইয়ের যুদ্ধে পতন ঘটেছিল। মাঝেমধ্যে রাবণ তাঁর মৃত ভাইয়ের কথা স্মরণ করেন।
কহিলা রাক্ষসপতি;—‘কুম্ভকর্ণ বলী
ভাই মম,—তায় আমি জাগানু অকালে
ভয়ে; হায়, দেহ তার, দেখ, সিন্ধু-তীরে
ভূপতিত, গিরিশৃঙ্গ কিম্বা তরু যথা
বজ্রাঘাতে!’
(১: ৭৫১-৭৫৫)
অথবা
...মরিল সংগ্রামে
শূলীশম্ভুসম ভাই কুম্ভকর্ণ মম,
কুমার বাসবজয়ী, দ্বিতীয় জগতে
শক্তিধর! প্রাণ আমি ধরি কোন্ সাধে?
আর কি দোঁহে ফিরি পাব ভবতলে?—
(৯: ৩৭-৪১)
এমন ইঙ্গিত থেকে আমরা ধরে নিতে পারি যে কুবের আর বিভীষণের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না থাকলেও রাবণ কুম্ভকর্ণের সঙ্গে সত্যিকারের ‘স্নেহবত্সল ভ্রাতা’র মতো ব্যবহার করতেন মেঘনাদবধ কাব্যে। তবে স্নেহটা কত গভীর মেঘনাদবধ কাব্য নয়, কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকেই জ্ঞাপন করা যায়।
কুম্ভকর্ণের পুরো ছয় মাস ঘুমানো উচিত ছিল। কিন্তু ভালো যোদ্ধা প্রয়োজন বলে অত সময় ঘুমোতে দেওয়া যায়নি। বাধ্য হয়ে কৃত্তিবাসের রাবণ তাঁর ভাইকে যত্ন করে জাগাতে আজ্ঞা দেন।
পাঁচ মাস গত নিদ্রা এক মাস আছে।
আজি লঙ্কা মজিলে সে কি করিবে পাছে।।
কুম্ভকর্ণে জাগাইতে করহ যতন।
প্রাণসত্ত্বে মোর যেন হয় সচেতন।
যখন তাঁর জাগ্রত ভাইয়ের ওপরে প্রথমে চোখ পড়ে তখন যারপরনাই খুশি।
কুম্ভকর্ণ গেল তবে ভেটিতে রাবণ।।
কুম্ভকর্ণে দেখিয়া রাবণ কুতূহলী।
সিংহাসন হৈতে উঠে করে কোলাকুলি।।
কুম্ভকর্ণ রাবণের বন্দিল চরণ।
বসিতে দিলেন রাজা রত্ন সিংহাসন।।
(পৃ. ৩৮৩)
কুম্ভকর্ণ মারা যাবার পর কৃত্তিবাস বলেন:
কুম্ভকর্ণ মৃত্যু কথা করিয়া শ্রবণ।।
ক্রন্দন করয়ে যত লঙ্কাবাসী জন।।
মুহূর্তেক পরে রাজা চেতন পাইয়া।।
বিলাপ করয়ে শোকে কাতর হইয়া।।
ভাই নহি আমি যে চণ্ডাল সহোদর।।
কাঁচা ঘুমে জাগায়ে পাঠাই যমঘর।।
(পৃ. ৩৯২-৩৯৩)
তারপরে ১১টি ত্রিপদী চরণ দিয়ে দীর্ঘ বিলাপ, যেমন:
হায় হায় কি হইল ক্রূর বিধি কি করিল
প্রাণাধিক ভাই নিল হরি।
কি করিব কোথা যাব কোথা গেলে তারে পাব
তা বিনে কিরূপে প্রাণ ধরি।।
ওরে প্রাণাধিক ভ্রাতা মোরে ছাড়ি গেলি কোথা
দেখিতে না পাই আর তোরে।
ধিক্ ধিক্ প্রাণে মোর, শুনিয়া মরণ তোর,
এখনো না ছাড়ে এ শরীরে।।
(পৃ. ৩৯৩)
ইত্যাদি। আর শেষে কৃত্তিবাস বলেন:
এই রূপে ক্রন্দন করয়ে দশানন।
অশ্রুজলে অভিষিক্ত হইল বদন।।
(পৃ. ৩৯৪)
কৃত্তিবাসের রাক্ষস রাজা তাঁর একজন ভাইয়ের কাছে একজন রীতিমতো ‘স্নেহবত্সল ভ্রাতা’, নিঃসন্দেহে। মাইকেলের রাবণও তা–ই।
এবার বোনসংক্রান্ত রাবণের ভ্রাতৃত্ব—তিনি ‘স্নেহবত্সল ভ্রাতা’ কি না—পরীক্ষা করা হোক। তাঁর একমাত্র বোনের সঙ্গে খুব ভাব ছিল, যুদ্ধের সময়ও আছে, বোধ হয়। তবে সোনার লঙ্কার শোচনীয় পরিস্থিতি অনেকটা ওই ভাবের প্রতিফলে। বেচারি অপমানিতা শূর্পণখার আবদারে রাবণ সীতাকে হরণ করতে গিয়েছিলেন। পরে মাইকেলের রাবণ আপনমনে বলেন:
...হায়, শূর্পণখা,
কি কুক্ষণে দেখেছিলি, তুই রে অভাগী,
কাল পঞ্চবটীবনে কালকুটে ভরা
এ বুজগে? কি কুক্ষণে (তোর দুঃখে দুঃখী)
পাবক-শিখা-রূপিণী জানকীরে আমি
আনিনু এ হৈম গেহে?
(১: ৯৯-১০৪)
যদিও বোনকে দোষ দিচ্ছেন, তবু স্বীকার করতে হবে যে তিনি কোমল, সহিষ্ণু, স্নেহবত্সলভাবে পুরস্কার করেন।
কৃত্তিবাসী রামায়ণে এত প্রকট ভাবাবেগ নেই বটে, তবে বোনের অনুরোধে তিনি সীতাকে হরণ করতে গিয়েছিলেন। বোনকে কি সন্তুষ্ট করার জন্য, না নিজের লোভ মেটাবার জন্য করেছেন, তা ঠিক জানা যায় না। মরে যাওয়ার সময়ে, কৃত্তিবাসের রাবণ রামকে কেবল বলেন:
আছয়ে অনেক কথা আমার মনেতে।
কত কব রঘুনাথ তোমার সাক্ষাতে।।
এক কথা কহি রাম, দেখ বিদ্যমান।
লক্ষ্মণ কাটিল শূর্পণখা নাক কান।।
সেই এসে উপদেশ কহিল আমারে।
তাহার বুদ্ধিতে আমি সীতা আনি হ’রে।।
শূর্পণখা কান্দিলেক চরণেতে ধ’রে।
মন হৈল সীতারে হরিয়া আনিবারে।।
(পৃ. ৫২৮)
মাইকেলের রচনায় রাবণের বোনের দুঃখের দরুন রাবণ দুঃখী এবং ওই দুঃখে সোনার লঙ্কায় সীতাকে আনেন। কৃত্তিবাস এক পয়ার দ্বিপদীতে বলেন যে শূর্পণখা কান্নাকাটি করেন আর সঙ্গে সঙ্গে রাবণ সীতাকে হরণ করা স্থির করে ফেলেন। মেঘনাদবধ কাব্যে যে পরিস্ফুট ভ্রাতৃস্নেহের পুষ্প আমরা দেখতে পাই, সেটার বীজ কৃত্তিবাসের কাব্যে রয়েছে।
মাইকেলের রাবণ দোষী বা নির্দোষ হন—না কেন, তিনি কী অর্থে অনুরাগী স্বামী, সে সম্বন্ধে একটু ভেবে নিতে হবে। প্রথম সর্গে তাঁকে তাঁর একজন স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে আমরা দেখি। সেই দৃশ্যতে মহিষী চিত্রাঙ্গদা তাঁর স্বামীর সমুখে এসে মৃদু স্বরে কেঁদে কেঁদে প্রশ্ন করে নালিশ জানান।
‘একটী রতন মোরে দিয়াছিল বিধি
কৃপাময়, দীন আমি থুয়েছিনু তারে
রক্ষাহেতু তব কাছে, রক্ষঃকুল-মণি,
তরুর কোটরে রাখে শাবকে যেমতি
পাখী। কহ, কোথা তুমি রেখেছ তাহারে,
লঙ্কানাথ? কোথা মম অমূল্য রতন?’
(১: ৩৪৭-৩৫২)
তদুত্তরে রাবণ বলেন:
‘এ বৃথা গঞ্জনা, প্রিয়ে, কেন দেহ মোরে!
গ্রহদোষে দোষী জনে কে নিন্দে, সুন্দরী?’
(১: ৩৫৭-৩৫৮)
এবং
‘এক পুত্রশোকে তুমি আকুলা, ললনে,
শত পুত্রশোকে বুক আমার ফাটিছে
দিবা নিশি!’
(১: ৩৬৭-৩৬৯)
তিনি এ স্ত্রীকে বলেন যে শোকার্ত হওয়ার বদলে তাঁর গর্ব বোধ করা উচিত। এই সব উক্তি থেকে কি বলা যায়, রাবণ ‘অনুরাগী স্বামী’? চিত্রাঙ্গদা অন্তত রাবণের কথায় সান্ত্বনা পান না।
‘কে, কহ, এ কাল-অগ্নি জ্বালিয়াছে আজি
লঙ্কাপুরে? হায়, নাথ, নিজ কর্ম-ফলে,
মজালে রাক্ষসকুলে মজিলা আপনি!’
এতেক কহিয়া বীরবাহুর জননী,
চিত্রাঙ্গদা, কাঁদি সঙ্গে সঙ্গীদলে লয়ে,
প্রবেশিলা অন্তঃপুরে।
(১: ৪০৩-৪০৮)
তবে পাটরানী মন্দোদরীর সঙ্গে রাবণ সত্যি সত্যি অনুরাগ ও বিষণ্নতা মেশানো একটা ভাব প্রকাশ করেন। মেঘনাদের মৃত্যুর পরে রাবণ যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হন। এমন সময় মন্দোদরী ছুটে এসে তাঁর স্বামীর পায়ে পড়েন। তখন রাবণ:
যতনে সতীরে তুলি, কহিলা বিষাদে
রক্ষোরাজ, ‘বাম এবে, রক্ষঃ-কুলেন্দ্রাণি,
আমা দোঁহা প্রতি বিধি! তবে যে বাঁচিছি
এখনও, সে কেবল প্রতিবিধিৎসিতে
মৃত্যু তার। যাও ফিরি শূন্য ঘরে তুমি;—
রণক্ষেত্রযাত্রী আমি, কেন রোধ মোরে?
বিলাপের কাল, দেবী, চিরকাল পাব!
বৃথা রাজ্যসুখে, সতী, জলাঞ্জলি দিয়া,
বিরলে বসিয়া দোঁহে স্মরিব তাহারে
অহরহ। যাও ফিরি; কেন নিবাইবে
এ রোষাগ্নি অশ্রুনীরে, রাণি মন্দোদরী?
(৭: ৩৩৮-৩৪৮)
যদিও এখানে স্ত্রীর চেয়ে পুত্রের জন্য রাবণের আবেগ অনেক বেশি প্রবল, তা না হলে তিনি কি বলতেন যে শুধু পুত্রের মৃত্যুর প্রতিবিধিত্সার জন্য বেঁচে আছেন—তবু মন্দোদরীর প্রতি সত্যি একটা অনুরাগের অভিব্যক্তি অস্বীকার করা যায় না।
কৃত্তিবাসী রামায়ণে রাবণ ও চিত্রাঙ্গদার মধ্যে সম্পর্ক তেমন ঘনিষ্ঠ নয় এবং বীরবাহুর মৃত্যুর পরে শুধু তাঁর পিতা রাবণ বিলাপ করেন। মাতা সেখানে অনুপস্থিত। মেঘনাদের হত্যার পর পিতা আর মাতা একসঙ্গে শোক প্রদর্শন করেন। যেখানে মেঘনাদবধ কাব্যে স্ত্রীর প্রতি করুণাময় রাবণ আন্তরিক হৃদয়তা দেখান, কৃত্তিবাসে সেই দৃশ্য নেই। তবে কৃত্তিবাসে রাবণ ও মন্দোদরী উভয়ে উপস্থিত এবং আক্ষেপ করেন। উপরন্তু রাবণের শোকের সঙ্গে রাগ এবং নিজে যুদ্ধে যাওয়ার উদ্যোগ মনস্থির করাটা আমরা দেখতে পাই কৃত্তিবাসে, যেমন আমরা পেয়েছি মেঘনাদবধ কাব্যে। কৃত্তিবাস বলেন:
কিছুদিন ছিল সুখ এখন ঘটিল দুখ
হেন পুত্র পড়ে রণস্থলে।।
পুত্রশোক মন্দোদরী করিছে রোদন।
মন্দোদরী ক্রন্দনেতে রুষিল রাবণ।।
…
শোকের উপরে শোক পাইল রাবণ।
বসিলে সোয়াস্তি নাই করয়ে শয়ন।।
ইন্দ্রজিৎ শোক তবু নহে পাসরণ।
আপনি সাজিল রাজা করিবারে রণ।।
স্ত্রীলোকের ক্রন্দন শুনিয়া ঘরে-ঘর।
অভিমানে পরিপূর্ণ রাজা লঙ্কেশ্বর।।
... ...
ধনুর্বাণ ল’য়ে রাবণ যায় মহাক্রোধে।
রাণী মন্দোদরী আসি পশ্চাতে বিরোধে।।
আপনার দোষে রাজা কৈলে বংশনাশ।
রামের সীতা তারে দেহ থাক গৃহবাস।।
মন্দোদরী পানে রাজা ফিরিয়া না চায়।
মৃত্যুকালে রোগী যেন ঔষধ না খায়।।
(পৃ. ৪৬৪–৪৬৬)
মাইকেল মধুসূদন দত্ত (২৫ জানুয়ারি ১৮২৪-২৯ জুন ১৮৭৩)