গানে-কবিতায় প্রতিবাদী এক কণ্ঠস্বরের নাম ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান। শুধু তা–ই নয়, রাজপথেও থাকেন সামনের সারিতে। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে সোচ্চার ছিলেন সায়ান। পরবর্তী সময়েও অন্যায় অবিচারে নিজের প্রতিবাদ থামিয়ে রাখেননি। এবার তিনি সমাজ ও রাষ্ট্রে ঘৃণা এবং সহিংসতার চর্চা বন্ধে নিজের অবস্থান জানিয়ে কথা বলেছেন।

সোমবার দেওয়া ফেসবুক পোস্টে সায়ান বর্তমান সরকারকে ঘৃণা, সহিংসতা ও হত্যার হুমকির মতো বিষয়গুলো নিয়ে কঠোর হওয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন

তিনি লিখেছেন, ‘আপনারা ঘৃণা চর্চার বয়ানকে চিহ্নিত করুন, আক্রমণাত্মক ভাষাভঙ্গি নিয়ে কাজ করুন। মানুষের জন্য মানবিক আচরণের ন্যূনতম একটা মানদণ্ড তৈরির কথা ভাবুন। বিভিন্ন মঞ্চে গিয়ে একে বেশ্যা, তাকে দালাল-এগুলো তো প্রতিদিনের ব্যাপার হয়েছে, তার সঙ্গে এই যে জবাই করার কথা বলা, “ধরে ধরে জবাই কর”, এটা পৃথিবীর যেকোনো সমাজে, যেকোনো রাষ্ট্রে কীভাবে গ্রহণযোগ্য? এভাবে ঘৃণার ও হত্যা হুমকির খুল্লামখুল্লা চর্চা চালিয়ে যাবে কেউ, আর তারপর সেটার কোনো পরিণতি হবে না, এটা কেন গ্রহণযোগ্য? এখানে তো ব্যক্তিকে হত্যা করার কথা বলা হচ্ছে। এটা কীভাবে স্বাভাবিক? এটা স্লোগান হিসেবে কেন আপত্তিকর নয়? হত্যার উসকানি নয়?’

সায়ান তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘এ ধরনের ভাষা তিনি ২০১৩ সালে শুনেছেন, যখন গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলছিল। তখনো এসব শুনে তাঁর আনন্দ হয়নি প্রাণে। শিহরিত হননি তিনি। সায়ান লিখেছেন, ‘বিচার চাওয়া আর জবাই করা এক ব্যাপার না। বিচারের সংস্কৃতিই সেটা নয়।’

সায়ানের মতে, ‘ঘৃণা নিয়ন্ত্রণ কমিশন’ এখন সময়ের দাবি—এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে শিল্পী বললেন, ‘সাধারণ জনতার ভিড়ে সুশীলও থাকেন, উন্মাদ মব-জনতাও থাকেন। তাদের কাছে কিছু আশা করি না বাড়তি। তারা রাষ্ট্রের দায়িত্বে নাই। তারা যে যার নীতি-গতি-বিবেক অনুযায়ী আচরণ করবেন, সকলেরই দেশ, সকলেই স্বাধীন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিক থেকে তো একটা মানদণ্ড থাকতে হবে আচরণের। কেন একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে বেশ্যা ডেকে পার পাবেন? কেন যে কেউ যে কাউকে ভালো না লাগলেই জবাই করার হুমকি দেবেন এবং তার স্বাভাবিকীকরণ হবে? কেন বিভিন্ন মাহফিলে ঘৃণা ছড়ানোর বয়ান চলতে পারে যুগের পর যুগ, অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি? মেয়েদের প্রতি? তাই একটা “ঘৃণা নিয়ন্ত্রণ কমিশন” এখন সময়ের দাবি।’

সাম্প্রতিক এক উদাহরণ টেনে সায়ান লেখেন, ‘সেদিন দেখলাম কোনো এক মঞ্চ থেকে কেউ কেউ তালে তালে বলছেন, “একটা একটা লীগ ধর, ধরে ধরে জবাই কর।” রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থাকা মানুষেরা কেন এই চর্চায় কোনো সমস্যা পাচ্ছেন না? মব-জনতা উন্মাদনায় ভেসে যাচ্ছে জংলিপনায়। কিন্তু রাষ্ট্রের নিযুক্ত সেবকেরা কী করে এখানে নির্বিকার থাকবেন? এগুলোকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে দেখতে চাই। কেউ অপরাধ করলে তার বিচার করবেন আদালতে। জবাই করার স্লোগানের মধ্যে ২০১৩–তেও দেশপ্রেম ছিল না, এখনো নাই। বিচারের মানসিকতা ছিল না, এখনো নাই।’

পোস্টের শেষ দিকে তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘গা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে সংস্কৃতি পাল্টাবে না। কাজ করতে হবে। প্রচারণা করতে হবে। এখানে মানুষ গালি দেওয়া এবং জবাই করার হুমকি দেওয়ার মধ্য দিয়ে দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব শেষ করে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। সরকারকে বলছি, কাউকে কেউ কিছু বললেই গায়েবি মামলা দিয়ে তুলে নিয়ে যাইয়েন না। কোন কথাগুলো উগ্র-হিংসাত্মক ও আপত্তিকর, সেগুলোর তালিকা করেন। আইনিভাবে ঘৃণা চর্চাকে নিষিদ্ধ করেন। এটা কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার জটিল প্রক্রিয়ার চেয়ে কিছুটা সহজ হবে করা। ঘৃণা চর্চাকে খাটো করে দেখবেন না। সেখান থেকে বৈধতা আসে বড় বড় অপরাধের।’

.

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ ও ন্যায়বিচার

নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের প্রতি সমর্থনে আন্তর্জাতিক দিবসটি পালিত হয় প্রতিবছর ২৬ জুন। এই দিন আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি সেসব ব্যক্তিকে, যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার। বাংলাদেশের সংবিধান, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ এবং জাতিসংঘ নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক শাস্তির অবমাননাকর আচরণের বিরুদ্ধে কনভেনশনের আলোকে কর্তৃপক্ষের জবাবদিহি ও ভুক্তভোগী ব্যক্তির ন্যায্য ক্ষতিপূরণ, ন্যায়বিচার নিশ্চিতের জোরাল দাবি আমরা সব সময় জানিয়ে আসছি। 

উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুরে সাতুরিয়া গ্রামের স্কুলছাত্র মো. লিমন হোসেনকে র‌্যাবের একটি দল গুলি করেছিল। পরে তাঁর বাম পা কেটে ফেলতে হয়। এমনকি ঘটনার পর পরিবারকে কোনো তথ্য না দিয়ে লিমনকে বেআইনিভাবে আটক এবং তাঁর বিরুদ্ধে দুটি মিথ্যা মামলা করা হয়, যা আদালতে খারিজ হয়ে যায়। একই বছর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, র‌্যাব সদরদপ্তর ও ঝালকাঠির র‌্যাব কার্যালয় থেকে তিনটি পৃথক তদন্ত কমিটি করা হলেও আজ পর্যন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। ভুক্তভোগী লিমন এখনও ন্যায়বিচার, ক্ষতিপূরণ এবং জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন।
২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার পল্লবীতে বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে জনি ও তাঁর ভাই রকিকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। পুলিশ হেফাজতে অমানুষিক নির্যাতনের ফলে জনির মৃত্যু ঘটে। থানায় মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানালে জনির ভাই মো. ইমতিয়াজ হোসেন রকি ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩’-এর অধীনে আদালতে মামলা করেন। ছয় বছর ধরে বিচার চলার পর ২০২০ সালে এ আইনের অধীনে দেশের প্রথম রায় ঘোষিত হয়। তিন পুলিশ সদস্যকে যাবজ্জীবন ও দুই পুলিশ সোর্সকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই সঙ্গে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি প্রত্যেকের কাছ থেকে ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়। বর্তমানে দণ্ডপ্রাপ্তদের আপিল উচ্চ আদালতে বিচারাধীন।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে এ ধরনের নির্যাতন বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ (আইনের দৃষ্টিতে সমতা), ৩১ (আইনের আশ্রয়-লাভের অধিকার), ৩২ (জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার-রক্ষণ), ৩৩ (গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ) এবং ৩৫ (বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে রক্ষণ) অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। একই সঙ্গে ২০১৩ সালে প্রণীত ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন’-এর লঙ্ঘন। এ ছাড়াও বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ও অভিযুক্তকে রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারকদের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা-সংবলিত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের যুগান্তকারী রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাস্তবে এ আইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার যথাযথ প্রতিপালন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। 
এই ঘাটতি প্রমাণ করে– নির্যাতন প্রতিরোধে শুধু জাতীয় আইন ও বিচার ব্যবস্থাই যথেষ্ট নয়। অভ্যন্তরীণ প্রতিকার ব্যবস্থা দুর্বল বা অকার্যকর হয়ে পড়লে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ও জবাবদিহি কাঠামো অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে ‘নির্যাতনের এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক, শাস্তির অবমাননাকর আচরণের বিরুদ্ধে কনভেনশন’ অনুস্বাক্ষর করলেও এখনও অনুচ্ছেদ ২১ (রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অভিযোগ প্রক্রিয়া), ২২ (ব্যক্তিগত অভিযোগের অধিকার) ও ২২-এর জন্য আলাদাভাবে সম্মতিমূলক ঘোষণা দেয়নি এবং অনুচ্ছেদ ২০ (নির্যাতন বিষয়ে কমিটির গোপন তদন্ত) পালনে এখনও রাজি বা সক্রিয় হয়নি। একই সঙ্গে ‘নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঐচ্ছিক প্রটোকল’ এখনও অনুমোদন না করায় বাংলাদেশে কোনো স্বাধীন জাতীয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা গঠিত হয়নি, যার মাধ্যমে আটকস্থলে নিয়মিত পরিদর্শন ও নিরীক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত হতো। এটা অনুমোদন করলে কার্যকর ও প্রতিরোধমূলক আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যবেক্ষণ কাঠামো গড়ে উঠত, যা হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর মতো ঘটনাগুলো প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। জাতিসংঘ সনদটির উল্লিখিত অনুচ্ছেদগুলোতে আলাদাভাবে সম্মতিমূলক ঘোষণা এবং ঐচ্ছিক প্রটোকল অনুমোদনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কাঠামোর সঙ্গে সাদৃশ্যমূলক অঙ্গীকার বাস্তবায়ন এবং জনগণের জন্য ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারে।

বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে সংঘটিত সব নির্যাতনের সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও দ্রুত তদন্ত এবং ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতেই হবে। এ ধরনের নির্যাতন প্রতিরোধে বিদ্যমান আইন এবং বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারসহ নির্যাতন, অন্যান্য নিষ্ঠুর-অমানবিক শাস্তি এবং অবমাননাকর আচরণ প্রতিরোধে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক সনদে অনুস্বাক্ষর ও অনুমোদনের মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে সুপ্রতিষ্ঠিত কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব। এতে দেশের জনগণকে এমন নির্যাতন থেকে সুরক্ষা প্রদান এবং ইতোপূর্বে সংঘটিত নির্যাতন ও নির্যাতনে মৃত্যুর যথাযথ জবাবদিহি নিশ্চিত করবে।

আয়েশা আক্তার, মোহাম্মদ রাকিনুল হাকিম আলভী, ফাহাদ বিন সিদ্দিক: যথাক্রমে আইন বিশেষজ্ঞ, পরামর্শক ও জ্যেষ্ঠ গবেষণা কর্মকর্তা, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট-ব্লাস্ট

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ ও ন্যায়বিচার
  • শিশুর কান্না ট্যানট্রাম নাকি মেল্টডাউন? দুটির পার্থক্য জেনে রাখা এত জরুরি কেন
  • টাঙ্গুয়ার হাওরে গাঁজা সেবন ও বিশৃঙ্খলা করায় ৫ পর্যটককে কারাদণ্ড
  • জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের দাবি জামায়াতের