গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফাহ শহরে মঙ্গলবার (২৭ মে) বিকেলে চালু হওয়া মার্কিন-সমর্থিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে ক্ষুধার্ত গাজার বাসিন্দারা ছুটে গেলে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গুলিতে বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন।

স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে আজ বুধবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলু।

গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “তথাকথিত বাফার জোনে ত্রাণ বিতরণের জন্য ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর পরিকল্পনা ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হয়েছে।”

আরো পড়ুন:

ধনীদের বসবাসের জন্য জনপ্রিয় ১০ শহর

যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় বন্দুকধারীর হামলা, নিহত ২

এতে বলা হয়েছে, “হাজার হাজার ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে ছুটে যাওয়ার পর ইসরায়েলি বাহিনী গুলি চালায়।”

বিবৃতিতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, “আজ যা ঘটেছে তা অনাহার, অবরোধ এবং বোমাবর্ষণের নীতির মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা মানবিক সংকট মোকাবিলায় দখলদার বাহিনীর ব্যর্থতার অকাট্য প্রমাণ।”

অফিসটি বলেছে, “মৃত্যু, গুলিবর্ষণ ও ক্ষুধার হুমকির মুখে সীমিত সাহায্য বিতরণের জন্য বাফার-জোনে ত্রাণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা সংকট মোকাবিলার প্রকৃত উদ্দেশ্যকে প্রতিফলিত করে না, বরং অনাহার দীর্ঘায়িত করা এবং ফিলিস্তিনি সমাজকে ভেঙে ফেলার লক্ষ্যে একটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রকৌশলের মূর্ত প্রতীক।”

মিডিয়া অফিস গাজায় খাদ্য সরবরাহের পতনের জন্য ইসরায়েলকে সম্পূর্ণরূপে দায়ী করেছে, সাহায্যকে ‘যুদ্ধের অস্ত্র ও ব্ল্যাকমেইলের হাতিয়ার’ হিসাবে ব্যবহারের নিন্দা জানিয়েছে। এছাড়াও সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ত্রাণ সাহায্য প্রবেশে ইসরায়েলি বাধার তীব্র সমালোচনা করেছে।

মিডিয়া অফিস জাতিসংঘ এবং নিরাপত্তা পরিষদকে “ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ করার জন্য জরুরিভাবে পদক্ষেপ নেওয়ার, বিধিনিষেধ ছাড়াই ত্রাণ প্রবেশে সীমান্ত ক্রসিংগুলো ‍খুলে দেওয়ার এবং মানবিক সংস্থাগুলোকে দখলদারদের হস্তক্ষেপ ও এজেন্ডা থেকে স্বাধীনভাবে তাদের মিশন পরিচালনা করতে সক্ষম করার আহ্বান জানিয়েছে।”

অফিসটি অনাহারের অপরাধ নথিভুক্ত করার জন্য এবং যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ইসরায়েলি নেতাদের বিচারের আওতায় আনার জন্য স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটি প্রেরণের দাবিও করেছে।

ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ইয়েদিওথ আহরোনোথ জানিয়েছে, ক্ষুধার্ত গাজাবাসীর চাপে মার্কিন-সমর্থিত ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র ‘গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)’ এর মার্কিন কর্মীদের রাফাহ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

ইসরায়েলের আরেকটি সংবাদমাদ্যম হায়োম জানিয়েছে, মার্কিন কর্মীদের সরিয়ে নেওয়ার পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ত্রাণ বিতরণ স্থানে সেনা মোতায়েন করেছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, মার্কিন ও ইসরায়েল-সমর্থিত সংস্থা জিএইচএফ মঙ্গলবার বিকেলে রাফাহর তাল আল-সুলতান এবং মোরাগ করিডোর এলাকায় ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র চালু করার পর সেখানে হাজারো পুরুষ, নারী ও শিশুকে ছুটে আসতে দেখা যায়। কিছুক্ষণ পরেই বিশাল জনতা কেন্দ্রের কাঁটাতারের বেড়া ও মাটি দিয়ে তৈরি বেড়া ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে।

স্থানীয়রা জানান, মানুষজন খাবারের প্যাকেট ছিনিয়ে নিচ্ছিল এবং ইসরায়েলি সেনারা গুলি ছুঁড়েছিল। এক ব্যক্তি বিবিসি আরবিকে বলেন, “একবারে মাত্র ৫০ জনকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল, এরপর বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়—মানুষ গেট টপকে উঠে, একে অপরকে আক্রমণ করে এবং ত্রাণ নিয়ে নেয়। এসময় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গুলি ছুড়ে।”

তিনি আরো বলেন, “এটা ছিল অত্যন্ত অপমানজনক অভিজ্ঞতা। আমরা চরম ক্ষুধার্ত।”

এক নারী বলেন, ‘ক্ষুধা আর দারিদ্র্য সবাইকে গ্রাস করেছে। মানুষ এতটাই ক্লান্ত যে নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেও খাবারের জন্য কিছু করতে প্রস্তুত।’

জাতিসংঘের মুখপাত্র স্তেফান দুজারিক এক বিবৃতিতে বলেছেন, “জিএইচএফ-এর বিতরণ কেন্দ্রে যা ঘটছে, সেই ভিডিওগুলো আমাদের হৃদয় ভেঙে দিয়েছে। আমাদের এবং আমাদের অংশীদারদের হাতে একটি সুসংগঠিত পরিকল্পনা রয়েছে, যার মাধ্যমে আমরা গাজাবাসীর কাছে ত্রাণ পৌঁছাতে পারি।” 

জিএইচএফ মার্কিন অস্ত্রধারী নিরাপত্তা ঠিকাদারদের ব্যবহার করে এবং জাতিসংঘকে উপেক্ষা করে গাজায় ত্রাণ সরবরাহের চেষ্টা করছে।

জাতিসংঘ এবং বেশিরভাগ ত্রাণ সংস্থা জিএইচএফ-এর সঙ্গে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, কারণ এটি মানবিক নীতিমালার পরিপন্থী এবং ত্রাণকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের আশঙ্কা তৈরি করেছে।

জিএইচএফ জানিয়েছে, তারা দক্ষিণ ও মধ্য গাজায় চারটি বিতরণ কেন্দ্র স্থাপন করবে, যার লক্ষ্য এই সপ্তাহের মধ্যেই ১০ লাখ মানুষকে খাওয়ানো। এই কেন্দ্রগুলোতে প্রবেশের জন্য ফিলিস্তিনিদের পরিচয় যাচাই ও হামাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে স্ক্রিনিংয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। এই ব্যবস্থাকে মানবিক নীতির পরিপন্থী হিসেবে দেখছে জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থা।

ইসরায়েল গত ২ মার্চ থেকে গাজা ক্রসিং বন্ধ করে রেখেছে, যা ছিটমহলে ইতিমধ্যেই তীব্র মানবিক সংকটকে আরো গভীর করে তুলেছে।

যুদ্ধবিরতির জন্য আন্তর্জাতিক আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজার বিরুদ্ধে নৃশংস আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে, ৫৪ হাজারেও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।

ঢাকা/ফিরোজ

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর য ক তর ষ ট র ইসর য় ল ত র ণ ব তরণ ক ন দ র ইসর য় ল র জন য প রব শ ইসর য

এছাড়াও পড়ুন:

গাজায় ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র আসলে ইসরায়েলের মারণকল

যখন কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়, তখন তা শুধু ক্ষুধার নয়, বরং সমাজের ভাঙনেরও প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। এ অবস্থায় মানুষ আবর্জনার স্তূপ থেকে খাবার খুঁজে আনে। কেউ গোপনে রান্না করে; কেউ আত্মীয়দের থেকে খাবার লুকিয়ে রাখে, কোনো পরিবার হয়তো খাবারের জন্য তাদের দাদিমার গয়না বিক্রি করে দেয়।

দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মুখে কোনো অনুভূতি থাকে না। তাদের চোখে থাকে ফাঁপা দৃষ্টি। মানুষ পশুর মতো খাবারের জন্য লড়াই করে। এটিই হলো সামাজিক অবক্ষয় ও অপমানের চরম রূপ। এটিই হলো মানবিক মর্যাদার বিলোপ। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে আজকের গাজাবাসী যাচ্ছে। 

গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন বা জিএইচএফ নামে একটি নতুন সংস্থা (যেটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে মে মাসে যাত্রা শুরু করে) নিজেদের কার্যক্রমকে একুশ শতকের আধুনিক ও সহানুভূতিশীল সংস্থা বলে দাবি করছে। তারা বলছে, তাদের চারটি ‘নিরাপদ বিতরণ কেন্দ্র’ থেকে তারা প্রতিদিন ২০ লাখের বেশি প্যাকেট খাবার বিতরণ করছে। সেখানকার ছবিতে দেখা যায়, বাচ্চাদের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন সংস্থার কর্মীরা।

আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি। 

ইসরায়েলি মুখপাত্ররা বলছেন, জাতিসংঘের ট্রাকগুলো গাজার সীমানার ভেতরে আছে কিন্তু জাতিসংঘ নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার বিতরণ করছে না। কিন্তু এ বক্তব্য খুব সহজ বিশ্লেষণেই ভেঙে পড়ে। 

প্রথমত, সংখ্যা ঠিক মিলছে না। গত এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা হিসাব করে জানায়, ১৮ মাসের অবরোধ ও যুদ্ধের পর এবং দুই মাসের পূর্ণ ইসরায়েলি অবরোধের ফলে মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে গাজায় জীবন বাঁচানোর জন্য যে পরিমাণ খাবার দরকার, তার অর্ধেকের নিচে নেমে যাবে। অর্থাৎ গাজার সব মানুষের খাদ্যের পুরো চাহিদা পূরণ করতে হবে এই ত্রাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিদিনের ২০ লাখ প্যাকেট খাবার গাজার প্রয়োজনের অর্ধেকও নয়। 

আরও পড়ুনইসরায়েল কেন গাজায় অস্ত্রধারী গুন্ডা পোষে ১১ জুন ২০২৫

দ্বিতীয়ত, শুধু সংখ্যায় খাবার পৌঁছালেই দুর্ভিক্ষ বন্ধ হয় না; দুর্ভিক্ষ আঘাত করে সবচেয়ে দুর্বল মানুষগুলোর ওপর। জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, যখন ২০ শতাংশ পরিবার মারাত্মক খাদ্যসংকটে পড়ে, তখন সেটিকে ‘দুর্ভিক্ষ’ বলা যায়। এ অবস্থায় নারীরা, বিশেষ করে যাঁদের স্বামী নেই এবং যাঁদের অনেক শিশু বা বয়স্ক অভিভাবক আছেন, তাঁরাই সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকেন। সেসব পরিবারকে চিনে ত্রাণ পৌঁছানোই আসল কাজ। 

জিএইচএফ গাজায় চারটি বিতরণ কেন্দ্র চালায়—তিনটি রাফার ধ্বংসস্তূপে, আরেকটি গাজার মাঝখানে। সব কটিই সামরিক এলাকায়। এরা খুব অল্প সময়ের জন্য এবং খাবার বিতরণের খুব অল্প আগে সবাইকে জানিয়ে খোলে। মানুষ ধ্বংসস্তূপে শিবির করে বসে থাকে, কখন দরজা খুলবে সেই আশায়। তারা জানে, ইসরায়েলি সেনারা ভিড় সামলাতে গুলি চালাতে দ্বিধা করে না। যেসব দুর্বল মা, বয়স্ক মানুষ বা প্রতিবন্ধী এই দৌড়ে অংশ নিতে পারেন না, তাঁরা কীভাবে খাবার পাবেন? 

আরও পড়ুনইসরায়েল এখন শেষ সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো১২ এপ্রিল ২০২৫

তৃতীয়ত, মানুষের বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী ত্রাণ দেওয়া দরকার। যেমন অপুষ্ট শিশুদের জন্য দরকার বিশেষ ধরনের খাবার (যেমন ‘প্লাম্পিনাট’, যা সাধারণ খাবার খেতে না পারা শিশুর জন্য তৈরি) দেওয়া দরকার। কিন্তু জিএইচএফের বক্সে থাকে ময়দা, পাস্তা, তেল, চাল, ডাল, তাহিনি (তিলবীজ থেকে তৈরি একধরনের মাখনবিশেষ)। জিএইচএফের ত্রাণের মধ্যে কোনো শিশুখাদ্য বা প্লাম্পিনাট নেই। কোনো প্রশিক্ষিত নার্স বা পুষ্টিবিদও নেই, যাঁরা অপুষ্ট শিশুদের সেবা দিতে পারেন। 

আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি। 

অ্যালেক্স ডি ওয়াল যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড পিস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক

দ্য গার্ডিয়ান, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র আসলে ইসরায়েলের মারণকল
  • ইসরায়েল বলছে তারা গাজায় ত্রাণ দিচ্ছে, তাহলে ফিলিস্তিনিরা না খেয়ে মরছে কেন