গাজায় বিতর্কিত সংস্থার ত্রাণ নিতে গিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে ৩ ফিলিস্তিনি নিহত, আহত ৪৬
Published: 28th, May 2025 GMT
ফিলিস্তিনের গাজা নগরের রাফাহ এলাকায় গতকাল মঙ্গলবার একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে খাদ্য নিতে গিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে তিন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৪৬ জন, নিখোঁজ রয়েছেন আরও ৭ ফিলিস্তিনি। গাজার কর্তৃপক্ষ সূত্রে এই তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) নামের বিতর্কিত একটি সংস্থা এই সাহায্য কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে এই ত্রাণকাজ পরিচালিত হচ্ছে। সমালোচকেরা মনে করেন, গাজার প্রকৃত মানবিক প্রয়োজনের বদলে রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই বিতরণ ব্যবস্থা চালু করেছে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র।
জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণের খবর শুনে সেখানে বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনি ভিড় করেন। তবে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে হতাহতের ঘটনাটি সংস্থাটি অস্বীকার করেছে।
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার সাংবাদিকরা জানান, ত্রাণকেন্দ্রের সামনে বহু ক্ষুধার্ত মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়েছিলেন। কারণ, সাহায্য দেওয়ার আগে প্রত্যেককে তল্লাশি করে ঢোকানো হচ্ছিল। এতে অনেক দেরি হচ্ছিল। এই দেরির কারণে তারা হঠাৎ করে ভেতরে ঢুকে পড়েন। এরপরই বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, আর তখনই শোনা যায় গুলির শব্দ। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে পরিচালিত বিতর্কিত জিএইচএফের সাহায্য বিতরণ কর্মসূচি পুরোপুরি ভেঙে পড়ে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেলে জিএএইচএফের সঙ্গে জড়িত মার্কিন কর্মকর্তাদের উদ্ধার করতে তৎপরতা শুরু করা হয়।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আরও দাবি করেছে, তারা ত্রাণ নিতে আসা মানুষের দিকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়নি। তবে ঘটনাস্থলে গুলির শব্দ শোনা যায়, যা হয়তো ওই কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মার্কিন ভাড়াটে প্রহরীদের সতর্কতামূলক গুলি হতে পারে।
গাজার সরকারি জনসংযোগ অফিস জানিয়েছে, ‘আজকের ঘটনা পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দেয়, দখলদার ইসরায়েল যে মানবিক সংকট ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করেছে, তা সামাল দিতে সম্পূর্ণভাবে তারা ব্যর্থ।’
জনসংযোগ বিভাগ বলেছে, ‘এই খাদ্য নিরাপত্তায় বিপর্যয়ের জন্য আমরা দখলদার ইসরায়েলকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করছি। আইনগত ও নৈতিক—উভয় দিক থেকে তারা এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী।’
জনসংযোগ অফিস আরও বলেছে, গাজার চারদিকে চরম খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ায় এই বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। ২ মার্চ থেকে ইসরায়েল গাজার সব সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে কোনো আন্তর্জাতিক সাহায্য, খাবার, ওষুধ বা জ্বালানি ভেতরে ঢুকতে পারছে না।
জিএইচএফের ত্রাণ নিয়ে সন্দেহ
ত্রাণকেন্দ্রে এই বিশৃঙ্খলার আগে গত সোমবার গাজায় জিএইচএফের পক্ষ থেকে কিছু ছবি প্রকাশ করা হয়। ছবিতে দেখা যায়, কিছু পুরুষ বড় বড় কার্টন হাতে নিয়ে ক্যামেরার বিপরীতে হেঁটে যাচ্ছেন। এমন একটি পথ দিয়ে তাঁরা যাচ্ছেন, যার দুই পাশে কাটাতারের বেড়া। দেখতে অনেকটা সামরিক এলাকার মতো।
জিএইচএফের দাবি, এগুলো তাদের খাদ্য সাহায্য বিতরণ কার্যক্রমের শুরু।
তবে গাজায় বসবাসরত মানুষ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা এসব ছবির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।
গাজায় বিতর্কিত জিএইচএফের দেওয়া ত্রাণ নিচ্ছেন গাজার এক ব্যক্তি। ২৭ মে, রাফাহ.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
গাজায় খাদ্যগুদামে ‘ক্ষুধার্ত মানুষের’ ঢল: ডব্লিউএফপি
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, দলে দলে ‘ক্ষুধার্ত মানুষ’ মধ্য গাজার একটি খাদ্যগুদামে ঢুকে পড়েছেন।
এ ঘটনায় দুজন নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। ডব্লিউএফপি জানিয়েছে, তারা বিস্তারিত তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখছে।
বার্তা সংস্থা এএফপির ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, দেইর আল-বালাহ শহরের আল-ঘাফারি গুদামে ক্ষুধার্ত লোকজন ঢুকে খাদ্যের বস্তা ও ময়দার প্যাকেট নিয়ে যাচ্ছেন। সেই সময় গুলির শব্দ শোনা যায়। গুলি কোথা থেকে এসেছে, তা তখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না।
ডব্লিউএফপি এক বিবৃতিতে বলেছে, প্রায় তিন মাস ধরে চলা ইসরায়েলি অবরোধের পর মানবিক সংকট ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে’। গত সপ্তাহে এ অবরোধ কিছুটা শিথিল করা হয়েছে।
ডব্লিউএফপি জানিয়েছে, বিতরণের জন্য ওই গুদামে আগেই খাদ্য মজুত রাখা হয়েছিল।
সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, গাজায় অবিলম্বে খাদ্যসহায়তা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। মানুষকে নিশ্চিত করতে হবে যে তাঁরা অনাহারে মরবেন না।
ডব্লিউএফপি বলেছে, তারা আগে থেকেই সতর্ক করে আসছিল, পরিস্থিতি দ্রুত খারাপের দিকে যাচ্ছে। সাহায্য সীমিত করার কারণে ক্ষুধার্ত মানুষের জীবন আরও হুমকির মুখে পড়ছে।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গতকাল বুধবার জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ১২১টি ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে, যাতে ছিল ময়দা ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী।
গত সপ্তাহে ইসরায়েল গাজায় সীমিত পরিমাণে ত্রাণ প্রবেশ করতে দেয়। তবে জাতিসংঘের মধ্যপ্রাচ্য দূত সিগ্রিড কাগ একে বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘জাহাজ ডুবে যাওয়ার পর যেন লাইফবোট দেওয়া হয়েছে।’ কারণ, গাজার প্রতিটি মানুষই দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল–সমর্থিত বিতর্কিত সংগঠন গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) ত্রাণ বিতরণের কাজ শুরু করেছে। জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থার মাধ্যমে এ সংস্থা পরিচালিত হচ্ছে। জাতিসংঘ একে অকার্যকর ও অনৈতিক বলে উল্লেখ করেছে।
জিএইচএফ দক্ষিণ ও মধ্য গাজায় চারটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র চালু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল দাবি করেছে, এ ব্যবস্থা হামাসের হাত থেকে ত্রাণ বাঁচাতে সাহায্য করছে। তবে হামাস ত্রাণ চুরির অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় জানিয়েছে, গত মঙ্গলবার রাফাহ শহরের একটি জিএইচএফ বিতরণকেন্দ্র চালুর এক দিন পর সেখানে উপচে পড়া ভিড় হয়। এ সময় সেখানে গুলিতে ৪৭ জন আহত হয়েছেন।
জাতিসংঘের আরেক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মানুষ জাতিসংঘের ত্রাণবাহী ট্রাক থেকেও জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যাচ্ছেন।
ফিলিস্তিনের জাতিসংঘ মানবিক দপ্তরের প্রধান জোনাথন হুইটল বলেন, হামাসের মাধ্যমে ত্রাণ চুরি হওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। বরং যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রকৃত লুটপাট চালিয়েছে কিছু অপরাধী চক্র, যাদের ইসরায়েলি বাহিনী কেরেম শালোম সীমান্তের কাছে কাজ করতে দিচ্ছে।
জাতিসংঘের মতে, যুদ্ধবিরতির সময় যেভাবে গাজায় দ্রুত ত্রাণ সরবরাহ করা হয়েছিল, ঠিক সেভাবে আবার ত্রাণ সরবরাহ বাড়ানো হলে ক্ষুধার্ত মানুষের হাতে লুটপাট বন্ধ হবে এবং গাজাজুড়ে জাতিসংঘের বিতরণ নেটওয়ার্ককে পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব হবে।