বৈশাখ থেকে আশ্বিন– এই ছয় মাস ইলিশের ভরা মৌসুম। কাগজ-কলমের হিসাব অনুযায়ী মৌসুমের অর্ধেক প্রায় গত, তবু উপকূলের নদী ও সমুদ্রে ইলিশের দেখা মিলছে না।
৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে আশায় বুক বেঁধে দিন-রাত উত্তাল সাগরে ভেসে থেকে দেনার বোঝা ভারী করে শূন্য হাতে ঘাটে ফিরছে জেলেদের ট্রলার। এখন খেয়ে-না খেয়ে হতাশায় দিন কাটাচ্ছে জেলে পরিবারগুলো।
সমুদ্রগামী জেলেদের ভাষ্য, প্রশাসনের কঠোর নজরদারি না থাকায় বাংলাদেশের জলসীমায় ভারত ও মিয়ানমারের জেলেরা তিন স্তরের বিশেষ ধরনের (লাশা-জাল) জাল ফেলছে। এভাবে উপকূলগামী ইলিশের গতি আটকে দিয়ে জেলেদের ভাগ্য ছিনিয়ে নিচ্ছে।
জালে মাছ কম ধরা পড়ার প্রভাব পড়েছে বাজারেও। লক্ষ্মীপুরের রামগতি মেঘনা নদীর পারের আড়তগুলোতে দেখা গেছে, এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৭০০ টাকায়। ৫০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ১০০ টাকায়।
ইলিশ না পেয়ে কষ্টে দিন কাটছে বলে জানিয়েছেন জেলেরা। তাদের দাবি, নিষেধাজ্ঞার সময় খাদ্য সহায়তা না পাওয়ায় দুর্ভোগে আছেন জেলার জেলেরা। তবে বুধবার রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের ১৫৮ জেলের মধ্যে চাল বিতরণ করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন অর্ধেক জেলে।
রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের কার্ডধারী জেলে আনিস ছৈয়াল বলেন, ‘সাগরে সরকারি নিষেধাজ্ঞার সময় বরাদ্দের চাল আমরা প্রকৃত জেলেরা ঠিকমতো পাই না। আমাদের নামে চাল এলেও তা বিতরণের সময় স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিজেদের লোকজনের মধ্যে ভাগ করে দেন। আমরা প্রতিবারই বঞ্চিত হই।’
কমলনগর উপজেলার আবু সাঈদ বলেন, ‘জেলে কার্ড আছে, নাম আছে তালিকায়, কিন্তু চাল পাই না। ধারদেনা করে সংসার চালাই, এভাবে আর কতদিন?’
রামগতি উপজেলার আজগর মাঝি জানান, অনেক দিন সরকারি সহায়তার কিছুই পাননি। হাতে কোনো টাকাও নেই। তাঁর প্রতিবেশী হারুন মাঝির ভাষ্য, জেলেরা না খেয়ে মরবে, সরকারের যেন তাতে কিছু যায় আসে না।
লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য অফিসের তথ্যমতে, জেলায় সমুদ্রগামী জেলে ২০ হাজার ১৫ জন। এর মধ্যে রামগতিতে ১৭ হাজার ৮৬০ জন, কমলনগরে ১ হাজার ৮১৫ জন, রায়পুরে ২২০ জন ও সদর উপজেলায় ১২০ জন জেলে দেখানো হয়েছে। তবে বাস্তবে আরও বেশি বলে দাবি জেলেদের।
জেলেরা অভিযোগ করেন, অনেক সময় তাদের নামে চাল বরাদ্দ হলেও তারা তা হাতে পান না। বরং মাস শেষ হওয়ার আগেই চাল বিতরণ দেখানো হয়। চালের বদলে বিকাশ বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নগদ অর্থ চান তারা।
জুন ক্লোজিংয়ে খাদ্য সহায়তা দেওয়া সম্পূর্ণ দেখানোর ঘটনা অস্বীকার করেছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেন। তাঁর ভাষ্য, ১ হাজার ১২০ টন খাদ্য প্রশাসনিক জটিলতায় বিতরণে বিলম্ব ছিল, সেই সহায়তা জুনের ক্লোজিংয়ে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ভোলার চরফ্যাসন উপজেলার সামরাজ, বকসি, গাছির খাল, বেতুয়া, ঢালচরসহ বৃহত্তম মৎস্য ঘাটে নিবন্ধিত জেলে ৪৪ হাজার ১০৫ জন। এর মধ্যে সমুদ্রগামী ট্রলার রয়েছে ১৭ হাজার ১৬৫টি। বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী আরও ছোট-বড় ৫০ হাজার জেলে রয়েছেন। মৎস্য পরিবহন ও বেচাকেনায় জড়িত আরও ৫০ হাজার শ্রমিক। নদী-সমুদ্রে ইলিশের আকাল থাকায় বেকার হয়ে পড়েছেন প্রায় দেড় লাখ মৎস্যজীবী। তারা ঘাটে ট্রলার নোঙর করে জাল বুনে সময় পার করছেন। নদীতেও ইলিশ সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে উপজেলার ২০টি বরফকল। এখানেও বেকার হয়ে পড়েছেন ৬০০ শ্রমিক।
ঢালচরের সমুদ্রগামী ফিশিং বোটের প্রধান মাঝি খলিল উদ্দিন জানান, ভারত ও মিয়ানমারের পতাকাবাহী শতাধিক অত্যাধুনিক জাহাজ সব সময় সাগরের বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থান করছে। প্রতিটি জাহাজের সঙ্গে রয়েছে ২০-২৫টি মাছ ধরার ছোট ট্রলার। ওইসব ট্রলার থেকে যান্ত্রিক উপায়ে এক ধরনের জাল ফেলা হয় সাগরে। এগুলো লাশা জাল নামে পরিচিত। তিন স্তরের ওই জাল ভেদ করে ছোট-বড় কোনো ইলিশই সাগরের বাংলাদেশ সীমান্তে আসতে পারছে না। ফলে দিন-রাত উত্তাল সাগরে জাল ফেলে মাছ না পেয়ে খালি হাতে ঘাটে ফিরতে হচ্ছে। লোকসানের মুখে পড়ছেন ট্রলার মালিকসহ জেলেরা।
সামরাজ ঘাটের জেলে ট্রলারের মাঝি আবদুর রব জানান, ২০ জন কর্মী নিয়ে দুই দিন সমুদ্রে ভেসে থেকে দুই ব্যারাল ডিজেলসহ ৪০ হাজার টাকা খরচ করে মাছ মিলেছে মাত্র ১০টি। আড়তে এই ১০টি মাছ বিক্রি করে পেয়েছেন মাত্র ৫ হাজার ৮২৫ টাকা। বিপাকে পড়েছেন ভাগীদার জেলেরা। একদিকে আড়তের দাদন, অন্যদিকে পরিবারের ভরণপোষণ মেটাতে হিমশিম অবস্থা তাদের।
নতুন স্লুইস মৎস্য ঘাটের আবুল মাঝি জানান, সাগরে ইলিশ ধরার জন্য মাঝারি আকারের একটি ট্রলার তৈরিতে ১৫ থেকে ১৮ লাখ টাকা খরচ হয়। এ বছর তিনি নতুন করে একটি ট্রলার বানিয়েছেন। ইতোমধ্যে সাত-আটবার সাগরে গিয়ে জাল ফেলেছেন, কিন্তু ইলিশের দেখা মেলেনি।
সামরাজ ঘাটের আড়ত মালিক হেলাল উদ্দিনের ভাষ্য, আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহের আবহাওয়া ইলিশ শিকারের উপযোগী ও ভরা মৌসুম। কিন্তু ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে তাঁর আড়তের দাদনভুক্ত ৩০টি ট্রলারের মধ্যে ১০টি ট্রলার ছোট-বড় ৬২টি ইলিশ নিয়ে ঘাটে ফিরেছে। যার বিক্রয়মূল্য ২১ হাজার টাকা। বাকি ২০টি ট্রলার ঘাটে ফিরেছে মাছশূন্য।
এই ঘাটের আড়ত মালিক কাদের মিয়ার দাবি, গত বছরের এই সময় প্রতিদিন ৬০-৭০ টন ইলিশ আসত ঘাটে। এবার দিনে ২০ হালি ইলিশও আসছে না। ঢালচর মৎস্য ঘাটের আড়ত মালিক নূরে আলম জানান, গত বছর এই সময়ে প্রতিদিন ১০০ টন মাছ আসত এই ঘাটে। এবার একেবারেই মাছ নেই।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার অপুর ভাষ্য, জলবায়ু পরিবর্তন ও আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব বিরাজ করছে। গভীর সাগরে সামান্য পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়লেও নদ-নদীতে একেবারেই ইলিশের দেখা মিলছে না। পুরোদমে বৃষ্টিপাত হলে নদ-নদীতে ইলিশের সংকট কেটে যাবে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র উপজ ল উপজ ল র র আড়ত ব তরণ মৎস য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
বহুজাতিক কোম্পানি আনতে করছাড় যথেষ্ট নয়
বহুজাতিক এবং দেশীয় বড় কোম্পানির জন্য শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে শুধু করছাড় যথেষ্ঠ নয়। নীতিগত অনিশ্চয়তা তাদের শেয়ারবাজারে না আসার অন্যতম কারণ। দেশের বড় কোম্পানিগুলোও শেয়ারবাজারে নানা জটিলতার কারণে আসতে চায় না। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা’ শীর্ষক আলোচনায় এমন মত দেন উদ্যোক্তারা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে করছাড় ও বিভিন্ন প্রণোদনা দেওয়ার পরও কোম্পানিগুলো কেন তালিকাভুক্ত হচ্ছে না, সে প্রশ্ন তুলেছে আইসিবিসহ শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা।
গতকাল বুধবার রাজধানীর নিকুঞ্জে ডিএসই টাওয়ারে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ, আইসিবির চেয়ারম্যান আবু আহমেদ, স্কয়ার ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফিকির সভাপতি ও ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও এমডি জাভেদ আখতার, ডিএসই চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম এবং ডিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলাম।
ড. আনিসুজ্জামান বলেন, সরকার ও প্রধান উপদেষ্টা শেয়ারবাজার নিয়ে যথেষ্ট ‘সিরিয়াস’। সংস্কারে ধৈর্য দরকার। সংস্কার করতে গিয়ে রাশিয়া ভেঙে গিয়েছিল। সংস্কার কার্যক্রমে কিছুটা ধীরগতি রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সবদিক ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে একটু সময় লাগছে।
আইসিবির চেয়ারম্যান আবু আহমেদ বলেন, ভারত, পাকিস্তান, নেপালে ইউনিলিভার তালিকাভুক্ত হলেও বাংলাদেশে হয়নি। ইউনিলিভারের মতো কোম্পানি জনগণের কাছ থেকে ব্যবসা করে মুনাফা করে। তাহলে জনগণের কাছে দায়বদ্ধতার প্রশ্ন আসা উচিত। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, মাত্র কয়েকটি শাখা নিয়ে তারা হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করে। বাংলাদেশে অনেক ব্যাংক শত শত শাখা নিয়েও তা পারে না। তা সত্ত্বেও স্থানীয় ব্যাংকগুলো তালিকাভুক্ত। কারণ তারা জনগণের অর্থ নিয়ে কাজ করে। এসব বহুজাতিক কোম্পানি অন্য কোনো দেশে তালিকাভুক্ত না হলে তিনি এ প্রশ্ন তুলতেন না। আবু আহমেদ বলেন, বিভিন্ন দেশ বহুজাতিক কোম্পানিকে ২০ শতাংশ শেয়ার ছেড়ে বাধ্যতামূলক আইন করলেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে উদার। মাত্র ১০ শতাংশ শেয়ার ছেড়ে তালিকাভুক্ত হয়ে করছাড় নিতে পারে।
জাভেদ আখতার বলেন, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিকল্প অর্থায়নের বহু সুযোগ আছে। শেয়ারবাজারে আসার জন্য শুধু করছাড় যথেষ্ট নয়। নীতিগত অনিশ্চয়তাও বড় কারণ। এক সময় বলা হয়েছিল ১০ শতাংশ শেয়ার ছেড়ে এলেই করছাড় পাওয়া যাবে। পরে বাড়িয়ে সম্পূর্ণ আইপিওর কথা বলা হয়। তাঁর মতে, আয়কর আইনে করপোরেট কর সাড়ে ২৭ শতাংশ বলা হলেও কার্যকর করহার ৪০ শতাংশের বেশি, যা কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত হতে আগ্রহ কমিয়ে দেয়।
তপন চৌধুরী বলেন, শেয়ারবাজারে আইনগত জটিলতা এবং বাজারের ভাবমূর্তি বড় কোম্পানিগুলোর আগমনকে বাধাগ্রস্ত করে। তাঁর মতে, বড় কোম্পানিগুলোর বাজারে না আসার আরেকটি কারণ হলো– ভালো মূল্য না পাওয়া এবং বাজারে মুনাফার সুযোগ নিয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের লোকসান হওয়া।
শেয়ারবাজার সংস্কার টাস্কফোর্স সদস্য এ এফ এম নেছারউদ্দিন বলেন, শুধু ‘টাকা দরকার নেই’ বলে শেয়ারবাজারে না আসার যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কোম্পানির বার্ষিক টার্নওভার ৫০০ কোটি রুপি ছাড়ালে তালিকাভুক্ত হতে ভারতে ২০১৮ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির প্রস্তাব স্মরণ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশেও তালিকাভুক্তি সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করতে বিএসইসি, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের সমন্বয় জরুরি।
বিএসইসি চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বলেন, ইউনিলিভারের পণ্য যদি ২ কোটি মানুষ ব্যবহার করে এবং প্রতিজনে পাঁচ টাকা মুনাফা দেয়, তাহলে সেই বিপুল মুনাফা তাদের একা রাখা উচিত নয়। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে মালিকানার অংশ জনগণের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, সরকার যদি নিজের ৩৯ শতাংশ মালিকানার মধ্যে থেকে ৫ শতাংশ শেয়ার ছাড়ে তাহলে বাকি ৬১ শতাংশের অংশীদারেরও একইভাবে অংশীদারিত্ব ছেড়ে দেওয়া উচিত।
ডিএসই চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজারের আর্থিক প্রতিবেদন ও নিরীক্ষা ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা না থাকলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো যাবে না। তিনি বাজেটে বাজারবান্ধব বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানান।