এক সময়ের বেকার তরুণ মো. তোফাজ্জল হোসেন অনেকের কাছেই এখন অনুপ্রেরণার এক জীবন্ত গল্প। নানা চাড়াই-উতরাই পেরিয়ে সমুদ্রের বহু জল সেচে স্বপ্নবাজ এ উদ্যোক্তা অনুকরণীয় এক সাহসে পরিণত হয়েছেন। গত প্রায় তিন দশকে তিনি তিল থেকে গড়ে তুলেছেন তিলোত্তমা। কৃষক বাবার ঘরে জন্ম নেওয়া কিশোর তোফাজ্জল মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হওয়া আগেই বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। যে স্বপ্ন তাঁকে ঘুমাতে দেয়নি। ভাঙাচোরা ঘরের মেঝেতে শুয়ে স্বপ্ন দেখে দেখে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। অদ্যম ইচ্ছা, সাহস, সততা আর সাধনার সমন্বয়ে আজ সফলতার শিখরে দাঁড়িয়ে আছেন তোফাজ্জল। তাঁর সফলতার এ গল্প এক দিনে তৈরি হয়নি। সময় লেগেছে প্রায় তিন দশক।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের পাথারপাড়া গ্রামের প্রয়াত হাফিজ উদ্দিনের ছেলে তোফাজ্জল হোসেন একটি অঞ্চলকে আলোকিত করেছেন। তাঁর হাত ধরেই শ্রীপুরের পশ্চিমাঞ্চলে পোলট্রি শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯৬ সালের শেষের দিকে শুরু করেছিলেন। বেকারত্বের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েন তিনি। গাঢ় অন্ধকারের ভেতর দিয়ে যিনি পথ চলতেন একা! সুদীর্ঘ পথ হেঁটে অতপর ক্লান্ত এই পথিক প্রাচীরের সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। আশপাশে কেউ ছিল না তখন। সমস্ত নিরাশা-অন্ধকার আর অশান্তি আগুনে পুড়ে তারুণ্য নামক শক্তিকে মূল পুঁজি করে নতুন এক পথে যাত্রা শুরু করেন তিনি। যে পথ অন্ধকার চেনে না, নিরাশার নাম শোনেনি কোনো দিন তিনি সেই পথের পাথিক। মাত্র ৩০০ মুরগি নিয়ে যাত্রা শুরু করে তোফাজ্জল তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন বিশাল আকারের কয়েকটি খামার।
তোফজ্জাল তখন ১৫ বছরের কিশোর। নানা অভাব-অনটন আর দুর্বিপাকে খেয়ে না খেয়ে পিতার সঙ্গে অনেক চেষ্টা করেছেন ভাগ্য ফেরাতে। কিন্তু কোনোটাতেই সুবিধা করতে পারেননি। ক্ষুদ্র অনেক ব্যবসার ধারণা পেলেও স্বপ্ন ছিল বড় কিছু করার। এরই মধ্যে গাজীপুর সদর উপজেলার সালনা এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যান। সেই বাড়ির উঠানে ব্রয়লার মুরগি পালনের একটি খামার নজরে আসে তাঁর। এই খামার তাঁকে উৎসাহিত করে। বাড়ি ফিরে নেমে পড়েন পুঁজি জোগাড় করতে। ছয় মাসের চেষ্টায় সামান্য পুঁজির ব্যবস্থা করেন তিনি। এরপর বাড়ির আঙিনায় অল্প খরচে একটি ছাপরা ঘর তুলে সেখানে খুব ছোট পরিসরে ৩০০ ব্রয়লার মুরগি পালন শুরু করেন। ৪০ দিন পর তা বিক্রি করে তিন হাজার টাকা লাভ হয়। সামান্য এ লাভ থেকেই সাহস বেড়ে যায়। পরে ঋণ করে ৫০০ লেয়ার মুরগি কিনে আনেন। কিন্তু এর ২৫ দিনের মাথায়ই স্বপ্নযাত্রায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ‘গাম্বা রোগ’। এই রোগে ২০০ মুরগি মরে যায়। পুঁজিও হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু দমে যাননি। আবার কিছু টাকা সংগ্রহ করে তা দিয়ে এবার ৫০০ ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা কেনেন। ৪০ দিন পর তা বিক্রি করে লাভ হয় আট হাজার টাকা। শুরুতে কাঠের বাক্স তৈরি করে এর ভেতরে মেঝেতে মুরগি পালন করতেন। পরে বিআরডিবি থেকে ১৬ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে খাঁচা কেনেন। একপর্যায়ে পুরোদমে ডিম উৎপাদন শুরু হয় খামারে। এভাবেই চলতে থাকে খামার সম্প্রসারণের কাজ।
দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য খামারে গিয়ে অর্জন করতে থাকেন বিশেষজ্ঞের দক্ষতা। তাছাড়া পোলট্রি সংক্রান্ত বইপুস্তক সংগ্রহ করে পড়তে থাকেন। এরপর আর তোফাজ্জলকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে প্রসার ঘটতে থাকে খামারের। এরই ফাঁকে গড়ে তোলেন রাইস মিল, ফিড মিল, ফিশারিজ, দুগ্ধ খামার, মেডিসিন সেন্টার ইত্যাদি। বর্তমানে তোফাজ্জলের খামারে রয়েছে ৫০ হাজার লেয়ার মুরগি। সব মিলিয়ে তাঁর শ্রমিকের সংখ্যা ৪০ জন। মায়ের নামে গড়ে তোলা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘আজিরন ফিড অ্যান্ড মেডিসিন সেন্টারে’ রয়েছে ডিমের বড় আড়ত। তোফাজ্জলের খামারের ডিম ছাড়াও আশপাশের খামারগুলোর লক্ষাধিক ডিম প্রতিদিন এই আড়ত থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়। লাভের একটা অংশ পান তোফাজ্জল হোসেন।
শ্রীপুরে যে ক’জন উদ্যোক্তা সর্বপ্রথম এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হন তোফাজ্জল তাদের মধ্যে একজন। তখন বন্ধুবান্ধব ও এলাকার লোকজন তাঁকে তিরস্কার করে কথা বলত। অন্যের কথায় কর্ণপাত করার সময় তাঁর কখনোই ছিল না। পোলট্রি খামারের লাভের টাকায় তোফাজ্জল উচ্চমূল্যের জমি, বাড়ি, গাড়ি সবই করেছেন। ৪ ভাইয়ের যৌথ একটা সংসার চালাচ্ছেন তিনি। শুধু তাই নয়, খামার করে শুধু তিনিই প্রতিষ্ঠা পাননি, প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজ এলাকাসহ পার্শ্ববর্তী ৬-৭ গ্রামের শতাধিক বেকার যুবককে। অসংখ্য বেকার তরুণকে আলোর পথ দেখানো তোফাজ্জল অনেকেরই প্রেরণা ও সাহসের নাম।
মোমবাতি আর কেরোসিনের বাতির পরিবর্তের ওই এলাকার ঘরে ঘরে এখন জ্বলে বৈদ্যুতিক বাতি, মাথার ওপর ফ্যান। পুরো এলাকায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। অথচ তোফজ্জল যখন শুরু করেন মুরগি পালন তখন এ অঞ্চল একটি অবহেলিত এলাকা ছিল। প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য সরকারি খরচে একবার ভিয়েতনামও গিয়েছিলেন। ছেলের পুরোপুরি সফলতা দেখে প্রয়াত হয়েছেন বাবা-মা।
তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের কথাই সত্য। তিনি বলেছেন, ‘স্বপ্ন সেটা নয়, যেটা মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে। স্বপ্ন সেটাই, যেটা পূরণের প্রত্যাশা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।’ তোফাজ্জাল বলেন, ‘সফল হওয়ার প্রেরণা-সফলতার একটি গল্প তৈরির জন্য কত রাত যে নির্ঘুম কাটিয়েছি। ভাঙা ঘরে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখতাম। আজ সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমি চমৎকার একটি স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই স্বপ্নে আমার আস্থা ছিল। জীবনে একটি স্বপ্ন থাকতে হয়, সেই স্বপ্নকে ভালোও বাসতে হয়। সেটা আমি করেছি। স্বপ্নকে পরম যত্নে লালনও করতে হয়। তবে মনে রাখতে হবে–স্বপ্নটা যেন কোনোভাবেই আকাশ-কুসুম না হয়।’ তরুণদের নানামুখী ক্ষুদ্রশিল্পের প্রতি ঝুঁকে পড়ার আহ্বান জানান তোফাজ্জল হোসেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ত ফ জ জল হ স ন ন ত ফ জ জল কর ছ ন র ম রগ র একট
এছাড়াও পড়ুন:
মরুর খেজুর চাষে সফলতা, বছরে আয় ৩০ লাখ
দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে সৌদি আরবের খেজুর চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন কুয়েত প্রবাসী জাকির হোসেন। তার বাগানে ছয় প্রজাতির খেজুর চাষ করে সফল হয়েছেন তিনি। বর্তমানে খেজুর ও চারা বিক্রিকরে বছরে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা উপার্জন করছেন প্রাক্তন এই প্রবাসী।
ফুলবাড়ীর স্বজনপুকুর এলাকায় তিন বিঘা জমি নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে জাকির হোসেনের খেজুর বাগান। তার বাগানে বর্তমান প্রায় ৮০টি গাছ রয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি গাছে পর্যাপ্ত ফল ধরেছে। মরিয়ম, আজওয়া, খলিজি, মেডজুল, বাহির ও আম্বার জাতের গাছ আছে। প্রতিটি গাছে পর্যাপ্ত ফল এসেছে। এসব খেজুর এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে পাক ধরবে। সুস্বাদু এই খেজুর প্রতিকেজি ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা কেজি হিসেবে বিক্রি হচ্ছে।
বাগানের পাশে আরও এক একর জমিতে জাকির হোসেন তৈরি করেছেন খেজুর গাছের নার্সারি। নার্সারিতে তৈরি করেছেন প্রায় ১২ হাজার চারা। এখান থেকে সাধারণ চারা বিক্রি করছেন তিনি ১০০০ টাকা করে এবং কলমি চারা বিক্রি করছেন প্রতিটি ১৫ হাজার টাকা করে।
খেজুর চারার নার্সারি
১৯৯৯ সালে কাজের উদ্দেশ্যে কুয়েতে যান জাকির হোসেন। প্রায় ২০ বছর থাকেন তিনি প্রবাসে। সেখানে সৌদি আরবের বিভিন্ন জাতের খেজুরের বাগান দেখে উৎসাহিত হন তিনি। ২০১৭ সালে তিনি ১২ কেজি পাকা খেজুর দেশে আনেন। সেই খেজুর থেকে চারা তৈরিতে সফল হন জাকির। প্রথমে ১৯টি চারা তৈরি করে তার পরিচর্যা করেন। চার বছর ধরে গাছগুলোর যত্ন নেওয়ার পর ২০২২ সালে তিনটি গাছে প্রথমবারের মতো ফল আসে। পরের বছর আরও নয়টি গাছে ফল আসে।
প্রথম তিনটি গাছে ৩০ থেকে ৩৫ কেজি করে খেজুর ধরেছিল। পরে নয়টি গাছে গড়ে ৮০-৯০ কেজি করে খেজুর ধরে। বর্তমান প্রতিটি গাছে ১৫০ থেকে ২০০ কেজি খেজুর ধরেছে। বর্তমানে বাগানটিতে তিন জন শ্রমিক কাজ করেন।
এলাকাবাসী জিল্লুর রহমান বলেন, “আমাদের এলাকায় এই প্রথম সৌদি আরবের সুমিষ্ট খেজুর চাষ হচ্ছে। আমাদের দেশের মাটি সোনার চেয়েও খাঁটি। আমি জাকির ভাইয়ের কাছ থেকে কয়েকটি চারা সংগ্রহ করেছি। গাছগুলো অনেকটা বড় হয়েছে। আশা করছি খেজুর চাষ করে স্বাবলম্বী হতে পারব।”
কাঁদি ভরা খেজুর
বাগানশ্রমিক রেজাউল করিম বলেন, “জাকির ভাইয়ের খেজুর বাগান তৈরির শুরু থেকে আমি কাজ করছি। গত কয়েক বছরের চেয়ে এবার অনেক বেশি খেজুর ধরেছে। খেজুর খুবই সুস্বাদু এবং মিষ্টি। বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসছেন এই বাগান দেখতে। আমরা এই বাগানে তিন জন কাজ করি। এখান থেকে যা দিন হাজরা পাই তা দিয়ে সংসার ভালই চলে।”
খেজুর বাগানমালিক জাকির হোসেন বলেন, “আমি ১৯৯৯ সাল থেকে কুয়েতে ছিলাম। সেখানে সৌদি আরবের বিভিন্ন জাতের খেজুর চাষ করতে দেখেছি। অনেক বাগান আছে। তখন চিন্তা করি, কেন আমার দেশে এই খেজুর হবে না? দেশে ফিরে প্রথমে পরিত্যক্ত ২০ শতক জমিতে চারা তৈরি করে আবাদ শুরু করি। ভাল ফলনও হয়। বর্তমান তিন বিঘা জমিতে বাগান করেছি। আমি এখানে খেজুরের চারার নার্সারি তৈরি করছি। সাধারণ চারা এক হাজার টাকা এবং কলমি চারা ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করছি। বর্তমান আমি বছরে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার খেজুর ও চারা বিক্রি করছি।”
ফুলবাড়ী উপজেলা অতিরিক্ত কৃষি অফিসার মো. শাহানুর রহমান বলেন, “ফুলবাড়ী উপজেলায় প্রথমবারের মতো জাকির হোসেন নামে একজন কুয়েত ফিরত ব্যক্তি সৌদি আরবের সুমিষ্ট খেজুর চাষ করছেন। এটা এলাকাবাসীর জন্য গৌরবের। এই জেলা ধান ও লিচুর জন্য বিখ্যাত। আশা করছি, খেজুরের জন্যও বিখ্যাত হবে। আমরা নিয়মিত ওই খেজুরের বাগান পরিদর্শন করছি এবং মালিককে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে আসছি।”
ঢাকা/এস