আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে প্রযুক্তি ও সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে নতুন রোগের উদ্ভব এবং পুরোনো রোগের পুনরুত্থান দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসজনিত রোগ, যা পানি, খাদ্য ও বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়।

রোগ মোকাবিলায় শক্তিশালী জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অভ্যাস প্রয়োজন। মুহাম্মদ (সা.

)-এর সুন্নাহ আমাদেরকে এমন পদ্ধতি শিখিয়েছে, যা আধুনিক স্বাস্থ্যবিধির সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।

পবিত্রতা ইমানের অর্ধেক

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনি তাঁদের ভালোবাসেন, যাঁরা তাঁর দিকে ফিরে আসেন এবং নিজেদের পবিত্র রাখেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২২২) নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘পবিত্রতা ইমানের অর্ধেক।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২২৩) এই বাণী থেকে বোঝা যায়, ইসলামে শারীরিক ও আধ্যাত্মিক পবিত্রতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। নবীজির জীবনাচরণে আমরা এমন অনেক অভ্যাস দেখতে পাই, যা আজকের বিজ্ঞানও স্বাস্থ্যকর বলে প্রমাণ করেছে।

হাঁচি-কাশিতে মুখ ঢাকার সুন্নাহ

হাঁচি বা কাশির সময় মুখ ঢাকা আধুনিক স্বাস্থ্যবিধির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ২০১৪ সালে এমআইটির (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) গবেষণায় দেখা গেছে, হাঁচি বা কাশির সময় নির্গত গ্যাসের মেঘ দীর্ঘ সময় বাতাসে ভাসতে পারে এবং এর কণা ৫ থেকে ২০০ গুণ দূরে ভ্রমণ করতে পারে। এটি বায়ুবাহিত রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি বাড়ায়। মুহাম্মদ (সা.) হাঁচির সময় মুখ ঢাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। (মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস: ৭৫৮৮)

নবীজির জীবনাচরণে আমরা এমন অনেক অভ্যাস দেখতে পাই, যা আজকের বিজ্ঞানও স্বাস্থ্যকর বলে প্রমাণ করেছে।

একজন মুসলিম হাঁচি বা কাশির সময় রুমাল, টিস্যু বা হাত দিয়ে মুখ ও নাক ঢাকেন। হাত দিয়ে ঢাকার ক্ষেত্রে ইসলামি নির্দেশনা অনুযায়ী হাত ধোয়া জরুরি, যা রোগের বিস্তার রোধ করে।

আরও পড়ুনভালো প্রতিবেশী হওয়ার ১০ উপায়০৫ জুন ২০২৫হাত ধোয়া: স্বাস্থ্য রক্ষার প্রথম ধাপ

হাত ধোয়া সংক্রমণ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়। অনেক ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া নাক বা মুখের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। ফেকাল-ওরাল পথে ছড়ানো রোগগুলো অপরিচ্ছন্ন হাতের মাধ্যমে খাদ্য বা বস্তুতে ছড়ায়। আধুনিক বিজ্ঞান এখন হাত ধোয়াকে স্বাস্থ্য রক্ষার প্রধান পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করে।

মহানবী (সা.) বিভিন্ন সময়ে হাত ধোয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর তিনি বলেন, সকালে হাত না ধুয়ে কোনো কিছু স্পর্শ করা উচিত নয়। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৬২) খাওয়ার আগে ও পরে (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৩,৮৫৪), টয়লেট ব্যবহারের পর, এটি ফেকাল-ওরাল রোগের বিস্তার রোধ করে এবং অজুর মাধ্যমে হাত, মুখ, নাক, বাহু ও পা ধোয়া হয়, যা নামাজের জন্য অপরিহার্য। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৯২)

অজু নিজেই একটি স্বাস্থ্যকর অভ্যাস, যা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ পরিষ্কার রাখে এবং রোগের বিস্তার রোধ করে।

মুহাম্মদ (সা.) সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করতেন এবং দুই-তিনবার জোরে ঝাড়া দিয়ে পানি বের করতে বলেছেন।নাক পরিষ্কার: শ্বাসতন্ত্রের সুরক্ষা

নাক আমাদের শ্বাসতন্ত্রের প্রথম প্রতিরক্ষা। এটি বাতাস পরিশ্রুত করে ধুলো, পরাগ, ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসকে ফুসফুসে পৌঁছাতে বাধা দেয়। নিয়মিত নাক পরিষ্কার না করলে সর্দি, সাইনাস সংক্রমণ, অ্যালার্জি ও শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি বাড়ে।

নবী মুহাম্মদ (সা.) সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করতেন এবং দুই-তিনবার জোরে ঝাড়া দিয়ে পানি বের করতে বলেছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৬২)

এই অভ্যাস নাকের পথ পরিষ্কার রাখে এবং শ্বাসতন্ত্রকে সুস্থ রাখে।

আরও পড়ুনমহানবী (সা.)–এর আতিথেয়তা১৩ জুন ২০২৫দাঁতের যত্ন: সামগ্রিক স্বাস্থ্যের অংশ

আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, মাড়ির রোগ (পিরিয়ডন্টাল ডিজিজ) হৃদ্‌রোগ, স্ট্রোক ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। মুখের ব্যাকটেরিয়া শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। মুহাম্মদ (সা.) মুখের পরিচ্ছন্নতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘মিসওয়াক মুখ পরিষ্কার করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৮৮৮) তিনি আরও বলেন, যদি উম্মতের ওপর বোঝা হওয়ার আশঙ্কা না হতো, তবে প্রতি নামাজের আগে মিসওয়াক ব্যবহারের নির্দেশ দিতেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫২)

মিসওয়াক মুখ পরিষ্কার করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৮৮৮

মিসওয়াক, যা সালভাডোরা পার্সিকা গাছের ডাল থেকে তৈরি, বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান (সালভাডোরিন ও ট্রাইমেথাইলামিন) ধারণ করে। এটি প্লাক ও মাড়ির প্রদাহ কমায় এবং টুথব্রাশের মতোই কার্যকর। (জার্নাল অব ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন, ২০১৩)

নবীজির অন্যান্য স্বাস্থ্যকর অভ্যাস

মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনে আরও কিছু অভ্যাস ছিল, যা আধুনিক স্বাস্থ্যবিধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন তিনি শরীর, পোশাক ও বাড়ি পরিষ্কার রাখার ওপর জোর দিয়েছেন (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২,৮০৩) এবং তিনি সুগন্ধি ব্যবহারকে পূর্ববর্তী নবীদের অভ্যাস ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২,৭৮৬)

শেষ কথা

মুহাম্মদ (সা.)-এর সুন্নাহ আমাদেরকে এমন একটি জীবনধারা শিখিয়েছে, যা শরীর, মন ও আত্মার সুস্থতা নিশ্চিত করে। হাত ধোয়া, নাক পরিষ্কার, মুখের পরিচ্ছন্নতা এবং হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢাকার মতো সাধারণ অভ্যাস আজকের বিজ্ঞানের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। এই সুন্নাহগুলো আমাদেরকে রোগ থেকে রক্ষা করে এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সহায়তা করে। আসুন, আমরা নবীর এই শিক্ষাগুলো আমাদের জীবনে গ্রহণ করি এবং পবিত্রতার পথে এগিয়ে যাই।

সূত্র: অ্যাবাউট ইসলাম ডট নেট

আরও পড়ুনউত্তম ব্যবসায়ী হওয়ার নববি কৌশল০৯ জুন ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন ক পর ষ ক র স ব স থ যকর সহ হ ব খ র ক শ র সময ম হ ম মদ আম দ র র জ বন ম সওয র করত আজক র

এছাড়াও পড়ুন:

সাইবেরিয়ান হাঁস

১.

নদীকে স্ফীত করে ফেলে যে কুয়াশা, তার ভেতর দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটি। তার গায়ের রং মেঘের মতোই ধোঁয়াশা সাদা। চোখ থেকে ঝরে পড়ছিল বৃষ্টি শেষের রোদ্দুর। আমি তার ছবির গ্রাহক। কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তার সব ছবিই কুয়াশায় আচ্ছন্ন কেন?

‘আমি এক সন্তানহারা রমণীর গল্প ফেরি করি আর ভালোবাসি কুয়াশা’; সে বলেছিল আমাকে উদ্দেশ করে।

এ কথার উত্তরে আমাকে বোবা হয়ে যেতে দেখে সে স্বগতোক্তির মতো করে বলে, ‘আমার মা ছিল সাইবেরিয়ান শীতের জমাট কুয়াশা, আর বাবা ছিল আটলান্টিক ওশানের আইসি ওয়াটার। আমি আর কীই–বা করতে পারতাম, বলো?

ওয়েল, ‘তুমি চাইলে অনেক কিছুই হতে পারতে।’

‘আমার ইচ্ছা ছিল সাইবেরিয়ান হাঁস হব। কুয়াশার ওপর দিয়ে মেঘের সাথে উড়ে বেড়াব। কিন্তু আমি হয়েছি আটলান্টিক স্যামন। আইসি ওয়াটারে সাঁতার কাটাই যার নিয়তি।’

আমি আর কথা না বাড়িয়ে ছবিটা বগলদাবা করে হাঁটা দিলাম। ওর কথায় চারদিক থেকে কুয়াশা নেমে আসতেছিল।

২.

জিপসি মেয়ের কাছ থেকে আনা ছবিটা আমার পড়ার ঘরের দেয়ালে টাঙালাম। সেটা থেকে কুয়াশা ঝরে পড়ছে। দৃষ্টিতে শীতলতা নিয়ে আমি তার ওম দেখি।

মেয়েটির নাম জানা হয়নি। ওর নামটা কি স্নো পড়া শুভ্রতাকে মনে করিয়ে দেবে? কেন যে আমি আর একটু থাকলাম না ওর সাথে, কেন আরও কিছু কথা শুনলাম না, কেন যে!

এর কয়েক দিন পর এক সাইবেরিয়ান রমণীর সাথে দেখা। তার কাছে শুনলাম জিপসি মেয়েটির নাম ক্যাথিয়া। তার মায়ের নাম তাতিয়া আর বাবা ভ্লাদ। ওরা সাইবেরিয়া থেকে যাত্রা শুরু করেছিল, পথই ওদের দেশ। অবিরাম চলতে থাকা তাতিয়া আর ভ্লাদ পথের পাশেই একদিন কুড়িয়ে পেয়েছিল ক্যাথিয়াকে। ক্যাথিয়া নামটা তাতিয়া বহু বছর আগেই ঠিক করে রেখেছিল। সে জানত, লাল টুকটুকে জামা পরা একটা মেয়েকে সে কোনো একদিন রাস্তার পাশে কুড়িয়ে পাবে। ও মেয়েটির নাম দেবে ক্যাথিয়া। দেশে দেশে, পথে পথে লাগাতার সাত বছর ওরা খুঁজে বেড়াবে ক্যাথিয়ার মা-বাবাকে, কিন্তু পাবে না। সাত বছর পর এই মেয়েটি ওর হবে। এই স্বপ্নই তাতিয়াকে পথে নামিয়েছিল। ক্যাথিয়া তার স্বপ্নের রাজকন্যা, তাকে বাস্তাবে পাওয়া যাবে কি না, তার তা জানা নাই।

আমি যতই তাতিয়ার কথা শুনছিলাম, ততই কুয়াশার ভেতর ঢুকে যাচ্ছিলাম।

অবিরাম চলতে থাকা তাতিয়া আর ভ্লাদ পথের পাশেই একদিন কুড়িয়ে পেয়েছিল ক্যাথিয়াকে। ক্যাথিয়া নামটা তাতিয়া বহু বছর আগেই ঠিক করে রেখেছিল। সে জানত, লাল টুকটুকে জামা পরা একটা মেয়েকে সে কোনো একদিন রাস্তার পাশে কুড়িয়ে পাবে।৩.

আগের দিনের যে কুয়াশাকে আমি রোমান্টিসাইজ করতেছিলাম, পরের দিনে সকালে তা–ই ভাসিয়ে দিচ্ছিল আমার পড়ার ঘর। দরজা খুলতেই গলগল করে কুয়াশা বের হয়ে রওনা করেছে ড্রয়িংরুমের দিকে।

আমি তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিলাম। কুয়াশার ভেতর দাঁড়িয়ে থেকে টের পাচ্ছিলাম একটা মনোরম ওম, যা হাঁসের পাখার নিচে লুকিয়ে থাকে।

আমি জানি, আমার বউ এই সব দেখলে রাগারাগি করবে। এমনকি ছবিটা গ্যারেজে নিয়েও রেখে দিতে পারে বা দিয়ে দিতে পারে সালভোসের অপ সপে। এর আগেও এমন হয়েছে।

একটা ছবি আমি কিনে এনেছিলাম ভিক্টোরিয়া রাজ্যের একদম শেষ প্রান্তের একটা ছোট্ট শহর মৌলামাইন থেকে। ছবিটা ছিল খুবই অর্ডিনারি, দিনের আলোতে সে খুবই নিরীহ একটা অতি সাধারণ ছবি।

কিন্তু রাতের বেলায় আবছা আলোতে সে জীবন্ত হয়ে উঠত। শোনা যেত শোঁ শোঁ, সাঁই সাঁই বাতাসের শব্দ, ঢেউ ভাঙার গর্জন। প্রথমে আস্তে আস্তে, তারপর মনোযোগটা টেনে নেওয়ার পর শুরু হতো উথালপাতাল ঢেউয়ের সাথে ঝোড়ো হাওয়ার তাণ্ডব। আমাদের ঘরটা তখন হয়ে যেত উত্তাল সমুদ্রে ঝড়ে পড়া ডিঙি। আর আমরা হয়ে যেতাম সেই ছবির মধ্যে নৌকায় টলমল করতে থাকা তিনজন যাত্রী; যারা নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে।

দুই–তিনবার এমন হওয়ার পর আমি আর ছবিটাকে রক্ষা করতে পারি নাই। কিছুদিন গ্যারেজে থাকার পর একদিন আমার বউ তাকে হার্ড রাবিশের সাথে রাস্তায় রেখে আসে।

আমি সারাক্ষণ চোখ রাখতেছিলাম, কে নেয় ছবিটা দেখার জন্যে। কিন্তু কখন যে ছবিটা উধাও হয়ে গেল; কে যে নিল, তা কিছুতেই খেয়াল রাখতে পারলাম না।

ছবিটার জন্যে এখনো আমার মন খারাপ হয়। মনে হয়, আমাদের বিদেশ–বিভুঁইয়ে, এই নিস্তরঙ্গ জীবনে সেটা ছিল একমাত্র আলোড়নের সম্ভাবনা। ছিল জাগতিক ভয়ের ঊর্ধ্বে ঐশ্বরিক এক শিহরণের স্বর্গীয় সম্ভাবনাকে জিইয়ে রাখার অবলম্বন। কিন্তু আমার বউ তা বুঝল না। এবারও সে বুঝবে না এবং আমার এই ক্রমাগত কুয়াশা বিচ্ছুরণের নিষ্পাপ উৎসকে কালিমা লেপে বাতিল করার ষড়যন্ত্রে উঠে–পড়ে লাগবে। আমি জানি, ও লাগবেই।

৪.

জিপসি মেয়েটাকে কীভাবে খুঁজে পাব, তার কোনো দিশা আমি ঠিক করতে পারতেছিলাম না। ওর সাথে দেখা হয়েছিল সানডে মার্কেটে। আমি ভিক্টোরিয়া রাজ্যের সানডে মার্কেট কখন কোথায় হয়, দেখতে গিয়ে দেখি, প্রায় গোটা বিশেক সানডে মার্কেট, মেলবোর্নের আশপাশেই বসে। আবার সময়েরও হেরফের আছে। কোনো মার্কেট হয়তো মাসের প্রথম সপ্তাহে বসে আর কোনোটা দ্বিতীয়, কোনোটাবা মাসের চতুর্থ সপ্তাহে।

কোনটা দিয়ে শুরু করব বুঝতেছি না।

আবার ও তো একটা মার্কেটে দুইবার বসে না। প্রতি সানডেতে সে একটা নতুন এলাকায় চলে যায় এবং সেখানকার সানডে মার্কেটে বসে। এটা খুবই হতে পারে যে ও যে মার্কেটে বসতেছে, সেখান আমি যাচ্ছি না। আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে সে নাই। একটা গোলকধাঁধার ভেতর ঢুকে যাচ্ছি, নিয়ন্ত্রণহীন, হাওয়ার ভেসে বেড়ানো বেলুনের মতো।

দিনের আলোতে সে খুবই নিরীহ একটা অতি সাধারণ ছবি। কিন্তু রাতের বেলায় আবছা আলোতে সে জীবন্ত হয়ে উঠত। শোনা যেত শোঁ শোঁ, সাঁই সাঁই বাতাসের শব্দ, ঢেউ ভাঙার গর্জন। প্রথমে আস্তে আস্তে, তারপর মনোযোগটা টেনে নেওয়ার পর শুরু হতো উথালপাতাল ঢেউয়ের সাথে ঝোড়ো হাওয়ার তাণ্ডব।৫.

লাগাতার কয়েক মাস সানডে মার্কেটে ঘোরাঘুরির পর একদিন তাতিয়াকে পেয়ে যাই। তাতিয়া তামা বা রুপার তার দিয়ে গহনা বানায়। সেগুলো সে কার্নিভ্যালে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে আর যখন কার্নিভ্যাল থাকে না, তখন সানডে মার্কেটে।

‘তুমি লাল জামা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছ কি মেয়েদেরকে হর্নি করার জন্যে?’ তাতিয়া আমাকে বলে। আমি লজ্জায় আরও একটু লাল হয়ে ওরে জিজ্ঞেস করি, ‘লাল জামা কি হর্নি করে নাকি?’

‘হ করে তো,’ ও বলে।

‘মেয়েরা কি এই জন্যেই লাল জামা পরতে পছন্দ করে?’ আমি জিজ্ঞেস করি।

ও বলে, ‘না। মেয়েরা লাল জামা তখনই পরে, যখন সে তার মা ও মাটিকে মিস করে। একটা নস্টালজিক মুগ্ধতার ভেতর থাকে তারা, সে সময়।’

‘রিয়েলি!’ আমি বলি।

তাতিয়া আমার দিকে এমনভাবে তাকায়, যেন সে কুয়ায় পড়ে যাওয়া কোনো বালককে দেখার চেষ্টা করতেছে।

আমার চোখ ওর চোখ থেকে সরিয়ে নিই। দেখি, দোকানে সাজিয়ে রাখা গয়নার ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা শূন্যতাকে। আর বলি, ‘তোমার গয়নাগুলো সুন্দর। আমার কেউ নাই, থাকলে আমি একজোড়া কিনে নিতাম।’

‘তুমি গয়না কিনতে আসো নাই, আমি জানি।’

আমার নীরবতা ওর কথাকে আর আগাতে দেয় না।

আমি চলে আসার মুহূর্তে তাতিয়া আমাকে বলে, ‘ক্যাথি আর ভ্লাদ বিয়ে করেছে। ওরা এখন অন্য শহরে থাকে।’

তাতিয়া এমন বাড়তি নির্লিপ্ততার সাথে কথাগুলো বলল, যেন কথা বলছে না, উগরে দিচ্ছে কতগুলো পরিত্যক্ত লোহালক্কড়। আর তারপরই দৃঢ় পদে আমার সামনে থেকে একজন কাস্টমারকে উদ্দেশ্য করে হেঁটে গেল, ওর দৃঢ়তা এবং স্থিরতা আমাকে পাহাড় ডিঙানো মহিষের কথা মনে করিয়ে দেয়।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে কুয়াশায় অন্ধকার হয়ে যাওয়া পথহীন একটা দুনিয়ার পথ ধরে মহিষের মৌনতা নিয়ে হাঁটতে থাকি।

৬.

বাড়ি এসে আমি নিজেই ছবিটা সালভোসের অপ সপে দিয়ে আসতে যাই। ছবিটা থেকে এখন আর কুয়াশা ঝরছে না, যেন মৃত কুয়াশাকে কবর দেওয়ার জন্যে তাতিয়া নিয়ে যাচ্ছে গোরস্তানে। একটা লাশ বহনকারী গাড়ির পেছন পেছন আমি হাঁটি। একটা দীর্ঘ ক্লান্তিকর ভ্রমণের পর সালভোসের দোকানে পৌঁছাই।

দোকানে গিয়ে দেখি, ক্যাথিয়ার আরও একটা ছবি সেখানে রাখা।

ছবিটার নিচের দিকে কুয়াশার ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে হাজার হাজার মাকড়সার বাচ্চা, সেই মাকড়সার চেইন দিয়ে লেখা হয়েছে দুইটা লাইন:
‘তোমার অপেক্ষা বিফলে যাবে,
দমকা বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যাবে নিস্ফলা গাছের শেষ পাতাটি।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ