যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের শুল্ক চুক্তি করার সম্ভাবনা রয়েছে। চুক্তির খসড়াও তৈরি হয়েছে, যা নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা হবে আগামী ৩ ও ৪ জুলাই। চুক্তি হলে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের বাংলাদেশি পণ্যের ওপর আরোপ করা বাড়তি ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের হার কিছুটা কমবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিতে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন ওয়াশিংটন যাবেন। একই বিষয়ে ২৬ জুন যুক্তরাষ্ট্র সফররত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মো.

খলিলুর রহমান ইউএসটিআরের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছেন। ইউএসটিআরের সঙ্গে আগামী বৈঠকেও খলিলুর রহমান উপস্থিত থাকবেন।

বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন গতকাল রোববার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক চুক্তি করার দ্বারপ্রান্তে আছি ঠিক, তবে এটা শর্ত সাপেক্ষে। যদি মনে করি যে বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতা বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া শর্তগুলো মানা সম্ভব, তাহলেই চুক্তি হবে।’

বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘কিছু তথ্য পাওয়া বাকি আছে। শর্তসহ পুরো প্রক্রিয়াটা উপদেষ্টা পরিষদকে জানাব। ৩ জুলাইয়ের আগে না গিয়ে পরেও যেতে পারি। নিরাপত্তা উপদেষ্টা তো যুক্তরাষ্ট্রে আছেনই।’

বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে আসছে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে। গত ৩ এপ্রিল হঠাৎ ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশি পণ্যের ওপর বাড়তি ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়। শুল্কের হার কম-বেশি করে দেশটি একই ধরনের সিদ্ধান্ত নেয় ৬০টি দেশের ওপর।

বাড়তি শুল্ক আরোপ কার্যকরের কথা ছিল ৯ এপ্রিল। তবে ওই দিনই যুক্তরাষ্ট্র বাড়তি শুল্ক হারের ঘোষণা তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখে। স্থগিতের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ৯ জুলাই। বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা আশাবাদী যে স্থগিতের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়ে দিতে পারেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

তিন মাসের জন্য সিদ্ধান্ত স্থগিত চেয়ে গত ৭ এপ্রিল ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান রপ্তানি পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক কমানো নিয়ে বাংলাদেশ কাজ করছে বলে জানানো হয়।

ইউএসটিআরের রাষ্ট্রদূত জেমিসন গ্রিয়ারের কাছে একই দিন আলাদা চিঠি পাঠিয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিতে যদি কোনো বাধা থাকে, তা দূর করতে বাংলাদেশ প্রস্তুত এবং বাংলাদেশ সব সময় গঠনমূলক সংলাপ ও সহযোগিতায় বিশ্বাসী।

উভয় দেশের মধ্যে এরপর দুই মাসে কয়েক দফা সরাসরি বৈঠক হয়েছে। হয়েছে চিঠি-চালাচালি এবং অনলাইন বৈঠক। ইউএসটিআরের সঙ্গে এর আগে গত ২১ এপ্রিলও ওয়াশিংটনে একটি বৈঠক হয় বাংলাদেশের। এতে তারা ছয়টি বিষয়ে জানতে চায়। ৪ জুন চিঠি দিয়ে ব্যাখ্যা জানানো হয়। শুল্ক চুক্তির খসড়াটি করা হয় ১২ জুন, যার ৫ দিনের মাথায় ১৭ জুন এর ওপর করা হয় অনলাইন বৈঠক। এ বৈঠকের ধারাবাহিকতায় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা খলিলুর রহমান ২৬ জুন ওয়াশিংটনে বৈঠক করেন।

যে ছয় বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, সেগুলো কী, এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে কথা না বলার শর্ত রয়েছে।

তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্র এমন কিছু বিষয় চেয়েছে, যা তাদের দেশের আইনে প্রযোজ্য। বাংলাদেশের আইনে প্রযোজ্য নয়, এমন বিষয়ে একমত না হতেই দর-কষাকষি করে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানতে পেরেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোর পাশাপাশি ভারত, ভিয়েতনাম, জাপান ইত্যাদি দেশ পাল্টা শুল্কের হার কমানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে যে এ বিষয়ে তারা কোনো ধরনের আলোচনায় আর বসবে না।

বাণিজ্যসচিব গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, পাল্টা শুল্কের হার কমাতে যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশই এগিয়ে রয়েছে।

সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে যেসব আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, তার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি তিন লাখ টন গম আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। প্রতি টনে ২০ থেকে ২৫ মার্কিন ডলার বেশি হলেও যুক্তরাষ্ট্র থেকেই এ গম আমদানি করা হবে। বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে বোয়িং উড়োজাহাজ আমদানির। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানির পরিমাণ বাড়াতে কয়েকটি গুদাম নির্মাণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা হয়, এমন বেশির ভাগ পণ্যের ওপর শুল্ক রাখা হয়নি অর্থাৎ শূন্য শুল্ক করে দেওয়া হয়েছে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৮৩৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হয়েছে ২২১ কোটি ডলারের পণ্য।

বাংলাদেশ নিট পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মো. ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আশা করছি যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন পাল্টা শুল্ক আরোপের বিষয়টি লম্বা সময়ের জন্য স্থগিত করবে। একান্ত যদি না–ই করে, সরকারের উচিত হবে দেশটির সঙ্গে দেনদরবার করে বাংলাদেশের শুল্কের হার যেন প্রতিযোগী ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ভারত ইত্যাদি দেশের সমান বা কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যায়।’

ফজলুল হক আরও বলেন, ভারতের পাল্টা শুল্কের হার বাংলাদেশের চেয়ে কম। ভারত যদি দর-কষাকষি করে আরও কমাতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের বিপদ ভবিষ্যতে বাড়বে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এ ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র থ ক ব ণ জ য উপদ ষ ট প রথম আল ক শ ল ক আর প র রহম ন আমদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

সাবেক গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের পরিবারের সদস্যদের হিসাব তলব

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাবেক ৩ গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর, সাবেক বিএফআইইউ প্রধান এবং তাদের পরিবারের সদস্য তথা স্ত্রী-সন্তান-জামাতা-পূত্রবধূর হিসাবও তলব করেছে। এসব ব্যক্তির হিসাবের যাবতীয় তথ্য জানাতে দেশের সব তফসিলি ব্যাংককে এ সংক্রান্ত চিঠি দিয়েছে বিএফআইইউ।

বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) বিএফআইইউর একজন কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।

তিনি জানান, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুরোধে সাবেক গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তাদের হিসাব তলব সংক্রান্ত চিঠি বুধবার ব্যাংকগুলোকে দিয়েছে বিএফআইইউ। 

আরো পড়ুন:

সাবেক ৩ গভর্নর ও ৬ ডেপুটি গভর্নরের ব্যাংক হিসাব তলব 

১২ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এল ১০৫ কোটি ডলার

বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালন করা এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আর্থিক খাতের বিভিন্ন অনিয়ম, ব্যাংক দখলের মাধ্যমে অর্থ লোপাট এবং অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়ে ঋণ বিতরণের মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। হিসাবের যাবতীয় তথ্য পাওয়ার পর এসব ব্যক্তির হিসাবে অস্বাভাবিক কোন লেনদেন হয়েছে কিনা সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।

যাদের হিসাব তলব করা হয়েছে তাদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান, ফজলে কবির এবং আব্দুর রউফ তালুকদার। অভিযোগ অনুযায়ী, ফজলে কবিরের মেয়াদে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর দখল নিয়ে লুটপাট শুরু হয় এবং তা অব্যাহত থাকে আব্দুর রউফ তালুকদারের সময়েও। বিশেষ করে রউফ তালুকদারের সময় টাকা ছাপিয়ে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাটের সুযোগ তৈরি হয়েছিল বলে তদন্তে উঠে এসেছে।

হিসাব তলব করা সাবেক ডেপুটি গভর্নরদের মধ্যে রয়েছেন এস কে সুর চৌধুরী, এস এম মনিরুজ্জামান, কাজী ছাইদুর রহমান এবং আবু ফরাহ মো. নাছের। এর মধ্যে এস কে সুর চৌধুরী বর্তমানে দুর্নীতি মামলায় কারাবন্দি। একই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন বিএফআইইউর সাবেক প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাসও।

অন্যদিকে সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে সরকারি ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের অবৈধ আর্থিক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আর আবু ফরাহ মো. নাছেরের বিরুদ্ধে নীতিমালা শিথিল করে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

বিএফআইইউর সাবেক প্রধান আবু হেনা মো. রাজী হাসান এবং মো. মাসুদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। বিএফআইইউ থেকে ব্যাংকগুলোকে পাঠানো চিঠিতে তাদের পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব, লেনদেন বিবরণী, হিসাব খোলার ফরম এবং পরিচয় সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ব্যাংকগুলোর কাছে চাওয়া হয়েছে। কোনো হিসাব বর্তমানে বন্ধ থাকলেও, সেটির তথ্য আলাদাভাবে জানাতে বলা হয়েছে।

ঢাকা/নাজমুল/সাইফ

সম্পর্কিত নিবন্ধ