দেশ যখন বহুমাত্রিক সংকটে জর্জরিত, তখন অর্থনীতির গাঢ় ধোঁয়ার ভেতর হঠাৎ একরাশ সূর্যকিরণ উদিত হয়েছে। রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের প্রবাহ অপ্রত্যাশিতভাবে আশাজাগানিয়া রূপ নিয়েছে। ২০২৫ সালের জুন মাসে একক মাসেই প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন রেকর্ড ২ দশমিক ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটি শুধু একটি সংখ্যামাত্র নয়, বরং সংকটে ন্যুব্জ অর্থনীতির বুকে আশার পুনর্জাগরণ। একই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। গত ১১ মাসে রিজার্ভ বেড়েছে ১১ বিলিয়নের বেশি। এই প্রবাহ অর্থনীতির চাকা আবার ঘুরতে শুরু করেছে বলে এক নিঃশব্দ বার্তা দিচ্ছে।
অর্থনীতির এক বিপন্ন প্রেক্ষাপটমাত্র এক বছর আগেও পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। রিজার্ভ নেমে গিয়েছিল ২০ বিলিয়নের নিচে। তখন বাজারে ছড়িয়ে পড়েছিল চরম অনিশ্চয়তা। ডলার–সংকট, আমদানিজট, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতায় দেশের অর্থনীতির ভিত্তিই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশের ঘরে ঘোরাঘুরি করছিল। পণ্য আমদানি বন্ধের মুখে বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান উৎপাদন স্থগিত করেছিল। বিদেশি ঋণ পরিশোধ ও খাদ্যশস্য আমদানির জন্যও সরকারকে হিমশিম খেতে হয়েছিল।
সেই পরিপ্রেক্ষিতে এখন যখন রিজার্ভ বাড়ছে, রেমিট্যান্সে রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে, তখন প্রশ্ন জাগে, এ কি সত্যিই ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু, নাকি কেবল একটি সাময়িক স্বস্তির ধারা?
রেমিট্যান্স–উত্থানঅর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ থেকে যেসব কারণ উঠে এসেছে, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়:
প্রথমত, ডলারের বিনিময় হার দীর্ঘদিন স্থিতিশীল রাখা গেছে। বাজারে ১১২ থেকে ১১৩ টাকার মধ্যে ডলারের মূল্য ধরে রাখা হয়েছে। হুন্ডির সঙ্গে প্রতিযোগী হারে বৈধ চ্যানেলে প্রেরণে প্রণোদনা সংযুক্ত করায় প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলকেই বেশি লাভজনক মনে করছেন।
দ্বিতীয়ত, সরকারের হুন্ডিবিরোধী অভিযান, মানি লন্ডারিং রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়া নজরদারিতে অবৈধ চ্যানেল সংকুচিত হয়েছে। এতে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে আইনি পথে অর্থ পাঠানোর মনোভাব গড়ে উঠেছে।
তৃতীয়ত, বিশ্ববাজারে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, রোমানিয়াসহ নতুন নতুন শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিক পাঠানো হচ্ছে। সরকার দক্ষ কর্মী প্রশিক্ষণ, ভাষাশিক্ষা এবং চুক্তিনির্ভর প্রেরণ নিশ্চিত করায় প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ও মান দুই-ই বেড়েছে।
চতুর্থত, অভ্যন্তরীণ ব্যাংকব্যবস্থার কিছু সংস্কার যেমন প্রবাসী অ্যাকাউন্টে লেনদেনের সুবিধা বৃদ্ধি ও রেমিট্যান্সভিত্তিক সঞ্চয় প্রকল্প চালু করা হয়েছে। এতে মানুষ বৈধ চ্যানেলের প্রতি উৎসাহী হয়েছে।
এই অর্জনের প্রভাব কীভাবে ছড়াচ্ছেরেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিদেশে থাকা কর্মীরা যখন নিজের পরিবারকে টাকা পাঠান, তখন তা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়ায়। এই বাড়তি মুদ্রা সরকারের জন্য বিভিন্ন কাজে সহায়ক হয়। যেমন আমদানি খরচ মেটানো, ঋণ পরিশোধ করা, খাদ্য ও জ্বালানি আমদানিতে সাহায্য করা ও বাজারে ডলারের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা। এর ফলে ব্যাংকগুলো আরও বেশি এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খুলতে পারে, বিশেষ করে শিল্প ও ওষুধ খাতে, যা দেশীয় উৎপাদন ও সেবা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে এখন নতুন একটা আস্থা তৈরি হচ্ছে, কারণ, রেমিট্যান্সের কারণে মুদ্রার জোগান সুষ্ঠু হচ্ছে। বাজারে ডলারের দাম কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ার ফলে আমদানি পণ্যের দামও নিয়ন্ত্রণে আসছে। খাদ্যপণ্যের মূল্য কমে আসায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় স্বস্তি ফিরে আসছে। এই মূল্যস্ফীতির চাপ কমে যাওয়ায় দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তাই রেমিট্যান্স শুধু অর্থ পাঠানো নয়, এটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির এক বড় চালিকা শক্তি।
পরিসংখ্যান যা বলছেঅর্থবছর মোট রেমিট্যান্স (বিলিয়ন ডলার) জুন মাসের আয় রিজার্ভ (জুলাই শেষে)
২০২১-২২ ২১ দশমিক শূন্য ৩ ১ দশমিক ৮৬ ৩৯ দশমিক ৭৮
২০২২-২৩ ২১ দশমিক ৬১ ১ দশমিক ৯৭ ২৩ দশমিক ৫৩
২০২৩-২৪ ৩০ দশমিক ৩৩ ২ দশমিক ২১ ৩১ দশমিক ৭২
এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে দেখায়, এক অর্থবছরে প্রায় ৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।
চ্যালেঞ্জ কি পেরিয়ে গেলামএত সুখবরের ভিড়ে একটা প্রশ্ন বারবার মাথাচাড়া দেয়, তাহলে কি আমরা সত্যিই সংকট পেরিয়ে এলাম?
না। এখানেই আসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। রেমিট্যান্স বাড়লেও ব্যাংক খাতে গৃহীত ঋণের অনাদায়ি প্রবণতা, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও দুর্বল শাসনব্যবস্থা এখনো বড় বাধা হয়ে রয়েছে। বিনিয়োগে আস্থা ফেরেনি, নতুন শিল্প গড়ে উঠছে না এবং বেসরকারি খাতে প্রবৃদ্ধি স্থবির। দেশে সর্বশেষ জুন মাসের শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় চার ভাগের এক ভাগের বেশিই এরই মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের এখন প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কার। ব্যাংক খাতকে দায়বদ্ধ করা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখা এবং করব্যবস্থাকে স্বচ্ছ করা ছাড়া এই অর্জন স্থায়ী হবে না।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো বিদেশনির্ভরতা। শ্রমিক পাঠানো কমে গেলে বা প্রবাসী দেশগুলোর বাজারে পরিবর্তন এলে রেমিট্যান্সপ্রবাহ এক ধাক্কায় কমে যেতে পারে। তখন আবার সংকট ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
রেমিট্যান্স বাড়ানোর কয়েকটি মূল পথ১.
প্রবাসী শ্রমিকদের সুবিধা ও সেবা উন্নয়ন
প্রবাসীদের জন্য ২৪ ঘণ্টা সহজলভ্য সেবা চালু করা, যেকোনো সময়ে ব্যাংকিং ও রেমিট্যান্সের প্রক্রিয়া সহজ করা। প্রাপকের (বেনিফিশিয়ারি) ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিশ্চিতকরণ, যাতে প্রেরিত অর্থ নিরাপদে পৌঁছায়। রিক্রুটিং এজেন্টদের নিয়ন্ত্রণ করে অতিরিক্ত খরচ কমানো। প্রবাসীদের জন্য ‘রেমিট্যান্স কার্ড’ চালু করে পয়েন্ট সিস্টেম ও পেনশন–সুবিধা দেওয়া, যা তাঁদের বৈধ মাধ্যমে টাকা পাঠানোর আগ্রহ বাড়াবে।
২. ব্যাংক ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) চ্যানেলের সক্ষমতা বৃদ্ধি
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংক শাখা ও রেমিট্যান্স অফিস সম্প্রসারণ। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের সুযোগ বাড়িয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে সহজ ও দ্রুত রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যবস্থাপনা। ‘ওয়েজ আর্নার্স এমএফএস অ্যাকাউন্ট’ চালু করে নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি ও প্রবাসীদের জন্য নিরাপদ অর্থ লেনদেন নিশ্চিতকরণ।
৩. হুন্ডি বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ ও সচেতনতা
মানি লন্ডারিং ও অবৈধ হুন্ডি ব্যবসার বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ ও শাস্তির ব্যবস্থা। মূল হুন্ডি চক্রের সদস্যদের শনাক্তকরণ ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিতকরণ। লাইসেন্স বাতিল ও অর্থ আটকানোর মতো পদক্ষেপ গ্রহণ। প্রবাসীদের হুন্ডি থেকে বিরত রাখার জন্য বৈধ চ্যানেলে উৎসাহিত করার বিকল্প ও সুবিধা প্রদান।
৪. দেশভিত্তিক ভিন্ন সমাধান ও দূতাবাসের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি
প্রতিটি দেশের বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দেশভিত্তিক কার্যকর সমাধান গ্রহণ, যেমন সৌদি আরব ও ইতালির উদাহরণ অনুসরণ। দূতাবাসের কর্মক্ষমতা ও জনবল বৃদ্ধি করে দ্রুত ও সহজ সেবা নিশ্চিতকরণ। দূতাবাসে প্রবাসীদের দুর্ভোগ কমানো ও সহযোগিতা বৃদ্ধি।
৫. কার্যকর প্রণোদনা নীতি গ্রহণ ও উৎসাহ সৃষ্টি
বর্তমান প্রণোদনার হার ২ দশমিক ৫%, যা আগে ছিল ৫%। এটা যদি অন্তত ৫% রাখা যেত, তাহলে প্রবাসীরাও এর বেশি উৎসাহিত হতেন রেমিট্যান্স পাঠাতে।
৬. শ্রমিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণ
বিদেশে প্রবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। বেতন সময়মতো প্রদানের ওপর কড়া নজরদারি। বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করা।
৭. রেমিট্যান্সের প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুতকরণ
‘ওপেন ব্যাংকিং’ ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা সম্প্রসারণের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো আরও সহজ করা। শ্রমিকদের কাজের সময়সূচি অনুযায়ী লেনদেনের সুবিধা প্রদান। দূরবর্তী স্থানে থাকা শ্রমিকদের জন্য মোবাইল বা অনলাইন মাধ্যমে দ্রুত রেমিট্যান্স প্রেরণের সুযোগ নিশ্চিত করা।
৮. অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমন্বয় ও সদিচ্ছা
রাজনৈতিক নেতৃত্বের আন্তরিকতা ও সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়াতে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় বাড়ানো। সরকারের দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়ন।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রেমিট্যান্সবিষয়ক বিভিন্ন বিষয় জোরালো মনিটরিং করায় রেমিট্যান্সপ্রবাহে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। এই উন্নত সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনাই দেশের অর্থনীতিতে সুশান্তির বাতাস বয়ে এনেছে, যা আমাদের সবাইকে স্বীকার করতে হবে।
উপসংহাররেমিট্যান্সের এই নতুন প্রবাহ দেশের অর্থনীতিতে স্বস্তি ও আশা নিয়ে এসেছে। এটা যেন কোনো স্বল্পস্থায়ী ঘটনা না হয়ে স্থায়ী হয়, তা নিশ্চিত করা দরকার। সে জন্য প্রয়োজন সুচিন্তিত, টেকসই ও বাস্তবসম্মত অর্থনৈতিক নীতি ও সংস্কার।
সরকার যদি এই সাফল্যের ধাপে কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে আসে, স্বচ্ছ শাসনব্যবস্থা বজায় রাখে এবং উৎপাদনমুখী বিনিয়োগে গুরুত্ব দেয়, তাহলে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ সম্ভব হবে। প্রবাসীদের কষ্টের অর্থ যেন শুধু সঞ্চয় না হয়ে দেশের অর্থনীতির শক্তি হয়। এখন সময় এসেছে পুরোনো অবিশ্বাস ও সংশয় দূর করে এগিয়ে যাওয়ার। সবার মিলিত প্রচেষ্টায় গড়তে হবে সমৃদ্ধি ও আত্মবিশ্বাসে ভরা বাংলাদেশ।
শোয়েব সাম্য সিদ্দিক ব্যাংকার ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন শ চ তকরণ প রব স দ র ন শ চ ত কর দ র জন য ব যবস থ সরক র র প রব হ উৎস হ দশম ক আমদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগ আদৌ ফল দেবে কি
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত চরম অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিগত সরকারের আমলে কতিপয় চিহ্নিত ব্যক্তি রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতকে ধ্বংস করে এটিকে শুধু খাদের কিনারে নিয়েই ক্ষান্ত হননি; বরং গভীর খাদে ছুড়ে ফেলেছেন। ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণের পরিমাণ এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এই বিপুল অঙ্কের অপরিশোধিত ব্যাংকঋণ দেশের ভেতরে বিনিয়োগ না করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। যেহেতু এ অর্থ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করা হয়নি, তাই ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এই বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত ঋণের চাপে কতিপয় ব্যাংক দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে।
ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিনের জমতে থাকা ঘনকালো মেঘের ঘনঘটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দীর্ঘদিনের গভীর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়, সেটি নড়েচড়ে বসার চেষ্টা করছে। কিন্তু দীর্ঘদিনের গভীর ঘুমের কারণে যে স্নায়ু বৈকল্যের সৃষ্টি হয়, সেটি থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি। যার প্রমাণ বর্তমান সময়ে রুগ্ণ হয়ে যাওয়া ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক একীভূতকরণ একটি প্রচলিত কৌশল, যা বিপর্যস্ত ব্যাংকগুলোকে তাদের দুর্বল আর্থিক অবস্থা থেকে উত্তরণে সাহায্য করে। ২০০৭-০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার পর এই কৌশল ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়। তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে ব্যাংক একীভূতকরণের বেশ কিছু সুবিধার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন একীভূতকরণের মাধ্যমে একটি বড় প্রাতিষ্ঠানিক সত্তার জন্ম হয়, যার বাজার নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা তৈরি হয়। আকারের সুবিধার কারণে মূলধনের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পায়, যা ঋণের প্রবাহ বাড়াতে সহায়তা করে।
এ ছাড়া ব্যাংকের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ঋণের বহুমুখীকরণের মাধ্যমে ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পারফরম্যান্স সূচকের উন্নতি ঘটাতে পারে। কিন্তু ব্যাংক একীভূতকরণ গবেষণায় দেখা যায়, একীভূত করার প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ ও জটিল। অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে এটি সফলতার মুখ দেখতে পায় না।
উপরন্তু এ কথা মনে রাখা অত্যন্ত জরুরি যে ব্যাংক একীভূতকরণ একটি বাজারমুখী কৌশল এবং তা শুধু বাজারসৃষ্ট সমস্যার সমাধান দেওয়ার জন্য প্রযোজ্য। অর্থাৎ ব্যাংকের আর্থিক দৈন্যদশা যদি বাজারসৃষ্ট কারণে হয়, যেমন সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়, ব্যাংকের স্বাভাবিক কর্মপ্রক্রিয়ার অদক্ষতা বা ব্যাংকের স্বাভাবিক সুশাসনের ঘাটতি ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর আর্থিক দৈন্যদশা কোনো সাধারণ বাজারমুখী কারণে সৃষ্টি হয়নি; বরং তা হয়েছে ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে কতিপয় রাজনৈতিক মদদপুষ্ট লোকের দ্বারা। সুতরাং এ ক্ষেত্রে ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া একদিকে যেমন প্রকৃত সমস্যাকে আড়াল করতে পারে এবং এই আর্থিক বিপর্যয়ের ভার ব্যাংকগুলোর হাজার হাজার কর্মী বাহিনীর ওপর বর্তাবে। যাঁদের মাধ্যমে এই ব্যাংকগুলোতে ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে, তাঁদের বিচারের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত না করে ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ বাজারে ব্যাংক কর্মচারীদের সক্ষমতা সম্পর্কে ভুল বার্তা দেবে। ফলে দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাংকিং খাতে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রুগ্ণ ব্যাংক একীভূতকরণের যে নীতি তা অনেকটাই পশ্চিমা নীতির সমার্থক, যা কিনা উন্নত আর্থিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর বাজারব্যবস্থা উন্নত বিশ্বের বাজারব্যবস্থার থেকে বেশ আলাদা। তাই যেসব নীতি উন্নত বাজারগুলোর জন্য প্রযোজ্য, তা আমাদের বাজারে প্রযোজ্য না-ও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাতে রাজনৈতিক প্রভাব একটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ। বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রভাব যে মাত্রায় ব্যবহৃত হয়, তা পশ্চিমা বিশ্বে হয় না। তাই ব্যাংক একীভূতকরণ আমাদের বাজারে কাজ যে করবে না, তা নিশ্চিতভাবেই অনুমান করা যায়। উপরন্তু এই কৌশল আমাদের ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি করবে বলে আমার বিশ্বাস।
ব্যাংকিং খাতের কর্তাব্যক্তিদের রাজনৈতিক যোগাযোগ নিয়ে বিস্তর গবেষণা রয়েছে। এসব গবেষণার মাধ্যমে এটি প্রতীয়মান হয়, ব্যাংকগুলো এই রাজনৈতিক যোগাযোগ ব্যবহার করে তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক যোগাযোগের এ ধনাত্মক প্রভাব শুধু তখনই কার্যকর হবে, যখন রাজনৈতিক যোগাযোগপুষ্ট ব্যক্তিরা ব্যাংকের মাইনরিটি নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করবেন। রাজনৈতিক যোগাযোগপুষ্ট ব্যক্তিরা যদি ব্যাংকের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিয়ন্ত্রক হিসেবে আবির্ভূত হন, তবে ব্যাংকের ঋণদান প্রক্রিয়া ও সুশাসনের প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতার সৃষ্টি হয় এবং তাঁরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী-প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারেন। ফলে তাঁদের অনৈতিক কার্যক্রম অনেক সহজতর হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটিই চরম সত্য।
এসব কারণে বলা যায়, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণের মাধ্যমে একটি বৃহৎ ব্যাংকের সৃষ্টি হলে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার অনেক সহজতর হবে। কারণ, তখন পাঁচটি ব্যাংক দখল না করে শুধু একটি ব্যাংক দখলই যথেষ্ট হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই একীভূতকরণ নীতি বরং ভবিষ্যতের কোনো রাজনৈতিক সরকারের সুবিধা প্রাপ্তিকে সহজতর করে দিতে পারে।
এ প্রসঙ্গে ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ের কথা মনে পড়ছে, যেখানে বিচারক বলেছিলেন তিনি প্রতিষ্ঠানের আকারের বিশালতায় শঙ্কিত। প্রখ্যাত ব্যাংকিং-বিষয়ক গবেষক রাজন ও জিংগেলস তাঁদের গবেষণায় দেখিয়েছেন যে বৃহৎ ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক প্রভাব বেশি ব্যবহার করে এবং এর মাধ্যমে তারা তাদের প্রতিযোগীদের থেকে বেশি মুনাফা করতে পারে, যা প্রতিযোগিতামূলক ব্যাংকিং ব্যাবসায়ের পরিপন্থী। সুতরাং বাংলাদেশে যদি একীভূতকরণের মাধ্যমে একটি নতুন বৃহৎ ব্যাংক আত্মপ্রকাশ করে, তা বাজারের প্রতিযোগিতাকে নষ্ট করবে। ফলে ঋণের সুদের হার বেড়ে যেতে পারে।
এ ছাড়া বৃহৎ ব্যাংকগুলোর ছোট ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা দেখা যায়। ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উপরন্তু গবেষণায় এটাও দেখা গেছে, একীভূত করার প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট বৃহৎ ব্যাংকগুলোর মার্কেট পাওয়ার বা বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অনেক বেশি থাকায় রাজনৈতিক শক্তিগুলো এসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে আরও সক্রিয় হয়। আর এ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে যে সহজেই ব্যবহার করা যায়, তা আমরা নিকট অতীতে দেখেছি।
সুতরাং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ব্যাংক একীভূতকরণের মাধ্যমে দেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধানের পথ না ধরে বিকল্প ব্যবস্থার দিকে দৃষ্টি দেওয়া। যেহেতু ব্যাংকিং খাতের মূল সমস্যা রাজনৈতিক প্রভাব, তাই ভবিষ্যতে ব্যাংকগুলোকে কীভাবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা যায়, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা।
একীভূত ব্যাংকের জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগানের পরিকল্পনা করা হয়েছে, সেই অর্থ প্রস্তাবিত একীভূত করার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে আনুপাতিক হারে বণ্টন করলে স্বল্প মেয়াদে তাদের তারল্যসংকট দূরীভূত হবে এবং বাজারে আস্থার সংকটের খানিকটা অবসান হবে। ফলে ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার দিকে মনোনিবেশ করতে সক্ষম হবে।এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে দেশের সব স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা মেধাবী শিক্ষার্থীরা চাকরি করেন। তাঁরা তাঁদের মেধা ও দক্ষতার মাধ্যমে দেশের ব্যাংকিং খাতকে একটি মজবুত ও জনপ্রিয় খাতে রূপান্তর করেছেন, যা বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক সরকারের অনুগত স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের আর্থিক স্বার্থে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি শুধু রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তবে আমাদের দেশের মেধাবী ব্যাংকাররা এ খাতকে আবারও একটি লাভজনক ও শক্তিশালী খাতে রূপান্তর করতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।
অধ্যাপক মসফিক, উদ্দিন লিডস বিশ্ববিদ্যালয় যুক্তরাজ্য