দেশ যখন বহুমাত্রিক সংকটে জর্জরিত, তখন অর্থনীতির গাঢ় ধোঁয়ার ভেতর হঠাৎ একরাশ সূর্যকিরণ উদিত হয়েছে। রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের প্রবাহ অপ্রত্যাশিতভাবে আশাজাগানিয়া রূপ নিয়েছে। ২০২৫ সালের জুন মাসে একক মাসেই প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন রেকর্ড ২ দশমিক ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটি শুধু একটি সংখ্যামাত্র নয়, বরং সংকটে ন্যুব্জ অর্থনীতির বুকে আশার পুনর্জাগরণ। একই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। গত ১১ মাসে রিজার্ভ বেড়েছে ১১ বিলিয়নের বেশি। এই প্রবাহ অর্থনীতির চাকা আবার ঘুরতে শুরু করেছে বলে এক নিঃশব্দ বার্তা দিচ্ছে।
অর্থনীতির এক বিপন্ন প্রেক্ষাপটমাত্র এক বছর আগেও পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। রিজার্ভ নেমে গিয়েছিল ২০ বিলিয়নের নিচে। তখন বাজারে ছড়িয়ে পড়েছিল চরম অনিশ্চয়তা। ডলার–সংকট, আমদানিজট, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতায় দেশের অর্থনীতির ভিত্তিই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশের ঘরে ঘোরাঘুরি করছিল। পণ্য আমদানি বন্ধের মুখে বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান উৎপাদন স্থগিত করেছিল। বিদেশি ঋণ পরিশোধ ও খাদ্যশস্য আমদানির জন্যও সরকারকে হিমশিম খেতে হয়েছিল।
সেই পরিপ্রেক্ষিতে এখন যখন রিজার্ভ বাড়ছে, রেমিট্যান্সে রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে, তখন প্রশ্ন জাগে, এ কি সত্যিই ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু, নাকি কেবল একটি সাময়িক স্বস্তির ধারা?
রেমিট্যান্স–উত্থানঅর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ থেকে যেসব কারণ উঠে এসেছে, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়:
প্রথমত, ডলারের বিনিময় হার দীর্ঘদিন স্থিতিশীল রাখা গেছে। বাজারে ১১২ থেকে ১১৩ টাকার মধ্যে ডলারের মূল্য ধরে রাখা হয়েছে। হুন্ডির সঙ্গে প্রতিযোগী হারে বৈধ চ্যানেলে প্রেরণে প্রণোদনা সংযুক্ত করায় প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলকেই বেশি লাভজনক মনে করছেন।
দ্বিতীয়ত, সরকারের হুন্ডিবিরোধী অভিযান, মানি লন্ডারিং রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়া নজরদারিতে অবৈধ চ্যানেল সংকুচিত হয়েছে। এতে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে আইনি পথে অর্থ পাঠানোর মনোভাব গড়ে উঠেছে।
তৃতীয়ত, বিশ্ববাজারে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, রোমানিয়াসহ নতুন নতুন শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিক পাঠানো হচ্ছে। সরকার দক্ষ কর্মী প্রশিক্ষণ, ভাষাশিক্ষা এবং চুক্তিনির্ভর প্রেরণ নিশ্চিত করায় প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ও মান দুই-ই বেড়েছে।
চতুর্থত, অভ্যন্তরীণ ব্যাংকব্যবস্থার কিছু সংস্কার যেমন প্রবাসী অ্যাকাউন্টে লেনদেনের সুবিধা বৃদ্ধি ও রেমিট্যান্সভিত্তিক সঞ্চয় প্রকল্প চালু করা হয়েছে। এতে মানুষ বৈধ চ্যানেলের প্রতি উৎসাহী হয়েছে।
এই অর্জনের প্রভাব কীভাবে ছড়াচ্ছেরেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিদেশে থাকা কর্মীরা যখন নিজের পরিবারকে টাকা পাঠান, তখন তা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়ায়। এই বাড়তি মুদ্রা সরকারের জন্য বিভিন্ন কাজে সহায়ক হয়। যেমন আমদানি খরচ মেটানো, ঋণ পরিশোধ করা, খাদ্য ও জ্বালানি আমদানিতে সাহায্য করা ও বাজারে ডলারের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা। এর ফলে ব্যাংকগুলো আরও বেশি এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খুলতে পারে, বিশেষ করে শিল্প ও ওষুধ খাতে, যা দেশীয় উৎপাদন ও সেবা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে এখন নতুন একটা আস্থা তৈরি হচ্ছে, কারণ, রেমিট্যান্সের কারণে মুদ্রার জোগান সুষ্ঠু হচ্ছে। বাজারে ডলারের দাম কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ার ফলে আমদানি পণ্যের দামও নিয়ন্ত্রণে আসছে। খাদ্যপণ্যের মূল্য কমে আসায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় স্বস্তি ফিরে আসছে। এই মূল্যস্ফীতির চাপ কমে যাওয়ায় দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তাই রেমিট্যান্স শুধু অর্থ পাঠানো নয়, এটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির এক বড় চালিকা শক্তি।
পরিসংখ্যান যা বলছেঅর্থবছর মোট রেমিট্যান্স (বিলিয়ন ডলার) জুন মাসের আয় রিজার্ভ (জুলাই শেষে)
২০২১-২২ ২১ দশমিক শূন্য ৩ ১ দশমিক ৮৬ ৩৯ দশমিক ৭৮
২০২২-২৩ ২১ দশমিক ৬১ ১ দশমিক ৯৭ ২৩ দশমিক ৫৩
২০২৩-২৪ ৩০ দশমিক ৩৩ ২ দশমিক ২১ ৩১ দশমিক ৭২
এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে দেখায়, এক অর্থবছরে প্রায় ৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।
চ্যালেঞ্জ কি পেরিয়ে গেলামএত সুখবরের ভিড়ে একটা প্রশ্ন বারবার মাথাচাড়া দেয়, তাহলে কি আমরা সত্যিই সংকট পেরিয়ে এলাম?
না। এখানেই আসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। রেমিট্যান্স বাড়লেও ব্যাংক খাতে গৃহীত ঋণের অনাদায়ি প্রবণতা, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও দুর্বল শাসনব্যবস্থা এখনো বড় বাধা হয়ে রয়েছে। বিনিয়োগে আস্থা ফেরেনি, নতুন শিল্প গড়ে উঠছে না এবং বেসরকারি খাতে প্রবৃদ্ধি স্থবির। দেশে সর্বশেষ জুন মাসের শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় চার ভাগের এক ভাগের বেশিই এরই মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের এখন প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কার। ব্যাংক খাতকে দায়বদ্ধ করা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখা এবং করব্যবস্থাকে স্বচ্ছ করা ছাড়া এই অর্জন স্থায়ী হবে না।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো বিদেশনির্ভরতা। শ্রমিক পাঠানো কমে গেলে বা প্রবাসী দেশগুলোর বাজারে পরিবর্তন এলে রেমিট্যান্সপ্রবাহ এক ধাক্কায় কমে যেতে পারে। তখন আবার সংকট ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
রেমিট্যান্স বাড়ানোর কয়েকটি মূল পথ১.
প্রবাসী শ্রমিকদের সুবিধা ও সেবা উন্নয়ন
প্রবাসীদের জন্য ২৪ ঘণ্টা সহজলভ্য সেবা চালু করা, যেকোনো সময়ে ব্যাংকিং ও রেমিট্যান্সের প্রক্রিয়া সহজ করা। প্রাপকের (বেনিফিশিয়ারি) ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিশ্চিতকরণ, যাতে প্রেরিত অর্থ নিরাপদে পৌঁছায়। রিক্রুটিং এজেন্টদের নিয়ন্ত্রণ করে অতিরিক্ত খরচ কমানো। প্রবাসীদের জন্য ‘রেমিট্যান্স কার্ড’ চালু করে পয়েন্ট সিস্টেম ও পেনশন–সুবিধা দেওয়া, যা তাঁদের বৈধ মাধ্যমে টাকা পাঠানোর আগ্রহ বাড়াবে।
২. ব্যাংক ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) চ্যানেলের সক্ষমতা বৃদ্ধি
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংক শাখা ও রেমিট্যান্স অফিস সম্প্রসারণ। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের সুযোগ বাড়িয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে সহজ ও দ্রুত রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যবস্থাপনা। ‘ওয়েজ আর্নার্স এমএফএস অ্যাকাউন্ট’ চালু করে নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি ও প্রবাসীদের জন্য নিরাপদ অর্থ লেনদেন নিশ্চিতকরণ।
৩. হুন্ডি বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ ও সচেতনতা
মানি লন্ডারিং ও অবৈধ হুন্ডি ব্যবসার বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ ও শাস্তির ব্যবস্থা। মূল হুন্ডি চক্রের সদস্যদের শনাক্তকরণ ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিতকরণ। লাইসেন্স বাতিল ও অর্থ আটকানোর মতো পদক্ষেপ গ্রহণ। প্রবাসীদের হুন্ডি থেকে বিরত রাখার জন্য বৈধ চ্যানেলে উৎসাহিত করার বিকল্প ও সুবিধা প্রদান।
৪. দেশভিত্তিক ভিন্ন সমাধান ও দূতাবাসের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি
প্রতিটি দেশের বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দেশভিত্তিক কার্যকর সমাধান গ্রহণ, যেমন সৌদি আরব ও ইতালির উদাহরণ অনুসরণ। দূতাবাসের কর্মক্ষমতা ও জনবল বৃদ্ধি করে দ্রুত ও সহজ সেবা নিশ্চিতকরণ। দূতাবাসে প্রবাসীদের দুর্ভোগ কমানো ও সহযোগিতা বৃদ্ধি।
৫. কার্যকর প্রণোদনা নীতি গ্রহণ ও উৎসাহ সৃষ্টি
বর্তমান প্রণোদনার হার ২ দশমিক ৫%, যা আগে ছিল ৫%। এটা যদি অন্তত ৫% রাখা যেত, তাহলে প্রবাসীরাও এর বেশি উৎসাহিত হতেন রেমিট্যান্স পাঠাতে।
৬. শ্রমিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণ
বিদেশে প্রবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। বেতন সময়মতো প্রদানের ওপর কড়া নজরদারি। বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করা।
৭. রেমিট্যান্সের প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুতকরণ
‘ওপেন ব্যাংকিং’ ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবা সম্প্রসারণের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো আরও সহজ করা। শ্রমিকদের কাজের সময়সূচি অনুযায়ী লেনদেনের সুবিধা প্রদান। দূরবর্তী স্থানে থাকা শ্রমিকদের জন্য মোবাইল বা অনলাইন মাধ্যমে দ্রুত রেমিট্যান্স প্রেরণের সুযোগ নিশ্চিত করা।
৮. অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমন্বয় ও সদিচ্ছা
রাজনৈতিক নেতৃত্বের আন্তরিকতা ও সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়াতে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় বাড়ানো। সরকারের দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়ন।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রেমিট্যান্সবিষয়ক বিভিন্ন বিষয় জোরালো মনিটরিং করায় রেমিট্যান্সপ্রবাহে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। এই উন্নত সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনাই দেশের অর্থনীতিতে সুশান্তির বাতাস বয়ে এনেছে, যা আমাদের সবাইকে স্বীকার করতে হবে।
উপসংহাররেমিট্যান্সের এই নতুন প্রবাহ দেশের অর্থনীতিতে স্বস্তি ও আশা নিয়ে এসেছে। এটা যেন কোনো স্বল্পস্থায়ী ঘটনা না হয়ে স্থায়ী হয়, তা নিশ্চিত করা দরকার। সে জন্য প্রয়োজন সুচিন্তিত, টেকসই ও বাস্তবসম্মত অর্থনৈতিক নীতি ও সংস্কার।
সরকার যদি এই সাফল্যের ধাপে কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে আসে, স্বচ্ছ শাসনব্যবস্থা বজায় রাখে এবং উৎপাদনমুখী বিনিয়োগে গুরুত্ব দেয়, তাহলে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ সম্ভব হবে। প্রবাসীদের কষ্টের অর্থ যেন শুধু সঞ্চয় না হয়ে দেশের অর্থনীতির শক্তি হয়। এখন সময় এসেছে পুরোনো অবিশ্বাস ও সংশয় দূর করে এগিয়ে যাওয়ার। সবার মিলিত প্রচেষ্টায় গড়তে হবে সমৃদ্ধি ও আত্মবিশ্বাসে ভরা বাংলাদেশ।
শোয়েব সাম্য সিদ্দিক ব্যাংকার ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন শ চ তকরণ প রব স দ র ন শ চ ত কর দ র জন য ব যবস থ সরক র র প রব হ উৎস হ দশম ক আমদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
চট্টগ্রাম বন্দরে ব্রাজিলফেরত কনটেইনারে তেজস্ক্রিয়তা
ব্রাজিল থেকে চার বন্দর ঘুরে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা এক কনটেইনারে তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া গেছে। বন্দরে তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণের ব্যবস্থা ‘মেগাপোর্ট ইনিশিয়েটিভ রেডিয়েশন ডিটেকটিভ সিস্টেমে’ এটি শনাক্ত হয়। এরপরই কনটেইনারটির খালাস স্থগিত করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া কনটেইনারটিতে রয়েছে স্ক্র্যাপ বা পুরোনো লোহার টুকরা। তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণ যন্ত্রে প্রাথমিক ও দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় কনটেইনারের অভ্যন্তরে তিনটি রেডিওনিউক্লাইড আইসোটোপের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই তিনটি হলো থোরিয়াম ২৩২, রেডিয়াম ২২৬ ও ইরিডিয়াম ১৯২।
কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিক পরীক্ষায় তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা পাওয়া গেছে এক মাইক্রোসিয়েভার্টস (তেজস্ক্রিয়তা থেকে যে বিকিরণ হয় তার একক)। এটি উচ্চ মাত্রার নয়, তবে পরীক্ষার আগে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না কনটেইনারে তেজস্ক্রিয়তার প্রকৃত মাত্রা কতটুকু। কারণ, লোহার টুকরা ও কনটেইনার ভেদ করে তেজস্ক্রিয়তার সঠিক মাত্রা আসে না। এ জন্য সতর্কতা হিসেবে কনটেইনারটি আলাদা করে রাখা হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের নথিতে দেখা যায়, ঢাকার ডেমরার রড তৈরির কারখানা আল আকসা স্টিল মিলস লিমিটেড ব্রাজিল থেকে পাঁচ কনটেইনারে ১৩৫ টন স্ক্র্যাপ আমদানি করেছিল। তেজস্ক্রিয়তা সংকেত পাওয়া কনটেইনার এই পাঁচটির একটি। ৩ আগস্ট বন্দরের জিসিবি টার্মিনালের ৯ নম্বর জেটিতে ‘এমভি মাউন্ট ক্যামেরন’ জাহাজ থেকে কনটেইনারটি বন্দরে নামানো হয়। এরপর বুধবার বন্দরের ৪ নম্বর ফটক দিয়ে কনটেইনারটি খালাস নেওয়ার সময় মেগাপোর্টের যন্ত্রে তেজস্ক্রিয়তা থাকার সংকেত বেজে ওঠে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ মারুফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সতর্কসংকেত পাওয়ার পর কনটেইনারটি খালাস স্থগিত করে আলাদা স্থানে রাখা হয়েছে। এখন পরমাণু শক্তি কমিশনকে বিষয়টি জানিয়ে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এসে সরেজমিন তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষা করবেন। এরপরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চিকিৎসা, শিল্পকারখানা, গবেষণাসহ নানা কাজে তেজস্ক্রিয় উৎস ব্যবহার হয়। এসব তেজস্ক্রিয় উৎস ব্যবহারের সময় বায়ুরোধী বিশেষ পাত্রে এমনভাবে আবদ্ধ রাখা হয়, যাতে তেজস্ক্রিয় দূষণ না হয়। ব্যবহার শেষে এসব তেজস্ক্রিয় উৎস সংগ্রহ করে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য হিসেবে ব্যবস্থাপনা করতে হয়। তবে অসতর্কতা, দুর্ঘটনাসহ নানা কারণে এসব তেজস্ক্রিয় উৎস বাইরে চলে আসে। তাতেই এই উৎস মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সতর্কসংকেত পাওয়ার পর কনটেইনারটি খালাস স্থগিত করে আলাদা স্থানে রাখা হয়েছে। এখন পরমাণু শক্তি কমিশনকে বিষয়টি জানিয়ে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এসে সরেজমিন তেজস্ক্রিয়তা পরীক্ষা করবেন। এরপরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।চট্টগ্রাম কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ মারুফুর রহমানচার বন্দর পেরিয়ে চট্টগ্রামে বাজল সংকেতযে কনটেইনারে তেজস্ক্রিয়তার সংকেত পাওয়া গেছে, সেটির গতিপথ পর্যবেক্ষণ করেছেন এই প্রতিবেদক। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক মেডিটেরানিয়ান শিপিং কোম্পানির (এমএসসি) ওয়েবসাইটের সাহায্য নিয়ে দেখা যায়, ব্রাজিলের উত্তরের শহর মানাউস থেকে কনটেইনারটিতে স্ক্র্যাপ বা পুরোনো লোহার টুকরা বোঝাই করা হয়।
গত ৩০ মার্চ দেশটির মানাউস বন্দরে এমএসসির একটি জাহাজে তুলে দেওয়া হয় কনটেইনারটি। এরপর ১৮ এপ্রিল পানামার ক্রিস্টোবাল বন্দরে নামিয়ে রাখা হয়। সেখান থেকে ৩ মে আরেকটি জাহাজে তুলে নেদারল্যান্ডসের রটারড্যাম বন্দরে নেওয়া হয়। রটারড্যাম থেকে ২ জুন আরেকটি জাহাজে তুলে শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে নেওয়া হয়। কলম্বো বন্দরে জাহাজ থেকে কনটেইনারটি নামানো হয় ১৫ জুলাই। সর্বশেষ ২৮ জুলাই কলম্বোর সাউথ এশিয়া গেটওয়ে টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রামমুখী জাহাজ মাউন্ট ক্যামরনে তুলে দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছায় ৩ আগস্ট।
বন্দরগুলোর ওয়েবসাইটে দেখা যায়, এই চার বন্দরের মধ্যে তিনটিতে তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণ যন্ত্র রয়েছে। এসব বন্দরে কনটেইনারটিতে তেজস্ক্রিয়তা ধরা পড়লে তা উৎস দেশে ফেরত পাঠানোর আন্তর্জাতিক নিয়ম রয়েছে। তবে ধরা না পড়ায় বিনা বাধায় কনটেইনারটি চট্টগ্রামে পৌঁছেছে। তবে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে ২০১১ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে স্থাপিত তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণ যন্ত্রে তা ধরা পড়ে।
কনটেইনারটিতে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা কতটুকু, তা পরীক্ষা–নিরীক্ষা ছাড়া বলা যাবে না। তবে যেহেতু সতর্কসংকেত পাওয়া গেছে, সে জন্য কনটেইনারটি আলাদা করে রাখা উচিত, যাতে মানুষের সংস্পর্শে না আসে। কারণ, সহনীয় মাত্রার বেশি তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে এলে মানবস্বাস্থ্যের ঝুঁকি রয়েছে।বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মাসুদ কামালব্রাজিল থেকে বাংলাদেশমুখী কনটেইনারে আগেও শনাক্ত হয়েছিল?ব্রাজিলের মানাউস নামে যে বন্দর থেকে আনা কনটেইনারে এই তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত হয়েছিল, সেই বন্দর থেকে আনা পণ্যে আগেও তেজস্ক্রিয়তার ঘটনা ধরা পড়েছিল। এ ঘটনা এত দিন অপ্রকাশিত ছিল। তবে সাড়ে তিন বছর আগের এই ঘটনা উঠে এসেছে ব্রাজিলিয়ান জার্নাল অব রেডিয়েশন সায়েন্সেস (বিজেআরএস) প্রকাশনায় এক নিবন্ধে। গত ১৫ জুলাই এই নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। মূলত কনটেইনারটি থেকে তেজস্ক্রিয় পদার্থ কীভাবে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়েছে এবং উৎসটিকে ব্রাজিলের সরকারি তেজস্ক্রিয় বর্জ্য সংরক্ষণাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে, তা তুলে ধরা হয় ওই নিবন্ধে। তাতেই বেরিয়ে আসে সাড়ে তিন বছর আগের ঘটনা।
এতে বলা হয়, ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ব্রাজিলের মানাউস বন্দর থেকে কনটেইনারটি চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে পাঠানো হয়। মানাউস থেকে চট্টগ্রামে সরাসরি জাহাজ চলাচল না থাকায় তা বিভিন্ন বন্দরে জাহাজ পাল্টে আনা হচ্ছিল। মাল্টা বন্দরে এক জাহাজ থেকে নামিয়ে আরেক জাহাজে তোলার সময় তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত হয়।পরে মাল্টা থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় এ কনটেইনারটি ব্রাজিলের সুয়াপে বন্দরে ফেরতআনা হয় ২০২২ সালের ২৩ জুন। সেখানে ব্রাজিলের ন্যাশনাল নিউক্লিয়ার এনার্জি কমিশনের একদল বিজ্ঞানী কনটেইনারটি থেকে তেজস্ক্রিয় উৎস আলাদা করার কাজ শুরু করেন। কনটেইনারটি থেকে তেজস্ক্রিয় উৎস আলাদা করে ব্রাজিলের তেজস্ক্রিয় সংরক্ষণাগারে স্থানান্তর করা হয়। পরীক্ষা করে কনটেইনারটিতে আরএ–২২৬ আইসোটোপ পাওয়া যায়।
বন্দরগুলোর ওয়েবসাইটে দেখা যায়, এই চার বন্দরের মধ্যে তিনটিতে তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণ যন্ত্র রয়েছে। এসব বন্দরে কনটেইনারটিতে তেজস্ক্রিয়তা ধরা পড়লে তা উৎস দেশে ফেরত পাঠানোর আন্তর্জাতিক নিয়ম রয়েছে। তবে ধরা না পড়ায় বিনা বাধায় কনটেইনারটি চট্টগ্রামে পৌঁছেছে।কী করা দরকারবাংলাদেশে প্রথম তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত হয় ২০১৪ সালে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভারতে রপ্তানি করার পথে ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে মরিচারোধী ইস্পাতের টুকরার একটি কনটেইনারে তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত হয়। সেটি ফেরত আনা হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। পরে যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশসহ চার দেশের বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে কনটেইনারটি থেকে ‘রেডিয়াম বেরিলিয়াম’ নামের তেজস্ক্রিয় পদার্থটি আলাদা করেন। পদার্থটি থেকে ঘণ্টায় ১২ হাজার মাইক্রোসিয়েভার্টস বিকিরণ হয়।
প্রথমবার তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিরাপদে উদ্ধার প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী মাসুদ কামাল। তেজস্ক্রিয়তার সর্বশেষ বিষয়টি জানানো হলে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মাসুদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, কনটেইনারটিতে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা কতটুকু, তা পরীক্ষা–নিরীক্ষা ছাড়া বলা যাবে না। তবে যেহেতু সতর্কসংকেত পাওয়া গেছে, সে জন্য কনটেইনারটি আলাদা করে রাখা উচিত, যাতে মানুষের সংস্পর্শে না আসে। কারণ, সহনীয় মাত্রার বেশি তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে এলে মানবস্বাস্থ্যের ঝুঁকি রয়েছে।