অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরের সাফল্য নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আত্মতুষ্টির এক চমকপ্রদ বাণী দিয়েছেন। অর্থনীতি নাকি ‘আইসিইউ থেকে কেবিনে গিয়ে এত দিনে বাড়ি ফিরে আসছে’। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন বিধায় তাঁর মতো একজন বিশেষজ্ঞের মন্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে মাপা উচিত। আওয়ামী আমলে তিনি একজন ‘পলিসি এক্সপার্ট’ হিসেবে অজস্র মন্তব্য রাখলেও তখন যে অর্থনীতি আইসিইউতে চলে গিয়েছিল, এ রকম কোনো বিশ্লেষণ প্রকাশ করেননি।
অর্থনীতি যে একটি সংকটের মধ্যে পড়তে যাচ্ছিল, সে কথা প্রায় সব অর্থনীতিবিদ বলতে শুরু করেন ২০২২ সাল থেকে। তখন কোভিড-উত্তর সময়ে অর্থনীতিতে কেবল নবজোয়ার শুরু হয়; কিন্তু জোগানের অপর্যাপ্ততা ও বিঘ্নতা এক আকস্মিক মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি করে। ঠিক তখনই রাশিয়াপতি ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণে তেলের জোগানেও বিঘ্ন ঘটে, যা মূল্যস্ফীতির আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়। বাংলাদেশেও শুরু হয় উচ্চ মূল্যস্ফীতির যুগ। ২০২১ সালের সাড়ে পাঁচ ভাগের মূল্যস্ফীতি ২০২২-এ প্রায় আট ভাগে উঠে যায়, যা ২০২৩-এ শতকরা ১০ ভাগ স্পর্শ করে।
আরও পড়ুনকেন এমন রেমিট্যান্স–উত্থান১৯ ঘণ্টা আগেএই বর্ধমান মূল্যস্ফীতির একাংশ বৈশ্বিক হলেও এর বৃহদংশ হাসিনা সরকার ভুল নীতির মাধ্যমে চাঙা করেছিল। ধনিকতুষ্টির ব্রতে জোর করে সুদহার কম রাখা এবং রাজস্ব অক্ষমতার কারণে গোপনে টাকা ছাপিয়ে উন্নয়ন ব্যয় মেটানোর কারণে মূল্যস্ফীতির অত্যাচার নবযৌবন লাভ করেছিল। এগুলোর বিরুদ্ধে অনেক অর্থনীতিবিদের পাশাপাশি বর্তমান অর্থ উপদেষ্টাও সোচ্চার ছিলেন; কিন্তু অর্থনীতি যে আইসিইউতে চলে গেছে সে রকম বলেননি। কখনো শুনিনি যে অর্থনীতি ‘গাজা’র মতো বিধ্বস্ত অবস্থায় শেষ হয়ে গেছে। শুনিনি এটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে।
দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি রোগ অর্থনীতির একটি কিডনি প্রায় নষ্ট করে দিয়েছিল; কিন্তু ওতেই পুরো শরীর নষ্ট হয়ে যায়নি। বাংলাদেশের প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা ২০২২ সালে তাদের ইতিহাসের কঠিনতম সংকটে পড়েছিল। একই অবস্থা পাকিস্তানের হয়েছিল ২০২৩ সালে; কিন্তু বাংলাদেশ পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কার মতো আইসিইউতে যায়নি। অন্যদিকে পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কাও গাজা হয়ে যায়নি। অসুস্থ হওয়া আর মুমূর্ষু হওয়া এক কথা নয়। মুমূর্ষু হওয়া আর মরে যাওয়াও এক কথা নয়।
দারিদ্র্য বেড়েছে। এই একটি সূচকই ঘুরে দাঁড়ানোর দাবিকে নস্যাৎ করে দেয়। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কত বাড়ল কিংবা চৌকস জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা কী কী সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে ট্রাম্পের কাছ থেকে ২০ ভাগ শুল্ক আদায় করে এনেছেন, এতে ছমিরন বিবির কিছু যায় আসে না। কলকারখানা বন্ধ হওয়া আর বেকারত্ব বৃদ্ধি ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ নয়।আওয়ামী আমলের শেষ দুই বছর বিশ্বব্যাংক সরকারের রাজস্ব দুর্বলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আইএমএফ ব্যাংক খাতে বর্ধমান খেলাপি নিয়ে সতর্কঘণ্টা বাজিয়েছে। হাসিনা সরকারের সুদহার বা বিনিময় হারের কোনোটি নিয়েই ওরা সন্তুষ্ট ছিল না। বৈশ্বিক রেটিং এজেন্সিগুলোও তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি ‘স্থির’ থেকে কমিয়ে ‘ঋণাত্মক’ করেছে; কিন্তু অর্থনীতি ‘ধ্বংসপ্রায়’ হয়ে গিয়েছিল, এমন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
একটি অর্থনীতি ধ্বংসপ্রায় অবস্থায় যাচ্ছে কি না, তার জন্য তিন ধরনের লক্ষণ থাকে ১.
২০২৩ সালের মে মাসে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি ৩৮ শতাংশে উঠেছিল। সে বছর পাকিস্তান কোভিডের বছর ছাড়া এর আগের অর্ধশতকের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি তথা ঋণাত্মক শূন্য দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেয়েছিল। শ্রীলঙ্কা ২০২২ সালে সর্বোচ্চ শতকরা ৫০ ভাগ মূল্যস্ফীতির আগুনে জর্জরিত হয়। কপালে জোটে বিগত ৫০ বছরের সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। আওয়ামী লীগের শেষ সময়ে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ছিল শতকরা ১১ ভাগের মতো। প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ২ ভাগ।
অর্থাৎ বাংলাদেশ কোনোভাবেই পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কার বিধ্বস্ত পর্যায়ের ধারেকাছেও ছিল না। তাহলে ওকে আইসিইউতে কখন নেওয়া হলো তা বোঝা গেল না। তার মানে এই নয় যে আওয়ামী আমলের শেষ ভাগের অর্থনীতিকে যৌক্তিক বলে প্রশংসা করা হচ্ছে। সেটি অবশ্য বিপর্যয়ের দিকে ধাবমান ছিল। ব্যাংক লুণ্ঠন আর অর্থ পাচারে হাসিনা সরকার কখনো লাগাম টেনে ধরেনি। আমলা ও ব্যবসায়ীনির্ভর সে সরকারের সে রকম সদিচ্ছা ছিল না। তাই বলে অর্থনীতি আইসিইউতেও ছিল না। এবার ‘কেবিন’ হয়ে বাড়ি ফেরার গল্পটি কেমন জুতসই, সেটি দেখা যাক।
অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, ‘অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে।’ এ কথা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাক্রো চলকগুলোর মাপকাঠিতে সত্য প্রমাণিত হয় না। সরকারের ভেতরে একমাত্র বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়া আর কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান দক্ষভাবে কাজ করতে পারছে না। মূল্যস্ফীতি দমনে উচ্চ সুদহার ও সঠিক মুদ্রানীতি থাকা সত্ত্বেও গভর্নর সন্তোষজনকভাবে মূল্যস্তর কমাতে পারছেন না।
এই সরকারের বড় ভুল হলো এটি একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের মতো আচরণ করতে চাওয়া। তাই রাজনীতিকদের মতো কৃতিত্বের দাবিনামা নিয়ে সরকার ব্যস্ত; কিন্তু যতই সময় যাচ্ছে, অর্থনীতি ততই ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। সম্প্রতি একজন অর্থনীতিবিদও সরকারকে ‘বহির্গমন কৌশল’ বের করার পরামর্শ দিয়েছেন।২০২৪ সালের জুলাই মাসে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল শতকরা ৯ দশমিক ৯ ভাগ, যা ২০২৫ সালের জুলাইয়ে মাত্র ৮ দশমিক ৫৫ ভাগে ঠেকেছে। এর কারণ সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজ দমনে যাদের রাখা হয়েছে, তারা ব্যর্থ। মাস্তান ও চাঁদাবাজদের বাগে আনা গভর্নরের কাজ নয়। গত বছর আগস্টের সাড়ে ২০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ এখন বেড়ে হয়েছে ২৫ দশমিক ২ বিলিয়ন। এখানে ভালো লক্ষণ থাকলেও এটি একটি মধ্যবর্তী লক্ষ্যমাত্রা।
অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চূড়ান্ত মাপকাঠি মানুষের জীবনযাত্রার মান। একে উন্নত করতে হলে দেখতে হবে বিনিয়োগ, নিয়োগ, প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি ও সর্বোপরি জনদারিদ্র্যের পরিস্থিতি। এর সব কটি সূচকেই কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি।
দারিদ্র্য বেড়েছে। এই একটি সূচকই ঘুরে দাঁড়ানোর দাবিকে নস্যাৎ করে দেয়। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কত বাড়ল কিংবা চৌকস জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা কী কী সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে ট্রাম্পের কাছ থেকে ২০ ভাগ শুল্ক আদায় করে এনেছেন, এতে ছমিরন বিবির কিছু যায় আসে না। কলকারখানা বন্ধ হওয়া আর বেকারত্ব বৃদ্ধি ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ নয়।
ব্যাংকে ব্যক্তি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি শতকরা ৬ দশমিক ৪ ভাগে ঠেকেছে, যা দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। জিডিপি প্রবৃদ্ধিও তিন দশকের সর্বনিম্ন। এগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ নয়। বিনিয়োগে অনাস্থা, বেকারত্ব বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধির শম্বুকগতি, ক্রয়ক্ষমতার অবনতি ও দারিদ্র্য বৃদ্ধির পরও অর্থ উপদেষ্টা কী করে অর্থনীতিকে কেবিন থেকে ‘ডিসচার্জ’ করলেন, তা বোঝা গেল না।
এই সরকারের বড় ভুল হলো এটি একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের মতো আচরণ করতে চাওয়া। তাই রাজনীতিকদের মতো কৃতিত্বের দাবিনামা নিয়ে সরকার ব্যস্ত; কিন্তু যতই সময় যাচ্ছে, অর্থনীতি ততই ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। সম্প্রতি একজন অর্থনীতিবিদও সরকারকে ‘বহির্গমন কৌশল’ বের করার পরামর্শ দিয়েছেন।
এক-এগারোর অন্তর্বর্তী সরকারের সময় এ রকম মেলা ভাঙার ডাক এতটা প্রবল হয়নি। কারণ, শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তার বিষয়ে তৎকালীন সরকার যথেষ্ট সাফল্য দেখিয়েছিল, যার অনেকটাই এখন অনুপস্থিত। চাঁদাবাজি ও মব সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ তখন ছিল না। ফলে তখন বিনিয়োগ, নিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি কমেনি। এই সরকার যদি শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিত, তাহলে অর্থনীতি দৃশ্যমানভাবেই ঘুরে দাঁড়াত, আর কেবিন থেকে রোগমুক্ত হয়েই বাড়ি ফিরত পরমানন্দে।
● ড. বিরূপাক্ষ পাল স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক অ্যাট কোর্টল্যান্ডে অর্থনীতির অধ্যাপক
* মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আইস ইউত র জন ত ক প রব দ ধ সরক র র আওয় ম দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা: বিদেশি শিক্ষার্থীদের ২২৪ আসন বরাদ্দ
২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষে দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তির জন্য এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সে বিদেশি শিক্ষার্থীদের আসন পুনর্বিন্যাস করেছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এ বছর বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ২২৪টি আসন বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ ২২৪ আসনের মধ্যে এমবিবিএস কোর্সে ১৮৪ এবং বিডিএস কোর্সের জন্য ৪০টি আসন নির্ধারণ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২২৪ আসনের মধ্যে ১২৫টি সার্ক দেশগুলোর জন্য এবং ৯৯টি আসন নন-সার্ক দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত। সার্ক ও নন-সার্ক কোটা সম্পূর্ণ আলাদা রাখা হয়েছে। নন-সার্ক কোটা সংরক্ষিত আসনে কোনো সার্ক দেশের শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হবে না।
আরও পড়ুনঅস্ট্রেলিয়া অ্যাওয়ার্ডস ফেলোশিপ, ৬ খাতে বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণের সুযোগ৪ ঘণ্টা আগেসার্ক দেশের আসন বণ্টনে ভারতের জন্য এমবিবিএসে ২২ ও বিডিএসে ২টি, পাকিস্তানের জন্য এমবিবিএসে ২১টি ও বিডিএসে ২টি, নেপালের জন্য এমবিবিএসে ১৯ ও বিডিএসে ৩টি, শ্রীলঙ্কার জন্য এমবিবিএসে ১৩ ও বিডিএসে ২টি, ভুটানের জন্য এমবিবিএসে ৩টি ও বিডিএসে ১টি, মালদ্বীপের জন্য এমবিবিএসে ৬টি ও বিডিএসে ১টি এবং আফগানিস্তানের জন্য এমবিবিএসে ৩টি ও বিডিএসে ১টি আসন বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে সার্ক দেশের জন্য এমবিবিএসে মোট ১১২ ও বিডিএসে ১৩, অর্থাৎ সর্বমোট ১২৫টি আসন বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
আরও পড়ুনমেডিকেল-ডেন্টালে ভর্তি পরীক্ষা : দেখে নিন আবেদনের নিয়মাবলি১৩ নভেম্বর ২০২৫নন-সার্ক দেশের আসন বণ্টনে সার্ক দেশের মতো একই বৃত্তির আওতায় মিয়ানমারের জন্য এমবিবিএসে ৫টি ও বিডিএসে ২টি, ফিলিস্তিনের জন্য এমবিবিএসে ১৮ ও বিডিএসে ৩টি এবং অন্য সব দেশের জন্য এমবিবিএসে ৪৯ ও বিডিএসে ২২টি আসন বরাদ্দ রয়েছে। সব মিলিয়ে নন-সার্ক দেশের জন্য এমবিবিএসে ৭২ ও বিডিএসে ২৭টি, অর্থাৎ মোট ৯৯টি আসন রাখা হয়েছে।
আরও পড়ুননিউজিল্যান্ড আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের যে নতুন সুযোগ দিল ১৬ নভেম্বর ২০২৫