বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে পুষ্টিহীনতার চিত্র এখনো উদ্বেগজনক। দেশে প্রায় ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ শিশু খর্বাকৃতি, ৮ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু অপুষ্টিজনিত ক্ষয়রোগে (ওয়েস্টিং) ভুগছে এবং ২১ দশমিক ৮ শতাংশ শিশু ওজনস্বল্পতায় ভুগছে। খর্বাকৃতি ও ওজনস্বল্পতার হার শহর ও গ্রামাঞ্চলের শিশুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন।

‘বাংলাদেশে বৃহৎ পরিসরে ফুড ফর্টিফিকেশন (খাদ্য সমৃদ্ধকরণ)’ শীর্ষক এক কর্মশালার মূল প্রবন্ধে এসব তথ্য তুলে ধরেন বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ শোয়েব। আজ বুধবার বেলা ১১টার দিকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি অনুষদের ডিন কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে এ কর্মশালা শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ হোসেন কেন্দ্রীয় গবেষণাগার ও আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশনের (জিএআইএন) যৌথ উদ্যোগে কর্মশালাটি অনুষ্ঠিত হয়।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে অধ্যাপক মোহাম্মদ শোয়েব আরও বলেন, ফুড ফর্টিফিকেশন বা খাদ্য সমৃদ্ধকরণ হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে কোনো খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে এক বা একাধিক ভিটামিন বা খনিজ উপাদান নির্দিষ্ট পরিমাণে মিশিয়ে খাদ্যের পুষ্টিমান বৃদ্ধি করা হয়। বর্তমানে চালের ফর্টিফিকেশনে ছয়টি পুষ্টি উপাদান সংযোজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই পুষ্টি উপাদানগুলো হলো ভিটামিন এ, বি-১ ও বি-১২, ফলিক অ্যাসিড, আয়রন ও জিঙ্ক। এ ছাড়া ভোজ্যতেলে ভিটামিন এ সমৃদ্ধকরণের মাধ্যমে নারী ও শিশুর ভিটামিন এর ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব।

এ সময় দেশের নারীদের অপুষ্টিজনিত অবস্থার পরিসংখ্যান তুলে ধরে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রজননক্ষম বয়সী (১৫ থেকে ৪৯ বছর) বিবাহিত নারীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ নারী পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। এর মধ্যে ৫০ লাখ নারী অপুষ্টির কারণে কম ওজন এবং ১ কোটি ২০ লাখ নারী অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতায় আক্রান্ত। অপুষ্টিজনিত সমস্যার টেকসই সমাধানের অন্যতম কার্যকর উপায় হলো ফুড ফর্টিফিকেশন অর্থাৎ খাদ্য সমৃদ্ধকরণ। তবে এটি শুরু করাটাই কেবল যথেষ্ট নয়, এর যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও জরুরি। ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানো পর্যন্ত খাদ্যের গুণগত মান, সঠিক ডোজ, নিরাপদ সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।

অধ্যাপক মুহাম্মদ হোসেন কেন্দ্রীয় গবেষণাগারের পরিচালক অধ্যাপক আমির হোসেনের সভাপতিত্বে কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) কৃষি কেন্দ্রের পরিচালক মো.

হারুনুর রশিদ এবং জিএআইএনের বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রুদাবা খন্দকার। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের শতাধিক শিক্ষক ও গবেষক এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

কর্মশালায় বিশ্বের অন্যান্য দেশে ফুড ফর্টিফিকেশনবিষয়ক ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। পাশাপাশি দেশে জাতীয় ফুড ফর্টিফিকেশন কর্মসূচির অংশ হিসেবে একটি বিশেষ কেন্দ্র স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই, কৌশলপত্র প্রণয়ন, খাদ্যমান নিয়ন্ত্রণ, বাজার তদারকি এবং দেশের চাহিদা অনুযায়ী যুগোপযোগী ফুড ফর্টিফিকেশন কর্মসূচি গ্রহণের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প–উদ্যোক্তাদের উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, অপুষ্টিজনিত রোগবালাই হ্রাস এবং জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন নিয়েও আলোচনা করা হয়।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রবন ধ উপস থ

এছাড়াও পড়ুন:

দেশে ২২ শতাংশের বেশি শিশু ও নারী ভিটামিন-ডি ঘাটতিতে ভুগছে

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফুড টেকনোলজি ও গ্রামীণ শিল্প বিভোগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ গুলজারুল আজিজ বলেছেন, “বাংলাদেশে কম বয়সী শিশুদের সামগ্রিক পুষ্টি পরিস্থিতি এখনও আশঙ্কাজনক। শিশু ও নারীদের মধ্যে ভিটামিন, আয়রন, জিঙ্ক ও আয়োডিনের ঘাটতি ব্যাপকভাবে বিদ্যমান। ২২ শতাংশের বেশি শিশু ও নারী ভিটামিন-ডি ঘাটতিতে ভুগছে।” 

তিনি বলেন, “অন্যদিকে নারীদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ জিঙ্ক এবং ৪২ শতাংশ আয়োডিন ঘাটতিতে আক্রান্ত। অপুষ্টি ও ভিটামিন-খনিজ ঘাটতি বর্তমানে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই লবণ ছাড়াও অন্যান্য খাবারে এসব পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধকরণ (ফর্টিফিকেশন) জরুরি হয়ে পড়েছে।”

আরো পড়ুন:

পায়রা নদীর তীর থেকে শিশুর মরেদেহ উদ্ধার

রাজশাহীতে পুকুরে ডুবে ২ শিশুর মৃত্যু

মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) সকাল ১১টায় ‘বাংলাদেশে খাদ্য সমৃদ্ধকরণের (ফুড ফর্টিফিকেশন) গুরুত্ব’ শীর্ষক এক কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি এসব তথ্য তুলে ধরেন। বাকৃবির কৃষি অনুষদীয় সম্মেলন কক্ষে কর্মশালাটি যৌথভাবে আয়োজন করে বাকৃবির প্রফেসর মুহাম্মদ হোসেন কেন্দ্রীয় গবেষণাগার (পিএমএইচসিএল) এবং গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (জিএআইএন)।

মূল প্রবন্ধে ড. মোহাম্মদ গুলজারুল আজিজ বলেন, ‘ফুড ফর্টিফিকেশন হলো খাদ্যের পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ করার একটি প্রক্রিয়া। এতে খাদ্যের সঙ্গে এক বা একাধিক ভিটামিন বা খনিজ উপাদান নির্দিষ্ট পরিমাণে মিশিয়ে খাদ্যের পুষ্টিমান বাড়ানো হয়। বর্তমানে চালের ফর্টিফিকেশনে ছয়টি পুষ্টি উপাদান সংযোজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে— ভিটামিন এ, বি-১, বি-১২, ফলিক এসিড, আয়োডিন, আয়রন ও জিঙ্ক। এছাড়া ভোজ্যতেলে ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধকরণের মাধ্যমে নারী ও শিশুর ভিটামিন-ডি ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব।”

তিনি করেন, “এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যেই বাধ্যতামূলক খাদ্য সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি চালু করেছে। যেমন— চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় লবণে আয়োডিন সমৃদ্ধকরণ চালু রয়েছে। ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে গমের আটা, তেল, চাল ও চিনি সমৃদ্ধ করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো কেবল লবণ আয়োডিনেশন কার্যকর রয়েছে। গমের আটা বা অন্যান্য খাদ্যে সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি।”

পিএমএইচসিএল-এর পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আমির হোসেনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন, বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া। বিশেষ অতিথি ছিলেন, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) মহাপরিচালক ড. শরিফুল হক ভূঁইয়া।

কর্মশালায় ‘বাংলাদেশে বৃহৎ আকারের ফুড ফর্টিফিকেশন’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জিএআইএন-এর লার্জ স্কেল ফুড ফর্টিফিকেশন অ্যান্ড ভ্যালু চেইনের পোর্টফোলিও লিড ড. আশেক মাহফুজ।

তিনি বলেন, “খাদ্য সমৃদ্ধকরণের জন্য আমাদের দেশে কোনো কেন্দ্রীয় হাব নেই। আমরা বর্তমানে বাংলাদেশ ও নাইজেরিয়ায় এ নিয়ে কাজ করছি। গবেষণার জন্য দেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে নেওয়া হয়েছে, যার একটি হলো বাকৃবি। আমরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফর্টিফিকেশন নয়, বরং বায়োফর্টিফিকেশন নিয়ে কাজ করছি। বায়োফর্টিফিকেশন সমৃদ্ধ ধান চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি ডাল জাতীয় ফসলে জিঙ্ক ও আয়রন সমৃদ্ধ করার কাজ চলছে।”

তিনি আরো বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে তেলে ভিটামিন-এ এবং লবণে আয়োডিন যোগ করা হচ্ছে। তবে সাধারণ ভোক্তা আসলে কতটুকু ভিটামিন-এ ও আয়োডিন পাচ্ছেন, সেটিও গবেষণার বিষয়।”

প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, “খাদ্যের পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধকরণের উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এ বিষয়ে জাতিকে সচেতন করা জরুরি, যাতে সবাই সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে। সচেতনতার অভাবে আজ অনেক মানুষ ডায়াবেটিস, ক্যান্সারসহ নানা মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। এ উদ্যোগকে সফল করতে আমার পক্ষ থেকে যেকোনো সহযোগিতা দেওয়া হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘খাদ্য পুষ্টিগুণ বিষয়ে সচেতনতা তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। তবে বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্প আলাদা আলাদাভাবে বাস্তবায়নের পরিবর্তে সমন্বিতভাবে পরিচালনা করা হলে ফলাফল আরো দ্রুত ও কার্যকর হবে।”

ঢাকা/লিখন/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দেশে ২২ শতাংশের বেশি শিশু ও নারী ভিটামিন-ডি ঘাটতিতে ভুগছে