ইউক্রেনের জন্য বোমা হামলার চেয়েও যেটা বড় হুমকি
Published: 14th, August 2025 GMT
যুদ্ধ সব সময় এমনভাবে শেষ হয় না যে এক পক্ষ পুরোপুরি জয়লাভ করে। সাধারণত আমরা যেসব গল্প শুনি, সেখানে বড় জয়গাথাই বেশি গুরুত্ব পায়। কারণ, এসব গল্প দেশপ্রেম উসকে দিতে কাজে লাগে। কিন্তু বাস্তব ইতিহাসে অনেক যুদ্ধ এমন অচলাবস্থায় শেষ হয়, যেখানে কেউই পুরোপুরি জেতে না।
এই বিষয়টা মনে রাখা জরুরি। এর কারণ, আগামী শুক্রবার আলাস্কায় যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির পুতিন মুখোমুখি হবেন, তখন তাঁরা গোটা পরিস্থিতিকে এমনভাবে দেখানোর চেষ্টা করবেন যেন ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে, অথচ এতে ইউক্রেনের মতামত নেওয়ারও প্রয়োজন হবে না। বাস্তবে অবশ্য এমনটা সম্ভব হবে না।
আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাছে এই বৈঠক ব্যক্তিগত মর্যাদার ব্যাপার। তিনি আগে ঘোষণা করেছিলেন, ক্ষমতায় ফিরেই কয়েক দিনের মধ্যে যুদ্ধ থামিয়ে দেবেন। কিন্তু সাত মাস কেটে গেলেও যুদ্ধ চলমান। এটি তাঁর নিজের ভাবমূর্তিতে (তিনি যেহেতু নিজেকে অসাধারণ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তুলে ধরতে ভালোবাসেন) আঘাত করেছে।
আরও পড়ুনইউক্রেন হেরে গেলে তারপর কী হবে...১৫ জুলাই ২০২৫
পুতিনও প্রথমে ভেবেছিলেন যুদ্ধ দ্রুত শেষ হবে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি এই বিশ্বাস নিয়ে সর্বাত্মক হামলা শুরু করেছিলেন যে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কিয়েভ দখল হয়ে যাবে। কিন্তু ইউক্রেনের দৃঢ় প্রতিরোধে তাঁর সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। এরপর তিনি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের কৌশল বেছে নেন। এর মাধ্যমে রাশিয়ার বিপুল সেনা ও বিমান হামলার মাধ্যমে ইউক্রেনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকিয়ে রাখার ক্ষমতা ধ্বংস করার চেষ্টা চলছে। রাশিয়ার শিল্প খাতকে যুদ্ধের জন্য সাজিয়ে তোলা হয়েছে। জনমতও দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
ক্রেমলিনপন্থী প্রচারকেরা দেশটির সামরিক ধৈর্যের গল্প ছড়াচ্ছেন। আর রুশ সেনা কর্মকর্তারা বারবার বলছেন, শিগগিরই তাঁরা শত্রুর প্রতিরক্ষা ভেঙে ইউক্রেনকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করবেন।
ইউক্রেনের হেরে যাওয়াটা পুতিনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, অন্য কোনো ফলাফল (যেমন এখন দখলকৃত এলাকা রেখে যুদ্ধ থামানো) তাঁর বড় লক্ষ্য পূর্ণ করতে দেবে না। যত দিন জেলেনস্কি এমন একটি দেশের প্রেসিডেন্ট থাকবেন, যে দেশটি নিজের জন্য সেনাবাহিনী রাখতে পারে এবং ইউরোপের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতে পারে, তত দিন পুতিনের প্রতিশোধের আগুন জ্বলে থাকবে।
ট্রাম্প যদি পুতিনকে খুব বেশি সমর্থন না করেও বৈঠকে অংশ নেন, তবু রাশিয়ার জন্য এটি লাভজনক হতে পারে। যদি ট্রাম্প বৈঠকের পর ক্রেমলিনের বক্তব্য প্রকাশ করেন, তাহলে ইউক্রেনের ক্ষতি হবে। ইউক্রেনের মিত্ররা আশঙ্কা করছেন, ট্রাম্প এমন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনবেন, যা জেলেনস্কি মেনে নিতে পারবেন না। তখন পুতিন বলবেন, তিনি তো শান্তি চেয়েছিলেন, কিন্তু ইউক্রেনের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।পুতিন মনে করেন, যেকোনো চুক্তি বা সীমান্তরেখা ক্রেমলিনকে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ ঠিক করার ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করবে। এটি তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তবে প্রয়োজনে কৌশলগত কারণে তিনি সাময়িকভাবে কিছু চুক্তিতে সই করতে রাজি হতে পারেন। কারণ, তিনি বুঝেছেন, ট্রাম্পের ধৈর্য এখন কমে গেছে এবং যুদ্ধ কেন এখনো শেষ হয়নি, তা ব্যাখ্যা করতে তিনি জেলেনস্কির ওপর আগের মতো প্রভাব রাখতে পারছেন না।
আলাস্কার বৈঠক হচ্ছে কারণ, ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির সময়সীমা ঠিক করতে চেয়েছিলেন এবং মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছিলেন। পুতিনকে এখন কিছুটা সমঝোতার ভান করতে হচ্ছে। তিনি ভেবেছেন, শীর্ষ বৈঠক এবং ‘ভূমি বিনিময়’ নিয়ে অস্পষ্ট ইঙ্গিত ট্রাম্পের ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করবে এবং যেকোনো বিষয়ে চুক্তি করতে ট্রাম্প রাজি হতে পারেন।
এই বৈঠকে পুতিন যুদ্ধকে এমনভাবে দেখানোর চেষ্টা করবেন, যা ট্রাম্পের ভুল ধারণার সঙ্গে মিলে যায়। তিনি দেখাবেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি চতুরভাবে জো বাইডেনকে ঠকিয়েছেন এবং এখনো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ অপচয় করাচ্ছেন। পুতিন বলবেন, যুদ্ধ প্রায় শেষ, ইউক্রেন জিতবে না, কিন্তু ইউক্রেন মিত্রদের আরও অর্থ খরচ করাতে থাকবে। তিনি রাশিয়া-আমেরিকার সম্পর্ককে সুদৃঢ় দেখানোর গল্প দেখাবেন এবং বলবেন, এই সম্পর্ক একটি বিদ্রোহী ইউরোপীয় প্রদেশের কারণে নষ্ট হয়েছে।
আরও পড়ুনইউক্রেন থেকে যেভাবে ফায়দা লুটছে আমেরিকা–ইউরোপ১২ জুলাই ২০২৫পুতিন এমন কিছু এলাকা দাবি করবেন, যা এখনো রাশিয়ার দখলে নেই। এসব এলাকার দখল নেওয়াকে পুতিন রাশিয়ার জন্য ন্যূনতম শর্ত হিসেবে দেখাবেন। তিনি চাইবেন ইউক্রেন ‘সামরিকীকরণহীন’ হোক, যাতে ভবিষ্যতে সহজে আক্রমণ করা যায় এবং এটিকে রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য জরুরি বলে দেখানো যায়। এসব দাবি তিনি অনেক মাস ধরে করে আসছেন এবং এই মাসের শুরুতেও আবার বলেছেন।
ট্রাম্প যদি পুতিনকে খুব বেশি সমর্থন না করেও বৈঠকে অংশ নেন, তবু রাশিয়ার জন্য এটি লাভজনক হতে পারে। যদি ট্রাম্প বৈঠকের পর ক্রেমলিনের বক্তব্য প্রকাশ করেন, তাহলে ইউক্রেনের ক্ষতি হবে। ইউক্রেনের মিত্ররা আশঙ্কা করছেন, ট্রাম্প এমন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনবেন, যা জেলেনস্কি মেনে নিতে পারবেন না। তখন পুতিন বলবেন, তিনি তো শান্তি চেয়েছিলেন, কিন্তু ইউক্রেনের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।
রাফায়েল বের দ্য গার্ডিয়ান–এর কলাম লেখক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউক র ন র ক য় র জন য করব ন বলব ন
এছাড়াও পড়ুন:
ঐহিক অমরতায় রণদা প্রসাদ সাহা
দানবীর রণদা প্রসাদ সাহাকে তাঁর গ্রামের ছোট–বড় সবাই ডাকে জেঠামনি। অবিভক্ত ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া উপাধি ছিল রায়বাহাদুর। সে নামেও তাঁকে ডাকতেন অনেকে। কিন্তু তিনি সেই অভিজাত সম্বোধন পছন্দ করতেন না। তবে আর পি সাহা নামটিই ছিল সাধারণের মধ্যে অধিক পরিচিত। দাতা বা দানবীর এই মানুষটি মির্জাপুরবাসীর কাছে আজও জেঠামনি হিসেবেই যেন ঘরের মানুষ, প্রাণের ভালোবাসার মানুষটি। এক উচ্চতর মূল্যবোধের অধিকারী, বিস্ময়কর রকম শক্তিমান মানুষ ছিলেন দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা। তাঁর প্রাণশক্তি, শ্রমশক্তি ও চিন্তাশক্তি ছিল বিস্ময়কর। আর বোধের জায়গাটিতে—মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করাকে তিনি মানবীয় কর্তব্য মনে করতেন। পৃথিবীকে সবার জন্য সুখকর করে তোলা সম্ভব এই বিশ্বাসেই তিনি জনহিতকর কাজ করে যেতেন অক্লান্তভাবে। এই ব্রত থেকেই লাভ করেছিলেন ‘দানবীর’ অভিধা। তাঁর কীর্তির চেয়ে অনেক বড় ছিলেন তিনি।
রণদা প্রসাদ সাহার জন্ম ১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর, টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা নারায়ণগঞ্জের কুমুদিনী কম্পাউন্ড থেকে পুত্র ভবানী প্রসাদসহ তাঁকে রাতের গভীরে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তারপর তাঁদের আর কোনো খোঁজ মেলেনি। ৭৪ বছরের কর্মময় জীবন রণদা প্রসাদ সাহার।
মির্জাপুর তখন একেবারেই অজপাড়াগাঁ। পিতা দেবেন্দ্র সাহার নির্দিষ্ট কোনো পেশা ছিল না। রুটিরুজির সন্ধানে বারবার তাঁকে পেশা বদল করতে হয়েছে। বেশির ভাগ সময়ে দলিল লেখকের কাজ করেছেন তিনি।
প্রসবকালে ধনুষ্টঙ্কারে অকালে মারা যান মা কুমুদিনী দেবী। তিনি রোগশয্যায় না পেয়েছেন এতটুকু ওষুধ-পথ্য, না পেয়েছেন সেবাযত্ন। শৈশবের এই অসহ্য স্মৃতি রণদা প্রসাদকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এমনভাবে যে পরবর্তীকালে তাঁকে তা একজন সেবকে পরিণত করেছিল। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দুস্থ মানুষের সেবাপ্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী’।ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অতুলনীয় মাতৃভক্তির কথা আমরা সবাই জানি। রণদা প্রসাদ বিদ্যাসাগরের মতো মাতৃভক্তি দেখানোর সুযোগ পাননি। তিনি মাকে হারান মাত্র সাত বছর বয়সে। মায়ের স্নেহের আঁচল জড়িয়ে ধরতে না ধরতে তিনি বিদায় নেন। অভাবের সংসারে প্রসূতি মায়ের যত্ন দূরে থাকুক, উপযুক্ত আহারই সময়মতো জোটেনি। চিকিৎসার জন্য সারা গ্রাম খুঁজে একজন ডাক্তারও সেদিন মেলেনি কিংবা অর্থাভাবে কোনো ডাক্তার আনা যায়নি। প্রসবকালে ধনুষ্টঙ্কারে অকালে মারা যান মা কুমুদিনী দেবী। তিনি রোগশয্যায় না পেয়েছেন এতটুকু ওষুধ-পথ্য, না পেয়েছেন সেবাযত্ন। অশৌচের অসিলায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুই ছিল তখনকার দিনে মেয়েদের এক মর্মান্তিক নিয়তি। মায়ের এই মৃত্যুদৃশ্যের নীরব দর্শক ছিল সাত বছরের অবোধ বালক রণদা প্রসাদ। শৈশবের এই অসহ্য স্মৃতি রণদা প্রসাদের নিদ্রা-জাগরণের প্রতিটি মুহূর্ত আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এমনভাবে যে পরবর্তীকালে তাঁকে তা একজন সেবকে পরিণত করেছিল। নিজের মায়ের জীবন দেখে তিনি নারী জীবনের অসহায়ত্ব উপলব্ধি করেন এবং নারী জাতির কল্যাণ্যে কিছু করার সংকল্প গ্রহণ করেন। সামর্থ্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই দুঃখ-স্মৃতিকে রূপ দিয়েছিলেন দুস্থ মানুষের সেবাপ্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী’তে—স্থাপন করেছিলেন মাতৃভক্তির এক অনন্য নজির।
রণদা প্রসাদ সাহা কোলাজ