যেমন ছিল মহানবী (সা.)–এর জুমার খুতবা
Published: 24th, September 2025 GMT
কল্পনা করুন, জুমার দিন, মদিনার মসজিদে নববিতে বসে আছি। হৃদয়ে এক অদ্ভুত উত্তেজনা, প্রতীক্ষার এক মধুর অনুভূতি। নবীজি মুহাম্মদ (সা.) এখনই মিম্বরে উঠবেন, খুতবা দেবেন। তাঁর কথা শোনার জন্য হৃদয় যেন অধীর হয়ে আছে। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে, তাঁর কণ্ঠে আল্লাহর বাণী শুনব—এই মুহূর্তটি যেন জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়।
ইসলামে জুমার দিন একটি উৎসবের মতো, যেমন নবীজি (সা.
এই কথাগুলো আমাকে মনে করিয়ে দেয় জুমার দিনটি কতটা বিশেষ।
নবীজি (সা.)–এর জুমার প্রস্তুতিনবীজি (সা.) নিজেই এই শিক্ষার জীবন্ত উদাহরণ ছিলেন। জুমার নামাজের আগে তিনি গোসল করতেন, যাতে তাঁর শরীর পবিত্র ও সতেজ থাকে। তিনি সেরা সুগন্ধি ব্যবহার করতেন, শরীরের প্রতিটি অংশে তা ছড়িয়ে দিতেন।
যদি কারও সামর্থ্য থাকে, তবে জুমার জন্য তার কাজের পোশাক ছাড়া আলাদা পোশাক কিনুক।সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১০৭৮মিসওয়াক দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করতেন, আর সবচেয়ে সুন্দর পোশাক পরতেন। তাঁর এই প্রস্তুতি যেন আমাদের শেখায়, জুমা কেবল একটি নামাজ নয়, এটি একটি উৎসব, যেখানে আমরা আমাদের সেরাটা দিয়ে আল্লাহর সামনে হাজির হই।
একবার হজরত উমর (রা.) বাজারে একটি সুন্দর রেশমি পোশাক দেখে তা নবীজি (সা.)–এর জন্য কিনে আনেন, যাতে তিনি তা জুমার খুতবায় বা প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাতে পরেন। কিন্তু নবীজি সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ রেশম মুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ।
তিনি বললেন, ‘যদি কারও সামর্থ্য থাকে, তবে জুমার জন্য তার কাজের পোশাক ছাড়া আলাদা পোশাক কিনুক।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১০৭৮)
এই ঘটনা আমার হৃদয়কে স্পর্শ করে। নবীজি (সা.)-এর সরলতা, তাঁর নীতির প্রতি অটলতা আমাদের শেখায়, জুমার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে হৃদয়ের পবিত্রতা ও নিষ্ঠা দিয়ে।
আরও পড়ুননবীজি (সা.)-এর ‘পেটে পাথর বাঁধা’ হাদিসের ব্যাখ্যা কী২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫মসজিদে নবীজির উপস্থিতিমসজিদে প্রবেশ করে নবী (সা.) মিম্বরে উঠতেন, সবাইকে সালাম দিতেন। তাঁর হাতে একটি লাঠি থাকত, যা তিনি ধরে বসতেন। তারপর হজরত বিলাল (রা.) আজান দিতেন। সেই সময়ের মানুষ দেয়ালের কাছে বসার চেষ্টা করতেন না, যেমনটা আজকাল অনেকে করে।
তাঁরা নবীজি (সা.)–এর শিক্ষা মেনে ইমামের কাছাকাছি বসতেন। তিনি বলেছিলেন, ‘খুতবায় উপস্থিত হও এবং ইমামের কাছে বসো। যে দূরে থাকে, সে জান্নাতে প্রবেশ করলেও পিছিয়ে থাকবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮৫৬)
এই কথা নবীজি (সা.)-এর কাছাকাছি থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগায় সাহাবিদের হৃদয়ে।
যখন তিনি বিশ্বাসীদের একটি ভবনের মতো শক্তিশালী বলে বর্ণনা করতেন, তখন তাঁর হাত দুটি শক্ত করে ধরতেন। যখন জিভের বিপদের কথা বলতেন, তখন নিজের মুখের দিকে ইশারা করতেন।নবীজির খুতবা ছিল এমন এক মুহূর্ত, যেখানে হৃদয় আর মন এক হয়ে যেত। তিনি সবাইকে লক্ষ করতেন, প্রতিটি বিষয়ে নজর রাখতেন। একবার আবু কায়স (রা.) মসজিদে এসে দেখলেন নবীজি (সা.) খুতবা দিচ্ছেন। তিনি রোদে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন। নবীজি তাঁকে ছায়ায় বসতে ইশারা করলেন।
আরেকবার সুলাইক আল-গাতাফানি (রা.) মসজিদে এসে দুই রাকাত নামাজ না পড়ে বসে পড়লেন। নবীজি খুতবা থামিয়ে তাঁকে দুই রাকাত নামাজ পড়তে বললেন। কেউ কেউ বলেন, সুলাইকের দরিদ্র অবস্থা সবাইকে দেখানোর জন্যই নবীজি (সা.) এটা করেছিলেন, যাতে নামাজের পর মানুষ তাঁকে সাহায্য করে।
নবীজির সহানুভূতি, তাঁর দৃষ্টি যেন প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে পৌঁছাত। (আল-আযিমাবাদি, মুহাম্মদ শামসুল হক, আউন আল-মাবুদ, ৩/১২৫, দার আল-কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১৯৯৮)
নবীজির খুতবানবীজি (সা.)–এর খুতবা ছিল যেন একটি সমুদ্র—গভীর, বিস্তৃত, মনোমুগ্ধকর। তিনি হাতের ইশারা, চোখের ভাষা আর কণ্ঠের সুরে কথা বলতেন।
যখন তিনি বিশ্বাসীদের একটি ভবনের মতো শক্তিশালী বলে বর্ণনা করতেন, তখন তাঁর হাত দুটি শক্ত করে ধরতেন। যখন জিভের বিপদের কথা বলতেন, তখন নিজের মুখের দিকে ইশারা করতেন। জান্নাতের দরজা খোলার কথা বলতে গিয়ে তিনি হাত দিয়ে দরজা খোলার ভঙ্গি করতেন।
তাঁর কথাগুলো এত স্পষ্ট ছিল যে তিনবার পুনরাবৃত্তি করে তিনি নিশ্চিত করতেন সবাই তা বুঝেছে। তাঁর চোখ আর কণ্ঠে আবেগ ফুটে উঠত—আনন্দের কথায় তাঁর মুখ উজ্জ্বল হতো, দুঃখের কথায় চোখে বিষাদ নামত।
আরও পড়ুনহজরত আলী (রা.)-এর ১০টি কালজয়ী উক্তি২৮ জুন ২০২৫উম্মে হিশাম, হারিস ইবনে নুমানের মেয়ে, বলেছিলেন, ‘আমি নবীজির জুমার খুতবা শুনে সুরা কাফ মুখস্থ করেছি।’
তিনি প্রতি জুমায় এই সুরা তিলাওয়াত করতেন, কারণ এটি জীবন ও মৃত্যুর গভীর আলোচনা করে। খুতবায় তাঁর উপস্থাপিত দৃষ্টান্ত আর উপমা ছিল এত জীবন্ত যে সাহাবিরা তাঁর কথা হৃদয় দিয়ে শুনতেন। তাঁদের শরীর এত নিশ্চল থাকত যেন মাথায় পাখি বসে আছে।
এসব বর্ণনা আমার হৃদয়ে একটি ছবি আঁকে—নবীজির সামনে বসে আছি, তাঁর কথায় হৃদয় ভরে যাচ্ছে, মন শান্ত হচ্ছে।
হৃদয়ের সাক্ষাৎএকবার নবীজি (সা.) খুতবা দিচ্ছিলেন, তাঁর নাতি হাসান ও হোসাইন (রা.) লাল পোশাকে তাঁর দিকে দৌড়ে এলেন। তাঁরা ছোট্ট শিশু ছিলেন, পোশাকের কারণে বারবার হোঁচট খাচ্ছিলেন। নবীজি খুতবা থামিয়ে মিম্বর থেকে নেমে তাঁদের কোলে তুলে নিলেন। তিনি আয়াত পড়লেন: ‘তোমাদের সম্পদ ও সন্তান কেবল একটি পরীক্ষা।’ (সুরা তাগাবুন, আয়াত: ১৫)
তারপর তাঁদের জন্য দোয়া করে কোলে নিয়ে মিম্বরে ফিরলেন।
এক জুমায় পুরুষ সাহাবিরা এত কাঁদছিলেন যে নারীরা নবীজির খুতবা শুনতে পাননি। পরে তাঁরা জানতে পারেন, নবীজি (সা.) কবরের পরীক্ষা ও কষ্ট নিয়ে কথা বলছিলেন।আরেকবার, আসমা বিনত আবু বকর (রা.) বলেন, এক জুমায় পুরুষ সাহাবিরা এত কাঁদছিলেন যে নারীরা নবীজির খুতবা শুনতে পাননি। পরে তাঁরা জানতে পারেন, নবীজি (সা.) কবরের পরীক্ষা ও কষ্ট নিয়ে কথা বলছিলেন।
নবীজির কথা এত শক্তিশালী ছিল যে তা হৃদয়কে কাঁদিয়ে দিত, মনকে জাগিয়ে তুলত।
জুমার নামাজে নবীজির সুন্দর পোশাক, সুগন্ধি, মিসওয়াকের ব্যবহার, তাঁর কণ্ঠের সুর—সবকিছু যেন আমাকে ডাকে। তাঁর কথায় জীবন ও মৃত্যুর পাঠ, তাঁর দৃষ্টিতে করুণা, তাঁর ইশারায় জ্ঞান—এগুলো আমার হৃদয়কে পূর্ণ করে।
নবীজি (সা.) আমাদের শিখিয়েছেন, জুমা একটি উৎসব, একটি দিন, যখন আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের সেরাটা নিয়ে হাজির হই। তাঁর খুতবা ছিল হৃদয় জাগানোর শিল্প, যা আমাদের আল্লাহর পথে নিয়ে যায়।
আসুন, আমরা জুমার এই আলোকে হৃদয়ে ধরে রাখি, নবীজির শিক্ষায় জীবনকে আলোকিত করি। আসসালামু আলাইকুম—শান্তি বর্ষিত হোক।
ওমর সুলাইমান রচিত মিটিং মুহাম্মাদ বই থেকে অনুবাদ: মনযূরুল হক
আরও পড়ুনযে ৪টি পরীক্ষা নবীজি (সা.)–এর জীবনকে দৃঢ়তা দিয়েছে২২ জুলাই ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর ক ষ আল ল হ ন নব জ আম দ র র জন য ম ম বর মসজ দ করত ন
এছাড়াও পড়ুন:
‘ঢাকাইয়া দেবদাস’ নিয়ে আসছেন বুবলী-আদর
ঢাকাই সিনেমার আলোচিত নায়িকা শবনম বুবলী। এর আগে আদর আজাদের সঙ্গে জুটি বেঁধে পর্দায় হাজির হয়েছেন। ফের জুটি বেঁধে অভিনয় করতে যাচ্ছেন এই যুগল। ‘ঢাকাইয়া দেবদাস’ শিরোনামের সিনেমাটি পরিচালনা করবেন জাহিদ হোসেন। শুক্রবার (৭ নভেম্বর) রাজধানীর একটি ক্লাবে মহরত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শুরু হবে সিনেমাটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা।
জাহিদ হোসেন জানান, ‘ঢাকাইয়া দেবদাস’ মূলত প্রেমের গল্পের সিনেমা। তবে এটিকে শুধু প্রেমকাহিনিও বলতে নারাজ। প্রেমের গল্পের পাশাপাশি পুরান ঢাকার কৃষ্টি ও সংস্কৃতিও উঠে আসবে সিনেমাটির গল্পে।
আরো পড়ুন:
শাকিবের ‘রহস্যময়’ বার্তা
বুবলীর যত লুক
পরিচালক জাহিদ হোসেন বলেন, “জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায়ের ভাষা, সমাজ–সংস্কৃতিভিত্তিক চলচ্চিত্র বিরল। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এমন বিষয়ের চলচ্চিত্রের সমাদর যথেষ্ট। সমাজ, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন হচ্ছে পুরান ঢাকা। রয়েছে হাজার বছরের বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্য ও সব সম্প্রদায়ের সহাবস্থানের গৌরবোজ্জ্বল চিত্র। এখানে সবাই মিলে সাকরাইন, ঈদ, মহররম, নববর্ষ, ব্যবসা-বাণিজ্যের হালখাতা, পূজাপার্বণ উদ্যাপন করে। আরো অনেক সংস্কৃতি আছে, যা এখনকার প্রজন্মের অনেকেই জানে না। এসব সংস্কৃতিও উঠে আসবে দুটি মানুষের গল্পের মাধ্যমে।”
খানিকটা ব্যাখ্যা করে নির্মাতা বলেন, “ঢাকাবাসীদের নবজাতক আগমনের নানা উৎসব ও কালচার থাকবে সিনেমাটিতে। মেয়েদের নাক-কান ফোঁড়ানো থেকে ছেলেদের সুন্নতে খতনা অনুষ্ঠান, মাজার শরিফ জিয়ারতসহ শিয়াদের হোসনি দালানের বৈচিত্র্যময় অধ্যায়—সব নিয়েই আমাদের চলচ্চিত্র ‘ঢাকাইয়া দেবদাস’।”
ঢাকাবাসীর জন্ম-মৃত্যু, বিয়েসহ পারিবারিক নানা বৈচিত্র্যময় কৃষ্টি-কালচার থাকবে সিনেমাটিতে। নববর্ষের গান, কাসিদা, কাওয়ালি, হিজড়া সম্প্রদায়ের গানসহ শিয়াদের শোকের গান। চলচ্চিত্রের নায়ক–নায়িকাসহ পুরান ঢাকার তরুণ–তরুণীদের প্রেম–ভালোবাসার ছন্দময় সংগীত থাকবে চলচ্চিত্রটিতে থাকবে বলেও জানান এই নির্মাতা।
আদর-বুবলী ছাড়াও এ চলচ্চিত্রে অভিনয় করবেন—তারিক আনাম খান, শহীদুজ্জামান সেলিম, রাশেদ মামুন অপু প্রমুখ। আগামী জানুয়ারিতে সাকরাইন উৎসবের সময়ে সিনেমাটির শুটিং শুরু হবে। সিনেমাটির প্রযোজনা ও পরিবেশনায় থাকছে এক্সেল ফিল্মস ও রেভুলেশন মুভিজ ইন্টারন্যাশনাল।
ঢাকা/শান্ত