রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ২১ জুলাইয়ের মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনার পর কেটে গেছে ১০০ দিন। শোক কাটিয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরতে চেষ্টা করছে স্কুল কর্তৃপক্ষ, বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও অন্যান্য সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের আয়োজন চলছে এখন।

তারই অংশ হিসেবে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শাখার বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে গেল ৪ নভেম্বর। তার আগে ১৫–২০ দিন জোর রিহার্সাল চলল। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ঝলমলে রঙিন পোশাক পরে দল বেঁধে স্কুলবাসে দিয়াবাড়ি ক্যাম্পাসে গেল।

সারা দিন গান, নাচ, আবৃত্তি, অভিনয় আর মূল ক্যাম্পাসের খোলামেলা পরিবেশে হইচই করে কাটানোর এ রকম দারুণ সুযোগ, বছরে একবারই মেলে। কিন্তু অভিভাবকদের একটা বড় অংশ দিয়াবাড়ি ক্যাম্পাসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাচ্চাদের অংশগ্রহণে দ্বিধান্বিত ছিলেন। দুর্ঘটনা এবং দুর্ঘটনা–সংক্রান্ত ভিডিও, ছবি, খবর ইত্যাদি অভিভাবক ও শিশুদের মনের শঙ্কার ছাপ রেখে দিয়েছে আজও।

আরও পড়ুনমাইলস্টোন স্কুল ট্র্যাজেডি: বেঁচে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মনের আতঙ্ক কমবে কীভাবে১৮ আগস্ট ২০২৫

শুধু মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি নয়, একের পর এক দুর্ঘটনা ও রাজনৈতিক সংকট ও দুর্যোগে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এখন নগরবাসীর মানসিক স্বাস্থ্য। অনেকেই খবরের কাগজ পড়া বন্ধ করে দিয়েছেন, রাস্তায় নেমে প্রতিমুহূর্তে আতঙ্কগ্রস্ত থাকেন ‘কখন কী হয়’ ভেবে। ঘটনাস্থলে না থেকেও ঘটনার ভয়বহতায় ট্রমাটাইজ এসব অভিভাবকের অনেকে পেশাদার মনোচিকিৎসকদের শরণাপন্ন হচ্ছেন নিয়মিতভাবে। হঠাৎ করে হাসিখুশি বাবা-মায়েরা অস্থির হয়ে উঠেছেন তাঁদের সন্তানদের সুরক্ষায়, আর না বুঝে বড়দের অতিরিক্ত নজরদারিতে অতিষ্ঠ হচ্ছে অবোধ শিশুদের দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবনধারা।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে হতাহত ব্যক্তিদের পরিবার ২১ জুলাইকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘শোক দিবস’ হিসেবে পালন করার দাবি জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া সংবাদ সম্মেলনে নিহত সবাইকে শহীদের মর্যাদাসহ প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান, ঘটনার সঠিক তদন্ত, দায়ী ব্যক্তিদের বিচার, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া, সরকারি ব্যবস্থাপনায় হেলথ কার্ডের ব্যবস্থা, আহত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন, নিহত ব্যক্তিদের কবর সংরক্ষণ, নিহতদের স্মরণে একটি মসজিদ নির্মাণ ইত্যাদি দাবি জানানো হয়।

আরও পড়ুনস্কুলে স্কুলে সংস্কৃতিচর্চার জোয়ার আনা জরুরি১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২

পরিবারগুলো তাদের অবর্ণনীয় ট্রমায় থমকে যাওয়া জীবনের গল্প বলতে গিয়ে অভিযোগ করে যে বর্তমানে স্কুল কর্তৃপক্ষ ছাড়া আর কেউ তাদের খোঁজখবর নেয় না। প্রধান উপদেষ্টা শিক্ষকের পরিবারের তিনজন সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। আহত ও নিহত শিক্ষার্থীদের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি।

নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে স্কুলে প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে। আহত শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার সঙ্গে সঙ্গে আহত বা ট্রমাটাইজ শিশু–কিশোর ও তাদের অভিভাবকদের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যার জন্য ক্যাম্প করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। ভুক্তভোগী অভিভাবক ও শিশুদের যে দীর্ঘস্থায়ী ট্রমা, তার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের একক উদ্যোগ আসলে কতটা কার্যকর হবে, যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়া না হয়?

ঘনবসতির এ নগরে বিমান আছড়ে পড়ে ছাই হয়ে যায় কোমলপ্রাণ শিশু–কিশোর আর শিক্ষকেরা, মিরপুরে গার্মেন্টসে আগুন লেগে শ্রমিক মারা যান, মাথায় মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড ছিটকে পড়ে মরে যান তরতাজা যুবক। এসব কাঠামোগত হত্যা বন্ধের ব্যাপারে ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ কোনো সমাধান হতে পারে না। হয়তো এটাই বাংলাদেশের বাস্তবতা। সমাজকেই শোক কাটিয়ে আবার এগোতে হয়, যদিও ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো ভরসা মেলে না কোথাও।

জিপিএ–৫–এর আকাঙ্ক্ষায় স্কুল, কোচিং ও প্রাইভেট টিউটরদের কাছে পড়া শেষ করে একজন শিশু বা কিশোরের কাছে শিল্পকলার চর্চা বাড়তি চাপ ছাড়া কিছু নয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে উৎসব ও আনন্দ আয়োজনের কেন্দ্রে থাকছে শুধু ‘জিপিএ–৫’। অকৃতকার্য বা পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের উৎসাহিত করার কোনো উৎসব নেই কোনো?

৪ নভেম্বর স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রার্থনা ও সুর-ছন্দে নিহতদের স্মরণ করে নব উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হলেও সেদিনের প্রায় সব জাতীয় দৈনিকের অন্যতম শিরোনাম ছিল, ‘প্রাথমিকে শারীরিক শিক্ষা ও সংগীত শিক্ষকের পদ বাতিল করল সরকার’ (সমকাল, ৪ নভেম্বর ২০২৫)। যদিও সরকারের তরফ থেকে বাতিলের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, প্রকল্পটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল এবং চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল হওয়ায় বৈষম্য সৃষ্টি হবে (সমকাল, ৫ নভেম্বর, ২০২৫)।

শিক্ষা কার্যক্রমের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হওয়ার কথা সংগীত, নৃত্য ও শিল্পকলা। ট্রমা থেকে মুক্তির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে সংগীত ও শিল্পকলার চর্চা। সংগীতের মাধ্যমে শিশুদের সূক্ষ্ম অনুভূতি জাগিয়ে তোলা যায়, শরীর আর মনের ভেতরের তাল ও ছন্দের বোধ জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে সৃষ্টি করা যায় বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা, যা শিশুমনের কল্পনাশক্তি আর সৃজনশীলতার জন্ম দিতে পারে। শিশু–কিশোরদের ট্রমা, প্রযুক্তি–আসক্তি কমাতেও সংগীত ও শিল্পচর্চার বিকল্প নেই। দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীগুলোর আপত্তি এখানে একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না।

আরও পড়ুনপ্রাথমিকে সংগীত ও ধর্মীয় শিক্ষক বিতর্ক: বাস্তবতা কী বলে২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

জিপিএ–৫–এর আকাঙ্ক্ষায় স্কুল, কোচিং ও প্রাইভেট টিউটরদের কাছে পড়া শেষ করে একজন শিশু বা কিশোরের কাছে শিল্পকলার চর্চা বাড়তি চাপ ছাড়া কিছু নয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে উৎসব ও আনন্দ আয়োজনের কেন্দ্রে থাকছে শুধু ‘জিপিএ–৫’। অকৃতকার্য বা পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের উৎসাহিত করার কোনো উৎসব নেই কোনো?

বিটিভির শিশু-কিশোরদের প্রতিভা অন্বেষণের জাতীয় প্রতিযোগিতা ‘নতুন কুঁড়ি’ আবার শুরু হলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে স্কুল পর্যায়ের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক চর্চার উদ্যোগ ও চর্চার পাশাপাশি দেশজ সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ তৈরি এবং ধর্মীয় মতাদর্শের সঙ্গে সংস্কৃতিচর্চার অহেতুক বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা রোধ করার জন্য রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছার প্রয়োজন।

শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের ফলে বহু বছর ধরেই সংগীত ও অন্যান্য শিল্পকলার চর্চা একটি ‘অলাভজনক’ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। স্কুল–কলেজ পর্যায়ে মানবিক বিভাগ সব সময় অপেক্ষাকৃত ‘দুর্বল’ শিক্ষার্থীদের ঠিকানা। এমনকি স্নাতক পর্যায়ের কলা অনুষদের বিষয়সমূহ, যেমন বাংলা, দর্শন, ইতিহাস, চিত্রকলা, নৃবিজ্ঞান, সংগীত ইত্যাদি মানবিক বিদ্যাকে হেয় করতে দেখা যায় শিক্ষিত সমাজের বেশির ভাগ মানুষকে। শিক্ষাকে অর্থ উপার্জনের নিমিত্ত ভাবার মানসিকতা ও ধর্মীয় ভাবাদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিকভাবে উপস্থাপনের প্রয়াসও আসলে সংগীত ও চিত্রকলার চর্চা থেকে দূরবর্তী করেছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের।

তার ফল হিসেবে আমরা পেয়েছি, চোখ থেকেও চারপাশে ছড়িয়ে থাকা পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখতে না পাওয়া, কান থেকেও সুর শুনতে না পাওয়া অথবা বুদ্ধি থেকেও বোধ না থাকা, মন থেকেও তাতে সুখ–দুঃখের অনুভব না থাকা বা মনের ভেতর আগুন জ্বলে না ওঠার এক নিদারুণ মনস্তাত্ত্বিক সংকট, যার আবর্তে ঘুরছে আমাদের  শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্য। সুর, তাল আর ছন্দ বিনা আমরা কীভাবে ভুলে থাকব আমাদের সব অবসাদ, ট্রমা?

ড.

ঈশিতা দস্তিদার নৃবিজ্ঞানী ও লেখক

*মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ক ত ক অন ষ ঠ ন ম ইলস ট ন দ র ঘটন র জন য উদ য গ চর চ র পর ব র

এছাড়াও পড়ুন:

খাগড়াছড়িতে চলছে রাস উৎসব ও মেলা

খাগড়াছড়িতে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে চলছে সনাতন ধর্মালম্বীদের রাস উৎসব। গত সোমবার সন্ধ্যায় ধর্মীয় আনুষ্ঠানিতার মধ্যদিয়ে শুরু হওয়া এই উৎসব চলবে আগামী বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) রাত পর্যন্ত।

দুর্গার পূজার এক মাস পর রাস পূজা করেন সনাতন ধর্মালম্বীরা। এই উৎসবকে ঘিরে খাগড়াছড়ির  শ্রী শ্রী লক্ষী নারায়ণ মন্দিরে এখন চলছে উৎসবের আমেজ। এই উৎসবকে ঘিরে মন্দিরের পাশে বসেছে মেলা। চট্টগ্রাম-ফেনীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে দোকানিরা এসে পসরা সাজিয়ে বসেছেন। 

আরো পড়ুন:

পুণ্যস্নান মধ্য দিয়ে কুয়াকাটায় শেষ হলো রাস উৎসব, মেলা চলবে ৫ দিন

বাউফলে খেলার মাঠে মেলা বন্ধের দাবিতে সড়কে বিক্ষোভ

পুণ্যার্থী সাগর চক্রবর্তী, স্বপন দে ও বিপাশা বিশ্বাস জানান, খাগড়াছড়ি যেহেতু পাহাড়ি জেলা এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বসবাস, সে জন্য এখানে ভিন্নতাও আছে। মেলায় প্রতিদিন ভিড় করছেন পাহাড়ি-বাঙালিরা। তারা সবার মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করবেন বলে জানান।

খাগড়াছড়ির লক্ষী নারায়ণ মন্দিরের পুরোহিত রতন চক্রবর্তী বলেন, “এই পূজা ও নামযজ্ঞের মধ্যে দিয়ে সবার জন্য মঙ্গল প্রার্থনা করেন ভক্তরা।”

খাগড়াছড়ি সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল বাতেন মৃধা বলেন, “পূজা যেন সুন্দর ও সুস্থভাবে শেষ হয়, সে জন্য পুলিশ প্রশাসনের থেকে নেওয়া হয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।  এই উৎসব উপলক্ষে সবাই যেন নির্বিঘ্নে যাতে ধর্মীয় কার্যক্রম চালাতে পারেন সেজন্য পুলিশ টহলের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও গোয়েন্দা পুলিশ কাজ করছে।”

ঢাকা/রূপায়ন/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘আলফ্রেড কোভালকোভিস্কি পুরস্কার’ পেলেন হাসানআল আব্দুল্লাহ
  • ‘ঢাকাইয়া দেবদাস’ নিয়ে আসছেন বুবলী-আদর
  • ভবিষ্যৎ গড়ার গল্প
  • এলাকার নামেই সিনেমা—আবেগে ভাসলেন পাইকগাছার মানুষ
  • মহারাসলীলা উৎসব
  • সুন্দরবনের বুকে শেষ হলো রাস উৎসব
  • স্বপ্ন, সাহস আর নেতৃত্বের উৎসবে অনুপ্রাণিত হলো হাজারো মানুষ
  • ট্রাম্পের লাল টুপি বনাম মামদানি সমর্থকদের নীল-হলুদ টুপি
  • খাগড়াছড়িতে চলছে রাস উৎসব ও মেলা