রাসুল (সা.) সর্বযুগের আদর্শ ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিক আমাদের জন্য অনুকরণীয়। তিনি পরিবারের নারীদের প্রতি যেমন মধুর ও সম্মানজনক ব্যবহার করতেন, তেমনি সমাজের অন্যদের সঙ্গেও তাঁর আচরণ ছিল অতুলনীয়।

নারীর প্রশংসা করা, সৌজন্যমূলক আচরণের সঙ্গে তিনি হাস্যরসাত্মক আচরণে তিনি কখনো কার্পণ্য করেননি।

নারীদের প্রশংসা ও সৌজন্য

রাসুল (সা.

) নারী ও পুরুষ সকল অতিথিকে হাসিমুখে স্বাগত জানাতেন। আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, একবার একদল নারী ও শিশুকে বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ফিরতে দেখে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা আমার কাছে সর্বাধিক প্রিয়।’ এই কথা তিনি তিনবার পুনরাবৃত্তি করেন, যা তাঁর নারীদের প্রতি গভীর স্নেহ ও সম্মান প্রকাশ করে। (সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস: ১,৮৯৯)

আবার আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, খাদিজা (রা.)-এর বোন হালা বিনতু খুওয়াইলিদ একদিন রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চাইলে, তিনি খাদিজার স্মৃতি মনে করে হতচকিত হয়ে বলেন, ‘আল্লাহ, এ তো দেখছি হালা বিনতু খুওয়াইলিদ!’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩,৮১৮)

এটা ছিল তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজার প্রতি ভালোবাসা এবং তাঁর পরিবারের প্রতি সম্মানের প্রকাশ।

আরও পড়ুনফকিহদের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের মধ্যকার প্রেম–ভালোবাসা২৬ জুলাই ২০২৫নারীদের জ্ঞানানুরাগ ও স্বাধীনতা

রাসুল (সা.)-এর যুগে নারীরা ছিলেন জ্ঞানানুরাগী ও স্বাধীনচেতা। তাঁরা ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিষয়ে রাসুল (সা.)-এর কাছে সরাসরি প্রশ্ন করতেন। এমনকি ঋতুস্রাব, যৌনকামনা বা একান্ত বিষয়েও তাঁরা অকপটে প্রশ্ন করতেন, যেখানে আধুনিক যুগের নারীরাও সংকোচ বোধ করতে পারেন।

রাসুল (সা.) অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে তাঁদের প্রশ্ন শুনতেন এবং বিস্তারিত উত্তর দিতেন। তিনি মদিনার আনসারি নারীদের প্রশংসা করে বলতেন, ‘আনসার নারীরা কতই-না উত্তম! দীনের জ্ঞানার্জনে লজ্জা কখনো তাঁদের বিরত রাখতে পারে না।’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৩১৬)

নারীদের আবেদনের প্রতি সম্মান জানিয়ে রাসুল (সা.) তাঁদের জন্য পৃথক শিক্ষার দিন নির্ধারণ করেন। আবু সায়িদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, একবার নারীরা বলেন, ‘আল্লাহর রাসুল, পুরুষেরা আপনার কাছে প্রাধান্য পাচ্ছেন, আমাদের জন্য একটি পৃথক দিন নির্ধারণ করুন।’

রাসুল (সা.) তাঁদের জন্য বিশেষ একটি দিন ঠিক করেন এবং সেদিন তাঁদের উপদেশ ও নির্দেশ দেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১০১)

নারীদের সরলতা ও রাসুল (সা.)-এর হাস্যরস

নারী সাহাবিরা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে অত্যন্ত সহজ ও অকপট ছিলেন। তাঁরা নিজেদের মনের ইচ্ছা প্রকাশে কখনো সংকোচ করতেন না। সাহল ইবন সাদ (রা.) বর্ণনা করেন, এক নারী রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বলেন, ‘আল্লাহর রাসুল, আমি নিজেকে আপনার কাছে উৎসর্গ করতে এসেছি।’

রাসুল (সা.) তাঁকে দেখে মাথা নিচু করেন, আর নারীটি বসে পড়েন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৩১০; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৪২৫)

আরেকটি ঘটনায়, হাসান (রা.) বর্ণনা করেন, এক বৃদ্ধা রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বলেন, ‘আল্লাহর রাসুল, দুআ করুন, আমি যেন জান্নাতে প্রবেশ করতে পারি।’ রাসুল (সা.) হাস্যরস করে বলেন, ‘মা, কোনো বুড়ো মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ এই কথা শুনে বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে চলে যান।

তখন রাসুল (সা.) তাঁকে ডেকে বলেন, ‘তুমি বুড়ো অবস্থায় জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি তাদেরকে বিশেষভাবে সৃষ্টি করেছি, আর তাদেরকে করেছি কুমারী’ (সুরা ওয়াকিয়া, আয়াত: ৩৫-৩৬)।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২,৫৪৭)

আরও পড়ুনমুসলিম নারী ক্যালিগ্রাফারদের গল্প১৫ জুন ২০২৫

আরেকটি ঘটনায়, আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, এক নারী সাহাবি, যিনি রিফাআ আল-কুরজির স্ত্রী ছিলেন, তিন তালাকের পর ইদ্দত পালন করে আবদুর রাহমান ইবন জুবায়েরের সঙ্গে বিয়ে করেন।

কিন্তু নতুন স্বামীর শারীরিক অক্ষমতার কারণে তিনি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে অকপটে বলেন, ‘আল্লাহর রাসুল, আমার বর্তমান স্বামী আমার হক আদায়ে অপারগ।’ চাদরের কোণ ধরে ইশারায় তিনি বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেন।

খালিদ ইবন ওয়ালিদ (রা.) তাঁকে ধমক দিতে চাইলে রাসুল (সা.) মুচকি হেসে বলেন, ‘তুমি হয়তো আগের স্বামীর কাছে ফিরতে চাও, কিন্তু এখন তুমি তার জন্য বৈধ নও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,০৮৪; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৪৩৩)

শত্রুপক্ষের নারীদের প্রতি সম্মান

রাসুল (সা.) শুধু মুসলিম নারীদের নয়, শত্রুপক্ষের নারীদের প্রতিও অতুলনীয় সম্মান দেখিয়েছেন। খায়বার যুদ্ধে বিজয়ের পর বনু কুরায়জা ও বনু নাজিরের যুদ্ধবন্দি নারীদের মধ্যে বনু নাজিরের সরদারকন্যা সাফিয়া বিনতু হুওয়াইকে দিহইয়া (রা.)-এর হাতে সমর্পণ করা হয়।

কিন্তু সাহাবিদের অনুরোধে রাসুল (সা.) তাঁর মর্যাদা বিবেচনা করে তাঁকে স্বাধীনতা দেন এবং বিয়ে করে উম্মুল মুমিনিনের মর্যাদা প্রদান করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৯৪৭; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৩,৬৫০)

সমুদ্রাভিযানের স্বপ্ন ও উম্মে হারাম

উম্মে হারাম বিনতে মিলহান (রা.), উবাদা ইবন সামিত (রা.)-এর স্ত্রী, রাসুল (সা.)-এর কুবায় গেলে তাঁর মেহমান হতেন। একদিন তিনি দুপুরে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। হঠাৎ হাসতে হাসতে জেগে উঠে বলেন, ‘আমি আমার উম্মতের একদল মুজাহিদকে দেখলাম, তাঁরা রাজকীয় অবস্থায় সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে।’

উম্মে হারাম তাঁর জন্য দোয়া চাইলে রাসুল (সা.) তাঁর জন্য দোয়াকরেন। এই ঘটনা পরে মুআবিয়া (রা.)-এর যুগে সত্য হয়, যখন উম্মু হারাম সমুদ্রাভিযানে অংশ নেন। কিন্তু ফেরার পথে ঘোড়া থেকে পড়ে তিনি শাহাদাতবরণ করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,২৮৩)

রাসুল (সা.)-এর নারীদের সঙ্গে আচরণ ছিল সম্মান, স্নেহ এবং রসিকতার এক অপূর্ব সমন্বয়। তিনি নারীদের জ্ঞানার্জনকে উৎসাহিত করেছেন, তাঁদের প্রশ্নের ধৈর্য সহকারে উত্তর দিয়েছেন এবং তাঁদের মর্যাদা রক্ষায় সর্বদা সচেতন ছিলেন।

এমনকি শত্রুপক্ষের নারীদের প্রতিও তিনি অতুলনীয় সম্মান প্রদর্শন করেছেন। তাঁর এই আচরণ আমাদের জন্য শিক্ষা যে, নারীদের প্রতি সম্মান ও সৌজন্য শুধু ধর্মীয় দায়িত্ব নয়, বরং একটি মানবিক গুণ, যা সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখে।

আরও পড়ুনমুসলিম নারী চিকিৎসকেরা হারিয়ে গেলেন কেন১৩ জুন ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সহ হ ব খ র দ র জন য আল ল হ এর ক ছ করত ন

এছাড়াও পড়ুন:

দুর্নীতিগ্রস্ত উপদেষ্টাদের শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে এনসিপি

বিরোধীদের নিয়ে কড়া বাক্য উচ্চারণের জন্য বহুল আলোচিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের জন্য রীতিমতো শঙ্কার বার্তা নিয়ে হাজির হলেন।

দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি বলেছেন, “বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। অনেকের আত্মীয়-স্বজনের খবর আমরা পাচ্ছি। উপদেষ্টাদের কে কে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, তা জনগণের সামনে আনতে শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে এনসিপি।”

আরো পড়ুন:

বক্স অফিসে ‘ওজি’ সিনেমার দাপট: কে কত টাকা পারিশ্রমিক নিলেন?

পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ভারতের ভিসা জটিলতা কমবে: হাইকমিশনার

মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) রাতে রাজধানীর বাংলামোটরে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রতীক ইস্যুতে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এসে এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন নাসীরুদ্দীন।

যে প্রতীক ইস্যুতে সংবাদ সম্মেলনে, সে বিষয়ে জোর দিয়ে নাসীরুদ্দীন বলেন, “শাপলা পেতে কোনো আইনি বাঁধা দেখছি না। এখানে ইসি স্বৈরাচারী ও বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে। প্রতীক প্রশ্নে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। ব্যাখ্যা দিয়েই কমিশনকে যেতে হবে।”

নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, “এনসিপির সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে ইসি। তারা একটি দলের পক্ষ নিয়ে তাদের সুবিধা দিচ্ছে।”

রাকঢাক ছাড়াই অভিযোগের তীর ছুড়ে নাসীরুদ্দীনের সোজা কথা, “অসাংবিধানিক আচরণের জন্য ইসি কমিশনারের পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছি।”

সাংবাদিকদের প্রশ্নে গণঅধিকার পরিষদ ও এনসিপির একীভূত হওয়ার আলোচনার প্রসঙ্গ এলে এক্ষেত্রেও সেটি সরাসরি খারিজ করে দিয়ে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, “একীভূত হওয়ার সুযোগ নেই। এনসিপিতে যোগ দিতে হলে সদস্য ফরম পূরণ করতে হবে। নির্বাচনেও এনসিপির হয়েই দাঁড়াতে হবে।”

অবশ্য এনসিপির অন্য নেতারা বলে আসছেন, একীভূত হওয়ার আলোচনা চলছে। কোনো সিদ্ধান্ত হলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবেন তারা।  

নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতাকে চ্যালেঞ্জন করে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক বলেন, “আওয়ামী লীগ, ভারত, বিএনপি ও নির্বাচন কমিশন সব এক পক্ষে। এই কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব।” 

বিএনপির বিরুদ্ধে ভারতের পক্ষে কাজ করার অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, দলটি ভারতের পক্ষে কাজ করছে, তাদের বাংলাদেশপন্থি রাজনীতি করার আহ্বান জানাচ্ছি।

রাজনীতির মাঠে বিরোধীদের নিয়ে কড়া বাক্য উচ্চারণ করায় এনসিপির নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত নাসীরুদ্দীন। এর আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে উদ্দেশ্য করে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছিলেন, আগে নারায়ণগঞ্জের গডফাদার শামীম ওসমান ছিল, এখন শুনছি কক্সবাজারের নব্য গডফাদার শিলং থেকে এসেছে।

নাসীরুদ্দীনের ওই মন্তব্যের জেরে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হয় সালাহউদ্দিন আহমেদের জন্মভূমি কক্সবাজারের চকরিয়ায়।

ঢাকা/রায়হান/রাসেল 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দুর্নীতিগ্রস্ত উপদেষ্টাদের শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে এনসিপি