ঢাকা কিংবা মফস্বলের রাস্তায় হাঁটলে একসময় দূর থেকেই চোখে পড়ত সিনেমা হলের ঝলমলে সাইনবোর্ড। টাঙানো পোস্টার, ভিড় জমা টিকিট কাউন্টার, দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শক—শুক্রবার মানেই ছিল নতুন সিনেমার উৎসব। শহরের রাস্তাঘাট তখন বেজে উঠত সেলুলয়েডের আনন্দধ্বনিতে। 

এখন সেই দৃশ্য যেন কেবলই অতীতের অ্যালবামে বন্দি। একটার পর একটা সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি সংবাদপত্রের পাতায় চোখ রাখতেই ‘নীলফামারীতে একে একে ২৬টি সিনেমা হল বন্ধ, চালু মাত্র ১টি’, ‘বন্ধ হচ্ছে মণিহার’, ‘মধুমিতা বন্ধের ঘোষণা’ শিরোনামগুলো দেখা যায়। এটা শুধু দরজা বন্ধ হওয়া নয়—এ যেন আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি। 

আরো পড়ুন:

লোকসানে বগুড়ার ‘মধুবন সিনেপ্লেক্স’ বন্ধ 

কাজাখস্তানে আফরান নিশোর ‘দম’

বাংলাদেশে একসময় প্রায় ১২০০ সিনেমা হল সক্রিয় ছিল। আজ সংখ্যা নেমে এসেছে প্রায় ১২০টিতে। এর মধ্যে আবার সারা বছর চালু থাকে মাত্র ৫০টির মতো। ঈদ বা পূজা ছাড়া বাকিটা সময় প্রেক্ষাগৃহে দর্শকদের হাহাকার। 

বাংলাদেশের বৃহত্তম সিনেমা হল ‘মণিহার’। সম্প্রতি জানা যায়, লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা নিয়েছে মালিকপক্ষ। তবে আশার আলো জ্বালিয়ে বলেছেন, “ভালো সিনেমা পেলে সিদ্ধান্ত বদলানো যেতে পারে।” 

রাজধানীর ‘মধুমিতা’ সিনেমা হলও একই দুরবস্থার শিকার। মালিক ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ একাধিকবার হল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। কারণ একটাই—ভালো সিনেমার অভাব। ঢাকার গুলিস্তান, বিউটি, রূপমহল, নাজ, শাবিস্তান, মল্লিকা, পূরবী, স্টার, সুরমা, লায়ন, যমুনা, অভিসার, আগমন, ডায়না, জোনাকি, অতিথি, মানসী, পূর্ণিমা, রাজমণি, পদ্মা, মুন—এমন আরো বহু হল এখন কেবলই স্মৃতি। 

জেলা শহরের ছবিও ভিন্ন নয়। নড়াইলের ছয়টি হলই এখন বন্ধ। দর্শকদের অভাবে মালিকরা বাধ্য হয়ে সিনেমা হলের অবকাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছেন। দর্শক খরার আসল কারণ ব্যাখ্যা করে হল মালিকরা বলছেন, “পর্যাপ্ত সিনেমা নেই। যে সিনেমা আছে, তা দর্শক টানতে পারছে না। খরচ মেটানোই কঠিন হয়ে পড়েছে।” 

মধুবন সিনেপ্লেক্সের মালিক রোকনুজ্জামান ইউনুস বললেন, “বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারীদের বেতন—কিছুই মেটানো যাচ্ছে না। সিনেমা চালালে যে খরচ হয়, সেটাও উঠছে না।” একই পরিস্থিতিতে পড়েছেন কেরানীগঞ্জের লায়ন সিনেমাসের কর্ণধার মির্জা আবদুল খালেক। 

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল মনে করেন, “সমস্যার মূল হলো মানসম্মত সিনেমার অভাব। ভালো সিনেমা নেই বলেই দর্শক নেই। আমাদের ইন্ডাস্ট্রি বাঁচাতে হলে সার্কভুক্ত দেশের সিনেমা আমদানি উন্মুক্ত করতে হবে।” 

সিনেমা আমদানির প্রতি জোর দিয়ে আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল বলেন, “ঈদ ছাড়া আমরা সারা বছরে কোনো সিনেমা পাই না। বড় বড় সিনেপ্লেক্সও ফাঁকা পড়ে থাকে। তাই সার্কভুক্ত দেশের সিনেমা প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়া এখন জরুরি।” 

হলবিমুখ হওয়ার পিছনে রয়েছে নানা কারণ। প্রথমত, দর্শকের অভ্যাস বদলেছে। টেলিভিশন, ইউটিউব, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম—সবই হাতের মুঠোয়। দ্বিতীয়ত, ভালো সিনেমার ধারাবাহিক অভাব। তৃতীয়ত, অবকাঠামো সমস্যা। অনেক হল আজও পুরোনো চেয়ার, ভাঙাচোরা সাউন্ড সিস্টেম নিয়ে টিকে আছে। তরুণ প্রজন্ম সেখানে গিয়ে সিনেমা দেখতে আর আগ্রহী নয়। 

সিনেমা হল কেবল বিনোদনের জায়গা নয়—এটা একটি দেশের সংস্কৃতি, সমাজ আর মানুষের স্মৃতির ভাণ্ডার। ‘মণিহার’ বা ‘মধুমিতা’ ভেঙে গেলে কেবল ইট-পাথরের কাঠামো ভাঙে না; ভেঙে যায় প্রজন্মের নস্টালজিয়া, আনন্দ, প্রেম আর কান্নার হাজার মুহূর্ত।

ঢাকা/শান্ত

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স ন ম হল চলচ চ ত র

এছাড়াও পড়ুন:

দূষণ শুষে নেওয়া পদ্ম ফুল কেন হারিয়ে যাচ্ছে

পদ্ম জলাভূমিতে শোভা ছড়ায়, এর ফুল মধু বিকোয়, কিছু খাদ্যমূল্যও আছে। তবে বিজ্ঞানী, উদ্ভিদবিদ ও জলবায়ুবিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহুগুণে সমৃদ্ধ পদ্ম বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন উদ্ভিদের একটি। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য দায়ী কার্বন ডাই–অক্সাইড শোষণে অন্যান্য জলজ উদ্ভিদের তুলনায় পদ্ম অনেক বেশি সক্ষম।

শুধু কার্বন শোষণ নয়, সিসা, তামা, ফ্লোরাইড কিংবা নাইট্রেটের মতো ভারী ধাতু শোধনের ক্ষমতাও রাখে পদ্ম। পানির মান কতটা ভালো হতে পারে, তার নির্ণায়ক পদ্ম। বৈশ্বিক নানা গবেষণায় দেখা গেছে, যে জলাশয়ে পদ্মের উপস্থিতি থাকে, সেখানে দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও) ভালো থাকে। খাবার, ওষুধ ও কসমেটিক–সামগ্রী হিসেবে পদ্মের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। পদ্মের বিশ্ববাজার এখন ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।

কার্বনসহ ভারী ধাতু শোধনের ক্ষমতা রাখে পদ্ম। পানির মান নির্ণায়ক পদ্ম। এর বিশ্ববাজার এখন ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।

কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতায় প্রেমিকা বরুনার জন্য ‘বিশ্বসংসার তন্নতন্ন করে খুঁজে’ ১০৮টা নীলপদ্ম আনার কথা বলেছিলেন। সম্প্রতি আমরাও পদ্ম আর পদ্মবিলের খোঁজে বেরিয়েছিলাম। মাঝশরতের সকাল পেরিয়ে দুপুর। টাঙ্গাইলের নানা স্থানে পদ্মবিলের খ্যাতি আছে। একসময় কালিহাতীর বিলগুলোয় ‘পদ্ম’ ফুটত। আমাদের উদ্দেশ্য, পদ্মশোভিত বিল দেখা। তপ্ত রোদ আর গরম উপেক্ষা করে ঘুরে বেড়ালাম পাইকড়া বিল, চারাণ বিল, নকীল বিল, কুমার বিল, সিংগুলি বিলসহ আরও কত বিল। কোথাও পদ্ম ফুলের দেখা পাওয়া গেল না। কচুরিপানায় ভরা বিলগুলোর একটির নাম সাতবিল। একটি ছোট নৌকার মাঝি মজনু শাহ বলেন, এ বিলে আগে পদ্ম থাকলেও এখন নেই।

ঘুরতে ঘুরতে জানতে পারলাম, কালিহাতীর নাগবাড়ী ইউনিয়নের ধানগড়া গ্রামের নান্দাই বিলে পদ্মফুল থাকতে পারে। কচুরিপানা আর হরেক রকম জলজ উদ্ভিদ ভেদ করে মাঝ বিলে গিয়ে দেখলাম, পদ্মপাতা ভাসছে। কিন্তু ফুল খুব কম। নৌকাচালক আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বিলে মাছে ছাষ অয়। আগে তো ম্যালা জায়গায় পদ্ম হইত। এহন এহানেই টিক্যা আছে। মাছের চাষ করতে গিয়্যা পদ্ম উডাইয়া ফেলে।’

আন্ধাশুরা বিলে ফুটে আছে পদ্ম। একসময় এ বিলে অনেক পদ্ম ফুটত। এখন তা কমে গেছে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনা কি ‘গ্ল্যামার’ হারাচ্ছে?
  • দূষণ শুষে নেওয়া পদ্ম ফুল কেন হারিয়ে যাচ্ছে