ইউরিয়া সার উৎপাদনের ক্ষেত্রে মূল কাঁচামাল হিসেবে কাজ করে প্রাকৃতিক গ্যাস। কিন্তু গ্যাস–সংকটে বছরের বেশির ভাগ সময় সরকারি সার কারখানা বন্ধ রাখতে হয়। প্রতিবছর সার উৎপাদন কমছে। চাহিদা মেটাতে বাড়তি দামে সার আমদানি করতে হচ্ছে। এখন আমদানি কমিয়ে উৎপাদন বাড়াতে চায় সরকার। তাই গ্যাস সরবরাহ বাড়িয়ে সার কারখানা চালু রাখার নামে বাড়ছে গ্যাসের দাম।

সার কারখানায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে আজ সোমবার গণশুনানি করেছে জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এতে অংশীজনেরা বলেন, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের কথা বলে ২০২২ সালে শিল্পে ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয় গ্যাসের দাম। যদিও বাড়তি দাম দিয়ে গ্যাস পায়নি শিল্প। সার কারখানায় প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম দাম ৪ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা করার পরও কারখানা বন্ধ ছিল। এখন আরও বাড়িয়ে ৩০ টাকা করার চেষ্টা চলছে।

সরকারি মালিকানায় ৫টি ইউরিয়া সার কারখানা আছে। এগুলো বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) অধীনে। সংস্থাটির কর্মকর্তারা শুনানিতে জানান, গ্যাসের অভাবে গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫) যমুনা সার কারখানা বন্ধ ছিল ৩৫১ দিন। তার মানে চালু ছিল মাত্র ১৪ দিন। আশুগঞ্জ সার কারখানা বন্ধ ছিল ২৫৯ দিন। শাহজালাল সার কারখানা বন্ধ ছিল ১৪৭ দিন। চট্টগ্রাম ইউরিয়া কারখানা বন্ধ ছিল ৮১ দিন। এর আগের বছরেও বেশির ভাগ সময় বন্ধ ছিল কারখানা। ২০০৬-০৭ অর্থবছর থেকেই বছরের বড় একটি সময় সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখা শুরু হয়।

রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে আজ সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত গণশুনানি চলে। এতে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) ও ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি দাম বাড়ানোর অভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরে। তারা সার কারখানার জন্য গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে বিইআরসি গঠিত কারিগরি কমিটির মূল্যায়ন প্রতিবেদনে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা নির্ধারণের যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়।

এর আগে গত ১০ আগস্ট সার কারখানায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় পেট্রোবাংলা। এরপর একই প্রস্তাব আলাদা করে জমা দেয় ৬টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। এতে বলা হয়, প্রতি ঘনমিটার গ্যাসে গড়ে খরচ হয় ২৮ টাকা ৭৮ পয়সা। বর্তমানে বিক্রি করা হচ্ছে ২২ টাকা ৯৩ পয়সা। প্রতি ঘনমিটারে লোকসান হচ্ছে ৫ টাকা ৮৫ পয়সা। এতে চলতি অর্থবছরে ১২ হাজার ২৯১ কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে। সরকার ভর্তুকি বরাদ্দ রেখেছে ৬ হাজার কোটি টাকা। সার কারখানায় গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে ঘাটতি কমানো সম্ভব হবে।

শুনানি শেষে বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, ২০ বছর আগে প্রিপেইড মিটারের কাজ শুরু হয়েছে, এখনো ২০ শতাংশ হয়নি। সদিচ্ছা থাকলে এটা হতো। গ্যাস খাতে সিস্টেম লস (কারিগরি ক্ষতি) কমাতে সদিচ্ছা থাকতে হবে। তিনি আরও বলেন, ১৭ কোটি মানুষকে খাইয়ে পরিয়ে রাখছে কৃষি। তাই কৃষির জন্য বোঝা তৈরি করা যাবে না। সার কারখানায় উৎপাদন ধরে রাখতে হবে। আবার পেট্রোবাংলার ঘাটতিও করা যাবে না। সব দিক চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন। সবার মতামত বিবেচনা করা হবে। এর বাইরে ১৩ অক্টোবরের মধ্যে লিখিত মতামত দিতে পারবেন।

শুনানিতে অংশ নিয়ে নাগরিকদের কেউ কেউ গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করেন। তাঁরা বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে সারের উৎপাদন খরচ বাড়বে। এরপর সেই অজুহাতে সারের দাম বাড়ানো হবে। এতে কৃষিপণ্যের খরচ বাড়বে, যা ভোক্তার ওপর প্রভাব পড়বে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো.

মনিরুজ্জামান বলেন, প্রতি টন সারে ভর্তুকি এখন ১৩ হাজার টাকা। কৃষক পর্যায়ে সারের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই। বাড়তি উৎপাদন খরচের দায় যদি সরকার ভর্তুকি দিয়ে মেটায়, তাহলে গ্যাসের দাম বাড়তে পারে।

তবে বিসিআইসির পরিচালক (পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন) দেলোয়ার হোসেন বলেন, ২০২২ সালে গ্যাস সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দাম বাড়িয়েছিল, সেটা রক্ষা করা হয়নি। এতে আগের চেয়ে বছরে উৎপাদন কমেছে ৩ লাখ টন। গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। আর দাম যদি বাড়াতেই হয়, তাহলে ১৬ টাকা থেকে ৪ টাকা বাড়িয়ে ২০ টাকা করা যেতে পারে। এতে কৃষক বাঁচবে।

বিসিআইসির তথ্য বলছে, ২০০৬-০৭ সালে তারা সার উৎপাদন করেছে ১৮ লাখ ১৭ হাজার টন। কমতে কমতে ২০২১-২২ সালে করেছে ১০ লাখ ১০ হাজার টন। গ্যাসের দাম বাড়ানোর পর ২০২২-২৩ সালে করেছে ৭ লাখ ১৮ হাজার টন ও ২০২৩-২৪ সালে করেছে ৬ লাখ ৯৪ হাজার টন। তবে গত অর্থবছরে উৎপাদন ১০ লাখ টন ছাড়িয়েছে। যদিও এর মধ্যে প্রায় ৮ লাখ টন উৎপাদন করেছে গত বছরের মার্চে উৎপাদনে আসা ঘোড়াশালের নতুন সার কারখানা। সেই হিসাবে আগের কারখানাগুলোয় উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ টন। যদিও পুরোনো কারখানাগুলোর জ্বালানির সাশ্রয়ী ব্যবহারের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে শুনানিতে। বিসিআইসির কর্মকর্তারা শুনানিতে বলেন, প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা করা হলেও সার আমদানির চেয়ে দেশে সার উৎপাদন খরচ কম হবে।

শুনানিতে অংশ নেবে না বলে আগেই ঘোষণা দিয়েছিল ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম আজ প্রথম আলোকে বলেন, দাম বাড়ানোর পর গ্যাস পাবে কোথায়? আগেও গ্যাস দেবে বলে দাম বাড়ানো হয়েছিল। এভাবে গ্যাসের দাম বাড়ানোর পর সারের দাম বাড়বে। সারের দাম বাড়লে কৃষি ধ্বংস হয়ে যাবে। এরপর খাদ্যও আমদানি করতে হবে। দেশ ধীরে ধীরে আমদানি বাজারে পরিণত হচ্ছে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গ য স সরবর হ র প রস ত ব হ জ র টন বন ধ ছ ল ব স আইস ল খ টন সরক র আমদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

আগামী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ জ্বালানি সরবরাহ

আগামী নির্বাচিত সরকারের সামনে জ্বালানি সরবরাহ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তাই এখন থেকেই এ খাতের নতুন বিনিয়োগ করা না হলে ২০৩১ সালে সরবরাহ সংকট দেখা দেবে। তাই এ খাতের ধারাবাহিক নীতি কাঠামোর দাবি জানান ব্যবসায়ীরা।

আজ বুধবার গুলশানের একটি হোটেলে বিদ্যুৎ খাতের বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে এক সেমিনারে এ কথাগুলো বলেন বক্তারা। ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ এই সেমিনারের আয়োজন করে। এতে এ খাতের বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতারা বক্তব্য দেন।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন ইএমএ পাওয়ার লিমিটেডের পরিচালক আবু চৌধুরী। তিনি বলেন, ২০২৯ সালে দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা ৩৫ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাবে। তাই এখন থেকে নতুন বিনিয়োগ না করলে ২০৩১ সালে বিদ্যুৎ–সংকট দেখা দিতে পারে। বর্তমানে দেশের বিদ্যমান উৎপাদন সক্ষমতার ৪৮ শতাংশ আছে বেসরকারি খাতের হাতে। তাই নতুন নীতি তৈরিতে বেসরকারি খাতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেন, আগামী সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে জ্বালানি সরবরাহ। শুধু সরকারি সংস্থা বাপেক্সের ওপর নির্ভরতায় গত ২০ বছরে সাফল্য আসেনি। তাই গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের আনা দরকার। এ নিয়ে এখন সিদ্ধান্ত না নিলে ২০৩১ সালে জ্বালানি সংকট তৈরি হবে।

চা–বাগানের ভূমি ব্যবহারের নীতি পরিবর্তন করা গেলে বাগান থেকে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে বলে মনে করছেন এমসিসিআইয়ের সভাপতি কামরান টি রহমান। তিনি বলেন, ১০ থেকে ১৫ বছরে রাস্তায় আমরা অনেক বৈদ্যুতিক গাড়ি দেখতে পাব। তখন বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে। তাই এ খাতে নীতি কাঠামো প্রয়োজন। বেসরকারি খাত বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, বিনিয়োগের জন্য সামাজিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। এটা সব দলের দায়িত্ব। নতুন বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান হবে না। এতে প্রতিবছর কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হওয়া ২৫ লাখ তরুণ কাজ পাবে না। ফলে কাজ না পেয়ে সমাজে অস্থিরতা তৈরি হবে।

সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর শুরা কাউন্সিলের সদস্য মোবারক হোসেনসহ ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সবজির দাম বেড়েছে, কমেছে মাছের 
  • টেকনাফে অস্ত্রের মুখে ঘর থেকে ব্যবসায়ীকে অপহরণ, এপিবিএনের সঙ্গে গোলাগুলি
  • যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জুতা রপ্তানি বেড়েছে
  • গ্রী গ্লোবাল বাংলাদেশের পার্টনারস মিট: কার্যক্রম আরও গতিশীল করতে দিকনির্দেশনা
  • চার মাসে শুল্ক–কর আদায়ে ঘাটতি ১৭ হাজার কোটি টাকা
  • ঢাকার কম্পিউটার বাজারে প্রসেসর সরবরাহে ঘাটতি
  • আগামী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ জ্বালানি সরবরাহ