নারীর ধূমপান, মব জাস্টিস এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ডেভিল দর্শন
Published: 3rd, March 2025 GMT
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছিলেন, যত দিন পর্যন্ত দেশে ডেভিল বা শয়তান থাকবে, তত দিন পর্যন্ত অপারেশন ডেভিল হান্ট চলবে।
দেশবাসীও মনে করেছিলেন, দেরিতে হলেও সরকার অপরাধীদের বিরুদ্ধে একটা কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। ছিনতাই, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণের ঘটনা কমবে। কিন্তু অভিযানের প্রায় এক মাস হতে চললেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। এই অপারেশন ডেভিল হান্টের মধ্যেই বনশ্রীতে একজনকে গুলি করে ২০০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ডাকাতি করে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা, এই অভিযানের মধ্যেই উত্তরায় ছিনতাইকারী সন্দেহে দুজনকে ফুটওভার ব্রিজে ঝুলিয়ে রেখেছে স্থানীয় লোকজন। কেউ অপরাধ করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাকে সোপর্দ করার কথা। আইন নিজের হাতে কেউ তুলে নিতে পারেন না।
অপারেশন ডেভিল হান্টের মধ্যে বাসে ডাকাতি হচ্ছে দিনদুপুরে। কয়দিন আগে বেলা দুইটার দিকে ঢাকায় আসার পথে সাভারের ব্যাংক টাউন এলাকায় একটি বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটল। এ সময় অন্তত ২০ থেকে ২৫ যাত্রীর মুঠোফোন, মানিব্যাগসহ মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নেয় ডাকাতেরা।
অনেক বাস অটো ডাকাতির সঙ্গে চালকেরও যোগসাজশ থাকে। গত শনিবার ডেমরা থেকে অটো যোগে ঢাকা আসছিলেন শুটিং শেষে ফেরার পথে ছিনতাইকারীর কবলে পড়লেন অভিনেতা হারুন রশিদ। ৩০০ ফিট থেকে কমলাপুর যাওয়ার জন্য কাঞ্চন ব্রিজ থেকে একটা সিএনজিতে উঠেছিলেন তিনি। পাঁচ মিনিট যাওয়ার পরই অন্ধকারাচ্ছন্ন এক জায়গায় গাড়ির স্টার্টজনিত সমস্যার কথা বলে দাঁড়িয়ে যায় ড্রাইভার। এরপরই কয়েক ছিনতাইকারী এসে ঘিরে ধরে অভিনেতাকে। এ সময় তার কাছে থাকা টাকাপয়সা ছিনিয়ে নেয়। তাঁর ধারণা চালকের সঙ্গে ছিনতাইকারীদের যোগসাজশ আছে।
প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, রোজা ও ঈদের কেনাকাটা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ঘিরে সক্রিয় হচ্ছে পেশাদার ও মৌসুমি অপরাধীরা। জাল টাকার কারবার, ছিনতাই, ডাকাতি, গাড়ি চুরি, অজ্ঞান পার্টি ও মলম পার্টির কিছু তৎপরতা ইতিমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। এ অবস্থায় রমজান মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ অভিযান আরও জোরদার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে অভিযানের নাম ‘ডেভিল হান্ট’ আর থাকছে না বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
কারণ, যে উদ্দেশ্যে অপারেশন চালানো হয়েছিল, সেটি পূরণ হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। এ অপারেশনের উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু থেকে জনমনে প্রশ্ন ছিল। আইনশৃঙ্খলার অবনতি রোধে অপারেশন শুরু করা হয়নি। করা হয়েছিল গাজীপুরে সাবেক মন্ত্রীর বাড়িতে হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। এ অভিযানে যাঁরা ধরা পড়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই একটি দলের নেতা-কর্মী। কোনো দলের নেতা-কর্মীরা অপরাধ করলে অবশ্যই সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, নিচ্ছেও। সেটা আগের সরকারের আমলের অপরাধের দায়ে। কিন্তু এখন যাঁরা অপরাধ করছেন, তাঁদের কজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, সেই প্রশ্ন এসেছে।
এ কারণেই কি সরকার অপারেশন ডেভিল হান্ট নামে আর অভিযান চালাতে চাইছে না? নিয়ত ঠিক না থাকলে কোনো অভিযানই সফল হয় না। গত ৮ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে শুরু হয় অপারেশন ডেভিল হান্ট। ১ মার্চ পর্যন্ত যৌথ বাহিনীর এ অভিযানে ১১ হাজার ৮৮২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
রমজান মাস শুরুর প্রথম ২৪ ঘণ্টায় ৫৭৫টি টহল দল রাজধানীতে নিয়োজিত ছিল বলে জানিয়েছে ডিএমপি। ৬৫টি তল্লাশিচৌকি পরিচালনা করা হয়েছে এ সময়। বিভিন্ন অপরাধে ঢাকায় ১৬৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে ৬ জন ডাকাত, ১৮ জন পেশাদার ছিনতাইকারী, ৪ জন চাঁদাবাজ, ১০ জন চোর বলে জানিয়েছে ডিএমপি। থানাভিত্তিক সন্ত্রাসীদের তালিকা হালনাগাদ করে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে কোর কমিটির সভায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে অপরাধী ধরার অভিযানও চলবে।
কিন্তু এসব টহল ও চেকপোস্ট খুব একটা কাজে আসছে বলে মনে হয় না। এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার একটি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, লালমাটিয়ায় আড়ংয়ের পাশের একটি চায়ের দোকানে দুই তরুণী চা-সিগারেট খাচ্ছিলেন। তখন পাশ দিয়ে যাওয়া একজন বয়স্ক ব্যক্তি তাঁদের সিগারেট খাওয়া নিয়ে আপত্তি জানিয়ে তাঁদের চলে যেতে বলেন। দোকানিকেও দোকান বন্ধ করতে বলেন। এ নিয়ে ওই ব্যক্তির সঙ্গে তরুণীদের কথা–কাটাকাটির এক পর্যায়ে ওই ব্যক্তির গায়ে চা ছুড়ে মারেন একজন।
সেখানে লোকজন জড়ো হয়ে দুই তরুণীর ওপর চড়াও হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। পরে রাত ১১টার দিকে দুই তরুণীকে পরিবারের জিম্মায় দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘দুই নারীর ওপর হামলার বিষয়ে আমি যতটুকু জানছি, ওনারা নাকি সিগারেট খাইতেছিল। ওই সময় কিছু লোক নাকি নামাজ পড়তে যাইতেছিল। এ সময় ওনারা (লোকেরা) বাধা দেওয়ায় তাদের ওপর চা ছুড়ে মারছে।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘আপনারা জানেন ওপেন জায়গায় সিগারেট খাওয়া কিন্তু নারী-পুরুষ সবার জন্যই নিষেধ। এটা কিন্তু একটা অফেন্স। এ জন্য আমি অনুরোধ করব, ওপেন যেন কেউ সিগারেটটা না খায়। আর এখন তো রোজার সময়, সবাইকে একটু সংযমী হতে হবে। বাইরে যেন কেউ খাবারটা না খায়, এ বিষয়ে আমাদের ধর্ম উপদেষ্টাও কিন্তু রিকোয়েস্ট করছেন। এটা যারা রোজা থাকতেছে, তাদের জন্য একটা সম্মান প্রদর্শন করা।’
জনপরিসরে ধূমপান রোধে ২০০৫ সালে ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন’ জারি হয়। এই আইন অনুযায়ী পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপান নিষেধ। কেউ এ আইনের লঙ্ঘন করলে ৩০০ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়ার কথা আছে।
পাবলিক প্লেস বা জনপরিসর বলতে বোঝায় সড়ক, স্টেশন, টার্মিনাল, যাত্রীবাহি বাস ইত্যাদি। কিন্তু সিগারেট খাওয়ার ঘটনাটি সেরকম কোন পাবলিক প্লেসে ঘটেনি। তাহলে তাঁরা আইন লঙ্ঘণ করেছেন–এমনটা বলা যাবে না।
দুই তরুণী উল্লিখিত ‘ভদ্রলোকের’ প্রতি চা ছুড়ে মেরে অন্যায় করেছেন, সেই বিষয়েও সন্দেহ নেই। কিন্তু স্থানীয় লোকজন যে তাদের হেনস্তা করলেন, সে সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কিছু বললেনি। তাছাড়া ধূমপান সংক্রান্ত আইনটি নারী–পুরুষ সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে সেটা হচ্ছে কি? এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্য তাই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এ ছাড়া এ ঘটনায় পুরুষ ধূমপান করলে স্বাভাবিক, কিন্তু নারী করলে সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড—এমন মনোভাবও কি প্রকাশ পেল না? এ ঘটনার প্রতিবাদ হিসেবে নারীর ধূমপানের বিষয়টিরও প্রচারণা দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নানা দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের প্রতিবাদ নানাভাবেই করা যায়, কিন্তু সেখানে ক্ষতিকর কোনো উপাদান থাকবে তা কাম্য নয়। সিগারেট তো নারী–পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য ক্ষতিকরই।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প বল ক প র ধ কর র জন য এ সময় অপর ধ সরক র র ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
পূজাকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলায় বাহিনী তৎপর : ডিসি
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, আইনসৃঙ্খলা স্বাভাবিক রয়েছে, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজাকে ঘিরে সকল ধর্মমত, সকল সম্প্রদায় তারা একত্রিত হয়েছে।
সকলেই সার্বিক সহয়তা করছে যাতে করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা উৎসব সুন্দর ভাবে পজলন করতে পারে। পূজাকে ঘিরে একটি গোষ্ঠি চাইবে পূজা উৎসব নষ্ট করে দেয়ার জন্য।
সে জন্য আমাদের তৎপরতা রয়েছে। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। তার পাশাপাশি র্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশবাহিহনী সবাই কাজ করছে যাতে করে সুন্দর ভাবে পূজা উৎসব শেষ করতে পারি।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ৫নং ঘাটে দূর্গা পূজার প্রতিমা বিসর্জনের স্থান পরিদর্শনকালে তিনি এ নির্দেশনা দেন।
দূর্গা পূজা বিজয়া দশমী শেষে প্রতিমা বিসর্জনের সময় যেকোনো অপ্রীতিকর দূর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সুন্দর ভাবে প্রতিমা বিসর্জনের স্থান নিরাপদ রাখতে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন জেলা প্রশাসক।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, নারায়ণগঞ্জের ২২৩টি পূজা মণ্ডপে সুষ্ঠুভাবে পূজা উদযাপনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে এবং সম্প্রীতি বজায় রেখে বর্তমানে পূজা উদযাপনের প্রস্তুতি চলছে।
এসময় তিনি প্রতিটি মণ্ডপে সুষ্ঠুভাবে ও নির্বিঘ্নে পূজা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে যথাযথ সহযোগিতার নির্দেশনা দেন।
তিনি বলেন, সকলে মিলে সব উৎসব উদযাপন করাই বাংলার ঐতিহ্য ও গৌরব।
এসময় জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিআইডব্লিউটিএ, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।