রাজধানীর কলাকেন্দ্রে যখন চলছে সাইদুল হক জুইসের প্রদর্শনী বনবিবির খোঁজে, তখন কাছে দূরে বহু স্থানে, সুন্দরবনে তো বটেই, চলছে বনভূমি ধ্বংসের কাজ। যদি বন না থাকে, বনবিবি মিলবে কোথায়?
হাজার বছর ধরে মানুষের বিশ্বাসে বেঁচে আছে বনদুর্গা বা বনবিবি। এখন শিকারিরা নিজের প্রতিও সহানুভূতিহীন। স্বার্থপরতা তো আত্মহত্যার মতোই। মানুষ এখন আত্মহত্যা করছে। বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে। বনবিবি নেই। পেলে তো আর শিল্পী বনবিবির খোঁজে বেরোতেন না।
শিল্পীর কাজ জড়ের জগৎকে জীবনের জগতে পরিণত করা। কলাকেন্দ্রে চলমান সাইদুল হক জুইসের বনবিবির খোঁজের ছবি, ভাস্কর্য, উপস্থাপনাকর্ম দেখে মনে হলো, খোঁজ মিলতে চলেছে। ভক্তের আহ্বানে মা অলক্ষ্যে এসে উপস্থিত হবেন– এটাই স্বাভাবিক।
শিল্পকর্মগুলোর নামের ভেতর অভিযান ও অনুসন্ধানী মেজাজ স্পষ্ট। বনবিবির খোঁজে, কোথায় খুঁজে পাব, কোথায় খুঁজে পাব তারে, সুন্দরবনের ইতিকথা এমন শিরোনামের আড়ালে প্রাকৃত নারীশক্তির অধিষ্ঠান দেখি। নারী তো প্রকৃতি। প্রকৃতির মতোই সে উর্বরা, রূপসী, অবরোধবিনাশিনী, জন্মদায়িনী। মানুষের শিল্পী মানুষের মাঝেই তো প্রাকৃত দেবীকে খুঁজবেন, এ আর বিস্ময়ের কী। নারীরা অবাধে স্থান পেয়েছেন কোলাজে। যেহেতু শিল্পকর্ম মানেই সেখানে শিল্পীর নিজস্ব জগতের আইনের অধিষ্ঠান থাকতে হবে, প্রতি আঁচড়ে ফুটে উঠতে হবে মৌলিক ক্ষত, সুতরাং দর্শকের চোখ সেই নারীচয়ের চতুর্পাশে শিল্পীর হৃদয়মাধুরী প্রকাশ করে এমন রংরঙিন আঁচড় দেখতে পাবেন অসংখ্য। এ কাজগুলো লক্ষণীয়। বনের একেবারেই প্রাকৃত আকৃতি এখানে প্রকাশিত।
শিল্প মানেই কিন্তু তথাকথিত ‘সুন্দর’ নয়, শিল্পী এই বিশ্বাস করেন। জানতে পারি কথাসাহিত্যিক সাগুফতা শারমীন তানিয়ার লেখা থেকে। নান্দনিক সেই ভূমিকায় তিনি শিল্পী সাইদুল হক জুইসের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পচিন্তা চিহ্নিত করেছেন। চিন্তাকে আকার দেওয়াও শিল্প। এইখানে সাইদুল হক জুইস সম্ভবত জড় জগৎ নির্মিত ভাস্কর্যকর্ম কিংবা আঁচড়ভিত্তিক স্কেচগুলোর ভাষায় সাহিত্যের সঙ্গে সদালাপে বসে গেলেন। সাহিত্য তো চিন্তারই শিল্পীত রূপ। সেখানে চিন্তার বাহন ভাষা। রং কিংবা ধাতু নয়। সাইদুল হক জুইস শিল্পকে সহজবোধ্য, সাধারণের সঙ্গে যোগাযোগসক্ষম রাখতে চান।
প্রকৃতি শিল্পীর অন্তর দেগে দিতে ভালোবাসে। শিল্প প্রাকৃত। সুতরাং শিল্পী প্রকৃতির বিনিয়োগের খাতায়। শিল্পীর অন্তরে ওই দেগে দেওয়াটাই প্রকৃতির মূলধন। আশির দশকের মাঝামাঝি স্নাতকোত্তর সাইদুল হক জুইসের অন্তরে প্রকৃতি কম বিনিয়োগ করেনি। সর্বশেষ বিনিয়োগটি কভিড মহামারি। এর ভয়াবহ নিঃসঙ্গতার বোধ তাকে ক্রমশ কারণসন্ধানী করে তোলে। মানুষের অতিনিয়ন্ত্রণের নেশা যেভাবে অনিয়ন্ত্রণের জন্ম দিচ্ছে, নরক করে তুলছে পার্থিব স্বর্গকে, এসবের কার্যকারণ আবিষ্কারে তো নিজের দিকে তাকানোর পর্যাপ্ত সময় দিতে হয়। সেই সময়টা কভিড শিল্পীদের দিয়েছে। এমন সময় তারা চাননি, কিন্তু পেয়েছেন। প্রকৃতির পৃথক রূপ পৃথকভাবে তাঁর মাতা ও প্রেয়সী। ছোটবেলার প্রকৃতি-সন্নিধানই তাকে কখনও সেই আদর, সেই মমতা ভুলতে দেয়নি। নয়তো জন্মস্থান রংপুরে তিনি কারুপণ্যের দপ্তরকে এমন বিশ্বমানের উদ্ভিজ স্বর্গে পরিণত করেন কী করে? যারা কারুপণ্যের কারখানা দেখেননি, রংপুর গেলে সাইদুল হক জুইসের সেই কাজ, দেখে আসতে পারেন।
শিল্পকর্মে বনদেবীর অধিষ্ঠান দেখতে হলে আসতে হবে কলাকেন্দ্রেই। বেশি সময় কোথায়। ২০ এপ্রিলের পর পর্দা নেমে যাবে এ প্রদর্শনীর।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বনব ব র খ
এছাড়াও পড়ুন:
এক দশকে ১ লাখ হেক্টর বনভূমি কমেছে
দেশে এক দশকে বনভূমি হ্রাস পেয়েছে ১ লাখ ১ হাজার হেক্টর, যা ঢাকা শহরের আয়তনের প্রায় সাড়ে তিন গুণ। গত এক দশকে দেশ থেকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির গাছ।
সারা দেশে বনাঞ্চলে যে পরিমাণ গাছ আছে, গ্রামাঞ্চলে গাছের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। তবে গ্রামে গাছের ঘনত্ব কম। আর বন উজাড় বেশি হয়েছে পার্বত্যাঞ্চলে। সেখানে একমুখী প্রজাতির ফসল চাষের প্রসার ও সড়ক সম্প্রসারণের কারণে বন উজাড় হচ্ছে।
বনের সার্বিক চিত্র জানতে ২০২৪ সালে বন অধিদপ্তরের করা জাতীয় বন জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। জরিপটি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, উপদেষ্টা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়২০১৫ সালে জাতীয় বন জরিপে বন আচ্ছাদনের পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৭৬ শতাংশ, সেটি এখন কিছুটা হ্রাস পেয়ে ১২ দশমিক ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক বন জরিপে দেশে বনভূমি আছে ১৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর। আগের বন জরিপে যেটির পরিমাণ ১৮ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর।
জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। সেটাকে মাথায় রেখে আমরা একটা পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছি। বান্দরবানের লামা অঞ্চল দিয়ে ফরেস্ট রিস্টোরেশনের (বন পুনরুদ্ধার) কাজ শুরু করব আমরা।’
‘জীববৈচিত্র্য রক্ষা, অবক্ষয়িত বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা’র আহ্বান জানিয়ে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৭২ সালে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক দিবসের মর্যাদা দেয়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফাওয়ের তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে বন উজাড়ীকরণের হার ১ দশমিক ১ শতাংশ হলেও বাংলাদেশে সেটি ২ দশমিক ৬ শতাংশ।
বন অধিদপ্তরের ২০টি দল মাঠপর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করে ২০২৪ সালের মার্চে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তাদের তথ্য সংগ্রহ শেষ হয়। উপকূলীয় বন, শালবন, সুন্দরবন, পার্বত্যাঞ্চল ও গ্রামীণ এলাকায় মোট ১ হাজার ৮৫৮টি নমুনা প্লটের ভিত্তিতে এ জরিপের ফলাফল নির্ধারণ করা হয়েছে।
জরিপে দেশে প্রতি হেক্টরে গাছের ঘনত্ব পাওয়া গেছে ১১৭টি। সবচেয়ে বেশি গাছের ঘনত্ব আছে সুন্দরবনে। এখানে গাছের ঘনত্ব প্রতি হেক্টরে ৭০২টি। বনাঞ্চলের চেয়ে গ্রামীণ এলাকায় গাছের ঘনত্ব কম হলেও মোট গাছের পরিমাণ বেশি। গ্রামীণ এলাকায় মোট গাছের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি।
২০১৫ সালের বন জরিপে গাছের সংখ্যা ছিল ১৬৯ কোটি। সাম্প্রতিক জরিপে সেটা কিছুটা কমে হয়েছে ১৫৭ কোটি। গত এক দশকে হ্রাস পাওয়া গাছের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। জরিপে সারা দেশে ৩২৬টি গাছের প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৪২টি প্রজাতি পাওয়া গেছে পার্বত্যাঞ্চলে। সুন্দরবনে পাওয়া গেছে ২২ প্রজাতির গাছ। এর আগে বন জরিপে (২০১৫) ৩৯০ প্রজাতির গাছ শনাক্ত করেছিল বন অধিদপ্তর। গত এক দশকে হারিয়ে গেছে ৬৪ প্রজাতির বৃক্ষ।
কেন কমছে পার্বত্যাঞ্চলের বন
২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ডারউইন ইউনিভার্সিটি পরিচালিত এক গবেষণায় পার্বত্যাঞ্চল বাংলাদেশের মোট বন আচ্ছাদনের ৪০ শতাংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে দ্রুত প্রসার ঘটছে অর্থকরি ফলের চাষ (হর্টিকালচার) ও একমুখী প্রজাতির বনায়ন (মনোকালচার), যেমন রাবারবাগান।
জানতে চাইলে জাতীয় বন জরিপের সঙ্গে যুক্ত থাকা বন অধিদপ্তরের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত) জহির ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বৈধ ও অবৈধভাবে বন উজাড় হয়ে আসছে। এখানে একদিকে বন উজাড় হচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কারণে বনায়ন করা যায় না। যার কারণে এখানে বনভূমি হ্রাস পাওয়ার পরিমাণ বেশি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক কামাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে বন বিভাগ কিছু করতে পারে না। পাহাড়িরা কিছু গামার আর সেগুনগাছের বাগান করেন। পুরো পার্বত্য অঞ্চলে সড়ক সম্প্রসারণ হয়েছে গত কয়েক দশকে। যেমন সীমান্ত রোড হয়েছে।
কামাল হোসাইন বলেন, এ ছাড়া এখানে বিনোদনকেন্দ্র ও রিসোর্টের সংখ্যা বাড়ছে। এটা একটা দিক। অন্যদিকে অনেক প্রভাবশালী এখন ড্রাগন, কাজু ও আমের চাষ করছেন প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে। এ অঞ্চলের বনের ওপর বহুমুখী চাপের কারণে এখানে বনাঞ্চল হ্রাস পাওয়ার হার অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশি।
কামাল হোসাইন আক্ষেপ করে বলেন, ‘কেউ বনকে ভালোবাসে না। মানুষের লোভের শিকার হয়েছে এখানকার প্রাকৃতিক বন। এটাই আমাদের সর্বনাশ করেছে।’