বিএসএফের ফেলে যাওয়া সেই ৭৮ জন যে ‘লোমহর্ষক’ বর্ণনা দিলেন
Published: 12th, May 2025 GMT
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পশ্চিম সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) রেখে যাওয়া ৭৮ জনকে শ্যামনগর থানায় হস্তান্তর করেছে কোস্টগার্ড। তাদেরকে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনে রাখা হয়। তাদের মধ্যে তিনজনকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবনে আলাপচারিতায় সমকালকে বিএসএফের নির্যাতনের ‘লোমহর্ষক’ বর্ণনা দেন তারা।
তারা বলেন, বিভিন্ন সময়ে ভারতের গুজরাটে কাজের জন্য গিয়েছিলেন তারা, অনেকে ৩৭ বছর ধরে ভারতে বাস করছিলেন। গত ২৬ এপ্রিল দেশটির পুলিশ তাদের আটক করে। এরপর ৯ মে বাংলাদেশে ফেলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের ‘মারধর’ করাসহ নানাভাবে ‘অমানবিক আচরণ’ করা হয়।
তাদের দাবি, প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে আটকে রাখার সময় তাদের নামমাত্র বিস্কুট ও পাউরুটি দেওয়া হয়েছে। এমনকি পানিও দেওয়া হয়েছে খুবই সামান্য। টয়লেটে যাওয়ার কথা বললে অধিক নির্যাতন করা হতো। পশ্চাৎদেশে ভারতের সিল মেরে দিয়ে পেটানো হতো বলেও অভিযোগ তাদের।
অনিশ্চিত গন্তব্যে যাত্রা
ফুয়াদ শেখ জানান, অনেকটা অনিশ্চিত গন্তব্যের উদ্দেশে তাদের যাত্রা করানো হয়। হঠাৎ করে ফজরের আজানের ঠিক আগমুহূর্তে তাদের বস্তি ঘেরাও করা হয়। পরে অনেককে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে পুলিশ স্টেশনে নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে চারদিন আটকে রাখা হয়। পরে ৫ মে কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে পিছমোড়া করে দুই হাত বেঁধে অন্যদের সঙ্গে বিমানে তোলা হয়। পরে ৬ তারিখে জাহাজে তুলে ব্যাপক মারধর করা হয়। রাত ১২ টার পর শরীরে লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে বঙ্গোপসাগরের চরে ফেলা হয় তাদের।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফুয়াদ জানান, তার তিন কন্যা ও স্ত্রী এখনও গুজরাটে রয়েছে। তাকে আটক করার সময় পরিবারের সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি। এমতাবস্থায় নিজ স্ত্রী সন্তানদের ফিরে না পেলে তিনি আত্মহত্যা করবেন বলেও জানান।
‘বাংলাদেশি’ বলে গালিগালাজ করেই মারধর
আবজাল মৃধা জানান, ছেলেকে নিয়ে তিনি আহমেদাবাদে প্লাস্টিক কুড়ানোর কাজ করতেন। হঠাৎ ২৬ এপ্রিল ফজরের নামাজের সময় গুজরাটের শাহআলম চান্ডালের মুসলিম বস্তি থেকে তাদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিমানে ওঠানোর আগে চোখ বেঁধে তাদেরকে মারধর করা হয়।
তিনি বলেন, হাফ গ্লাস পানি আর দুর্গন্ধযুক্ত পাউরুটি ছাড়া কিছুই খেতে দেওয়া হতো না। আটকের দিন বেলা ১১টায় এক গ্লাস পানি অর একটা বিস্কুট দেওয়া হয়। আর বিকেলে দেওয়া হয় এক টুকরো দুর্গন্ধযুক্ত পাউরুটি।
কি অপরাধে তাদের ধরে নেওয়া হয়েছে আর কেনই বা মারধর করা হয়েছে - সেসবের কিছুই জানেন না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ফুয়াদ, আফজাল কিংবা রাহাতের মতো বিএসএফের ফেলে যাওয়া সেই ৭৮ জনের একই বক্তব্য। তারাও জানান অমানবিক নির্যাতনের গল্প।
পশ্চাৎদেশে ‘ভারতের সিল’ লাগিয়ে পিটিয়েছে
কয়েকজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করে বলেন, তারা আমাদের পশ্চৎদেশে ভারতের সিল লাগিয়েছে। কোমরের নিচ থেকে পা পর্যন্ত ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে।
আমরা বাংলাদেশি উল্লেখ করে পশ্চাৎদেশে ‘ভারতের সিল’ লাগিয়ে মারধর করেছেন বলেও জানান তারা।
‘দিল্লির নেতাদের নির্দেশে’ এমন অবস্থা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন কয়েকজন ভুক্তভোগী।
৮ সন্তান ও স্ত্রী রেখে ৩৭ বছর পর ফিরলেন হারুন
১৯৮৮ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে ভারতে পাড়ি জমান হারুন শেখ। সেখানে গিয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন তিনি। ২০০০ সালে কলকাতার মেয়ে পারভীনকে বিয়ে করে গুজরাটে বসবাস শুরু করেন। একপর্যায়ে কিছু জায়গা-জমিও কেনেন তিনি। তার পুরো সংসার ও ছেলেমেয়ে সব ভারতে রয়েছেন। আর তাকে তুলে নিয়ে মারধর করে করে ৩৭ বছর পর বাংলাদেশে ফেলা হয়েছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশি হয়েও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী তিন তরুণ
বিএসএফের রেখে যাওয়া ৭৮ জনকে শ্যামনগর থানায় হস্তান্তর করা হলেও তিন বাংলাদেশিকে নিয়ে নতুন করে ঝামেলা দেখা দিয়েছে। তাদের বাবা-মা বাংলাদেশি হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্ম ভারতে। এ কারণে তাদেরকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের পিও (মিউজ) মোঃ মশিউর রহমান বাদী হয়ে ওই তিন তরুণের বিরুদ্ধে ১৯৫২ সালের অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর ধারায় মামলা করায় তাদেরকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত।
সেই তিন তরুণ হলেন- খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা থানার খালিদ শেখ ও কাকলী দম্পতিরে ছলে আব্দুর রহমান (২০), নড়াইল জেলার কালিয়া থানার বিষ্ণুপুর গ্রামের মৃত মুন্না শাহ ও মৃত নুরজাহান বেগমের ছেলে মোঃ হাসান শাহ (২২) এবং সোহেল শেখ ও সাবিনা দম্পতির ছেলে সাইফুল শেখ (১৯)।
এহাজারে উল্লেখ করা হয়েছে, পিতা-মাতা গুজরাটে অবস্থানকালে গুজরাটের ফুলবাড়িয়া এলাকার নেহেরীনগর জোপারপাচ্চি এলাকায় তাদের জম্ম।
সন্তানের কুলখানীতে অংশ নিতে পারেননি সাব্বির
কালিয়া থানার ভেন্দারচর এলাকার আলাউদ্দীন শেখের ছেলে সাব্বির শেখ প্রায় চার বছর আগে বিয়ে করেন কলকাতার মেয়ে শাইজাহানকে। গত চার মাস আগে তাদের কোলে আসে ফুটফুটে ছেলে সন্তান। হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ২২ মে একমাত্র সন্তান সামির মারা যান। সে কারণে ২৬ এপ্রিল কুলখানীর আয়োজন করা হয়। তবে সেদিন ফজরের নামাজে যাওয়ার পথে মসজিদের প্রবেশদ্বার থেকে তাকে আটক করে নিয়ে যায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এরপর থেকে আর যোগাযোগ করতে পারেননি পরিবারের সঙ্গে। এসব কথা জানান সাব্বির।
পনের দিন পর মুখে ভাত
পনের দিন পরে মুখে দু’টো ভাত উঠেছে বলে ‘হাউ-মাউ’ করে কান্না শুরু করেন ৬০ বছরের মনির শেখ। সুরাট থেকে তাকে আটকের তথ্য দিয়ে তিনি জানান, কাজের সন্ধানে ১২ বছর ধরে তিনি ভারতে থাকেন। একটা অধার কার্ড করলেও এক বছর আগে পুলিশ সেসব কাগজপত্র ছিনিয়ে নেয়।
আটকের পর থেকে প্রতিদিন একটা বিস্কুট ও এক টুকরো পাউরুটি দেওয়া হতো জানিয়ে তিনি বলেন, অসুস্থ হওয়ায় তাকে কম মারা হয়। তবে পানি বা খাবার চাইলে লাঠি দিয়ে পায়ের নিচে আঘাত করা হতো।
শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ হুমায়ুন কবির মোল্যা জানান, রোববার রাতে ৭৮ জনকে কোস্টগার্ড তাদের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছে। তিনজনকে অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অন্যদের স্বজনদের খবর পাঠানো হয়েছে। সোমবার বিকেল তিনটা থেকে তাদেরকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোছাঃ রনী খাতুন বলেন, প্রত্যেকটি মানুষ খুবই দুর্বল ছিল। দীর্ঘদিন খেতে না পারাসহ নানা নির্যাতনে তারা অনেকে ভালোভাবে চলতেও পারছিলেন না। তবে বাংলাদেশে প্রবেশের পরই তাদেরকে প্রাথমিকভাবে মান্দারবাড়িয়া এলাকার বনবিভাগের অফিসে রেখে খাবারসহ ওষুধের ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তীতে রোববার রাতে শ্যামনগরে পৌঁছানোর পর তাদের থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থার পাশাপাশি একাধিক মেডিকেল টিমকে তাদের সেবায় নিযুক্ত করা হয়।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: শ য মনগর ব এসএফ ব এসএফ র শ য মনগর
এছাড়াও পড়ুন:
নওগাঁর দুই সীমান্ত দিয়ে আরও ১৮ জনকে ঠেলে পাঠাল বিএসএফ
নওগাঁর ধামইরহাট ও সাপাহার সীমান্ত দিয়ে নারী, শিশুসহ ১৮ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে এ ঘটনা ঘটে। পরে তাঁদের আটক করে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে বিজিবি।
বিজিবি, পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দা সূত্রে জানা যায়, ধামইরহাট উপজেলার কালুপাড়া সীমান্ত এলাকা দিয়ে গতকাল রাতের কোনো এক সময় ১৪ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠায় বিএসএফ। পরে রাত ৩টার দিকে ২৭১/১ এস সীমান্ত পিলারের কাছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কালুপাড়া এলাকা থেকে তাঁদের আটক করে বিজিবি। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাঁদের ধামইরহাট থানার পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আটক ১৪ জনের মধ্যে ৯ জন নারী ও পাঁচজন পুরুষ। তাঁদের বাড়ি খুলনা, নড়াইল ও যশোরের বিভিন্ন এলাকায় বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে।
নওগাঁর পত্নীতলা ১৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে ধামইরহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমাম জাফর জানান, বিজিবির হস্তান্তর করা ওই ১৪ জনকে থানা হেফাজতে রাখা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা নিজেদের বাংলাদেশি বলে দাবি করেছেন। তাঁদের দাবি করা পরিচয় যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে তাঁদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
এদিকে গতকাল রাতের কোনো এক সময় সাপাহার উপজেলার বামনপাড়া এলাকা দিয়ে চারজনকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠায় বিএসএফ। রাত সাড়ে ৩টার দিকে সীমান্তের ২৪৬/২ এস পিলারের কাছে বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে ওই চারজনকে আটক করে বিজিবি। পরে তাঁদের সাপাহার থানার পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সাপাহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল আজিজ বলেন, বিজিবির হস্তান্তর করা ওই চারজনের মধ্যে দুজন পুরুষ ও দুজন নারী। তাঁরা একই পরিবারের সদস্য। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা জানিয়েছেন, তাঁদের বাড়ি নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলায়। তাঁদের দাবি করা পরিচয় যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
এর আগে গত ৩১ জুলাই নওগাঁর ধামইরহাট সীমান্তের আগ্রাদ্বিগুণ এলাকা দিয়ে ১০ জনকে ঠেলে পাঠায় বিএসএফ।