বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পর প্রথম দিন ডলারের দরে হেরফের হয়নি। আমদানি-রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ডলারের দর আগের মতোই। ব্যাংকগুলোর নিজেদের মধ্যে বেচাকেনা এবং নগদ ডলারের দরও অপরিবর্তিত ছিল। তবে মানি এক্সচেঞ্জ বা খোলাবাজারে ডলারের দর কিছুটা বেড়েছে।  

গতকাল সাতটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, প্রথম দিন ডলার দরে কোনো ওঠানামা হয়নি। ব্যাংকগুলো এখন বাজার পর্যবেক্ষণ করছে। আগামী সপ্তাহে হয়তো বোঝা যাবে। তারা বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার কেনাবেচা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে তদারকি করছে। তবে ব্যাংকগুলো কোন দরে ডলার বেচাকেনা করবে, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্তা হলো, প্রতিদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘রেফারেন্স দর’-এর সঙ্গে বড় কোনো তারতম্য হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাখ্যা দিতে হবে। কোনো ব্যাংকে বেশি সংকট দেখা দিলে ওই ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূলত এভাবে বাজার তদারকি করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান সমকালকে বলেন, বাজারভিত্তিক করার পর প্রথম দিন ডলারের দরে কোনো ওঠানামার খবর পাওয়া যায়নি। রেমিট্যান্সে উচ্চ প্রবাহের কারণে ডলারের দরে বড় কোনো পরিবর্তন আসবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত কয়েক মাসে রিজার্ভ বেড়েছে। আবার আইএমএফের ঋণ নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছানোর ফলে আগামী জুনের মধ্যে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো থেকে কম সুদের ৩৫০ কোটি ডলার রিজার্ভে যোগ হবে। ফলে রিজার্ভ আরও শক্তিশালী হবে।
এদিকে খোলাবাজারে ডলারের দর সামান্য বেড়ে গতকাল সর্বোচ্চ ১২৬ টাকায় উঠেছে। এদিন মানিচেঞ্জারের প্রতিনিধিরা ১২৫ টাকা ৫০ থেকে ৬০ পয়সায় কিনে ১২৬ টাকা পর্যন্ত দরে বিক্রি করেছেন। আগের দিন ১২৫ টাকা ২০ থেকে ৩০ পয়সা দরে কিনে বিক্রি হয়েছিল ১২৫ টাকা ৫০ থেকে ৬০ পয়সা দরে। বেশ কিছুদিন ধরে খোলাবাজারে এ রকম দরেই বেচাকেনা হচ্ছিল। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ব্যাংকগুলোর কাছে এখন নগদ ৫ কোটি ডলার মজুত রয়েছে, যা সাম্প্রতিক সময়ের সর্বোচ্চ। আবার মোট ডলারের সামান্য অংশ লেনদেন হয় নগদে। 

ফলে নগদ ডলার নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকগুলোর দেওয়া গড় দরের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রতিদিন বেলা ১১টা এবং  বিকেল ৫টায় ‘রেফারেন্স রেট’ প্রকাশ করবে। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেফারেন্স রেট ঘোষণা করে ১২১ টাকা ৯৫ পয়সা। আর বিকেলে তা সামান্য বেড়ে হয় ১২১ টাকা ৯৯ পয়সা। আগের দিন সকালে ১২১ টাকা ৯৯ পয়সা এবং বিকেলে ১২১ টাকা ৯৩ পয়সা ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে গত এক মাসের রেফারেন্স রেট দেওয়া হয়েছে। এ সময়ে প্রায় একই রকম দর ছিল। বড় কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার সিদ্ধান্ত ভালো। প্রথম দিন দরে কোনো পার্থক্য হয়নি। আগের দিনের মতোই ১২২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১২২ টাকা ৭০ পয়সায় ডলার বিক্রি করা হয়েছে। দেখতে হবে কোনো ব্যাংক যেন বাজারভিত্তিক করার সুযোগের অপব্যবহার না করে। অপ্রয়োজনে বেশি দরে ডলার বেচাকেনা করলে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোনো ব্যাংক প্রয়োজন ছাড়া ডলার ধরে না রাখলে এবং যার যেটুকু দরকার, সেটুকু কিনলে আর কোনো সমস্যা হবে না। 

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার ব্যাংকগুলো একে অন্যের কাছ থেকে ডলার কিনেছে ১২২ টাকা দরে। মোট কেনাবেচা হয়েছে ১ কোটি ৪১ লাখ ডলার। ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সের ডলার কিনেছে ১২১ টাকা থেকে ১২১ টাকা ৭০ পয়সা দরে। আর আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করেছে সর্বনিম্ন ১২২ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১২২ টাকা ৭০ পয়সায়। আর ব্যাংকগুলো নগদ ডলার ১২২ টাকায় কিনে বিক্রি করেছে ১২৩ টাকায়। কিছুদিন ধরে এ রকমই দর ছিল। অবশ্য এতদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক মৌখিকভাবে সব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১২২ টাকায় ডলার কিনে ১২৩ টাকায় বিক্রির নির্দেশনা দিয়ে রেখেছিল। এখন থেকে এ রকম কোনো নির্দেশনা নেই। তবে নৈতিক চাপ প্রয়োগ এবং প্রয়োজনে ডলার বিক্রির মাধ্যমে বাজারে অস্বাভাবিকতা ঠেকাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বেসরকারি একটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান সমকালকে বলেন,  বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দিনে  দু’বার রিপোর্ট করতে হচ্ছে। কোনো ব্যাংক অস্বাভাবিক আচারণ করলে তাৎক্ষণিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বুঝতে পারবে। ব্যাংকগুলো এই মুহূর্তে বাজার পর্যবেক্ষণ করছে। কোনো ব্যাংক রেফারেন্স রেটের অনেক বেশি দরে বেচাকেনা করবে না। 
প্রসঙ্গত, বিনিময় হার বাজারভিত্তিক না করায় আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দুই কিস্তি কয়েক মাস  ঝুলে ছিল। তবে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি আটকে গেলে অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাও আর ঋণ ছাড় করবে না। আবার দেশের ঋণমান কমে এলসিসহ বিভিন্ন খরচ বাড়বে। এসব কারণে বাংলাদেশ ডলারের দর বাজারভিত্তিক করতে সম্মত হয়েছে এবং গত বুধবার প্রজ্ঞাপন জারি করে। শর্ত মানার কারণে আগামী জুনের মধ্যে আইএমএফ ঋণের দুই কিস্তির ১৩০ কোটি ডলার এবং অন্যান্য সংস্থার ২২০ কোটি ডলার পাওয়ার আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। 
২০২৩ সালে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি শুরু হয়। ঋণের শর্ত পালনে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালুর আগের ধাপে বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছর ‘ক্রলিং পেগ’ নামে আইএমএফের একটি পদ্ধতি চালু করে। তখন ডলারের দর  একবারে ৭ টাকা বাড়িয়ে মধ্যবর্তী দর ঠিক করা হয় ১১৭ টাকা। এর সঙ্গে প্রথমে ১ টাকা ওঠানামার সুযোগ রাখা হয়। পরে এই সীমা আড়াই শতাংশ করা হয়। তবে গত জানুয়ারিতে মৌখিকভাবে ব্যাংকগুলোকে বলে দেওয়া হয়, সর্বোচ্চ ১২২ টাকায় কিনে ১২৩ টাকায় বিক্রি করা যাবে। এর আগে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত দীর্ঘদিন ধরে কৃত্রিমভাবে ডলারের দর ৮২ থেকে ৮৪ টাকার মধ্যে রাখা হয়েছিল। 

গত বুধবার ডলারের দর বাজারভিত্তিক করার ঘোষণার আগে সকালে গভর্নর ড.

আহসান এইচ মনসুর সব ব্যাংকের এমডিদের নিয়ে ভার্চুয়াল সভা করেন। সেখানে তিনি দুবাইভিত্তিক এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, রেমিট্যান্সে উচ্চ প্রবাহ ও রপ্তানি বৃদ্ধির কারণে রিজার্ভ ভালো অবস্থায় এসেছে। বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্য ভালো অবস্থায় রয়েছে। বিদেশি কোনো বকেয়া নেই। ফলে ব্যাংকগুলো যেন অস্বাভাবিক আচরণ না করে। কোনো সংকট দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সহায়তা করবে।



 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আইএমএফ র প রথম দ ন ১২২ ট ক ১২১ ট ক

এছাড়াও পড়ুন:

এনসিপির সঙ্গে আইএমএফের বৈঠক

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।

শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এনসিপির সঙ্গে আইএমএ এর মিশন টিমের সঙ্গে বৈঠক হয়।

আরো পড়ুন:

এনসিপিকে নিয়ে প্রথম বই ‘এনসিপির যাত্রা`

এনসিপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ, যুবক আটক

বৈঠকে এনসিপি প্রতিনিধি দল দেশের সংকটময় সময়ে বাংলাদেশকে সহায়তা প্রদান এবং জরুরি সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ দেওয়ার প্রতি আইএমএফ-এর ধারাবাহিক সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে।

বৈঠকে উপস্থিত (আইএমএফ) বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব আহরণ, রাজস্ব–জিডিপি অনুপাত, ডিস্ট্রেসড অ্যাসেট এবং যুব কর্মসংস্থান বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে।

এনসিপি প্রতিনিধিরা এসব চ্যালেঞ্জ স্বীকার করে বলেন, যে তারা রাজস্ব ডিজিটালাইজেশন, আর্থিক খাতের চলমান সংস্কারকে সমর্থন এবং সংস্কার বাস্তবায়নের ধীরগতির বিষয়ে উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রতি সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

সভায় আরো আলোচ্য ছিল পূর্ববর্তী সরকারের ‘ক্লেপ্টোক্রেসি’ কীভাবে শুরু হয়েছিল, জাতীয় অর্থনীতি ও প্রশাসনে এর প্রভাব কী ছিল এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্নীতিকে রোধ করতে কী ধরনের কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন।

অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে ছিল, অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি কমানো, সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং অন্তর্বর্তী সরকার থেকে নির্বাচিত সরকারের কাছে শান্তিপূর্ণ, সুশৃঙ্খল ক্ষমতা হস্তান্তর। উভয়পক্ষই আশা প্রকাশ করে যে বাংলাদেশের কঠোর পরিশ্রমী জনগণই উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি এবং জনগণের সম্মিলিত মেধা ও শ্রমের মাধ্যমে দেশ আরো সহনশীল ও স্থিতিশীল অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাবে।

বৈঠকে আইএমএফ-এর পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন ক্রিস পাপাজর্জিউ, বাংলাদেশ মিশন চিফ, ম্যাক্সিম ক্রিশকো, ঢাকা রেসিডেন্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ এবং তৌহিদ এলাহি, ডেপুটি সেক্রেটারি ও ইকোনমিক এনালিস্ট ।

এনসিপি এর পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন জাবেদ রাসিন, যুগ্ম আহ্বায়ক ও প্রধান, শিল্প ও বাণিজ্য সেল, মো. সুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া, যুগ্ম আহ্বায়ক ও প্রধান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সেল, আলাউদ্দিন মোহাম্মদ, যুগ্ম সদস্য সচিব ও কো-লিড, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সেল, আব্দুল্লাহ আল মামুন ফয়সাল, সংগঠক ও কো-লিড, শিল্প ও বাণিজ্য সেল এবং মো. আব্দুল্লাহ আল ফয়সাল, যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক ও সদস্য, শিল্প ও বাণিজ্য সেল।

ঢাকা/রায়হান/এসবি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দুর্বল+দুর্বল=আরও দুর্বল, নাকি সবল ব্যাংক
  • এনসিপির সঙ্গে আইএমএফের বৈঠক