ইতিহাস কি চোখ রাঙাচ্ছে বাংলাদেশকে
Published: 26th, June 2025 GMT
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ৭৯.৩ ওভারে ২৪৭। শ্রীলঙ্কা ১ম ইনিংস: ৭৮ ওভারে ২৯০/২।
রেক্স ক্লেমেন্ত সরাসরিই বলে দিলেন, ‘বাংলাদেশ ভুল করেছে।’ প্রেসবক্সে মধ্যাহ্নভোজের টেবিলে বসে করা তাঁর মন্তব্য কান খাঁড়া করল। নির্দিষ্ট করে কোনটাকে ভুল বলছেন দীর্ঘদিন ধরে মাঠে থেকে ক্রিকেট কাভার করা স্থানীয় এই সাংবাদিক? ভুল তো অনেক!
টসে জিতে ব্যাটিং নিয়ে টেস্টের প্রথম দিনে বাংলাদেশের একের পর এক উইকেট দিয়ে আসা ভুলভাল খেলেই তো! নাকি টসে জিতে ব্যাটিং নেওয়াটাই ভুল হয়েছে বাংলাদেশের? রেক্স শুধরে দিলেন, ‘না, এই উইকেটে আগে ব্যাটিং নেওয়া ঠিক আছে। ভুলটা হলো প্রথম দিনেই বাংলাদেশ নিজেদের ইনিংসটা প্রায় শেষ করে দিল। তাদের উচিত ছিল কালকের দিনটা পার করে দিয়ে আজ রানের জন্য যাওয়া। এখানে দ্বিতীয়, তৃতীয় দিনে ব্যাটিং করা সহজ। পরের দুই দিন আবার এত সহজ নাও হতে পারে।’
লাঞ্চের ওই সময়ে শ্রীলঙ্কার রান বিনা উইকেটে ৮৩। বাংলাদেশের বোলারদের তেমন কোনো প্রতিরোধের মুখে না পড়ে ২১ ওভারেই তা করে ফেলেন দুই ওপেনার পাথুম নিশাঙ্কা ও লাহিরু উদারা। এর আগে সকালে ৭.
সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের (এসএসসি) উইকেট নিয়ে রেক্সের মন্তব্যকে সঠিক প্রমাণ করেই দিনের বাকি সময়টা খেলে গেছেন শ্রীলঙ্কার ব্যাটসম্যানরা। দ্বিতীয় দিনে বাংলাদেশের বোলারদের একমাত্র অর্জন হয়ে দাঁড়াচ্ছিল উদারাকে ৪০ রানের মাথায় তাইজুলের বোল্ড করা। শেষ বেলায় সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ৭ রান দূরে থাকতে নাঈম হাসানের বলে দিনেশ চান্ডিমালের কট বিহাইন্ড হতাশা কিছুটা হলেও কমিয়েছে। দ্রুত রান তুলতে গিয়ে নাঈম হাসানকে রিভার্স সুইপ করে চান্ডিমাল ক্যাচ দেন উইকেট কিপার লিটন দাসের হাতে।
বাংলাদেশের বোলারদের কাজ অবশ্য এখনো অনেকটাই বাকি রেখে দিয়েছেন নিশাঙ্কা। গলে ১৮৭ রানের ইনিংস খেলে আসা এই ওপেনার কলম্বোতে ডাবল সেঞ্চুরির অতৃপ্তি দূর করতে এগোচ্ছেন। দিন শেষে অপরাজিত ২৩৮ বলে ১৮ বাউন্ডারিতে ১৪৬ রান নিয়ে। উদারার সঙ্গে ৮৮ রানের ওপেনিং জুটির পর দ্বিতীয় উইকেটে চান্ডিমালের সঙ্গে গড়েন ১৯৪ রানের জুটি, ৫ রান নিয়ে নিশাঙ্কার সঙ্গী নাইট ওয়াচম্যান প্রবাত জয়াসুরিয়া।
কলম্বো টেস্টের প্রথম দুই দিনে কিছুটা হলেও ফিরে আসছে ২০০৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শ্রীলঙ্কার ঐতিহাসিক টেস্টের স্মৃতি। সেই ম্যাচে তৃতীয় উইকেটে মাহেলা জয়াবর্ধনে ও কুমার সাঙ্গাকারার ৬২৪ রানের জুটি টেস্ট ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় জুটির রেকর্ড। তাঁদের সৌজন্যেই সেবার টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেটে ৭৫৬ রান করে ইনিংস ঘোষণা করেছিল শ্রীলঙ্কা।
অতীতের প্রসঙ্গ যখন এসেই পড়ল, একটু বিস্তারিতই বলা যাক। তাতে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা চলতি কলম্বো টেস্টের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও একটা ধারণা মিলতে পারে। এই টেস্টের সঙ্গে কিছু মিলও বোধ হয় পাওয়া যাবে সেই টেস্টের।
সেবারও টসে জিতে ব্যাটিং নিয়েছিল অতিথি দল দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রথম দিনে ৫০.২ ওভারে ১৬৯ রানে অলআউট হয়ে তাদের অবস্থা হয়েছিল বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ। পরে শ্রীলঙ্কাও ব্যাটিংয়ে নেমে হারায় ১৪ রানে ২ উইকেট। সিংহলিজের উইকেটে তখনো প্রথম দিনে ব্যাট করা সহজ ছিল না। বোলাররা, বিশেষ করে পেসাররা এই উইকেটে যা একটু সুবিধা পান প্রথম দিনেই। দ্বিতীয় দিনে উইকেট হয়ে যায় ব্যাটসম্যানদের।
শুরুর বিপর্যয়ের পর উইকেটে গিয়ে পরের দিনের অপেক্ষায় মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেন সাঙ্গাকারা ও জয়াবর্ধনে। সেশন ধরে ধরে পার করে দেন দিনের বাকি সময়। আর কোনো উইকেট না হারিয়ে প্রথম দিন শেষে শ্রীলঙ্কার রান হয়েছিল ১২৮। সাঙ্গাকারা ও জয়াবর্ধনে আসল কাজটা করলেন পরদিন, অর্থাৎ টেস্টের দ্বিতীয় দিনে। দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের ক্লান্তিকর সেই দিন শেষে শ্রীলঙ্কার রান ওই ২ উইকেটেই ৪৮৫। ততক্ষণে ডাবল সেঞ্চুরি হয়ে গিয়েছিল সাঙ্গাকারা ও জয়াবর্ধনে দুজনেরই।
তৃতীয় দিন চা বিরতির পর ইনিংস ঘোষণা করে শ্রীলঙ্কা। সাঙ্গাকারা-জয়াবর্ধনের রেকর্ড জুটির সৌজন্যে তার আগেই ১৮৫.১ ওভারে ৫ উইকেটে ৭৫৬ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকা ৪৩৪ করেও পারেনি ইনিংস হার এড়াতে।
বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা চলতি কলম্বো টেস্টের স্কোরকার্ডেও যেন কিছুটা সেই ছায়া। দ্বিতীয় দিন শেষে শ্রীলঙ্কা ২ উইকেটেই করে ফেলেছে ২৯০ রান, এগিয়ে গেছে ৪৩ রানে। কাল তৃতীয় দিনে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বাংলাদেশের ওপরই বড় কিছুই চাপাতে চাইবে তারা।
অথচ টেস্টের প্রথম দিনে শ্রীলঙ্কার বোলারদের কঠিন বলগুলোকে ভালোভাবে সামলে দক্ষিণ আফ্রিকার তুলনায় ভালো শুরুই করেছিল বাংলাদেশ। বিশেষ করে সকালের কঠিন সময়টাতে খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়তে হয়নি। ব্যাটসম্যানরা বাজে আউট না হলে আজ দিন শেষে শ্রীলঙ্কা যে জায়গায়, তার চেয়ে খুব খারাপ থাকত না বাংলাদেশের অবস্থা।
টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করার সুযোগ পেয়েও এসএসসির ব্যাটিং উইকেটে ব্যাটিংয়ের জন্য পয়মন্ত সময়টাই বাংলাদেশকে কাটাতে হচ্ছে শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানদের বোলিং করে, তাদের বাউন্ডারি কুড়িয়ে এনে। এসএসসির অতীত, এখানকার উইকেটের চরিত্র—কোনোটাই অবশ্য অজানা নয়। তার মধ্যেও বাংলাদেশকে চেষ্টা করতে হতো কীভাবে ম্যাচটাকে নিজেদের হাতে রাখা যায়। ব্যাটসম্যানরা তাতে ব্যর্থ, বোলাররাও পারছেন না অসাধারণ কিছু করতে।
চোট কাটিয়ে দুই বছর পর দলে ফেরা পেসার ইবাদত হোসেন প্রথম তিন ওভারে দিয়েছেন ১৭, তাঁর প্রথম স্পেলও ওখানেই শেষ। সপ্তম ওভারে বোলিংয়ে এসে নাহিদ রানার প্রথম স্পেল থেমে যায় ২ ওভারে, রান দিয়েছেন ২০। নাহিদ অবশ্য পরে এসে কিছু বাউন্সার দিয়ে ভয় ধরাতে চেয়েছেন শ্রীলঙ্কার ব্যাটসম্যানদের মনে, যদিও সেই বাউন্সারের কয়েকটিকে ব্যাটসম্যানরা বাউন্ডারিও বানিয়েছেন।
সবচেয়ে বিস্ময়কর লেগেছে পেসারদের দিয়ে কাজ না হওয়ার পরও গল টেস্টে ৫ উইকেট নেওয়া অফ স্পিনার নাঈম হাসানকে প্রথম সেশনে বোলিংয়ে না আনাটা। ইনিংসের ২৬তম ওভারে নিজের প্রথম ওভার করেন নাঈম। শেষবেলায় চান্ডিমালের উইকেটটাও এসেছে তাঁর বলেই।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ট স ট র প রথম ব য টসম য ন প রথম দ ন র উইক ট কলম ব
এছাড়াও পড়ুন:
‘একশটা টেস্টই যেন শেষ না হয়’
যে ক্ষণটার জন্য অপেক্ষা ছিল, যে সময়টার জন্য প্রতীক্ষা ছিল তার খুব কাছাকাছি ক্রিকেটাঙ্গন। বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম যিনি টেস্ট ক্রিকেটের তিন অঙ্কে পৌঁছতে যাচ্ছেন। ১৯ নভেম্বর ঢাকায় আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্ট। এই টেস্টেই শততম টেস্টে মাইলফলক স্পর্শ করবেন মুশফিকুর।
সময় তাই যত ঘনিয়ে আসছে ততই মুশফিকুরকে ঘিরে বাড়ছে উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা ও রোমাঞ্চ। যা ছুঁয়ে যাচ্ছেন মুশফিকুরের কোচদেরও। যাদের সঙ্গে ক্যারিয়ারের বিভিন্ন সময় কাজ করেছেন, তাদের সবার চাওয়া মাইলফলক ছোঁয়া এই সময়টা তিনি উপভোগ করুক প্রাণ খুলে। নিজের আনন্দে খেলুক। শুধু তা-ই নয়, একশ টেস্টেই যেন থমকে না যায় মুশফিকুর ব্যাট। অন্তত এক-দুই বছর তাকে টেস্ট অঙ্গনে দেখতে চান প্রত্যেকে।
আরো পড়ুন:
মুশফিকুরের শততম টেস্ট নিয়ে আশরাফুলের উচ্ছ্বাস
লর্ডসে প্রথম, মিরপুরে শততম টেস্ট মুশফিকুর
সোহেল ইসলাম
কোচ, বিসিবির গেম ডেভেলাপমেন্ট বিভাগ
‘‘আমাদের দেশে যারা টেস্ট খেলে তাদের টেস্টের সংখ্যা কম। এটা যদি ইংল্যান্ড হইতো বা অস্ট্রেলিয়াতে হতো বা ভারতেরও হতো, ওর যতদিন ধরে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার, এতদিনে দেড়শ টেস্ট খেলে ফেলতো। সেই হিসাবে ইদানিং আমাদের একটু টেস্ট সংখ্যা বেড়েছে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের কারণে। আগে তো অনেক কম হইতো। সেখান থেকে একশটা টেস্ট খেলা মানে বিশাল কিছু।’’
‘‘ওর সফরটা দেখেন আপনি। শুধু একশ টেস্ট বলবেন…ও কতদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছে। এমন না যে অযথাই খেলছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কিন্তু আপনার পারফর্ম করে খেলতে হয়। আপনি পারফর্ম ছাড়া থাকলে আপনাকে কিন্তু খেলাবে না।’’
‘‘মুশফিকুরকে তার পারফরম্যান্সটা ধরে রাখতে হয়েছে। আমাদের দেশের প্রথম একজন যে একশ টেস্ট খেলতে যাচ্ছে। এজন্য ও নিজেকে প্রস্তুত রেখেছে। ওই ক্ষুধাটা তার ছিল। ওই জেদটা তার ছিল। আমি আশা করব, যদি দলের চাহিদা থাকে এবং তারও খেলার ইচ্ছা তাহলে যেন আরো খেলা চালিয়ে যায়। আরো বেশিদিন মাঠে থাকে। মানে একশটা টেস্ট যেন শেষ না হয়।’’
মিজানুর রহমান বাবুল
কোচ, বিসিবির গেম ডেভেলাপমেন্ট বিভাগ
‘‘মুশফিকুরকে শুভকামনা। একজন পারফেক্ট ব্যাটসম্যান। একজন পারফেক্ট স্পোর্টসম্যান। যাকে আপনি অনুসরণ করলে, যাকে আপনি মেনে চললে, আদর্শ ভাবলে ক্যারিয়ারে উন্নতি করতে পারবেন। বাংলাদেশের ক্রিকেট যেভাবে চলে, যে ধাঁচে এগিয়ে যায় সেখানে একজনের ক্যারিয়ার শীর্ষ পর্যায়ে ২০ বছর টিকে থাকা মুশকিল। মুশফিকুর প্রমাণ করেছে যদি আপনার নিবেদন থাকে, ভালো করার ইচ্ছা থাকে তাহলে আপনি পারবেন।’’
‘‘ব্যাটসম্যান মুশফিকুর সব সময়ই বাংলাদেশ দলের সেরা। মিডল অর্ডারে লম্বা সময় বাংলাদেশকে সার্ভ করেছে। দেখুন তাকে চ্যালেঞ্জ করে কেউ তাকে রিপ্লেস করতে পারেনি। পারফর্ম করেই সে টিকে আছে এবং খেলে যাচ্ছে। আমি চাই সে সেই ধারাবাহিকতাই ধরে রাখুক। এখনো ফিট আছে। অন্যদের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করছে। খেলার প্রতি ভালোবাসা না থাকলে এটা হয় না।’’
‘‘শততম টেস্টটায় সেঞ্চুরি লাগবেই, এমনটাই নয়। হলে ভালো। না হলেও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। থামলে হবে না। ওর অভিজ্ঞতাটা এই দলের প্রয়োজন এখন। যতদিন খেলতে মন চায় খেলুক। ও তো পারফর্ম না করে আর খেলবে না। তরুণ একজন ক্রিকেটার যদি তার ডেডিকেশন সম্পর্কে জানতে পারে সেটাই হবে বড় পাওয়া।’’
ঢাকা/ইয়াসিন