শিশুদের পুষ্টিমান উন্নয়ন তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য। সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করা হলে শিশুদের উচ্চতা ও ওজন বয়স অনুযায়ী ঠিক থাকে। তাদের শেখার ক্ষমতা ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ে। এ কারণে বলা যায় শিশুপুষ্টির উন্নয়ন দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গঠনের অন্যতম ভিত্তি। এ জন্য পুষ্টিবান্ধব বার্ষিক পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।

গতকাল বৃহস্পতিবার নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের সহায়তায় পরিচালিত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর শিশুপুষ্টি বিষয়ক কনসোর্টিয়াম ‘রাইট টু গ্রো’ ও প্রথম আলো আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকের মূল ধারণাপত্রে এ মন্তব্য করা হয়। রাইট টু গ্রো প্রকল্প শিশুদের পুষ্টিমান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কাজ করছে। তাদের লক্ষ্য প্রতিটি শিশু যেন তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। সকালে কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের সভাকক্ষে ‘শিশুপুষ্টি উন্নয়নে স্থানীয় সরকার, নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি খাতের ভূমিকা’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এতে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ।     

বৈঠকের শুরুতেই রাইট টু গ্রো কনসোর্টিয়ামের টিম লিড ইকবাল আজাদ পাওয়ার পয়েন্টে শিশুপুষ্টি নিয়ে তাঁদের কার্যক্রমের পরিচিতি তুলে ধরেন। আন্তর্জাতিক ছয়টি সংস্থা—অ্যাকশন এগেইনস্ট হাঙ্গার, সেন্টার ফর ইকোনমিক গভর্ন্যান্স অ্যান্ড কাউন্সেলিং ইন আফ্রিকা, ম্যাক্স ফাউন্ডেশন, সেভ দ্য চিলড্রেন, দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট ও ওয়ার্ল্ডভিশন এবং তিনটি দেশি সংস্থা এইচএলপিএফ, জাগরণী ও এডিএ কাজ করছে রাইট টু গ্রো প্রকল্পে। এর নেতৃত্ব দিচ্ছে ম্যাক্স ফাউন্ডেশন। রাইট টু গ্রো দেশের খুলনা, বরগুনা, সাতক্ষীরা ও পটুয়াখালী জেলার পাঁচটি উপজেলা ডুমুরিয়া, তালতলী, দেবহাটা, পটুয়াখালী সদর ও গলাচিপার ৪০টি ইউনিয়নে অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশুদের পুষ্টিমান নিশ্চিত করা নিয়ে কাজ করছে। তারা দুই শতাধিক গ্রামে অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী ৩০ হাজার ৭৪৫ শিশুর পুষ্টিমান নিশ্চিত করা নিয়ে কাজ করছে। রাইট টু গ্রো জনসচেতনতা সৃষ্টি, মাঠপর্যায়ে গবেষণাসহ বিভিন্ন কাজ করছে। শিশুদের পুষ্টিমান উন্নয়নে সরকারি–বেসরকারি উদ্যোক্তা ও নাগরিকদের নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করার প্রতি তারা গুরুত্ব দিয়ে আসছে। 

আলোচনা পর্বে সুজনের সম্পাদক ও দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমাদের দেশে শিশুদের অপুষ্টির একটি প্রধান কারণ নারীদের অধস্তন অবস্থা। নারী স্বাস্থ্যবান হলে সন্তান স্বাস্থ্যবান হবে। নারী শিক্ষিত হলে সন্তান শিক্ষিত হবে। নারী উপার্জনক্ষম হলে সেই উপার্জন তিনি সন্তানের জন্য ব্যয় করেন, ফলে সন্তানের ভবিষ্যৎ উন্নত হয়। জাতির উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা এর সঙ্গে জড়িত; কিন্তু সন্তান গর্ভে থাকার সময়ই মা যদি অপুষ্টিতে ভোগেন, তবে তার প্রভাব পড়ে সন্তানের ক্ষেত্রে। এসব অপুষ্টিজনিত শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মায়। ভবিষ্যতে তারা ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকিতে থাকে। মায়ের অপুষ্টি থেকে শিশুর অপুষ্টি, সেখান থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মে নেতিবাচক প্রভাব অপুষ্টির এই দুষ্টচক্র ভাঙতে হবে। এ জন্য এখন জনসচেতনতা ও গণজাগরণের প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, পুষ্টি নিয়ে ২২টি মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম আছে। তাদের বার্ষিক কর্মপরিকল্পনায় পুষ্টির বিষয়টি থাকে। এই মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হয়। সার্বিকভাবে দেশের পুষ্টিমানের পরিস্থিতি হতাশাজনক নয়। শিশু পুষ্টিমান উন্নয়নের জন্য সরকারের সঙ্গে নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি খাত সমন্বিতভাবে কাজ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। 

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো.

এনামুল হক বলেন, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তবে খাদ্যের দূষণের কারণে রোগের ঝুঁকি বেড়েছে। পুষ্টিকর খাবার শুধু খাদ্যই নয়, ওষুধ হিসেবেও কাজ করে। খাদ্য নিরাপদ হওয়া জরুরি। আগে আমাদের খাদ্যাভাব ছিল, উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে খাদ্যাভাব অনেক কমেছে; কিন্তু নানা প্রকার রাসায়নিক ও ভেজালের কারণে খাদ্য দূষিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তা কুখাদ্যে পরিণত হয়েছে। তিনি নিরাপদ খাবারের জন্য ঘরে তৈরি খাবার খেতে উৎসাহিত করেন। 

স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের ইউনিয়ন পরিষদ অধিশাখার যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ ফজলে আজিম বলেন, ইউনিয়ন পরিষদে শিশুপুষ্টি খাতে সরাসরি কোনো বরাদ্দ না থাকলেও বার্ষিক মোট বরাদ্দের ১৫ শতাংশ বরাদ্দ থাকে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে। ইউপি চেয়ারম্যানরা নিজ বিবেচনা ও পরিবেশ–পরিস্থিতি বিবেচনা করে শিশুপুষ্টির উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দ করতে পারেন। তিনি বলেন, এ খাতে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব এলে সরকার তা বাস্তবায়নের বিবেচনা করতে পারে।

নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা, বাণিজ্য ও ব্যবসায় উন্নয়নবিষয়ক জ্যেষ্ঠ নীতি উপদেষ্টা ওসমান হারুনি বলেন, সরকারের নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থা ও উদ্যোক্তাদের ভূমিকা আরও বেশি হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি তরুণ প্রজন্ম, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও ক্লাব ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের পরামর্শক এ এফ এম ইকবাল কবির বলেন, সামগ্রিক বাজেটে বরাদ্দ থাকলেও সেখানে শিশুপুষ্টি খাত সুনির্দিষ্ট করা নেই। ফলে অনেক সময় এই খাত উপেক্ষিত থাকে। 

নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের এ দেশীয় পরিচালক সায়কা সিরাজ শিশুখাদ্য হিসেবে বাজারে যেসব মানহীন বা কুখাদ্য বিক্রি করা হচ্ছে এবং সেগুলোর আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির প্রতি গুরুত্ব দেন। প্রয়োজনে আইন করে এসব প্রতিরোধ করার আহ্বান জানান।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী সাইফুর রহমান বলেন, জনস্বাস্থ্য বিভাগ এখন পুষ্টির সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করছে। 

জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান স্কুল পর্যায়ে শিশুদের ওজন ও উচ্চতা নির্ণয় করার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

ম্যাক্স ফাউন্ডেশনের এদেশীয় পরিচালক তারিকুল ইসলাম অংশগ্রহণকারীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা অনেক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেন। এর মধ্য থেকে সম্ভাব্যতা যাচাই করে অনেক দৃষ্টান্ত সরকারিভাবে সারা দেশে বাস্তবায়ন করা যায়। 

গোলটেবিলে আরও বক্তব্য দেন ইউনিসেফের পুষ্টিবিজ্ঞানী গেলাম মহিউদ্দিন খান সাদী, ওয়ার্ল্ডভিশনের জ্যেষ্ঠ পরিচালক চন্দন জেড গমেজ, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের এদেশীয় পরিচালক (ইনচার্জ) এ এস এম রহমত উল্লাহ ভূঁইয়া, দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের এদেশীয় পরিচালক প্রশান্ত ত্রিপুরা, খুলনার ডুমুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম, লাল তীর সিডস লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক এম আবদুর রশিদ, এসএমসির অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক সালাহ উদ্দিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক আলী আব্বাস মোহাম্মদ খোরশেদ। 

গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন শ চ ত কর ক জ করছ ব সরক র বর দ দ ক জ কর র জন য র ইট ট সমন ব

এছাড়াও পড়ুন:

সোনালি কুকুর

শুয়ে পড়ার অনেকক্ষণ পর শহিদের মনে হলো, মশারি যতটা কাঁপছে, জোরে ঘুরতে থাকা ফ্যানের বাতাস ততটা গায়ে লাগছে না। শব্দও হাওয়ার চেয়ে বেশি। এখন বর্ষাকাল, ঘুমিয়ে পড়লে কখন বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দেয় বিছানা, সে আশঙ্কায় ঘরের সব জানালা বন্ধ করে শহিদ শুয়েছিল। তবে কেবল একটিই খানিকটা ফাঁক করে রেখেছিল, সেখান দিয়ে হাওয়া ঢুকলে পর্দা কাঁপে। গত রাতে তার বড় ছেলে, ৯ বছরের অর্ক প্রশ্ন করেছিল, ‘বাবা, বলো তো, কোন দেশে আত্মার জানালা আছে?’ শুনে সে চমকে উঠে বলল, ‘এ রকম আছে নাকি!’

‘হ্যাঁ বাবা, সুইজারল্যান্ডের একটা শহরে সব বাড়িতেই আছে। আত্মার জানালা। একটা করে।’ মাথা দুলিয়ে বলতে থাকে সে, ‘কিন্তু খুব ছোট, একটা ঘরেই শুধু থাকে, সেখানে আর কোনো জানালা থাকে না।’ নিজের সন্তানের কাছে এ রকম অদ্ভুত এক তথ্য আছে ভেবে শহিদ সম্ভবত পুলক বোধ করে। বলে, ‘সত্যি! কীভাবে জানলে?’ তখন জনকের প্রায়-পশমসংকুল তামাটে বুকের ওপর অর্কের বাদামি নরম হাত; সে বলে, ‘শোনো বাবা, যখন কারও মরে যাওয়ার সময় হয়, বাড়ির লোকজন তাকে সেই ঘরে নিয়ে যায়। লোকটা যখন মারা যায়, তখন তার আত্মা ওই জানালা দিয়ে বের হয়ে যায়।’ দম ফেলার আগে সে কোনো বাক্যই শেষ করে না। শহিদের মনে পড়ে, অর্ক জানতে চেয়েছিল, মরে যাওয়ার আগে মানুষ কি জানতে পারে কখন তার মৃত্যু হবে। কিন্তু সে শুধু বলেছে, ‘হোমওয়ার্কটা করে ফ্যালো বাবা, কাল তো স্কুল আছে তোমার।’

শহিদ দেখল, মাঠ থেকে একটা সিঁড়ি সোজা ওপরের দিকে উঠে গেছে। সে অনুভব করল, এ বাড়িতেই তাকে যেতে হবে। সিঁড়ি বেয়ে সে একটা ঘরে ঢুকল। সেখানে বন্ধ হয়ে থাকা একটা জানালা ছিল। খুলতে গেলে পেছন থেকে এক লোক তাকে নিষেধ করল। বারান্দায় এল সে। দেখল, নিচে সশস্ত্র এক লোক তার ঘর বরাবর ‘কিছুই ঘটছে না’ চোখে তাকিয়ে আছে। তার মনে হলো, এই জায়গা থেকে সে বেরোতে পারবে না; কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারবে এবং ওঠার সময় তাকে ওই লোক গুলি করে যে মারবে, এটা নিশ্চিত। একটা জনাকীর্ণ জায়গায় সে গেল এবং শুনতে পেল, আগামী শুক্রবারই তাকে হত্যা করা হবে; কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় নয়, যখন তার জন্য নির্ধারিত ঘরে ঢুকবে, তখনই লোকটি তাকে গুলি করবে। সে ভাবল, কাপুরুষের মতো পিঠে গুলি খেয়ে মরে যাওয়া তার ঠিক হবে না। লোকটির কাছে সে একবার ঘরে ঢোকার সুযোগ চাইবে এবং অনুরোধ করবে, সে যেন বারান্দায় দাঁড়ানো অবস্থায় বুকে গুলি চালায়। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় স্বপ্নের মধ্যেই শহিদের মনে হলো, পরিবারের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেলে ভালো হতো। কিন্তু মোবাইলটা বেশ আগেই কেড়ে নেওয়া হয়েছে; যেন খুব স্বাভাবিক, সে ওই ঘরে ঢুকে দেখল তার স্ত্রী রাকা সেখানকার একটা খাটে দাঁড়িয়ে জানালাটি খোলার চেষ্টা করছে এবং পারছে না। একটা লোক দরজায় এসে তাকে লক্ষ করে বলল, ‘নিষেধ আছে। বের হয়ে যান।’

লোকটা প্যান্টের পকেট থেকে একটি খাম বের করে বলল, ‘এই ওষুধগুলা খাবেন।’

রাকা বলল, ‘দেখি কী ওষুধ!’ লোকটা তাকে ঘর থেকে বের করে দিলে শহিদ তার পিছু ছোটে, কিন্তু বারান্দায় গিয়ে দেখে মাঠ থেকে ওই লোক তার দিকে অস্ত্র তাক করে আছে। আর এগোয় না সে। ঘরে ঢুকে ভাবে, এখান থেকে পালানো দরকার অথবা আত্মহত্যা করতে হবে। তবে তার মনে হয়, শুক্রবারের আরও দুই দিন বাকি। এর মধ্যে বাঁচার একটা চেষ্টা করা যায়। রাকা ও অন্যরা নিশ্চয় সেটা করছে। যদি মরতেই হয়, হত্যাকারীরা তার শেষ ইচ্ছা কী, জানতে চাইবে। চাইবে না? সে বলবে যে মৃত্যুর আগে পরিবারের সবাইকে একসঙ্গে দেখতে চায়, তাদের উদ্দেশে কিছু বলতেও চায়। সে জানে যে তারা তাকে বলবে, ‘আপনার পরিবার আজই আসছে। তবে তিন মিনিটের জন্য আপনি বারান্দা থেকেই তাদের দেখবেন, বলতেও পারবেন কিছু।’ শহিদ দেখে, তারা এসেছে। বৃষ্টির পরের নীল আকাশের নিচে ঘাসের রং যেমন হয়, তেমন তাজা-সবুজের ওপর সশস্ত্র লোকটির পাশে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মাঠ থেকে অর্ক ডাকছে, ‘বা-বা!’ সে ভাবে যে কী বলবে, নাকি দেখেই শেষ করবে তিনটি মিনিট। কিন্তু তাদের এবং পৃথিবীর উদ্দেশে তিনটি বাক্য সে মনে করতে পারে:

‘তোমরা ভালো থেকো।’

‘মানবতার জয় হোক।’

‘পৃথিবী এগিয়ে যাক।’

স্বপ্নের ভেতর শহিদের মনে হয়, একটা দিন তো চলে গেল। শুক্রবারের আর মাত্র এক দিন বাকি। রাকা নিশ্চয়ই তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে।...তাকে আরেক অচেনা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তার ঊর্ধ্বতন সহকর্মী কালামের সঙ্গে দেখা হয়। পরের দিন তাকেও যে হত্যা করা হবে, সে জানায়। সিঁড়ি এখানেও আছে, তবে আগেরটির চেয়ে অনেক চওড়া, লোকজনও কম নয়। শহিদের মনে হয়, এখানে সবাই মৃত্যুদণ্ডিত, নিজেকে রক্ষার শেষ চেষ্টার জায়গা এটা। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় তার হাতে এক টুকরা কাগজ ওই লোক দেয়। তারা একটা ঘরে ঢোকে। শহিদ দেখে, এক পুলিশ অফিসার বসে আছে। তাকে কাগজটি দিলে সেটি সে পড়ে বলে, ‘বৈষম্য, অধিকার, নারী—এসব নিয়ে তো যথেষ্ট গবেষণা করেছেন আপনি।’ চোখের কালো বৃত্ত হাইলাইট করে হাসে, বলে, ‘ঠিক হয়ে যাবে। সময়মতো মুক্তি পাবেন।’ কথাটা ভীতিকর রকমের ইঙ্গিতপূর্ণ মনে হয় শহিদের। তবু সে বলে, ‘আমার বাচ্চাটা খুব ছোট।’...লরিতে ওঠার আগে কালাম তাকে বলে, ‘তোমাকে আরেকটু সময় দেওয়া হইছে, বুঝলা!’ বাহনটি চলতে শুরু করলে শহিদ চেঁচিয়ে ওঠে, ‘আমার সন্তানকে আপনাদের কাছে রেখে গেলাম।’...কিছু লোক রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে ছিল।

পাশের বাড়ির ছাদের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা খোপ থেকে কবুতরগুলোর সম্মিলিত ও একক স্বর ভেসে আসছে। শহিদের মনে পড়ে, জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে অর্ক বলেছিল, ‘বাবা, কবুতরের জানালা কত ছোট, দ্যাখো!’

বিছানার যে অংশে পিঠ রেখেছিল, ঘামে সেটি ঠান্ডা হয়ে গেছে, সে টের পায়। ভাবে, কী অপরাধ সে করেছে জীবনে। তেমন কিছু করেছিল কি? কৃত অপকর্মের একটা তালিকা করতে গিয়ে আকস্মিক হাওয়ায় কেঁপে ওঠা পর্দায় চোখ পড়ল তার। ভাবল, আত্মা বিষয়ে এই অদ্ভুত তথ্য কোত্থেকে অর্ক পেল, জানা দরকার।

দুপুরের পর অফিসে অচেনা এক দুলুনি টের পায় শহিদ। অনুভব করে, শরীর চেয়ারে রেখে মাথা উড়ে যেতে চাইছে কোথাও। মনে হলো, এত বড় বড় জানালায় কী কাজ, যদি ওপরের দিকে ছোট একটা ছিদ্র না থাকে! ছাদই-বা কেন! ...ফেরার পথে, বিকেলবেলা, তার খুব বমি হয়েছিল। মাথা পাক খাচ্ছিল সুতায় টান-পড়া ঘুড়ির মতো। বাশারকে জানাতেই প্যারেড গ্রাউন্ডের পাশে গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে দিয়েছিল সে। এমন ঝাঁজালো গন্ধের বমি মদ্যপেরও হয় নাকি! আর এত যন্ত্রণাদায়ক! তার মনে হলো, আত্মা বের হওয়ার জন্য কোনো জানালা লাগে না। করোটি কাঁপিয়ে ডায়াফ্রাম চুরমার করে ফেলা বমনে ভর দিয়ে ফুটপাত, দুলতে থাকা দেয়াল পেরিয়ে তার মুক্তি ও ঊর্ধ্বগমন।...গাড়িটি চলতে শুরু করলে মুহূর্তের মধ্যে সে নেতিয়ে পড়ে আর অনুভব করে ঠান্ডা একটা ঘরে সে বসে আছে। এইচ আর শরমিন তার সামনের চেয়ারে মুখোমুখি উপবিষ্ট, স্লিভলেস কালো জামার ওপর সরু সোনালি শিকল তার বুকের উচ্চতাবশত অর্ধতরঙ্গ তৈরি করেছে। টেবিলে ছড়ানো তার সোনালি নখগুলো দেখতে দেখতে শহিদ শুনল, ‘আপনার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে। আপনি কলিগদের নিয়ে ঘন ঘন ছাদে যান আর বাদাম খান।’

‘আর?’

‘বৈষম্য, অধিকার আর মেয়েদের নিয়া কথা বলেন। খেপিয়ে তোলেন।’

শহিদ নিজের স্বর শুনতে পেল, ‘বাহ্, বেশ লাগছে, লাগছে তো!’

‘কী?’

‘দুঃখিত, আপনি যা শুনতে চান, তা বলা সম্ভব না।’

সোনালি নখ থেকে খনখনে আওয়াজ এল, ‘ইয়ার্কি না, সারপ্লাস ভ্যালু আর মালিকের আরাম–আয়েশ নিয়া কী বলছেন আপনি? প্রমাণ আছে আমার কাছে।’ পাশে রাখা ফাইল থেকে হলুদ একটি খাম বের করল সে। শহিদ খেয়াল করল, সোনালি নখে অনাবশ্যক সুন্দর, কালো আর ভৌতিক হয়ে উঠেছে আঙুলগুলো। আরেকটা কাগজ বের করে এগিয়ে দিতে দিতে সেই নারী বলল, ‘এখানটায় সাইন করেন।’ সে দেখল, কাগজটিতে মোটাসোটা একটা কুকুরের ছবি। প্রাণীটির গায়ে শরমিন কী যেন মাখছে। হ্যাঁ, তেলই তো, ওই যে, সারমেয়টির পশ্চাৎ পদযুগলের পাশে বাটি দেখা যাচ্ছে। কাগজের মধ্যেই ছবিটি গতিশীল হয়ে উঠল, তেল মাখতে মাখতে অমিত, লাবু, মতিন, প্রজ্ঞা, মুরাদ এবং আরও কয়েকজন এসে পড়ল হামাগুড়ি দিয়ে। তাদের শরীর কুকুরটির আড়াল রচনা করেছে। তবে যখন মিলিতভাবে ও পালা করে ওই কুকুরের লেজে তারা জিব বোলাতে লাগল, তখন ফের প্রকাশ্য হলো। যন্ত্রণাক্লিষ্ট অভিভূতের মতো শহিদ দেখল, কুকুরটি সোনালি হয়ে উঠছে এবং লেহনকারীদের উধাও করে দিয়ে পৃষ্ঠাজুড়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। শরমিনকে খুঁজতে লাগল শহিদ। সম্ভবত সে কারণে তার সেই সোনালি শিকল কুকুরটির গলায় দেখতে পেল।...

বাশার বলল, ‘নামেন স্যার। আপনারে বাসায় রাইখা আসি। আর তো দেখা হইব না। দোয়া কইরেন স্যার।’

বমনের পর যা হয়, নিজের শরীরকে নির্দোষ মনে হলো শহিদের। শিশুরা হাওয়াই মিঠাইওয়ালার সামনে জড়ো হয়েছে; কিন্তু অস্পষ্ট লাগছে সবকিছু। আকাশ কালো হয়ে এল নাকি! বাসার দিকে যেতে যেতে শহিদ ভাবে, একটা ঝামেলা তো গেল, এখন চালাক হওয়া দরকার। রাজনীতিটা শিখতে হবে।

রেলিং ধরে সিঁড়ি পেরোতে পেরোতে তার মনে পড়ল, কোনো এক বই থেকে সে জেনেছিল, বের হয়ে যাওয়ার পর আত্মা বদলে যায়, অন্য শরীর ধারণ করে। ভাবল, ওই কুকুরের শরীর যদি নেয়? ‘মন্দ হয় না, বেশ হয়’ বাক্যসুদ্ধ নিজের মৃদু হাসি, সম্মতিসূচক, শুনতে পেল সে।...

পেছন ফিরে দেখল, কেউ নেই। ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল, হর্নও বাজল দুবার। শহিদের চোখ ভিজে আসছিল।

সম্পর্কিত নিবন্ধ