সংস্কার লইয়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) যেই অচলাবস্থা বিদ্যমান, তাহা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান, সমস্যাটি নিরসনে সরকার অদ্যাবধি যথেষ্ট সক্রিয় নহে, যাহা অধিকতর উদ্বেগের কারণ। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে আমরা জানি, সরকার এনবিআর ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) বিলুপ্তিপূর্বক রাজস্বনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে দুইটি বিভাগ সৃষ্টি করিয়া গত ১২ মে একটা অধ্যাদেশ জারি করে। উদ্দেশ্য হিসাবে বলা হইয়াছিল, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে করহার নির্ধারণের ন্যায় নীতিগত কাজ এবং কর আদায়ের কাজ পৃথক রাখা সম্ভবপর হইবে এবং ফলস্বরূপ রাজস্ব ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন যাবৎ বিরাজমান দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ হইবে। কিন্তু অভিযোগ উঠিয়াছে, অধ্যাদেশটি জারির পূর্বে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহিত উহা লইয়া যথেষ্ট পরিমাণ আলোচনা করা হয় নাই। অনেকটা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের একটি শর্ত পূরণের তাগিদ হইতে অতি দ্রুততায় অধ্যাদেশটি জারি করা হয়। আইএমএফের শর্ত ছিল রাজস্বনীতি ও আদায়ের কাজে আলাদা সংস্থা করা। ইহাসহ আরও কিছু শর্ত অপূর্ণ থাকিবার কারণে আইএমএফ উক্ত ঋণের দুইটি কিস্তির অর্থ আটকাইয়া দেয়। এখন আইএমএফের কিস্তি ছাড় করিতে গিয়া যদি অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণই স্থবির হইয়া থাকে, তাহা হইলে পদক্ষেপটি হিতের বিপরীতে অহিতই ডাকিয়া আনিতেছে, বলা যায়।
তবে সরকার যথেষ্ট সচেতন থাকিলে যে এহেন অচলাবস্থা পরিহার করা যাইত, তাহাও বলা প্রয়োজন। জানা গিয়াছে, এনবিআরের কর্মকর্তাগণ প্রতিষ্ঠানটির বিভাজন তথা ইহাকে দ্বিধাবিভক্তিকরণ লইয়া তেমন আপত্তি করিতেছেন না। তাহাদের মূল আপত্তি নূতন দুই বিভাগে পদায়ন-সংক্রান্ত। যেখানে তাহাদের দাবি এই পদায়নে রাজস্ব খাতের কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার, সেখানে সরকার উপযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগের কথা বলিয়া বস্তুত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগের পথ উন্মুক্ত রাখিয়াছে। স্পষ্টত, অধ্যাদেশে রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের মত উপেক্ষা করিয়া সরকার এক প্রকার পক্ষপাত প্রদর্শন করিয়াছে, রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপক হিসাবে সরকারের নিকট যাহা আদৌ প্রত্যাশিত নহে। এই দিক হইতে বিচার করিলে এনবিআর কর্মীদের চলমান আন্দোলনের যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যায় না।
আলোচ্য আন্দোলন ইতোমধ্যে এক মাস অতিক্রান্ত। সরকারও তাহাদের সহিত কয়েক দফা আলোচনায় বসিয়াছে। কিন্তু উভয় পক্ষ স্বীয় অবস্থানে অনড়। তদুপরি পরিস্থিতি যেন ক্রমশ জটিলতর রূপ পরিগ্রহ করিতেছে। শুক্রবার প্রকাশিত সমকালের প্রতিবেদন অনুসারে, পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির অংশ হিসাবে বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নিজেদের প্রধান কার্যালয়ে কলমবিরতি পালন শুরু করেন এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ। এই সময় সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতিতে এনবিআর প্রশাসনের পক্ষ হইতে ভবনটির ফটকগুলিতে ভিতর হইতে তালা লাগাইয়া দেওয়া হয়। অন্যদিকে আন্দোলনকারীরা বাহির হইতে উক্ত ফটকগুলিতে আরেক দফা তালা লাগাইয়া দেন। শুধু উহাই নহে, অপরাহ্ণ ৪টার দিকে এনবিআরের সম্মুখের সড়কে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ সংবাদ সম্মেলন করে, যেখানে সমগ্র দেশের শুল্ক-কর কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঢাকামুখী ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
দেশের রাজস্ব সংগ্রহের প্রায় সম্পূর্ণ অংশই সম্পাদন করে এনবিআর। অর্থাৎ আন্দোলনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীগণের সংগৃহীত রাজস্ব দিয়াই সরকার তাহার যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করে। তাই কোনো সংস্কার কর্মসূচি, তাহা যতই ভালো হউক, উক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীগণের উপর জোর করিয়া চাপাইয়া দিয়া কোনো কল্যাণকর ফল লাভ করা যাইতে পারে না।
উপরন্তু রাজস্ব সংগ্রহকার্য বিশেষায়িত জ্ঞান ও দক্ষতা দাবি করে, যাহার খুঁটিনাটি স্বল্প সময়ে কাহারও পক্ষে আয়ত্ত করা সহজ হইতে পারে না। ফলে বিভাগসমূহ পরিচালনাকার্যে এই বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মকর্তাগণের অগ্রাধিকার কোনো অন্যায় আবদার নহে। তবে সকল পক্ষকেই বুঝিতে হইবে, এই অচলাবস্থা দ্রুত দূর করিতে হইবে এবং আলোচনা ব্যতিরেকে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ নাই। এই ক্ষেত্রে সরকার আরও আন্তরিক হইবে বলিয়া আমাদের বিশ্বাস।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র র কর মকর ত সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাসহ ৪ কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি খারাপ
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাসহ চার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো খারাপ অবস্থায় আছে বলে মনে করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। অন্য তিনটি কারণ হলো কঠোর আর্থিক ও রাজস্ব নীতির প্রভাব, বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা বৃদ্ধি এবং ব্যাংক খাতে অব্যাহত চাপ। আইএমএফের ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ অনুমোদন দেওয়ার বিষয়ে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়েছে।
আইএমএফের সঙ্গে চলমান ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ কর্মসূচি থেকে দুই কিস্তির ১৩৭ কোটি মার্কিন ডলার একসঙ্গে পাচ্ছে বাংলাদেশ। আগামীকাল ২৬ জুন বাংলাদেশের হিসাবে এ অর্থ জমা হবে। গত সোমবার রাতে আইএমএফের বোর্ড সভায় দুই কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়টি অনুমোদন করা হয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আইএমএফ আরও বলেছে, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে আগের সরকারের পতন হয়।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আছে, এ নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। বিনিয়োগ স্থবিরতাও কাটেনি। আইএমএফ অর্থনীতির কিছু বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যা ঠিকই আছে। জাহিদ হোসেন, সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক, ঢাকা কার্যালয়তখন সামষ্টিক অর্থনীতি আরও চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে। পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নানা উদ্যোগে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি হয়; যা অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতার পথে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জটিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেও আইএমএফ কর্মসূচির অধীন তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের পর্যালোচনায় বাংলাদেশের পারফরম্যান্স মোটামুটি সন্তোষজনক ছিল। সরকার প্রয়োজনীয় নীতিগুলো বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সম্প্রতি বিনিময় হার আরও নমনীয় করার পাশাপাশি কর রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আছে, এ নিয়ে কারও দ্বিমত নেই। বিনিয়োগ স্থবিরতাও কাটেনি। আইএমএফ অর্থনীতির কিছু বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যা ঠিকই আছে।
জাহিদ হোসেনের মতে, আইএমএফ মূলত তিন ধরনের সুপারিশ করেছে। কঠোর আর্থিক নীতি অব্যাহত রাখার কথা বলেছে। এ ছাড়া যে বিনিময় হার ব্যবস্থা প্রচলন করা হয়েছে, তা যেন বজায় রাখা হয়। আর রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজেট–ঘাটতি কমাতে হবে।
অর্থনীতি নিয়ে আইএমএফের মূল্যায়নআইএমএফ বলছে, চলতি অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। আগামী অর্থবছরে তা বেড়ে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হবে।
এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিও আগামী অর্থবছরে কিছুটা সহনীয় হবে। আইএমএফের মতে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি গড়ে ৬ দশমিক ২ শতাংশে নেমে আসতে পারে। চলতি অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি গড়ে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ হওয়ার কথা বলেছে আইএমএফ।
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি নানা ধরনের সামষ্টিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছে। কঠিন পরিবেশ সত্ত্বেও আইএমএফের কর্মসূচির অধীনে প্রতিশ্রুত খাতগুলোর অগ্রগতি সন্তোষজনক রয়েছে এবং সরকার প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও সংস্কার বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এখন বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ পুনর্গঠন এবং মূল্যস্ফীতি কমানোর ওপর জোর দেওয়া উচিত।
সম্প্রতি সরকার নতুন বিনিময় হার ব্যবস্থা চালু করেছে এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিয়েছে, যা ইতিবাচক। কঠোর মুদ্রানীতির ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন নীতিমালার সমন্বয়, নমনীয় বিনিময় হার এবং রাজস্ব ঘাটতি হ্রাস—এই তিনটি মিলেই অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক খাতে ভারসাম্য স্থাপনে সহায়ক হবে বলে মনে করে আইএমএফ।
সরকারি ভর্তুকি ধাপে ধাপে কমিয়ে একটি টেকসই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া উচিত বলেও মত দিয়েছে আইএমএফ। এ ছাড়া সরকারি অর্থের দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে ব্যয়ের দক্ষতা বাড়াতে হবে। আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ খাতে সংস্কারের জন্য ধাপে ধাপে বাস্তবায়নযোগ্য কৌশল প্রণয়ন জরুরি। পাশাপাশি ক্ষুদ্র আমানতকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে ব্যাংক খাত পুনর্গঠনের জন্য নতুন আইন দ্রুত কার্যকর করা দরকার।
আইএমএফের মতে, বাংলাদেশকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে টেকসই কাঠামোগত সংস্কার অপরিহার্য। এর মধ্যে রয়েছে রপ্তানি বৈচিত্র্য, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করা, সুশাসন জোরদার এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্তের গুণগত মান উন্নয়ন।
২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য সাড়ে তিন বছর মেয়াদি ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণপ্রস্তাব অনুমোদন করে। ঋণ কর্মসূচি অনুমোদনের সময় আইএমএফ বলেছিল, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, ঝুঁকিতে থাকা ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে এ ঋণ কর্মসূচি। চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়া, টাকার দরপতন হওয়া এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া—মূলত এ তিন কারণে তখন আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার এবং ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার বাংলাদেশ পেয়েছে। অর্থাৎ তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৩১ কোটি ডলার।