উচ্চ সুদহারের পাশাপাশি ব্যাংক খাতে উচ্চ খেলাপি ঋণ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। তবে এর মধ্যে বর্তমানে টাকা-ডলার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা ব্যবসায়ীদের কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে। গতকাল শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘ব্যাংক খাতের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ: ঋণ গ্রহীতার প্রেক্ষিত’ শীর্ষক সেমিনারে ব্যবসায়ীদের বক্তব্যে এমন মত উঠে আসে। ব্যাংক খাত নিয়ে আলোচনায় গ্যাস সংকটসহ ব্যবসায়ীদের অন্য সমস্যাও তুলে ধরেন বক্তারা। 
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড.

আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, আইসিইউ থেকে দেশের অর্থনীতি টেনে তুলেছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। তিনি মনে করেন, সুদহার ছাড়াও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের নানা পন্থা রয়েছে। তবে চীন ছাড়া সারা বিশ্ব এ নীতি থেকে বের হতে পারছে না। বর্তমান অবস্থায় ভালো ব্যাংক কেন উচ্চ সুদে ঋণ দিচ্ছে, সেই প্রশ্ন রাখেন তিনি। এ ছাড়া ঋণদাতা ও গ্রহীতা উভয়কেই দায়িত্বশীল হওয়ার পরামর্শ দেন। 

আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ১৫ বছরে দেশের দুর্নীতির অবস্থা জেনেও আইএমএফ ঋণ দিয়েছে। এর দায় কি আইএমএফের নেই? চুরি হচ্ছে জেনে এডিবি-বিশ্বব্যাংক ঋণ দিয়েছে। তাদেরও কী দায় নেই? জুলাই বিপ্লবের আগে বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যাবে, তারা বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রগতি নিয়ে প্রশংসায় ভাসিয়ে ফেলেছে। এখন আবার তারা (বিশ্বব্যাংক) নানা রকম উপদেশ দিচ্ছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. এজাজুল ইসলাম বলেন, উচ্চ সুদের কারণে ব্যবসা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলা হচ্ছে। অথচ ব্যবসায়ীদের দাবি শুনে গত সরকার সুদহার বেঁধে দিয়ে ঋণে ৯ শতাংশ এবং আমানতে ৬ শতাংশ করেছিল। এই নয়-ছয় উচ্চ মূল্যস্ফীতির বীজ বপন করে। বিনিয়োগ আনা যায়নি, মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি। মাঝখান থেকে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ ক্ষয় হয়েছে। 

তিনি বলেন, জুলাইয়ের পর বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা করা হয়েছে। রিজার্ভ বেড়ে ৩০ বিলিয়নের ওপরে উঠেছে। এ কারণে ব্যবসায়ীরা আস্থা পাচ্ছেন। সুদহার নির্ধারণে এখন ব্যাংকগুলোর স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। ভালো ব্যাংক চাইলে কম সুদে ঋণ দিতে পারে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিরোধিতার পরও বিগত সময়ে কিছু নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স চাপিয়ে দেওয়া হয়। একটা গ্রুপের হাতে অনেক ব্যাংক তুলে দেওয়া হয়। ফলে এ খাতে অস্বচ্ছতা ও অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়।

ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, কিছু মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে চলে গেছে। সেই দায় সবাই নেবে না। বিদেশি ব্যাংক এখন অর্ধেকের বেশি ব্যাংকের এলসি নিচ্ছে না। ব্যাংক খাতের ২৪ শতাংশের বেশি ঋণ এখন খেলাপি। স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগে এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশে নেমেছে, কর্মসংস্থানের ওপর যা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালা কঠিন করার ক্ষেত্রে আরও সময় দাবি করেন তিনি। 
মূল প্রবন্ধে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ডলারের দর ৮৫ টাকা থেকে ১২২ টাকা হওয়ায় বিনিময় হারজনিত লোকসান হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। আবার ৯ শতাংশ সুদহার এখন ১৪ শতাংশ হওয়ায় বাড়তি সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যবসায় খরচ বেড়েছে ৪০ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করলে বিক্রি কমেছে ৩০ শতাংশ। অল্প কিছু ব্যাংকের খেলাপি ঋণের কারণে পুরো খাতের খেলাপি অনেক বেড়েছে। 

ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির চেয়ারম্যান আব্দুল হাই সরকার বলেন, ব্যাংক খাতে এত খেলাপি ঋণ অথচ অর্থঋণ আদালত মাত্র চার থেকে পাঁচটা। এর মধ্যে বিচারকরা অসুস্থ থাকেন। শুনানি পিছিয়ে যায়। অর্থঋণ আদালতের সমস্যার সমাধান করা গেলে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ খেলাপি ঋণ ঠিক হয়ে যাবে।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও আনোয়ার গ্রুপের এমডি হোসেন খালেদ বলেন, খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে, যা অব্যাহত থাকলে আগামীতে কারখানা চালুর রাখাই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে আসবে। 
 র‍্যাংগস মোটরসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহানা রউফ চৌধুরী বলেন, ব্যবসায়ীদের সমস্যার শেষ নেই। উৎপাদন খাতে এত বেশি সুদহার দিয়ে টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি স্থানীয়ভাবে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনে স্বল্প সুদের তহবিল গঠনের সুপারিশ করেন। 
মার্কেন্টাইল ব্যাংকের এমডি মতিউল হাসান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকারি-বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন তিনি। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব যবস য় দ র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি

ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ অনুমোদন দেওয়ার সময় আইএমএফ বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিবিধি সম্পর্কে যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তা উদ্বেগজনকই। তারা মনে করে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাসহ চার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো খারাপ অবস্থায় আছে। অন্য তিনটি কারণ হলো কঠোর আর্থিক ও রাজস্ব নীতির প্রভাব, বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা বৃদ্ধি এবং ব্যাংক খাতে অব্যাহত চাপ।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কথা স্বীকার করে বলেছেন, বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটেনি। প্রশ্ন হলো গত ১০ মাসে অন্তর্বর্তী সরকার এই স্থবিরতা কাটাতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কি না। আইএমএফ বলছে, চলতি অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। আগামী অর্থবছরে তা বেড়ে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হবে। সংস্থাটির মতে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি গড়ে ৬ দশমিক ২ শতাংশে নেমে আসতে পারে। মূল্যস্ফীতিই জনজীবনে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলছে, সেটা জানা গেল বিশ্বব্যাংকের আরেক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, জাতীয় দারিদ্র্যের হার ২০২৫ সালে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ হবে। ২০২২ সালে তা ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা, যঁাদের দৈনিক আয় ২ ডলার ১৫ সেন্টের নিচে ছিল, তঁাদের সংখ্যা ৩০ লাখ হতে পারে। দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব। যে হারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে, সে হারে মানুষের আয় বাড়েনি। আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যরেখা দিয়ে দরিদ্র মানুষ চিহ্নিত করা হয়। ক্রয়ক্ষমতা সমতা (পিপিপি) অনুসারে, দিনে ২ দশমিক ১৫ ডলার আয় করে প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা কেনার সামর্থ্য না থাকলে অতিদরিদ্র হিসেবে ধরা হয়।

রাজনীতির সংস্কার ও বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় সরকারের সমালোচনা করেছে আইএমএফ। অবশ্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে বিনিময় হার আরও নমনীয় করা ও কর রাজস্ব বাড়াতে নেওয়া সংস্কারকাজের প্রশংসা করেছে তারা। এর পাশাপাশি সংস্থাটি বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ পুনর্গঠন ও মূল্যস্ফীতি কমানোর পরামর্শ দিয়েছে। সরকারি ভর্তুকি ধাপে ধাপে কমিয়ে একটি টেকসই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া উচিত বলেও মত দিয়েছে আইএমএফ। 

স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বর্তমানে আন্তর্জাতিক মহল থেকে যেসব সুযোগ–সুবিধা পাচ্ছে, উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হলে তার অনেকটাই কমে যাবে। এ জন্য কেবল বিদেশি সংস্থা নয়, দেশের অর্থনীতিবিদেরাও প্রাক্‌–প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলেছেন।  

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে যে অর্থনীতি মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ে, সেটা জানতে আইএমএফ বিশ্বব্যাংক বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনের প্রয়োজন পড়ে না। দেশের সাধারণ মানুষ সাদাচোখেই সেটা দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ বিষয়ে কতটা সজাগ আছে, সেই প্রশ্ন আছে। দিনের পর দিন আলোচনা করেও কেন তারা সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারছে না? যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান পরস্পর বিপরীত মেরুতে, সেখানে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করা কঠিনই বটে। 

আমরা আশা করব, রাজনৈতিক দলগুলো অবিলম্বে ন্যূনতম বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করবে, যাতে একটি শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করা যায়। কোনো দল যদি নিজের অবস্থানে অনড় থাকে এবং অন্যদের কথা শুনতে না চায়, তাহলে রাজনৈতিক ঐকমত্য কখনো হবে না। এই সরল সত্য কথাটি সংশ্লিষ্ট সবাই মনে রাখবে আশা করি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কর্মকর্তাদের দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করবে এনবিআর
  • আইএমএফের ঋণের অর্থ এল, রিজার্ভ বাড়ল
  • ঋণ নয়, অধিকার চাই, প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তারা
  • রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি
  • আলোচনাই সমাধানের পথ
  • প্রবাসী আয় ও বিদেশি ঋণে রিজার্ভ বেড়ে ৩ হাজার কোটি ডলার
  • মোট রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল
  • নির্বাচনের সময় প্রকাশের পর দাতারা অর্থ ছাড় শুরু করেছে: অর্থ উপদেষ্টা