আমাদের প্রত্যেকের স্মৃতিতে জুলাই-আগস্ট ’২৪ এখনও জীবন্ত। আমরা অনেকেই নানা রকম মানসিক ট্রমার ভেতর দিয়ে গিয়েছি। হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীকে রাস্তায় বিক্ষোভে অংশ নিতে দেখেছি। ২০২৪-এর জুলাই মাসব্যাপী চলা বৈষম্যবিরোধী বা কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে এটি কীভাবে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে রূপ নিল, তা আমরা বেশ কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। তবে সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার ছিল এটি যে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি বড় প্রত্যাশার জায়গা তৈরি হয়েছিল। তারা এই রাষ্ট্রব্যবস্থার ত্রুটি এবং জবাবদিহিহীন শাসনব্যবস্থা নিয়ে খুবই সোচ্চার ছিল। দেশব্যাপী দেয়ালে তাদের আঁকা ও লেখা নানা রকম গ্রাফিতি পড়লে তা খুব সহজেই বোঝা যায়। দেয়ালের শব্দগুলোই ছিল এই রাষ্ট্রের কাছে তাদের চাওয়া। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের যে বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে বা এখনও নেয়নি, তার বিরাট একটি অংশ দেয়ালের গ্রাফিতিতে ছিল এবং এখনও অক্ষত আছে।

আমি গত বছর জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে এবং আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিন ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়ায় হেঁটেছি এবং নানা বয়সের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছি। ১ আগস্ট আমি ধানমন্ডি ২৭ নাম্বার রোড এবং লালমাটিয়ার আশপাশে অনেকক্ষণ হেঁটেছি। সেখানে বেশ কিছু শিক্ষার্থী দেয়ালে গ্রাফিতি করছিল। তাদের কথাবার্তা শুনে বোঝা গেল তারা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে লেখাপড়া করে। তাদের মধ্যে একটি গ্রুপের আলাপ ছিল এ রকম– ‘দোস্ত, দেশ ছেড়ে আর কোথাও যাব না। দেশেই ভালো কিছু করতে চাই। এবার দেশের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন হবে।’ এ কথা শুনে আরেকজনকে বলতে শুনলাম– ‘হ্যাঁ, আমিও আর আইইএলটিএস দেব না। এখানেই ভালো একটা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাব। এত প্যারা নিয়ে লাভ নাই। এবার দেশের জন্য কিছু একটা করতে হবে।’
তাদের বন্ধুদের দু-একজন এই আলাপে যোগ দিল এবং তাদের বলতে শুনলাম– ‘এবার হয়তো অনেকেই দেশে ফেরত আসবে। আমাদের ব্রেইন ড্রেন ঠেকানো দরকার।’ আমি আমাদের শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের মুখে এসব আলোচনা শুনে শিহরিত হলাম। নিজের ভেতরে দারুণ ভালো লাগা কাজ করল। বাসায় ফিরে এসে অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতাম। আমার কাছে মনে হতো, বাংলাদেশের প্রতিটি তরুণ বা শিক্ষার্থী এভাবেই ভাবছে এবং তারা এবার রাষ্ট্রের মেরামত করেই ছাড়বে।

গণঅভ্যুত্থানের পরপরই আমি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং জেনেছি তাদের বাস্তবসম্মত চিন্তাভাবনা এবং প্রত্যাশা। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তাদের প্রত্যাশা ছিল হাতেগোনা কয়েকটি, যেগুলো যে কোনো সরকার সদিচ্ছা নিয়ে কাজ করলে বাস্তবায়ন করতে পারে। মোটামুটি তাদের দাবি ছিল এ রকম: ১.

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে; ২. বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের (লেজুড়বৃত্তি) রাজনৈতিক দলবাজি নিষিদ্ধ করতে হবে; ৩. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান এবং শিক্ষার পরিবেশ (আবাসিক হল এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা) উন্নত করতে হবে; ৪. সত্যিকারের যোগ্য দক্ষ নীতিবান শিক্ষককে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে; ৫. সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা বাতিল করতে হবে এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে; ৬. শিক্ষিত বেকার তৈরি যাতে না হতে পারে সেই ব্যাপারে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে এবং নতুন নতুন চাকরির বাজার তৈরি করতে হবে; ৭. অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে এবং পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনতে হবে; ৮. বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে; ৯. একটি ‘শিক্ষা সংস্কার কমিশন’ গঠন করতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে হবে; ১০. প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকের শিক্ষাক্রম আধুনিক ও মানসম্মত করতে হবে এবং শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে; ১১. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিতভাবে শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচন হতে হবে, অবশ্যই সেখানে কোনো লেজুড়বৃত্তির রাজনৈতিক পরিচয় থাকা যাবে না; ১২. রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরে ইতিবাচক মৌলিক সংস্কার করতে হবে, যাতে জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়; ১৩. রাষ্ট্রকাঠামোর প্রতিটি স্তর থেকে দুর্নীতি সমূলে উৎপাটন করতে হবে; ১৪. একটি টেকসই গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা বা রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

এই তালিকা ছিল আমাদের তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা। এসব দাবির কথা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে পৌঁছানো হয়েছে। কিন্তু আমরা খুবই আশাহত হই যখন দেখি এসবের অনেক বিষয়ে সরকারের ভেতরেই কোনো সিরিয়াস আলাপ নেই। এমনকি তাদের সংস্কার কর্মসূচির মধ্যেও নেই। গত ১০ মাসের মধ্যে তারা একটি জাতীয় ‘শিক্ষা সংস্কার কমিশন’ গঠন করতে পারল না। ইচ্ছে করেই হয়তো করেনি। বিভিন্ন দলের রাজনীতিকরা এই বিষয়ে বেশ চুপচাপ। তারা সংসদ নির্বাচন নিয়ে খুব সরব। তাদের ছাত্র সংগঠনগুলো আগের মতোই ক্যাম্পাসে লেজুড়বৃত্তি রাজনীতিতে মত্ত হয়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে দলীয় রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য হওয়ার দৌড় অব্যাহত আছে। এসব খুবই হতাশাজনক! 
সব শেষে বলতে চাই, দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করা না গেলে এবং শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিক ও উন্নত করা না গেলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সুস্থ, ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে না। এতে করে আমাদের তরুণ প্রজন্মের ভেতর আবারও নতুনভাবে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। এখন অনেকেই আলাপ করছে কত দ্রুত দেশ ছেড়ে বিদেশে যাওয়া যায়! ‘রিভার্স ব্রেইন ড্রেন’ আর হয়তো ঘটবে না!

শেখ নাহিদ নিয়াজী: সহযোগী অধ্যাপক; ইংরেজি বিভাগ; স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ 
nahidneazy@yahoo.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন ন শ চ ত কর র জন ত ক ব যবস থ সরক র র আম দ র র ভ তর ন করত ত করত

এছাড়াও পড়ুন:

পূজার ছুটির পর গকসুর অভিষেক

৭ বছরের বিরতির পর গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে (গবি) অনুষ্ঠিত হলো চতুর্থ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (গকসু) নির্বাচন। গত ২৫ সেপ্টেম্বর ভোটগ্রহণ ও ফলাফল ঘোষণার মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন নতুন নেতৃত্ব।

তবে পূজার ছুটি শেষ না হওয়ায় এখনও হয়নি অভিষেক ও শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। ফলে দায়িত্বভার নিতে পারছেন না নবনির্বাচিতরা।

আরো পড়ুন:

গকসুর জিএস, এজিএসের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আপত্তি, পুনর্নির্বাচন দাবি

চাকসু নির্বাচন: দুই নারী প্রার্থীকে সাইবার বুলিংয়ের অভিযোগ

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দুর্গাপূজার পর অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচিত নেতৃবৃন্দের অভিষেক। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনও নির্দিষ্ট তারিখ জানানো হয়নি। এতে নির্বাচনের পর যে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তা এখন রূপ নিয়েছে অপেক্ষার আবহে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ২৫ সেপ্টেম্বর দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ৭ বছরের ব্যবধান ঘুচিয়ে শিক্ষার্থীরা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব বেছে নেন। ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, প্রার্থীদের প্রচারণা আর ভোটের দিন ক্যাম্পাসজুড়ে উৎসবমুখর পরিবেশ শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাসে ভরিয়ে তোলে।

ভোট শেষে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হলেও আনুষ্ঠানিক অভিষেক না হওয়ায় এখনো কার্যক্রম শুরু করতে পারেননি তারা।

আইন বিভাগের শিক্ষার্থী রেশমা আক্তার বলেন, “গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হলেও নির্বাচিত সদস্যরা এখনও শপথ গ্রহণ করেননি। এই বিলম্বের সুযোগে কিছু মহল নির্বাচন নিয়ে অপপ্রচার ও মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। এই গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে সফল করতে এবং অপপ্রচার রোধে নির্বাচিত সদস্যদের দ্রুত শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা করা জরুরি। প্রশাসনের উচিত অবিলম্বে এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের দায়িত্ব পালন শুরু করতে পারেন।”

সদ্য নির্বাচিত সহ-সভাপতি ইয়াছিন আল মৃদুল দেওয়ান বলেন, “নির্বাচনের পরের দিনটি সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল এবং দুর্গাপূজার ছুটির কারণে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম ছিল। উপাচার্য স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি, তিনি জানিয়েছেন পূজার ছুটির পর যতদ্রুত সম্ভব অভিষেক ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো. ওহিদুজ্জামান বলেন, “ছুটি শেষে শপথ গ্রহণ ও অভিষেক অনুষ্ঠান সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করা হবে। এখন পর্যন্ত কোনো তারিখ নির্ধারিত হয়নি।”

২০১৩ সালে প্রথমবার গকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ ২৫ সেপ্টেম্বর চতুর্থ নির্বাচনে সম্পাদকীয় ও অনুষদ প্রতিনিধি মিলিয়ে মোট ১২টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ৫৮ জন প্রার্থী। ভোটার ছিলেন ৪ হাজার ৭৬১ জন।

ঢাকা/সানজিদা/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইন্দোনেশিয়ায় স্কুল ভবন ধস: ধ্বংসস্তুপের নিচে এখনও আটকা ৯১ জন
  • বাজেট বিল নিয়ে অচলাবস্থা, শাটডাউনের পথে যুক্তরাষ্ট্র
  • পূজার ছুটির পর গকসুর অভিষেক