পারিবারিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন মা। এ সুযোগে কাউকে কিছু না বলে ১০ বছরের আফিয়া ও ৮ বছরের মিম বাড়ির পাশে নতুন খনন করা পুকুরে গোসল করতে নামে। ঘণ্টাখানেক পর পরিবারের লোকজন তাদের হদিস না পেয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। এক পর্যায়ে তাদের মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় পুকুরে। ঘটনাটি ঘটেছে গত ১৮ জুন নড়াইল সদরের বাঁশগ্রাম ইউনিয়নের বেদভিটা গ্রামে।
ঈদুল আজহা তখন বাকি তিন দিন। ২২ মাস বয়সী রাহাদ ও রিহান বাড়ির উঠানে খেলছিল। পরিবারের সদস্যরা ব্যস্ত ছিলেন পারিবারিক কাজে। এরইমধ্যে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বাড়ির সামনে পুকুরে নেমে পড়ে তারা। যখন তাদের খোঁজ পড়ল, তখন তারা আর বেঁচে নেই। গত ৪ জুন কালিয়ার আটলিয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে।
শুধু এ দুই ঘটনাই নয়, গত জুন মাসে জেলায় পানিতে ডুবে মারা গেছে ছয় শিশু। গত ১৫ মাসে মারা গেছে ১৫ জন। এর মধ্যে আট শিশু ও সাত কিশোর। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবারের অসাবধানতা বা গাফিলতি দায়ী ছিল। সাঁতার না জানাও বড় ভূমিকা রেখেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের অপমৃত্যু এড়াতে সাবধানতার পাশাপাশি সাঁতার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
নড়াইল আব্দুল হাই সিটি কলেজ থেকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক মো.

মনির মল্লিক বলেন, শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর পেছনে প্রধানত পরিবারের অসচেতনতাই দায়ী। তাদের সার্বক্ষণিক নজরে রাখা এবং সচেতন হওয়া প্রয়োজন। এতে শিশু-কিশোররা দুর্ঘটনার শিকার হবে না। তিনি শিশুদের নিরাপদ রাখা এবং সার্বিক বিকাশে পরিবারের আরও দায়িত্বশীল ও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন।
গত ১১ জুন লোহাগড়ার ঝিকড়া গ্রামের আবির তাজ ইমামের ২ বছরের মেয়ে আয়েশা পুকুরে ডুবে মারা যায়। ১০ জুন কালিয়ার ঘোষপাড়া এলাকার তারক ঘোষের সন্তান পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া শ্রেষ্ঠ ঘোষসহ তিন বন্ধু নবগঙ্গা নদীতে ডুবে প্রাণ হারায়। সে সাঁতার জানত। ১ এপ্রিল লোহাগড়ার চাচই গ্রামে নানাবাড়িতে পুকুরে গোসল করতে নেমে ডুবে মারা যায় ফাতেমা সিদ্দিকা (৭)।
২০২৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর লোহাগড়ার পার-শানগর গ্রামের ফজলু রহমানের মেয়ে ফাতেমা খানম (২) ডুবে মারা যায়। পুকুরে ডুবে যাওয়ার আগে উঠানে খেলছিল সে। ৫ সেপ্টেম্বর লোহাগড়ার ছত্রহাজারি গ্রামে নানাবাড়ি বেড়াতে এসে আয়েশা (৩) পুকুরে ডুবে মারা যায়। সেও বাড়ির উঠানে খেলছিল। ১ আগস্ট সদরের শিমুলিয়া গ্রামের শফিকুল বিশ্বাসের ছেলে ১৫ মাস বয়সী আকিব বালতির পানিতে ডুবে মারা যায়। বালতি ধরে দাঁড়াতে গিয়ে তার মাথা নিচের দিকে চলে গেলে তার মৃত্যু হয়।
২৬ জুন নদীতে বন্ধুদের সঙ্গে গোসল করতে গিয়ে নবম শ্রেণির ছাত্র আসমাউল মীরের মৃত্যু হয়। সে নড়াইল পৌরসভার উজিরপুর এলাকার বিল্লাল মীরের ছেলে। ১৪ মে শহরের বরাশোলা এলাকার সাইফুর রহমানের ছেলে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র রাজ শেখ চিত্রা নদীতে ডুবে মারা যায়। বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলে নদীতে গোসল করতে নেমেছিল সে। ১১ মে সদরের নাকশি এলাকার সাইফুল শিকদারের ছেলে মাদ্রাসাছাত্র রায়হান শিকদার নদীতে গোসল করতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যায়। সে ভালো সাঁতার না জানায় কলাগাছের অংশ ধরে ছিল। একপর্যায়ে সে নদীতে তলিয়ে গেলেও বন্ধুরা তাকে উদ্ধার করতে পারেনি।
২০ এপ্রিল সদরের বাহির গ্রামের নূর জালাল মোল্যার দুই সন্তান তিন্নি (৫) ও তানহা (৩) ঘেরের পানিতে পড়ে মারা যায়। কালিয়ার আটলিয়া গ্রামে ডুবে মারা যাওয়া রিহানের বাবা রিয়াজ শেখের ভাষ্য, বাড়িতে সবাই কাজে ব্যস্ত থাকায় রিহান ও চাচাতো ভাই রাহাদের বিষয়ে কারও খেয়াল ছিল না। তারা বাড়ির উঠানেই খেলছিল। পরে বাড়ির পাশের ডোবায় তাদের মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। নড়াইল শহরের বরাশোলা এলাকায় চিত্রা নদীতে গোসল করতে গিয়ে নিহত রাজ শেখের কাকা মো. হাফিজুর রহমান বলেন, বাড়ির পাশে হলেও রাজ কখনও নদীতে নামেনি, সে সাঁতারও জানত না।
অনেক অভিভাবক সন্তানের সাঁতার শেখাতে আগ্রহী নন এবং তাদের গাফিলতিও রয়েছে বলে মনে করেন জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, সরকারিভাবে বার্ষিক সাঁতার প্রশিক্ষণের জন্য মাসব্যাপী ব্যবস্থা থাকে। গত মে মাসে ৮০ জনের বেশি শিশু-কিশোরকে সাঁতার শেখানো হয়েছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে জুলাই থেকে প্রতি শুক্র ও শনিবার নড়াইল পৌরসভার পেছনে কালিদাস ট্যাঙ্ক পুকুরে পানি জীবাণুমুক্ত করে সাঁতার শেখানোর চেষ্টা চলছে। স্থায়ীভাবে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার জন্য জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলবেন তিনি। কারণ প্রশিক্ষককে সম্মানী দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। 
সাঁতার শেখা প্রত্যেক শিশুর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক শারমিন আক্তার জাহান বলেন, সরকারিভাবে সাঁতার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। উপজেলা পর্যায়ে শেখানোর ধারণাটি সময়োপযোগী। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে জেলা পর্যায়ে এসে সাঁতার শিখতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গ্রামীণ পর্যায়ে শিশুদের সাঁতার না শিখিয়ে পুকুরে ছেড়ে না দিতে অভিভাবকদের প্রতি তিনি অনুরোধ জানান।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: পর ব র র ল হ গড় র ব যবস থ পর য য় এল ক র সদর র

এছাড়াও পড়ুন:

মেঘনা-ধনাগোদা বেড়িবাঁধ সড়ক যেন মরণফাঁদ

চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত ৬৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সড়কটি এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। সড়কের বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় অনেক গর্ত। এসব গর্তের পাশ দিয়ে প্রতিদিনই ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছেন পথচারী ও যানবাহন। এলাকাবাসীর অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের দাবি জানানো হলেও সড়ক ও জনপদ বিভাগ (সওজ) কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। যে কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন তারা।

সরেজমিনে দেখা যায়, মেঘনা-ধনাগোদা বেড়িবাঁধের দুই পাশে জায়গায় জায়গায় বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও সড়কের পিচ উঠে গেছে, কোথাও আবার গর্তের গভীরতা এত বেশি যে, ছোট যানবাহন উল্টে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। 

আরো পড়ুন:

রাজশাহীতে দুর্ঘটনায় কলেজছাত্রের মৃত্যু, ট্রাকে আগুন

সিলেটে বাস-প্রাইভেটকার সংঘর্ষ, বাবা-মেয়ে নিহত

মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের বেড়িবাঁধটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের হলেও, এর ওপরে নির্মিত পাকা সড়কটি সওজ বিভাগের আওতাধীন। এ সড়কটি ব্যবহার করে মতলব উত্তর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও ঢাকা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর যানবাহন চলাচল করে।

স্থানীয় অটোরিকশা চালক রোবেল হোসেন বলেন, ‍“নির্মাণের দুই-তিন বছর যেতে না যেতেই সড়কের দুই পাশে অনেক গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এখন প্রতিদিন গাড়ি চালাতে হচ্ছে ঝুঁকি নিয়ে। একটু অসাবধান হলেই ঘটবে দুর্ঘটনা।”

মোটরসাইকেল চালক আনোয়ার হোসেন বলেন, “দিনে কোনোভাবে পার হওয়া যায়, কিন্তু রাতের পরিস্থিতি থাকে ভয়ঙ্কর। কারণ, অনেক সময় দূর থেকে গর্ত দেখা যায় না। এই সড়কে খুব ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাতে হয়।” 

পিকআপ ভ্যানের চালক আব্দুর রহমান বলেন, “কয়েক বছর না যেতেই রাস্তা গর্তে ভরে গেছে। রাতের বেলায় গর্তগুলো বোঝা যায় না, তাই সব সময় আতঙ্ক নিয়ে গাড়ি চালাতে হয়।”

কলাকান্দা ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান বলেন, “বেড়িবাঁধ সড়কটি এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি। এখন গর্তের কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগকে দ্রুত মেরামতের জন্য আমরা একাধিকবার জানিয়েছি।”

মতলব উত্তর প্রেস ক্লাবের সভাপতি বোরহান উদ্দিন ডালিম বলেন, “এই বেড়িবাঁধ শুধু মতলব নয়, পুরো অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের প্রধান সড়ক। তাই সওজ বিভাগের উদাসীনতা জনজীবনে ঝুঁকি তৈরি করছে। বর্ষার আগেই এই সড়কটির পূর্ণাঙ্গ সংস্কার জরুরি।”

চাঁদপুর সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “অতিবৃষ্টির কারণে গর্ত তৈরি হয়েছে। আমরা সড়কটি মেরামতের ব্যবস্থা নিয়েছি।”

উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন জানান, মতলব ব্রিজ থেকে বেড়িবাঁধের পূর্ব অংশে সংস্কার কাজের জন্য টেন্ডার করা হয়েছে। পশ্চিম অংশ এখনও ঠিকাদারের দায়িত্বে আছে, তাদেরকেও মেরামতের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী (চঃ দাঃ) সেলিম শাহেদ বলেন, “বেড়িবাঁধটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের হলেও এর ওপরে থাকা পাকা সড়ক সওজ বিভাগের দায়িত্বে। বেড়িবাঁধের যদি কোথাও ক্ষতি হয়, আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেই; সড়ক সংস্কার কাজ সওজ বিভাগকেই করতে হয়।”

চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদা কুলসুম মনি বলেন, “বেড়িবাঁধ সড়কের বিভিন্ন স্থানে গর্ত দেখা গেছে, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে।”

ঢাকা/অমরেশ/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ