গাজায় নারীদের জন্য ‘মায়াকান্না’ নেতানিয়াহুর
Published: 26th, July 2025 GMT
গাজায় নারীদের অধিকার নিয়ে ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছেন যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় থাকা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সম্প্রতি ফুল সেন্ড পডকাস্টে হাজির হয়ে এ উদ্বেগ জানান তিনি।
গাজা ও এর বাসিন্দাদের ধ্বংসে যিনি বদ্ধপরিকর, তাঁর মুখে এমন ‘সহানুভূতির’ কথা শুনে বিস্মিত অনেকে।
নেতানিয়াহু তাঁর মায়াকান্নায় বলেন, ‘গাজার নারীরা সম্পত্তি, তাঁদের কোনো মূল্য নেই, তাঁদের কোনো অধিকার নেই, তাঁরা পুরোপুরি দমন-পীড়নের শিকার। ঈশ্বর না করুন, তাঁরা যদি কথিত কোনো অপরাধ করে বসেন, তবে তাঁদের প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। এটি একেবারেই অযৌক্তিক।’
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘(গাজার) তরুণ-তরুণীরা প্রগতিশীল মূল্যবোধের নামে হামাসকে সমর্থন করছেন। তাঁরা বুঝতে পারছেন না, কী ভালো, আর কী মন্দ।’ তিনি বাইবেলের উদ্ধৃতি টেনে বলেন, ‘তাঁদের কি চোখ নেই দেখতে, কান নেই শুনতে?’
নেতানিয়াহু যাঁদের মুক্তির কথা বলে আবেগে গলা চড়াচ্ছেন, সেই ফিলিস্তিনি নারীদেরই মৌলিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অধিকার ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে ছিনিয়ে নিচ্ছে। নির্বিচার বোমা হামলা ও দমনমূলক নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া সেই ইসরায়েল সরকারেরই প্রধান তিনি।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত ৫৯ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাঁদের অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু। এ সংখ্যাও রক্ষণশীল একটি হিসাব। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার মতে, নিহত ফিলিস্তিনিদের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি।জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত ৫৯ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাঁদের অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু। এ সংখ্যাও রক্ষণশীল একটি হিসাব। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার মতে, নিহত ফিলিস্তিনিদের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) জানিয়েছে, গাজায় প্রায় ৫০ থেকে ৫৫ হাজার অন্তঃসত্ত্বা নারী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে শুধু রাফা অঞ্চল থেকেই ১৮ হাজার ৫০০ জনকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে।
নেতানিয়াহুর বক্তব্য এমন এক সময়ে এল, যখন গাজার ক্ষুধার্ত নারী–পুরুষ ও শিশুরা ইসরায়েলের টানা অবরোধের মধ্যে অবর্ণনীয় দুরবস্থায় দিনাতিপাত করছে। জাতিসংঘ ও ত্রাণ সংস্থাগুলো এ উপত্যকায় ওষুধ, সুপেয় পানি ও খাদ্য সরবরাহ করতে পারছে না।
আরও পড়ুনখাবারে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত নেতানিয়াহু২০ জুলাই ২০২৫বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানায়, গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুই-তৃতীয়াংশ কার্যত অচল। ৬৮৬টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে ইসরায়েলি হামলার তথ্য তারা নথিভুক্ত করেছে। মাত্র আটটি হাসপাতাল আংশিক মাতৃত্বসেবা দিতে পারছে। অন্তঃসত্ত্বা নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রায় নেই বললেই চলে।
সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদ
নেতানিয়াহুর এ বক্তব্য পডকাস্টে প্রচারিত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
গাজার নারীরা সম্পত্তি, তাঁদের কোনো মূল্য নেই, তাঁদের কোনো অধিকার নেই, তাঁরা পুরোপুরি দমন-পীড়নের শিকার। ঈশ্বর না করুন, তাঁরা যদি কথিত কোনো অপরাধ করে বসেন, তবে তাঁদের প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। এটি একেবারেই অযৌক্তিক। —বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীএকজন লিখেছেন, ‘ওদের মুক্তি দিচ্ছি বলে বোমা মারছি—কী ভণ্ডামি!’ আরেকজন মন্তব্য করেছেন, ‘গাজার নারীরা শিক্ষিত, চিকিৎসক, নার্স, আইনজীবী, প্রকৌশলী, শিল্পী, শিক্ষক এবং একই সঙ্গে মা, বোন, স্ত্রী। তাঁরা সবচেয়ে শক্তিশালী নারী। শুধু হিজাব বা পর্দা করার কারণে তাঁদের অবদমিত হিসেবে চিত্রায়ণ করা ভয়ংকর অপমানজনক।’
আরও একজন লিখেছেন, ‘নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলার সময় আপনি তাঁদের ঘরবাড়িতে বোমা ফেলছেন, সন্তানদের না খাইয়ে মারছেন, চিকিৎসাসেবা ও নিরাপত্তার সুযোগ কেড়ে নিচ্ছেন। দখলদারি নারীবাদ চলে না। নারীদের মেরে মুক্তি দেওয়া যায় না।’
আরও পড়ুননেতানিয়াহুর ঘুম যেভাবে কেড়ে নেওয়া যেত...০১ জুলাই ২০২৫
নেতানিয়াহুর এ বক্তব্যকে শুধু ভণ্ডামি নয়; বরং ইতিহাস বিকৃতিরও প্রয়াস বলে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, ফিলিস্তিনি নারীরা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও প্রতিরোধ সংগ্রামের অগ্রভাগে আছেন। তাঁদের শুধু ‘ভুক্তভোগী’ হিসেবে তুলে ধরা (নেতানিয়াহুর বক্তব্যে) তাঁদের পরিচয়কেই সংকুচিত করে, বাস্তবতাকে আড়াল করে।
সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে নেতানিয়াহু আরও বলেন, ‘হামাস যাঁদের দমন করে রেখেছে, তাঁদের কেন হামাসের সমর্থক হিসেবে দেখা যাচ্ছে? তাঁদের আটক করে রাখা হয়েছে কেন? তাঁদের তো চলে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত, স্বাধীনতা দেওয়া উচিত, বাঁচার ও ভবিষ্যতের সুযোগ দেওয়া উচিত।’
আরও পড়ুননেতানিয়াহুর প্রতি হোয়াইট হাউসের সন্দেহ দিন দিন বাড়ছে২৩ জুলাই ২০২৫আরও পড়ুননিজের দুর্নীতির বিচার বন্ধে গাজা যুদ্ধকে কাজে লাগাচ্ছেন নেতানিয়াহু: ইসরায়েলি আইনপ্রণেতাদের অভিযোগ৩০ জুন ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র দ র প রক প রক শ
এছাড়াও পড়ুন:
আসামি না হয়েও স্বেচ্ছায় কারাগারে যাওয়া সেই যুবক প্রতারণা মামলায় গ্রেপ্তার
চট্টগ্রামে মাদকের একটি মামলায় আসামি সেজে আদালতে আত্মসমর্পণের পর কারাগারে যাওয়া এক যুবককে জালিয়াতি ও প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তার (শ্যোন অ্যারেস্ট) দেখিয়েছেন আদালত। তাঁর নাম মো. রাকিব। পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আজ মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এস এম আলাউদ্দিন মাহমুদ শুনানি শেষে এই আদেশ দেন। কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে প্রকৃত আসামি মো. সুমনের হয়ে আদালতে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন রাকিব। আদালতের আদেশে ১ জুলাই থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) মফিজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারে আটক রাকিবকে জালিয়াতি ও প্রতারণা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করে কোতোয়ালি থানা-পুলিশ। শুনানি শেষে আদালত তা মঞ্জুর করেন। আসামিকে রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে।
আদালত সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের ৩১ আগস্ট নগরের আকবর শাহ থানার কৈবল্যধাম এলাকায় একটি পিকআপ ভ্যানে অভিযান চালিয়ে ৪০ কেজি গাঁজা উদ্ধার করে র্যাব, যার মূল্য ৪ লাখ টাকা। ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার করা হয় গাড়িচালক রাহাত ইসলামকে। পালিয়ে যান চালকের সহকারী (হেলপার) মো. সুমন। এ ঘটনায় র্যাব কর্মকর্তা বাদী হয়ে আকবর শাহ থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেন। তদন্ত শেষে চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এতে রাহাত ইসলাম ও মো. সুমনকে আসামি করা হয়।
আদালত পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করে পলাতক আসামি সুমনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এরই মধ্যে সুমনের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার পূর্বধলা এলাকায় অভিযান চালায় পুলিশ। বিষয়টি জানতে পেরে সুমন নিজেকে কারামুক্ত রাখতে তাঁর পরিবর্তে নোয়াখালীর রাকিবকে আদালতে আত্মসমর্পণ করায় ১ জুলাই। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মোস্তফা শুনানি শেষে আসামির জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান। সুমনের হয়ে রাকিব আত্মসমর্পণের সময় তাঁর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন ওয়াহিদ মুরাদ।
আদালতে একজনের পরিবর্তে আরেকজন আত্মসমর্পণের বিষয়টি ধরা না পড়লেও কারাগারে গিয়ে ধরা পড়ে। জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেজে (তথ্যভান্ডার) ভোটারদের আঙুলের ছাপ সংরক্ষিত আছে। এ পদ্ধতিকে বলা হয় ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেনটিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ পদ্ধতি ব্যবহার শুরু করে চট্টগ্রাম কারা কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে আঙুলের ছাপে ধরা পড়েছে অনেক বন্দীর আসল পরিচয়। এসব ঘটনায় মামলাও হয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি মাসের জুলাই পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করে জালিয়াতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আসা ১৬ জনের আঙুলের ছাপে শনাক্ত করা হয়।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মো. ইকবাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আদালত থেকে কারাগারে আসা প্রত্যেক নতুন আসামির আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। সেখানে আসামির জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকা আসল পরিচয় উঠে আসে। ইকবাল হোসেন আরও বলেন, ‘সুমনের হয়ে কারাগারে আসা রাকিব স্বীকার করেছেন তিনি মাদক মামলার প্রকৃত আসামি নন। ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি সুমন সেজেছেন। তাঁকে বলা হয়েছে, দ্রুত কারাগার থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া হবে। তাই তিনি রাজি হয়েছেন। বিষয়টি চিঠি দিয়ে আদালতকে জানানো হয়েছে।’
আরও পড়ুনচট্টগ্রামে ‘আয়নাবাজি’, ধরা পড়েছে আঙুলের ছাপে০৮ নভেম্বর ২০২৩কারাগার থেকে চিঠি পাওয়ার পর মামলা করার নির্দেশ দেন চট্টগ্রাম চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মিজানুর রহমান। একই সঙ্গে আসামিকে আত্মসমর্পণকারী আইনজীবী ওয়াহিদ মুরাদের কাছে কারণ ব্যাখ্যা চেয়েছেন আদালত। আদালতের প্রসিকিউশন শাখার আকবর শাহ থানার জিআরও সাইদুর রহমান বাদী হয়ে গত রোববার রাতে নগরের কোতোয়ালি থানায় প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে মামলা করেন। মামলায় মো. রাকিব ও মো. সুমনকে আসামি করা হয়। সুমন এখনো পলাতক।