সেই স্বপ্নের বীজ যেন কোনোভাবেই অঙ্কুরে বিনষ্ট না হয়
Published: 9th, August 2025 GMT
চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের দীর্ঘদিনের চর্চিত মননপটে নিঃসন্দেহে কিছু পরিবর্তন এনে দিয়েছে। গত এক বছরে অনেক ঘটনাই আমাদের বারবার হতাশার দিকে ঠেললেও কখনো কখনো আশাও জিইয়ে রাখতে হয়। ৫ আগস্ট বহুল প্রতীক্ষিত ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ ঘোষিত হলো। যতটা আশা নিয়ে সবার দৃষ্টি এ ঘোষণাপত্রের দিকে ছিল, সেই আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিসমাপ্তিও ঘটেছে অনেকের আশা-নিরাশার দোলাচলের মধ্য দিয়ে।
যাহোক, ঘোষণাপত্রে কী পেলাম, সেদিকে না গিয়ে গত এক বছরে আমাদের আকাঙ্ক্ষার জায়গাগুলো কোথায় কোথায় ছিল, সেসব একটু খতিয়ে দেখা যাক। কোটা সংস্কারের দাবি থেকেই জুলাই আন্দোলনের সূত্রপাত। খুবই সাধারণ কয়েকটি দাবি—কোটার পরিমাণ কমিয়ে মেধার মূল্যায়ন করা, সবার জন্য অভিন্ন বয়ঃসীমা নির্ধারণ, সরকারি চাকরিতে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা, দেশের অনগ্রসর জনগোষ্ঠী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য ন্যায্যতার ভিত্তিতে কোটা সংরক্ষণ রাখা। অর্থাৎ দেশের নাগরিকদের সাম্যের ভিত্তিতে সুযোগ দেওয়া।
এবারের আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ভবিষ্যৎ গঠনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সার্থক প্রয়োগ’। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে খুবই উপযোগী একটি স্লোগান; কিন্তু প্রশ্ন হলো জুম পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে বিদ্যুৎই এখনো পৌঁছায়নি, সেখানে কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চর্চা হবে!জুলাই আন্দোলনের ফলে দেশের পুরো প্রেক্ষাপটই পাল্টে গেছে। কোটা বিষয়ে আদালতের সর্বশেষ রায়ে, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা’ নির্ধারণের বিষয়টি গত এক বছরে অনুচ্চারিতই ছিল। ২০২২ সালের শুমারি অনুযায়ী পাহাড় ও সমতলে ৫০টির অধিক জাতিগোষ্ঠীর মোট সংখ্যা সাড়ে ১৬ লাখ। কোটা নির্ধারণ প্রক্রিয়াটি দেশের মোট জনসংখ্যার বিচারে নয়, জাতিসত্তাগুলোর সংখ্যার বিচারে আগের ৫ শতাংশ কোটা পুনর্বহাল করা দরকার।
এ বছর আদিবাসী দিবস উদ্যাপনে একটু বিশেষত্ব আছে। ১৫ বছর ধরে আদিবাসী দিবস পালনে সরকারের বাধা, সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করে ‘আদিবাসী’ শব্দ নিষিদ্ধ করা, মিডিয়ায় আদিবাসী শব্দ ব্যবহার না করার ওপর চাপ ছিল। এই বছর অন্তত সেই ‘চাপ’ এখন পর্যন্ত অনুভূত হচ্ছে না। দেশের সব জনগোষ্ঠী নিয়ে নতুন সংবিধান তৈরি ও তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির সংকট দূর করার কথা বলছে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক এবং জুলাই চেতনার প্রতিফলন। তাদের এই অঙ্গীকারকে সাধুবাদ জানাই।
এবারের আদিবাসী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ভবিষ্যৎ গঠনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সার্থক প্রয়োগ’। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে খুবই উপযোগী একটি স্লোগান; কিন্তু প্রশ্ন হলো জুম পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে বিদ্যুৎই এখনো পৌঁছায়নি, সেখানে কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চর্চা হবে!
একজন জুমিয়া কৃষকের যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তাঁর কাছে গিয়ে আপনি যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তাঁর অধিকার ও ভবিষ্যৎ গঠনের কথা বলবেন, তখনকার পরিবেশটার কথা একবার ভাবুন তো! দেশে ‘বাটন মোবাইল’ ব্যবহারের প্রচলন প্রায় উঠে গেছে। অথচ মিটমিট করে পাওয়া মোবাইল নেটওয়ার্কে প্রত্যন্ত পাহাড়ের মানুষ সেই বাটন ফোন দিয়ে যোগাযোগের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
কাজেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চেয়ে বাস্তবতার দিকেই আমাদের মনোযোগ দিতে হবে বেশি। পাহাড়ে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের জন্য সরকারকে আরও অধিক যত্নশীল হতে হবে। অতিবৃষ্টি, খরার সময় পাহাড়ে যে নীরব দুর্ভিক্ষ চলে, সেসব উপদ্রুত এলাকার মানুষদের মৌলিক চাহিদা পূরণে যথাযথ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শুধু তা–ই নয়, যোগ্যতা অনুযায়ী তাঁদের কর্মসংস্থানের সুযোগ গড়ে দিতে হবে।
দেশে নির্বাচনের মৃদু বাতাস বইতে শুরু করেছে। আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক সব দলের প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে—তাদের দলীয় নির্বাচনী ইশতেহারে বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অঙ্গীকারবিষয়ক সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকতে হবে। কারণ, জনগণের রায়ে নির্বাচিত হয়ে তারাই আগামীর বাংলাদেশ কীভাবে পরিচালিত হবে, সেটি নির্ধারণ করবেন। তাই জনগণের সামনে তাদের নিজ নিজ দলের ভাবনাগুলো নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে তুলে ধরুক।
পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সবার আগে রাজনৈতিক দলগুলোকে সেখানকার মানুষদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, যাঁরা দেশ পরিচালনার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছেন, তাঁরা আওয়ামী দুঃশাসনের নেতিবাচক দিকগুলোকে স্মরণে রেখে ভবিষ্যতে পাহাড়ে কীভাবে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব, সে বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে ভাববে। পাহাড়কে অশান্ত রেখে দেশের টেকসই উন্নয়নের গতি বাড়ানো কোনোভাবে সম্ভব নয়। দেশের একাংশের পুরোনো ক্ষত মলম দিয়ে ঢেকে রেখে মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে আর যা-ই হোক রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে না।
সরকারের উচ্চ পদে আসীন ব্যক্তিরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে ডাম্পিং জোন হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। সমতল অঞ্চলের কোনো কর্মকর্তা দুর্নীতি বা নৈতিকতাহীনতায় জড়িয়ে পড়লে তাঁকে শাস্তিমূলক হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলি করা হয়। তঁারা বোধ হয় ভুলে যান, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশেরই অখণ্ডিত ভূখণ্ড।
এ ধরনের বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্মকর্তাদের এটা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমতলের দুর্নীতিবাজ, নীতিভ্রষ্ট ও চরিত্রহীন কর্মকর্তাদের স্বর্গরাজ্য নয়। অপরাধীকে তার অপরাধের জন্য আইনের আওতায় এনে বিচার করা হোক। পার্বত্য চট্টগ্রামকে আবর্জনার ভাগাড় বানিয়ে যারা বদলি–বাণিজ্যের ফায়দা লুটতে চায়, তাদেরও চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করা হোক।
বাংলাদেশ একটি বহু জাতি ও বহু সংস্কৃতির দেশ। তাই সব সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে এ দেশের বহুত্ববাদকে গ্রহণ করতে হবে। চব্বিশের জুলাইয়ের পর সংবিধান সংস্কারসহ রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বারবার বলা হচ্ছে। সংবিধানে দেশের সব জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়তে হবে। জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাওয়া নতুন এই বাংলাদেশে বৈষম্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক চেতনার যে স্বপ্ন তরুণ প্রজন্ম দেখছে, সেই স্বপ্নের বীজ যেন কোনোভাবেই অঙ্কুরে বিনষ্ট না হয়, সে জন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
● ইলিরা দেওয়ান মানবাধিকারকর্মী ও লেখক
* মতামত লেখকের নিজস্ব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক ত র ম ব দ ধ মত ত র র জন য আম দ র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
আদিবাসী দিবসে স্বীকৃতি চান পাহাড়িরা
দীর্ঘ বছর ধরে ‘আদিবাসী’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি না পাওয়ায় হতাশ পাহাড়ের আদিবাসীরা। তারা মনে করেন, পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নসহ আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ফিরে আসবে। তাই দ্রুত পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নসহ পাহাড় আর সমতলের সকল আদিবাসীদের, আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন পাহাড়ের আদিবাসীরা।
৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবসকে ঘিরে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এমএন লারমার দল ও বিভিন্ন সংগঠন খাগড়াছড়িতে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সেসব কর্মসূচি উপলক্ষ্যে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন পাহাড়িরা।
পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমতলের সকল আদিবাসীকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি দীর্ঘদিনের কিন্তু এতদিন পরেও সেই স্বীকৃতি না পাওয়ায় হতাশার কথা জানিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসকৃত বিভিন্ন জাতিস্বত্তার মানুষ।
তারা জানিয়েছেন, আদিবাসী হিসেবে তাদের নিজস্ব ঐহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, কালচারসহ সবকিছু থাকা সত্ত্বেও বিগত ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী সরকার তাদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। তাদের ভূমি অধিকারও হরণ করা হয়েছে।
আদিবাসী বিষয়ক জাতীয় কোয়ালিশন, জেলা সমন্বয়কারী, নমিতা চাকমা বলেন, “পাহাড়ের ১৯০০ সালের আইন অনুসারে প্রথাগত আইনের মাধ্যমে ভূমির দখলি সত্ত্বটা বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। তাই তাদের অনেকের ভূমির কোনো দলিল বা কাগজপত্র নেই। আর এই সুযোগে আমাদের ভূমি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে ১৯৭৪ সালের পর পাহাড়ে বাঙ্গালী পুর্নবাসন শুরু করার পর থেকে পাহাড়ের ভূমি বেদখল হয়ে গেছে, এখনো যাচ্ছে। বেদখলকৃত ভূমি উদ্ধার করার জন্য ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক ভূমি কমিশন করা হয়, সেই কমিশনে প্রায় ১৬ হাজার আবেদন জমা পড়লেও কমিশনের কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেই।”
ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরনার্থীর সভাপতি অজিত বরণ চাকমা বলেন, “ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরনার্থীদের সাথে সরকারের যে ২০ দফা প্যাকেজ চুক্তি ছিল, তাও বাস্তবায়ন করা হয়নি। তাই পাহাড়ের আদিবাসীরা মনে করেন, পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নসহ আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিলে পাহাড়ের আদিবাসীদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত হবে আর স্থায়ী শান্তি ফিরে আসবে।”
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির এমএন লারমা দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা বলেন, “আদিবাসী স্বীকৃতির দাবিটা দীর্ঘ বছরের। পাহাড়-সমতল মিলিয়ে ৪৪/৪৫টি জাতিসত্ত্বা আছে বাংলাদেশে। বিগত সরকারের কাছে জোর দাবি ছিল, দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল- সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের জন্য। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারের কাছে দাবি দাওয়া পেশ করে আসছি। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হলেও আমাদের দাবি সরকারের কাছেই। দেশে যে সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকুক বা যে সরকার আসুক, আমাদের দাবি আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি।”
তিনি আরো বলেন, “বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর আমরা আশা করেছিলাম অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাদের দাবি নিয়ে যথেষ্ট নমনীয় হবেন, আন্তরিক হবেন কিন্তু সে ধরনের কোন আলামত দেখছি না। আগামীতে যে সরকার ক্ষমতায় আসুক, আদিবাসী হিসেবে যেন স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশে আদিবাসীরা যেসব অধিকার ভোগ করে, বাংলাদেশের আদিবাসীরাও যেন সেসব অধিকার ভোগ করতে পারেন।”
ঢাকা/রূপায়ন/এস